অস্তিত্বের উদ্দেশ্যহীনতা ও নৈতিকতার অনস্তিত্ব
.
আচ্ছা চুরি করা কি খারাপ? কেন খারাপ? কারো ক্ষতি হচ্ছে বলে? আচ্ছা ক্ষতি করা কি খারাপ? কেন খারাপ?…
.
প্রশ্নগুলো আপনার কাছে আজগুবি ঠেকলে বলতে হয় আপনি এখনো বিজ্ঞানমনস্কতার মাকামে পৌঁছতে পারেননি। আপনাকে একটু বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টা ব্যাখ্যা করি।
.
বিজ্ঞানমনস্করা বলে যে, বিজ্ঞানীরা বলেন যে, বিজ্ঞান বলে এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টির পেছনে আল্লাহর কোনো ভূমিকা নেই। মানে বুদ্ধিমান কোনো সত্ত্বা এর পেছনে দায়ী নয়। এই গোটা বিশ্বজগৎ একটি অন্ধ শক্তির দ্বারা সংঘটিত দুর্ঘটনা। জড় পদার্থ থেকে আস্তে আস্তে এককোষী জীব, সেখান থেকে আস্তে আস্তে বর্তমান মানুষের উদ্ভব।
.
এই বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ নামক কোনো বস্তু কখনো তৈরি হয়নি। ইনফ্যাক্ট, একটা জিনিসকে সর্বসম্মতভাবে ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ বলে আখ্যা দেয়ার কোনো মানদণ্ড নেই। সত্ত্বাগতভাবে একটা জিনিস কখনো ‘ভালো’ বা ‘খারাপ’ হয় না। কেউ যখন সেটাকে ‘ভালো’ বলে, তখনই কেবল সেটা ‘ভালো’। কেউ ‘খারাপ’ বললে ‘খারাপ’। আবার একজন ব্যক্তি বা একটি গোষ্ঠী বা জাতির কাছে যা ভালো, অন্য ব্যক্তি/গোষ্ঠী/জাতির কাছে তা খারাপ হতেই পারে। বিভিন্ন যুগে একই জিনিস কখনো ভালো, কখনো খারাপ বলে বিবেচিত হয়।
.
আমরা যা কিছুকে ভালো বা খারাপ বলে জানি, তা হলো কোনো না কোনো ধর্ম বা সামাজিক রীতিনীতি বা রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত ভালো-খারাপ। আমরা আমাদের মনকে সে অনুযায়ী প্রোগ্রাম করে নেই। কিন্তু আমাদের এই নির্মাণ এবং প্রোগ্রামের বাইরে একটা নির্লিপ্ত বাস্তবতার অস্তিত্ব আছে। নির্লিপ্ত বলার কারণ হলো, বুদ্ধিমান সত্ত্বার হস্তক্ষেপ ছাড়াই নিজে নিজে সৃষ্ট এই জড় প্রকৃতিতে ভালো-খারাপ, ন্যায়-অন্যায়ের কোনো পার্থক্য নেই। সাপ ব্যাঙকে খায়। এখানে অন্যায়কারী কে?
.
তাই বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, আপনার চারপাশে আপনি যতকিছুর অস্তিত্ব দেখছেন তা পয়েন্টলেস। মানে এদের অস্তিত্বের কোনো উদ্দেশ্য নেই। আপনার আমার তৈরি করা ‘ভালো’, ‘খারাপ’, ‘ন্যায়’, ‘অন্যায়ে’র এই সিস্টেমটাও আসলে উদ্দেশ্যহীন। সবকিছুর শেষে ওই এক জিনিস- মৃত্যু!
.
আরো কঠিন করে ব্যাখ্যা করা যায়। এ নিয়ে বিজ্ঞান, তত্ত্ব ও সাহিত্যের ফীল্ডে জিনিসপাতির ভাণ্ডার রয়েছে। সেদিকে গেলে আলোচনাটা জটিল হয়ে যায় ও প্রাসঙ্গিকতা হারায়।
.
অস্তিত্বশীল এই জগতের উদ্দেশ্যহীনতাকে যদি আপনি স্বীকার করেন (অর্থাৎ ধর্মীয় কোনো বিশ্বাসের মাধ্যমে জগতের উদ্দেশ্যহীনতাকে অস্বীকার না করেন), তাহলে আপনার সামনে কয়েকটা অপশান খোলা থাকে।
.
