#উপলব্ধি
.
রাহাতের সাথে এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। শেষবার তাকে দেখেছিলাম ভার্সিটির সমাবর্তনের দিন। হল ছাড়ার জন্য যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম, তখন সে আমার রুমে এসেছিল। ব্যস্ততার ফাকে সামান্য কিছু সময় তার সাথে কথা হয়েছিল। এরপর অনেক চেষ্টা করেও তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারি নি।
.
সেদিন শুক্রবার, আমি আসরের সালাত আদায় করে মসজিদ থেকে বের হচ্ছি, ঠিক এই সময়ে কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকল। আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম লম্বা সাদা পাঞ্জাবি, বাদামি বর্ণের টুপি, আর মুখভর্তি দাড়িওয়ালা এক যুবক। চিনতে একটু কষ্ট হচ্ছিল, তবুও ডাক শুনে তার কাছে গেলাম।
.
আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, আসসালামু আলাইকুম। আমি রাহাত।
.
আমি চোখ বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে সে বলল, আমি রাহা–ত। রাহাত রায়হান।
চিনতে পেরেছিস?
.
নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললাম আপনি কি সেই রাহাত, যার সাথে আমি বিশ্ববিদ্যায়ে পড়েছি?
.
সে কেবল মাথা নাড়ল।
.
আর আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।
.
এইত কিছুদিন আগেও যে ছেলেটা স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান ছিল, আজ সে দিব্বি ধার্মিক মুসলিম। গায়ে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি আর লম্বা দাড়ি দেখে বুঝারই উপায় নেই যে এ রাহাতই সেই রাহাত, যে একসময় নাস্তিক ছিল।
আমি মনে মনে এসব কল্পনা করতেই সে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল।
.
কথাবার্তার মাধ্যমে জানতে পারলাম সে তার খালাত ভাই এর শ্বশুর বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। এরপর কুশলাদি বিনিময় করে আমরা মসজিদ থেকে বাইরে বের হলাম।
.
বের হয়েই আমি রাহাতের হাত শক্ত করে ধরে বললাম, আজ আর তোকে ছাড়ছি না। কত দিন তোকে খুঁজেছি কিন্তু কোন হদিস করতে পারি নি।
.
আমার কথা শুনেই সে তার চিরচেনা মুচকি হাসিটা উপহার দিল।
.
আমি বললাম, রাহাত KFC তে যাবি?
.
রাহাত তো অবাক এই অজপাড়া গায়ে আবার KFC আসবে কোথা থেকে?
.
আমি বললাম আরে চল না।
.
আমরা KFC তে পৌছেই চায়ের অর্ডার দিলাম।
.
চায়ে চুমুক দিয়েই রাহাত জিজ্ঞাসা করল, তুই না আমাকে KFC তে নিয়ে যাবি বললি?
.
আমি কিছু না বলে শুধু আংগুল দিয়ে উপরের দিকে ইশারা করলাম।
.
রাহাত উপরের দিকে তাকিয়েই হেসে কুটি কুটি।
হাসি থামিয়ে বলল, এই তোর KFC?
.
আমি বললাম, হুম।
দেখিস না লিখা আছে কামাল ফুড কর্ণার। কামালের K ফুডের F আর কর্ণারের C মিলিয়েই আমাদের গাঁয়ের বিখ্যাত KFC.
.
সে আরেক ফালি হাসি উপহার দিল।
.
আমি তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাব, এই মুহূর্তে সে বলল,
ভাই তুই যদি সেইদিন আমাকে কড়া কড়া কথাগুলো না বলতি, তাহলে হয়ত আমার মাথা থেকে নাস্তিকতার ভূত নামতই না। কোন সুদূরে যে পড়ে থাকতাম তা বলাই বাহুল্য।
.
-সেইদিন মানে?
.
-তোর মনে নেই, সমাবর্তন পরবর্তী রাতের কথা।
.
আমি মাথা চুলকাচ্ছি দেখে সে বলল, আরে ঐ যে আমি তোকে কতগুলো উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করেছিলাম, আর তুই খুব সুন্দর করে সেগুলোর জবাব দিয়েছিলি।
.
