মুখোশের অন্তরালে নাস্তিকতা ১ (জাফর ইকবাল)
.
একজন লেখককে জানার সবচেয়ে ভাল উপায় হল তার লেখা পড়া। লেখায় মানুষের চিন্তা চেতনাগুলো ফুটে উঠে। সুনির্দিষ্ট চিন্তাগুলোকে অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে শব্দ, শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বাক্য এভাবে একসময় পুরো একটি লিখা সম্পন্ন হয়। সেই লিখা লিখবার সময় লেখক চিন্তা করেছেন, হয়ত লিখে কেটেছেন, কোনও অংশ বাদ দিয়েছেন… সবশেষে তিনি যেটা চেয়েছেন সেটাই আমরা পাই। আর তার লিখাগুলোয় যদি একই বা একইরকম ধারণার বারংবার প্রকাশ ঘটে তবে আমরা লেখকের স্বরূপ, তার মতামত, ইচ্ছা ইত্যাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারি।
.
আমি যে অনেকগুলো কারণে লিখি তার একটি হল সত্য থেকে মিথ্যা আর অনিশ্চয়তাগুলোকে সুস্পষ্টভাবে আলাদা করে চিহ্নিত করা। এই লিখাটিও লিখছি একই কারণে – যাতে সত্য স্পষ্ট হয়ে যায় আর অনিশ্চয়তাগুলো দূর হয়ে যায়, এরপরও যদি কেউ মিথ্যার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে তবে বুদ্ধিমানেরা জানবে যে অমুক জেনেশুনে এখনও মিথ্যার পক্ষ নিয়েছে – এতটুকুই।
.
এমন একজন লেখকের বইগুলো ঘেঁটে দেখা শুরু করে রীতিমত অবাক হয়েছি। একবার দুইবার না… বারবার। এত সুন্দর আর সুচারুভাবে তিনি তার লেখায় নাস্তিকতা মিশিয়েছেন, তার তুলনাই হয় না। লেখকের নাম মুহম্মদ জাফর ইকবাল। প্রথমে ভেবেছিলাম তার সমস্ত লিখাগুলোয় যত নাস্তিকতা এসেছে সব একসাথে করে একটা নোট লিখে ফেলব। কিন্তু একথা ভেবে আসলে শ্রদ্ধেয় লেখকের অসম্মানই করলাম যেন। ওয়াল্লাহি তার লেখায় কখনও প্রতি প্যারায়, কখনও প্রতি বাক্যে বাক্যে এতই সুকৌশলে ধর্মবিদ্বেষ আর নাস্তিকতা ছড়ানো হয়েছে যে অবশেষে সিরিজ আকারে লিখারই সিদ্ধান্ত নিলাম। জানি এই লেখকের অনেক ভক্তদের হয়তো ব্যাপারটা খারাপ লাগবে, কিন্তু একবার পড়ে দেখলেই ব্যাপারটার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারবেন। আল্লাহ আপনার আমার উভয়ের জন্য সত্য মেনে নেওয়ার তাওফিক দিন এবং সহজ করুন, এমনকি তা আমাদের অপছন্দনীয় হলেও।
.
[১] ক্যাথোলিক চার্চের ঘটনার আড়ালে সমস্ত ধর্মকে হেয় করা –
অ্যারিস্টটলের গ্রিক জ্ঞানগরিমায় প্রভাবের কারণে তার সব কথাই প্রায় অকাট্য হিসেবে গ্রহণ করছিল পরবর্তী জ্ঞানপিপাসুরা। এতে করেই খ্রিস্টাব্দ প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীতে বাইবেল সংকলনের সময় সেখানে অ্যারিস্টটলের জ্ঞানের প্রভাব থেকে যায়। ফলে খ্রিস্টপূর্ব থেকেই চলে আসা টলেমি আর অ্যারিস্টটলদের সমর্থনকৃত মতবাদ “পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে, আর সূর্য ও অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরছে” একথা চলে আসে। শুধু তাই না, দাপটের সাথে প্রায় ১৫০০ বছর ধরে বাইবেলে শোভা পায়।
.
সমস্যার শুরু হয় যখন বিজ্ঞানী কোপার্নিকাস বাদ সাধেন, আর দাবি করেন যে, “সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে আর পৃথিবীসহ অন্যান্য সব গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।” চার্চের এত বছর ধরে শেখানো বিদ্যের বিপক্ষে যাচ্ছে বলে প্রভাব খাটিয়ে এই মতবাদ দমন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে বিজ্ঞানী গ্যালিলিও যখন নিজস্ব পর্যবেক্ষণ করে একই দাবি করে বসেন আর লিখালিখি শুরু করেন তখন চার্চের মাথা খারাপ হয়ে যায়। রচিত হয় “বিজ্ঞান আর চার্চের দ্বন্দ্ব” নামক ইতিহাস।
.
