“একেক বিজ্ঞানী একেক কথা বলে। কারটা শুনবো?”
.
সন্ধানীর কথায় চমকে তার দিকে ফিরলো কানিজ। টিএসসি’র এই প্রাণবন্ত পরিবেশে কথাটা কেমন বেখাপ্পা ঠেকলো। বেশ কয়েকদিন যাবত বই-ব্লগ-ফেসবুক ঘেঁটে বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধের কয়েকটা লেখা পড়ছে সন্ধানী। সেগুলোই তার মাথা খেয়েছে।
.
কানিজ সাহস যুগিয়ে বললো, “আরে আজব! একেকজন একেক কথা বললেই কি তুই মেনে নিবি নাকি? তোর কি নিজের বিবেক-বুদ্ধি নেই?”
.
“বিবেক-বুদ্ধি আছে,” অধৈর্য ভঙ্গিতে বললো সন্ধানী, “কিন্তু টেকনিকাল টার্মসের জটিল আলাপের একটা পর্যায়ে গিয়ে সেগুলো আর কাজ করে না, বুঝলি?”
.
“তো কোনো টার্ম না বুঝলে নেট ঘেঁটে জেনে নে। অথবা আমাকে জিজ্ঞেস কর। আমিও না পারলে বায়োকেমিস্ট্রির নাবিলা আছে। একটু কষ্ট করলেই তো হয়।”
.
“দ্যাখ তুই ফিজিক্সে পড়েই তো বিবর্তনবাদের অনেক কিছুই ক্লিয়ারলি বুঝিস না। জানি নাবিলারও অনেক কিছু ক্লিয়ার না। এখন আমরা যারা আর্টস-কমার্সের ছাত্রী, তারা কী করবো? পৃথিবীর এত রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, কৃষক এরা কী করবে? সবাই একেকজন আরজ আলী মাতুব্বর হবে? তুইই বল, এটা সম্ভব?”
.
“দ্যাখ, সন্ধানী। কারো বোঝা-না বোঝা দিয়ে তো কিছু আসে যায় না, তাই না? যার পক্ষে বৈজ্ঞানিক প্রমাণ আছে, যুক্তি আছে, মানুষ চাক্ষুষ দেখছে, সেসব কি মিথ্যা হয়ে যাবে?”
.
“আচ্ছা বল তো কানিজ, কয়জন জীবনে পানির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে এক অণু অক্সিজেন আর দুই অণু হাইড্রোজেন তৈরি হতে দেখেছে?”
.
“আরে বাবা বিজ্ঞানীরা তো দেখেছেন নাকি?”
.
“তাহলে আমরা তাদের কথা শুনেই বিশ্বাস করবো?”
.
“তা কেন? তুই কোনো ল্যাবে গিয়ে বল, তোকে চাক্ষুষ দেখিয়ে দেবে।”
.
“আর বাকি কোটি কোটি যত থিওরি, সেসব দেখাবে? এক জীবনে সব দেখে শেষ হবে? নিয়ান্ডারথাল থেকে মানুষের উৎপত্তি আমাকে ল্যাবে দেখাবে?”
.
“শোন সন্ধানী, তোকে একটা কথা বলি।” মৃদু হাসলো কানিজ, “সবকিছু নিজ চোখেই দেখতে হবে তা তো আমরা বলি না। বিজ্ঞানীরা হলেন বিজ্ঞানের প্রতিনিধি। সত্যবাদী প্রতিনিধি। তাঁদের সত্যবাদিতাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এতজন একসাথে মিথ্যা কেন বলবে?”
.
“এখন মুসলমানরা যদি বলে মোহাম্মদের (সাঃ) ৪০ বছরের সত্যবাদিতাই উনার ধর্মের সত্যতার প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট? সোয়া লাখ না জানি দুই সোয়া দুই লাখ…কতজন নবী যেন তোদের?”
.
“কী জানি মনে নেই।” জোর করে চেপে গেলো কানিজ।
.
সন্ধানী মরিয়া হয়ে বললো, “আচ্ছা এক লক্ষই ধরলাম। এখন যদি কেউ বলে এক লাখ মানুষ একজন ঈশ্বরের আরাধনা করতে বলে গেলো। এটা মিথ্যা হয় কী করে? কী জবাব দিবো?”
.
কানিজ মনে মনে জবাব গোছাতে গোছাতেই সন্ধানী আবার বললো, “এক বিজ্ঞানীর মরার একশ বছর পর প্রমাণ হয় তার থিওরি ভুল। কারো থিওরি নিয়ে জীবিতদের মধ্যেই হাজারো ডিবেট। ভয় হয় বুঝলি কানিজ, এই এক জীবনে এত ডিবেটের ভেতর থেকে সত্যটা বের করে নিতে পারবো কিনা।”
.
