কখনোই তোমরা তা পারবে না
.
একেক যুগে মানব সভ্যতার একেকটি দিক উৎকর্ষতা লাভ করে। যেমনঃ মুসা(আঃ) এর যুগে জাদুবিদ্যা ছিল উৎকর্ষতার শীর্ষে। আল্লাহতায়ালা মুসা(আঃ) কে মুযিযা হিসেবে এমন এক লাঠি দিয়েছিলেন যা দিয়ে তিনি সে সময়ের সেরা সেরা জাদুকরদের পরাজিত করেছিলেন। ঈসা(আঃ) এর যুগ ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানে রোমানদের সেরা যুগ। আল্লাহতায়ালা ঈসা(আঃ) কে এমন কিছু দিয়েছিলেন যেটা তার সময়ে কেউই করতে সক্ষম ছিল না। আল্লাহর ইচ্ছায় ঈসা(আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন,কুষ্ঠ রোগীদের সুস্থ করতেন।
.
ঈসা(আঃ) এর পর আসে মুহম্মদ(সাঃ) এর কথা। তিনি এমন সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যখন আরব সভ্যতা সাহিত্যের বিচারে ছিল শ্রেষ্ঠ। কবিতাই ছিল তাদের নিজেদের আবেগ,ভালবাসা,হিংসা,ক্রোধ এমনকি অশ্লীল যৌনতা প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম। আল্লাহতায়ালা সে সময় মুহম্মদ(সাঃ) কে রিসালাতের মর্যাদা দান করলেন আর পুরো মানজাতির উদ্দেশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন –
.
“আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি, তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে, তোমরা এর অনুরুপ একটি সূরা নিয়ে আস।”
[সূরা আল বাকারা ২;২৩]
.
তারপর এটাও বলে দিলেন-
.
“এবং তোমরা যদি সত্যবাদী হও, তাহলে আল্লাহ্ ব্যতীত তোমাদের সকল সাহায্যকারীকে আহ্বান কর। যদি তা না পার, এবং কখনোই তোমরা তা পারবে না। তাহলে সেই আগুন কে ভয় কর, অবিশ্বাসীদের জন্য যা প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে, মানুষ এবং পাথর হবে যার জ্বালানী।” [২;২৩-২৪]
.
প্রায় ১৪০০ বছর পুরানো চ্যালেঞ্জ! অনেকের ধারণা আরবরা তো এখন শুধু মুসলিম, তাই এখন আর এই চ্যালেঞ্জ খাটে না। অনেকেই জানেন না, আরবদের মধ্যে এখনো রয়েছে প্রায় ১৪ মিলিয়ন আরব খৃষ্টান,এছাড়া রয়েছে অনেক নাস্তিক-এগনোস্টিক। তারা কেউই এই চ্যালেঞ্জ এর সামনে বলার মত তেমন কিছু নিয়ে আসতে পারেননি। যারা চেষ্টা করেছেন তারা শুধু হাসির খোরাকই যুগিয়েছেন।
.
১৯৯৯ সালে আনিস সরোস নামে এক খৃষ্টান এভেঞ্জালিস্ট কুরআনের মত একটা বই রচনার দাবী নিয়ে আসেন। রচনা করেন একটা বই-“আল ফুরকানুল হক” বা “The true Furqan” । শুধু যে বইয়ের নাম ‘ফুরকান’ কুরআন থেকে কপি তাই ই নয় বরং অনেক সূরা কুরআন থেকে ডাইরেক্ট কপি-পেস্ট করা হয়েছে, শুধু শব্দগুলো একটু এদিক,সেদিক করা হয়েছে। আর আমরা জানি আল্লাহতায়ালা কুরআনে যথাযথ শব্দ-চয়ন করছেন। তাই শব্দের এদিক-সেদিক করে তিনি যে জগাখিচুড়ি বানিয়েছেন, তা তাঁর বইয়ের মান নামিয়েছে অনেক নীচে।
.
আর তাকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। কারণ, আরবী সাহিত্যের সেরা সময়ে যারা সেরা ছিলেন, তারাই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। যেমনঃ ওয়ালিদ ইবন মুগিরা, আরবের অন্যতম সেরা ভাষাবিদ ও বুদ্ধিজীবি, রাসূল(সাঃ) এর সাথে ডিবেট করতে যান এবং সম্পূর্ণ নাস্তানাবুদ হয়ে কুরাইশদের উদ্দেশ্যে বলেন –
.
“আমি কি বলব? তোমাদের মধ্যে কেউই কাব্য এতোটা ভালো জানো না, যতটা আমি জানি, না তোমাদের মধ্যে কেউ আমার সাথে ভাষা গঠন ও অলংকরণের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় পারবে। তারপরেও আমি বলছি, আল্লাহর কসম, মুহম্মদের কথার সাথে আমি যা জানি তার কোন কিছুরই সাদৃশ্য নেই আর আমি আল্লাহর কসম করে বলছি সে যা বলে তা খুবই মাধুর্যপূর্ণ।”
.
রাসূল(সাঃ) এর প্রধান শত্রু আবু জাহল কুরআন সম্পর্কে বলে, “ বনু হাশিম যা কিছু করেছে আমরা তাদের সাথে প্রতিযোগিতা করেছি।কিন্তু এখন তারা এমন কিছু নিয়ে এসেছে(কুরআন) যার সাথে আমরা কখনোই পারব না।”
.