এখন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল – এটা ছিল মূলত ক্যাথলিক চার্চের সাথে দ্বন্দ্ব। কিন্তু এখন কেউ যদি একে বিজ্ঞানের সাথে “ধর্মের” দ্বন্দ্ব বলে প্রচার শুরু করে, আর এমন মেসেজ দেয় যে বিজ্ঞানই হল সেরা তখন ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়?
.
জাফর ইকবাল লিখেছে –
“পর্যবেক্ষণ করে বিজ্ঞানের কোনো রহস্য বুঝে ফেলার একটা উদাহরণ তৈরি করে ছিলেন কোপর্নিকাস … … … গ্যালিলিও যখন সেটিকে গ্রহণ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করতে লাগলেন তখন ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে পৃথিবী সবকিছুর কেন্দ্র, সেই পৃথিবী সূর্যকে ঘিরে ঘুরছে ঘোষাণা করা ধর্মগ্রন্থকে অস্বীকার করার মতো। ভ্যাটিকানের পোপেরা সে জন্য তাকে তখন ক্ষমা করেন নি। ব্যাপারটি প্রায় কৌতুকের মতো যে গ্যালেলিওকে ভ্যাটিকান চার্চ ক্ষমা করেছে মাত্র ১৯৯২ সালে। তাদেরকে দোষ দেয়া যায় না- ধর্মের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, কাজেই ধর্মগ্রন্থে যা লেখা থাকে সেটাকে কেউ কখনো প্রশ্ন করে না, গভীর বিশ্বাসে গ্রহণ করে নেয়। বিজ্ঞানের বিশ্বাসের কোনো স্থান নেই। বিজ্ঞানের যে কোনো সূত্রকে যে-কেউ যখন খুশি প্রশ্ন করতে পারে, যুক্তি-তর্ক, পর্যবেক্ষ্ণ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে সেই সূত্রের সত্যতা তখন প্রমাণ করে দিতে হবে। কাজেই কেউ যদি বিজ্ঞান ব্যবহার করে ধর্মচর্চা করে কিংবা ধর্ম ব্যবহার করে বিজ্ঞানচর্চা করার চেষ্টা করে তাহলে বিজ্ঞান বা ধর্ম কারোই খুব একটা উপকার হয় না।” (একটুখানি বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ১৩)
লিখাটি বইয়ের একেবারে প্রথমের লিখা। “তাদেরকে দোষ দেওয়া যায় না…” থেকে শুরু করে সব ধর্মকে জেনারালাইজ করে একটা সিদ্ধান্ত টানা হয়েছে। কেবল বুদ্ধিমানরাই বুঝতে পারবেন, এখানে শুধু “Conflict Thesis” এর ধারণা কৌশলে ঢুকিয়েই দেওয়া হয় নি, সাথে সাথে সমস্ত ধর্মের প্রতি একরকম সমবেদনা দেখিয়ে বিজ্ঞানই সেরা এমন একটা মেসেজ দেওয়া হয়েছে।
.
এখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, “Conflict Thesis” বা “বিজ্ঞান আর ধর্মের দ্বন্দ্ব” কিন্তু মূলত ঘুরেফিরে ধর্মগ্রন্থে ভুল থাকা বোঝায়। আর কুরআনে অনেক আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল যে খ্রিস্টানরা তাদের কিতাব বিকৃতি করেছে। সুতরাং, ওদের কিতাবে ভুল থাকা অতি স্বাভাবিক। তাই বর্তমানের প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে সহজেই ভুলে ভরা বাতিল ধর্মগ্রন্থগুলোর অমিল থাকলে এত অবাক হওয়ার তো কিছুই নেই। কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় যখন কুরআনকেও ওই ধর্মগ্রন্থগুলোর সাথে একই কাতারে আনা হয়।
.
মানবজাতিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া আল-কুরআন নিদর্শনে ভরপুর। সেখানে বারবার চিন্তাশীলদের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বলাই বাহুল্য, এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে কুরআনের কোনো কথা সাংঘর্ষিক হয় নি, হওয়া সম্ভব নয়। বরং বারবার কুরআনের মু’জিযা দেখেছে পৃথিবীর মানুষ। শুধুমাত্র এই সূর্য আর পৃথিবীর ব্যাপারটাতেই দেখুন আল্লাহ কী বলেছেন –
“ তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও দিন এবং সূর্য ও চাঁদ। সমস্তকিছুই আপন আপন কক্ষপথে বিচরণ করে। ” (সূরা আম্বিয়া ২১:৩৩)
.
তাফসীরকারগণ বলছেন, ‘সমস্তকিছু’ বলতে সমস্ত ‘মহাজাগতিক বস্তু’ কে বোঝানো হয়েছে। মজার ব্যাপার হল, কোপার্নিকাস আর গ্যালিলিওর এতসব দরদভরা ইতিহাস রচনা করলেও তারাও যে “সূর্য মহাবিশ্বের কেন্দ্রে রয়েছে” অর্থাৎ, ‘সূর্য স্থির’ বলে ভুল করেছে সেকথা কিন্তু লেখক জাফর ইকবালের লেখায় আসে নাই। আর কুরআনের আয়াত সম্পর্কিত কোনোকিছুও আসে নাই।
কুরআন এখানে পরিষ্কার ভাবেই চাঁদ এবং সূর্যের একটি নিদিষ্ট অরবিটে ঘূর্ণনের কথা বলেছে। সূর্যের নিজ অক্ষে ঘুর্ণন এবং নিজস্ব অরবিটে গ্যালাক্সীর চারদিকে আবর্তন একটি সাম্প্রতিক আবিষ্কার। অথচ ১৫১২ সালে দেয়া কোপার্নিকাসের “Heliocentric theory” এর মতে সূর্য স্থির।
.