একটা অপশান হলো আপনি সুইসাইড করে ফেলতে পারেন। সবকিছুই যখন অর্থহীন, সবকিছুর শেষ পরিণতি যখন মৃত্যু, তো এখনই নয় কেন? আরেকটা অপশান হলো বিনোদন। সবরকমের দৈহিক চাহিদা পূরণ করে আপনি চরমতম বিনোদনময় জীবনযাপন করে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষাটাকে ভুলে থাকতে পারেন। অথবা রক্তপিপাসু ক্ষমতাধর শাসক হয়ে জীবনের সর্বোচ্চ মজাটা লুটে নিতে পারেন মরার আগে। অথবা নিজের জীবনের উপর নিজেই একটা অর্থ আরোপ করতে পারেন যে ‘আমি এই এই উদ্দেশ্যে বাঁচবো’।
.
বিজ্ঞানমনস্ক জীবনদর্শনের ভয়াবহ দিক হলো উপরে এখন পর্যন্ত যা যা বলা হলো তা। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্করা আপনাদের সামনে তাদের ধর্মের সবকিছু উল্লেখ করে না। করলে আপনারা তাদের উপর বিরক্ত হয়ে যেতেন। আসিফ মহিউদ্দীনরা যখন দাবি করে যুক্তি ব্যবহার করা তাদের রীতি, আর চাপাতি দিয়ে কোপানো মুমিনদের রীতি- এ কথা দিয়ে সে মুমিনদের উপর বিজ্ঞানমনস্কদের একটা মোরাল সুপিরিওরিটি প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু তার এ কথাটা কোনো ভ্যালু বহন করে না।
.
কারণ সব যুক্তি নিয়ে বেঁচে থাকার পরও অর্থহীন জীবনের শেষটা হয় ওই অর্থহীন মৃত্যুর মাধ্যমে। আর বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যেহেতু ন্যায়-অন্যায় বলে কিছু নেই, তাই চাপাতি দিয়ে কোপানোটাও একটা প্রাকৃতিক ফেনোমেনন ছাড়া কিছু না। খনি থেকে আহরিত লোহা প্রক্রিয়াজাত হয়ে হাতলযুক্ত ধারালো ইস্পাত হয়। একটি হোমো সেপিয়েন্সের ঐচ্ছিক পেশীর নড়াচড়ায় অপর হোমো সেপিয়েন্সের খুলিতে ফাটল হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে ভেতরকার সেরেব্রাল বডিগুলো ভূমিতে পড়ে যায়। এর বেশি কিছু না।
.
উপরের এই জটিল ঝামেলা অল্প কথায় সমাধান হয়ে যায় ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণের একটা সত্ত্বায় বিশ্বাস করলে। আল্লাহ বলেছেন ন্যায়, অতএব ন্যায়। আল্লাহ বলেছেন অন্যায়, অতএব অন্যায়।
.
ইসলামী শাস্ত্রের পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করলে দেখবেন, কী কী কারণে মানুষকে হত্যা করা যায় তার লিস্ট আছে। কিন্তু কী কী কারণে মানুষকে হত্যা করা যায় না, তার কোনো লিস্ট নেই। কারণ সেটা অসীম। লিস্ট করে শেষ করা যাবে না। ওই নির্ধারিত কারণগুলোর বাইরে একটা মানুষকে হত্যা করা মানে সমগ্র মানবজাতিকে annihilate করে ফেলা। কেন? আল্লাহ বলেছেন তাই।
.
বিজ্ঞানমনস্ক না হয়ে আমার ইসলামে বিশ্বাস করার কারণগুলোর মাঝে একটা হলো এই যে এটা আমার জীবনকে সহজ করে। ইসলাম আমার জীবনকে একটা উদ্দেশ্য দেয়। বিজ্ঞানমনস্কদের মতো পাতার পর পাতা কঠিন ভাষায় মোটা মোটা বই লিখে শেষে উপসংহারে গিয়ে আমাকে বলে না “তোমার এই অস্তিত্ব অর্থহীন, তোমার মৃত্যু অর্থহীন।”
======================
লেখকঃ নিলয় আরমান
Leave Your Comments