কানিজ বললো, “না পেলে না পেলি! কী আসে যায়? মরে গেলে সব শেষ।”
.
“যদি সব শেষ না হয় তখন?”
.
“তখন আল্লাহ, গড, ঈশ্বরকে বলিস তুই যথেষ্ট প্রমাণ পাসনি উনাকে বিশ্বাস করার।”
.
জিদ লাগলো সন্ধানীর। কানিজ যে নিজেই নিজের বিশ্বাসে অটল না, সেটা প্রায়ই কথার ফাঁকে টের পেয়ে যায় সন্ধানী। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে গেলো সে, “সামনের মাসেই একটা নাটক নামাবো আমরা। অ্যাবসার্ডিস্ট থিয়েটারের। অ্যাবসার্ডিস্ট ফিলোসফি জানিস তো নাকি?”
.
“হুম,” খুশি হয়ে উঠলো কানিজ, “জোস হবে তাহলে। কোন নাটক?”
.
“তাহলে তো এগুলোর মূল কথাগুলো জানিসই,” বলে চললো সন্ধানী, “কেন এলাম? কোথায় যাবো? কেন বেঁচে আছি? কীই বা হবে বিবর্তনবাদ সত্যি হলে বা মিথ্যা হলে? কেন ভার্সিটিতে পড়ছি? মৃত্যুই যদি শেষ কথা হবে, তো আত্মহত্যা নয় কেন? অ্যাবসার্ড এই জগতের বাইরে সত্যিই কি কোনো মহাশক্তিধর সত্ত্বা আছে, যার কারণে এই অর্থহীন পৃথিবী অর্থপূর্ণ হয়? বল তো আমাদের নাস্তিকদের কাছে সত্যিই এর কোনো জবাব আছে?”
.
হাসার চেষ্টা করলো কানিজ, “জীবনটা অর্থহীন, তাই তুই এর উপর নিজের মতো করে অর্থ আরোপ করবি। এটাই তো অ্যাবসার্ডের সবচেয়ে সুন্দর দিকটা, নাকি?”
.
“হুম,” দীর্ঘশ্বাসের ভঙ্গিতে বললো সন্ধানী, “হয়তো আমি আবার ধার্মিক হয়ে যাবো রে।”
.
“কী বলিস?” মুখ বাঁকালো কানিজ, “এত ধর্মের মাঝে কোনটা ঠিক কীভাবে বের করবি?”
.
“একটা একটা করে বাদ দিতে দিতে যাবো। আজ যেমন নাস্তিকতা নামের ধর্মটা বাদ দিলাম। এভাবেই যেতে থাকবো। শেষে কিছু না পেলে deist হয়েই থাকবো নাহয়, তবু atheist না।”
.
অনেকক্ষণ নীরবতার পর সন্ধানী হোস্টেলে ফেরার জন্য উঠলো, “যাই রে।” কিছু বললো না কানিজ। একটু দূর গিয়ে পেছন ফিরে সন্ধানী বললো, “কানিজ, শোন। ঠাকুমা আমার নাম সন্ধানী রেখেছেন একটা কারণে। যাতে আমি সত্যটা খুঁজে নেই। আমি সে নামের সার্থকতা রাখবোই।” বলে আবার হাঁটা দিলো সে।
.
তাকিয়ে ছিলো কানিজ। মাগরিবের আজানের শব্দে হুঁশ ফিরলো। রাতের ডানাগুলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। অপ্রিয় একটা বাস্তবতার সময় ঘনিয়ে আসছে, যা সে ছাড়া কেউ জানে না। আগামী ১০-১১ ঘন্টা আস্তিক থাকবে সে। রাতের ভয়াল পরিবেশটা কেটে গিয়ে আবার যখন পাখি গাইবে গান, সূর্য ছড়াবে আলো, মানুষের পদভারে গমগম করবে শহর, তখন আবার সে ফিরে আসবে প্রিয় নাস্তিকতায়। প্রশান্তির দায়িত্বহীনতায়।
.
#HujurHoye
========================
উৎস: হুজুর হয়ে
হুজুর হয়ে পেইজের লেখার লিঙ্কঃ https://www.facebook.com/Hujur.Hoye/posts/614380502088336
প্রবন্ধের কপিরাইট © হুজুর হয়ে পেইজ
পুনঃপ্রকাশ, “হুজুর হয়ে” পেইজ অনুমোদিত
Leave Your Comments