১৬০৯ সালে কেপলারের “Astronomia Nova ” নামক বইতে সব গ্রহের নিজ অক্ষের চারদিকে ঘুর্ণনের কোন কথা বলা হয় নি। সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে সূর্য ২৫ দিনে নিজ অক্ষে একবার ঘূর্ণন সম্পন্ন করে। কেবল গত শতাব্দীতে আমরা এইসব বিস্ময়কর তথ্য পাই। সূর্য 251km/s বেগে স্পেসের মধ্যদিয়ে 225-250 মিলিয়ন বছরে milkyway Galaxy এর কেন্দ্রের চারদিকে আবর্তিত হয়। অর্থাৎ বর্তমানে বিজ্ঞানের ঘোষণা হল “Sun rotates and Revolves.”
.
ঠিক এ ঘোষণাই কুরআন ১৪০০ বছর আগে দিয়েছে। সূরা আম্বিয়ার ৩৩ নং আয়াতে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে তা হল ‘ইয়াসবাহুন’। ‘সাবাহা’ শব্দটি থেকে এ শব্দটি এসেছে। এ শব্দটি কোন মাটিতে চলা লোকের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে বুঝতে হবে সে হাঁটছে অথবা দৌঁড়াচ্ছে। এ শব্দটি পানিতে থাকা কোন লোকের ক্ষেত্রে বলা হলে এর অর্থ এই না যে লোকটি ভাসছে, বরং বুঝতে হবে লোকটি সাঁতার কাটছে। এ শব্দটি কোনো মহাজাগতিক বস্তুর (Celestial body) ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলে এর অর্থ করতে হবে এটা নিজ অক্ষে ঘুরছে সাথে সাথে কোন কিছুকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে!
.
বিদ্বেষীরা হয়তো বলবে যে, আয়াতটিতে পৃথিবীর আবর্তনের কথা আসে নাই। পৃথিবী কি তাহলে ‘সমস্ত মহাজাগতিক বস্তু’ থেকে বাইরে? তাছাড়া কুরআনের কোথাও ‘পৃথিবী স্থির’ একথা বলা হয় নাই। বাইবেলের প্রায় পাঁচটি জায়গায় সুস্পষ্টভাবে ‘পৃথিবী স্থির’ বলা হয়েছে। (কিছু না বলতে চেয়েও অনেককিছু বলে ফেললাম। এই বিষয়েও বিস্তারিত পরে লিখব ইন-শা-আল্লাহ)
.
এখন আমরা ধরে নিলাম যে জাফর ইকবাল কুরআনের এতসব তথ্য জানতো না। ব্যস্ত মানুষদের কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনার সময় থাকে না… কিন্তু সে যদি নাই জানতো তাহলে এক চার্চের ঘটনা থেকেই সমস্ত ধর্মকে নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে কেন চলে আসা?
আচ্ছা একবার হলে বুঝলাম হয়তো আবেগের বশে লিখেছেন। কিন্তু একই ঘটনা বারবার এনে একসাথে সব ধর্মকে দোষারোপ তো ধর্মবিদ্বেষেরই প্রমাণ। একই বইয়ের ৩৮ পৃষ্ঠায় সে আরও লিখেছে –
” মহামতি গ্যালিলিও গ্যালিলির প্রতি যে অবিচার করা হয়েছিল সেটি বুঝতে ক্যাথলিক চার্চের সময় লেগেছিল মাত্র সাড়ে তিনশত বৎসর। পৃথিবীর কত বড় বড় মনীষীর হাঁটুর সমান মেধা নিয়ে শুধুমাত্র ধর্মের লেবাস পরে তাদের উপর নিপীড়ন করার উদাহরণ শুধু যে ক্যাথলিক চার্চে ছিল তা নয় অন্য ধর্মেও ছিল। শুধু যে অতীতে ছিল তাই নয় এখনও আছে।” (একটুখানি বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ৩৮)
.
(চলবে ইন শা আল্লাহ)
.
শেয়ার করে বা অন্ধভক্তদের ট্যাগ দিয়ে তাদের অন্ধত্ব দূরীকরণের একটা ছোট চেষ্টা করে দেখুন। অবশ্য…
“It is not the eyes that are blind, but the hearts” (Surah Al-Haj, 22: 46)
#মুখোশের_অন্তরালে_নাস্তিকতা ১
#জাফর_ইকবাল
============================
লেখকঃ তানভীর আহমেদ
Leave Your Comments