আমি বললাম, ওহ, হ্যাঁ মনে পড়েছে।
.
.
সারাদিন সমাবর্তন অনুষ্ঠানের পেছনে দৌড়াদৌড়ি করে রাতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। ভেবেছিলাম একদিন আরাম করে পরদিন সকালে রওয়ানা দেব কিন্তু বাসের অগ্রীম টিকিট কাটা ছিল বলে অগত্যা সেদিনই রওয়ানা দিতে হয়েছিল।
জিনিসপত্র গুছাচ্ছিলাম।
এমন সময় রাহাত এসে হাজির।
.
আমাকে দেখে বলল, চলে যাচ্ছিস?
-আমি মাথা নাড়লাম।
-আমার যে একটা প্রশ্ন ছিল?
– বল।
– আচ্ছা তোরা বিশ্বাসের প্রতি এত গুরুত্ব দিস কেন? এখন বিজ্ঞানের যুগ প্রযুক্তির যুগ, বিশ্বায়নের যুগ। সবকিছুকে বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করেই যাচাই করলেই হয় না। স্রষ্টা আর ধর্ম জিনিসটা আদিম ব্যপার ছাড়া কিছুই নয়।
.
একে তো ক্লান্ত শরীর, আবার যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গোছাতে হচ্ছে, তার উপর আবার রাহাতের উপদ্রব। মাথাটা ভন ভন করছিল।
.
আমি কিছুটা উচ্চস্বরেই বললাম, হুমায়ুন আজাদের “আমার অবিশ্বাস” বই থেকে বলছিস, তাই না?
.
রাহাত বলল তুই কিভাবে বুঝলি?
.
কথার জবাব না দিয়েই আমি বললাম, আচ্ছা রাহাত! তুই যাদেরকে বাবা মা বলে ডাকিস, তারা তোর বাবা মা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ করেছিলি কোনদিন?
.
– না।
.
-তাহলে তুই কিভাবে বুঝলি যে যাদেরকে তুই বাবা মা বলে ডাকিস এদের থেকেই তুই জন্ম নিয়েছিলি? এরাই তোর আসল বাবা-মা? এমনও তো হতে পারে যে, তোকে একটি ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে। ডাস্টবিনের ডাবের খোসা, পলিথিন, খাবাড়ের উচ্ছিষ্টের র্যান্ডম সংমিশ্রণের ফলেই তোর জন্ম হয়। তুই যাদেরকে নিজের পরিবারের সদস্য হিসেবে জানিস তারা তোকে ডাস্টবিনে পেয়ে দত্তক নিয়ে নিলো।
.
রাহাত বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। কেননা, সে তো তার প্রিন্সিপ্যাল থেকে সরতে পারে না। যা সে দেখেনি, তা বিশ্বাস করবে কেমন করে? তার কাছে তো আসলেই এমন প্রমাণ নেই যে সে যাদেরকে পিতামাতা হিসেবে জানে তাদের থেকেই তার জন্ম। কেননা আফটার অল, সৃষ্টিকর্তা বলে তো কিছু নেই। সবকিছুই তো র্যান্ডমলি ক্রিয়েট হয়েছে !!!
.
যাই হোক রাহাতের তাৎক্ষণিক জবাব ছিল, আমি ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে বাবা মা হিসেবে দেখে আসছি। আর আমার ফ্যামিলি মেম্বার, আত্নীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবাই তো সাক্ষী দেয় যে, তারাই আমার বাবা মা।
.
-তার মানে তোর বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ ছাড়া কথার উপর ভিত্তি করেই তাদেরকে বাবা মা বলে ডাকিস?
.
-রাহাত কিছুটা নিচু গলায় বলল, হ্যাঁ।
.
-তাহলে এখানে তোর বিজ্ঞান কোথায় গেল? কেন বিজ্ঞান দিয়ে যাচাই না করেই তাদেরকে বাবা মা হিসেবে মেনে নিলি?
.
-আচ্ছা তোর বাবা মা তোকে ভালোবাসে?
.
-অবশ্যই। কেন বাসবে না?
.
-তাহলে বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ দে যে তোর বাবা মা তোকে ভালোবাসে। নয়ত আমি কিভাবে বুঝব?
