ডারউইনিজমের ব্যবচ্ছেদ: পর্ব-১
.
‘ডারউইনিজম’ ‘ইভোল্যুশন’ ‘এথেইজম’ ইত্যাদি ‘টার্ম’ গুলোর সাথে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। ‘ডারউইনিজম’ ‘ইভোল্যুশন’ নামগুলো শুনলে অনেকে বুঝে অথবা না বুঝে পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ‘ইভোল্যুশন’ বা বিবর্তনবাদ শব্দটি শুনলেই আমরা মনে করি, এটা ডারউইন আর নাস্তিকদের সম্পত্তি, তাই ধর্মবিশ্বাসী অনেকেই চোখ বন্ধ করে এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে নেয়, যেটা আসলে সঠিক নয়।
.
জীব বিজ্ঞানের ভাষায় বিবর্তন হলো জীবের বৈশিষ্টের ধারাবাহিক পরিবর্তন। প্রকৃতি বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদ থিওরির আগেও বিবর্তন নিয়ে অনেক হাইপোথিসিস ছিলো। বিজ্ঞানী কার্ল লিনিয়াস, পিয়েরে লুইস মৌপার্টিয়াস, ব্যাপ্টিস্ট ল্যামার্কস সহ অনেকে ইভোল্যুশন নিয়ে কাজ করেছেন।
.
ডারউইনের সাফল্য হলো সে সর্বপ্রথম বিবর্তনের মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটা তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন। ডারউইনের দেয়া বিবর্তনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী জীবের মধ্যকার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তিত হয় ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ এর মাধ্যমে। প্রতিকূল পরিবেশের সাথে যে খাপ খাইয়ে চলতে পারে সেই বেঁচে থাকে-সোজা বাংলায় বলতে গেলে এটাই হচ্ছে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরি। আমরা অনেকে ডারউইনিজম ও ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরি একই জিনিস মনে করি, যেটা আসলে ভুল।
.
ডারউইন ছাড়াও আরো অনেক বিজ্ঞানী ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরী নিয়ে কাজ করেছেন, যেমন আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস (ডারউইনের সহ-কর্মী), উইলিয়াম চার্লস ওয়েলস, প্যাট্রিক ম্যাথিউ তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘
.
ডারউইনিজম’ হলো বিজ্ঞানী ডারউইনের ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরির নিজস্ব ব্যাখ্যা। পরবর্তীতে হার্বার্ট স্পেন্সার এই থিওরিকে ‘সারভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট’ নামে কিছুটা ভিন্ন রূপে ব্যাখ্যা করেন। ডারউইন তার ‘ওরিজিন অফ স্পেসিস’ বইয়ে সকল জীব একই আদিরূপ থেকে এসেছে বলে যে মতামত দিয়েছে এটাও ডারউইনিজমের অন্যতম একটা মতবাদ।
ডারউইনের ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ আরো দশটা বৈজ্ঞানিক থিওরির মতোই আলোচিত সমালোচিত হয়েছে। তৎকালীন অনেক খ্যাতিমান বিজ্ঞানী যেমন, কার্ল ফন নাগেলি, উইলিয়াম থম্পসন, ফ্লেমিং জেনকিন তার ব্যাখ্যার বিপক্ষে দারুন সব বৈজ্ঞানিক যুক্তি উপস্থাপন করেন ফলস্বরূপ ডারউইনকে তার বইয়ে কিছু পরিবর্তন আনতে হয়। উল্লেখিত বিজ্ঞানীগণ একাডেমিক্যালি ডারউইনের থেকে অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন।
.
মজার ব্যাপার হলো, ডারউইনের সময়েই খুব অল্প সংখ্যক বিজ্ঞানী ইভোলুশনের সাথে ন্যাচারাল সিলেকশনের সম্পৃক্ততা স্বীকার করতো, অধিকাংশের মতে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ খুবই ‘মাইনর’ একটা ভূমিকা পালন করে এ ক্ষেত্রে। বিংশ শতাব্দীতে এসে ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ তত্ত্ব ‘ডেথ বেড’এ চলে যায়। সামগ্রিকভাবে সবাই ‘ইভোল্যুশন’ তত্ত্ব মেনে নিলেও ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরিকে অগ্রহনযোগ্য বলে রায় দেন অনেক খ্যাতিমান বিজ্ঞানী যেমন, এবেরহার্টেড ডেনার্ড, ভার্নন কেলোগ সহ আরো অনেকে। কিছুদিনের মধ্যেই ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরির বিপরীতে আরো চারটি মতবাদ প্রতিষ্ঠা পায় তার মধ্যে ‘সালট্যাশনিজম’ অন্যতম।
.
এই ইভোলুশনারি মেকানিজমটা ডারউইনের থেকে পুরোটাই আলাদা। ডারউইন যেখানে বলেছিলো ইভোল্যুশন ধীরে ধীরে অনেক সময় নিয়ে হয়, সেখানে ‘সালট্যাশনিজম’ তত্ত্ব অনুসারে ‘দ্রুত বৃহৎ মিউটেশন’ এর মাধ্যমে ইভোল্যুশন সংঘটিত হয়। এই তত্ত্বে বিশ্বাসীদের মধ্যে জেনেটিক্সের প্রাণপুরুষ হুগো দ্যা ভ্রেইস থেকে শুরু করে আধুনিককালের কার্ল ভয়েস, নোবেল জয়ী বারবারা ম্যাক ক্লিনটকও আছেন। মডার্ন মলিকুলার বায়োলজি সমর্থিত এই তত্ত্বটি অন্য সব থিওরি থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
.
উপরের সংক্ষেপিত আলোচনা থেকে এটা পরিষ্কার বিবর্তনবাদের উপরে আদি থেকে আজ পর্যন্ত যত থিওরী পাওয়া যায় তার মধ্যে ডারউইনের ‘ন্যাচারাল সিলেকশন’ থিওরী বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে সবচেয়ে অনির্ভরযোগ্য ও অপ্রায়োগিক। প্রশ্ন হতে পারে, তারপরেও বাকি সব থিওরি থেকে ডারউইনের থিওরী কেনো বেশি আলোচিত ও সমালোচিত? এর পিছনেও অনেক কারণ আছে, তার যতটা না বৈজ্ঞানিক তার থেকেও সামাজিক ও রাজনৈতিক। পরবর্তী পর্বে এই বিষয়ে আলোচনা হবে ইনশাআল্লাহ।
==============================
লেখকঃ সাইফুর রাহমান
Leave Your Comments