.
– তুই কি পাগল! ভালোবাসা কি বিজ্ঞান দিয়ে মাপার জিনিস? এটা তো অনুভব করে নিতে হয়।
.
– স্রষ্টাও এমন জিনিস যাকে অনুভব করে নিতে হয়। বিজ্ঞান দিয়ে তাকে মাপা যায় না, তার অস্তিত্ব অনুভব করা যায়।
.
আমার উত্তরে সে সন্তুষ্ট হল কিনা জানি না, আমি আবার পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
.
-আচ্ছা তোর দাদার বাবার নাম কি জানা আছে?
.
-সে তার দাদার বাবার নাম বলল।
.
-তুই যে তোর দাদার বাবা থেকে এসেছিস তা বিজ্ঞান দিয়ে প্রমাণ কর।
.
-ইয়ে মানে…
.
-ইয়ে মানে করে লাভ নেই, বিজ্ঞান দিয়ে তোকে প্রমাণ করতেই হবে। নয়ত তুই তোর দাদার বাবা থেকে না বরং চিড়িয়াখানায় বানর থেকে এসেছিস বলে মেনে নিতে হবে।
.
সে এবার খানিকটা নড়ে চড়ে বসে বলল,
.
-আমি আমার দাদার বাবার কাছ থেকে এসেছি এর প্রমাণ আমি নিজেই।
.
-Exactly দোস্ত, তুই তোর দাদার বাবার কাছ থেকে এসেছিস এর প্রমাণ তুই নিজেই। ঠিক তেমনি এই মহাবিশ্বই প্রমাণ যে মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা আছে। মহাবিশ্বের প্রত্যকেটি আনুবীক্ষণিক বস্তু থেকে শুরু করে দৃশ্যমান সকল বস্তুও কথার সাক্ষ্য বহন করে যে, মহাবিশ্বের একজন স্রষ্টা অবশ্যই আছে। চাই বিজ্ঞান দিয়ে তাকে প্রমাণ করা যাক বা না যাক।
বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে, আর মানুষের জ্ঞানেরও সীমাবদ্ধতা আছে। মানুষ তার মস্তিষ্কের খুব কম অংশই ব্যবহার করতে পারে। যার ফলে তার সীমাবদ্ধ জ্ঞান দিয়ে অসীম জ্ঞানের অধিকারী স্রষ্টাকে প্রমাণ করতে যাওয়ায়া হাস্যকরই বইকি।
পিতামাতাকে যদি বিজ্ঞানভিত্তিক প্রমাণ ছাড়াই তুই বিশ্বাস করিস, ভালবাসাকে তুই যদি বিজ্ঞান দিয়ে না মেপেই অনুভব করিস, তোর বংশপরিচয় যদি তুই যাচাই না করেই মেনে নিস; তাহলে স্রষ্টাকে মানতে আপত্তি কোথায়?
.
রাহাত কিছুটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বলল, আচ্ছা! ভাল থাকিস।
.
আমি কাপড় গোছাচ্ছিলাম, পেছনে ফিরে তাকাতেই দরজা বন্ধের আওয়াজ পেলাম।
.
.
.
সেইদিনকার ঘটনাটি মনে মনে স্মরণ করতে গিয়ে চা খাওয়ার কথাই ভুলে গেছিলাম।
.
হঠাৎ রাহাত বলল, কিরে কই হারিয়ে গেলি? চা তো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। তুই তো আবার ঠাণ্ডা চা খেতে পারিস না।
.
আমি মুচকি হেসে বললাম, এখনো মনে রেখেছিস।
.
চা খেতে খেতে রাহাত তার জীবনের অনেক কথাই বলল। আমি কেবল নিরব শ্রোতার মত শুনে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে হ্যাঁ, হুম, আচ্ছা ইত্যাদি ছাড়া আর কিছুই বলি নি।
.
মসজিদের মিনার থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসল। চায়ের বিল দিয়ে আমরা সালাতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।
.
#স্রষ্টার_অস্তিত্ব – ১
.
লেখকঃ জাকারিয়া মাসুদ [ফেসবুক id: Jakaria Masud]
Leave Your Comments