ভন্ড নবী মুসাইলিমা আল-কাযযাব- এর কথা কে না জানে! সে দাবী করেছিল তার কাছেও জিবরাইল(আঃ) ওহী নিয়ে আসেন, যা কুরআনের মতই পবিত্র। সে কুরআনের বেশ কয়েকটি সূরার অনুরূপ সূরা তৈরীর চেষ্টা করে।যেমনঃ সূরা-ফীল কপি করে একটা সূরা তৈরীর চেষ্টা করে।
.
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ بِأَصْحَابِ الْفِيلِ [١٠٥:١]
আপনি কি দেখেননি আপনার পালনকর্তা হস্তীবাহিনীর সাথে কিরূপ ব্যবহার করেছেন?
أَلَمْ يَجْعَلْ كَيْدَهُمْ فِي تَضْلِيلٍ [١٠٥:٢]
তিনি কি তাদের চক্রান্ত নস্যাৎ করে দেননি?
وَأَرْسَلَ عَلَيْهِمْ طَيْرًا أَبَابِيلَ [١٠٥:٣]
তিনি তাদের উপর প্রেরণ করেছেন ঝাঁকে ঝাঁকে পাখী,
تَرْمِيهِم بِحِجَارَةٍ مِّن سِجِّيلٍ [١٠٥:٤]
যারা তাদের উপর পাথরের কংকর নিক্ষেপ করছিল।
فَجَعَلَهُمْ كَعَصْفٍ مَّأْكُولٍ [١٠٥:٥]
অতঃপর তিনি তাদেরকে ভক্ষিত তৃণসদৃশ করে দেন।
.
.
এর অনুরূপে মুসাইলিমা যে সূরাটি বানায়, তা হচ্ছে-
الفيل
হাতি।(আল-ফীল)
ما الفيل
হাতি কি? (মাল ফীল?)
وما أدراك ما الفيل
তুমি কি জানো হাতি কি? ( ওয়া মা আদরকা মাল ফীল?)
له ذنب وبيل والخرطوم طويل
এর প্রশস্ত দুই কান এবং লম্বা একটা নাক আছে। (লাহু জানাবুন ওয়াবিল, ওয়া খুরতুমুন তাওইল)
.
.
……
হাস্যকর এক চেষ্টা তাতে কোন সন্দেহ নেই, না আছে মাথা,না আছে মুন্ডু। তার উপর প্রথম তিনটি আয়াত কুরআনের সূরা আল-কারিয়া কে কপি করার চেষ্টা করা হয়েছে (আল কারিয়াতু,মাল কারিয়া,ওয়ামা আদরাকা মাল কারিয়া)।
.
আমর ইবনুল আসকে(রাঃ) মুসাইলিমার কাছে পাঠানো হয়েছিল যাতে সে তওবা করে। মুসাইলিমার কাছে গেলে সে আমর ইবনুল আসকে জিজ্ঞেস করে-
.
“তোমার বন্ধুর কাছে কি নতুন কোন ওহী এসেছে।?”
আমর ইবনুল আস উত্তর দেন, “একটি ছোট তবে যথাযথ সূরা তাঁর উপর নাযিল হয়েছে।
.
মুসাইলিমা জিজ্ঞেস করে, “কি সেটা?”
আমর ইবনুল আস তখন সূরা আসর তিলওয়াত করেন-
.
– وَالْعَصْرِ
কসম যুগের (সময়ের),
إِنَّ الْإِنسَانَ لَفِي خُسْرٍ
নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত;
إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَتَوَاصَوْا بِالْحَقِّ وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ
কিন্তু তারা নয়, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে তাকীদ করে সত্যের এবং তাকীদ করে সবরের।
.
.
তিলওয়াত শুনে মুসাইলিমা কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে। তারপর বলেন, আমার কাছেও অনুরূপ সূরা নাযিল হয়েছে।তারপর সে তিলয়াত করে,
يا وبر يا وبر ،
হে জংলী ইদুর! হে জংলী ইদুর! ।(ইয়া ওয়াবারু,ইয়া ওয়াবারু)
نقز إنما أنت أذنان وصدر
তুমি তো দুইটা কান আর বক্ষ ছাড়া কিছুই না।(ইন্নামা আনতা আযনানী ওয়া সাদরুন )
، وسائرك حفز بقر
আর সবই তো তোমার নগণ্য।(ওয়াসাইরুকা হাকরুন বাকরুন)।
😀
.
মুসাইলিমা এরপর আমর ইবনুল আস(রাঃ) কে জিজ্ঞেস করে, “কেমন হয়েছে (আমার সূরা)?”
.
আমর(রাঃ) জবাব দেন, “আমায় আর কি জিজ্ঞেস করছ? যেখানে তুমি নিজেই জানো এর সবই মিথ্যা।”
.
আমরা অনেকেই সত্য অস্বীকারে মুসাইলিমা থেকে কম এগিয়ে না। জীবনের কোন এক পর্যায়ে এসে আবু জাহলের মত আমরা সত্য কিছুটা হলেও চিনতে পারি। কিন্তু বাঁধা দেয় আমাদের ইগো,ক্ষমতার দাপট আর নিজেকে মুক্ত ভাবার অহংকার।
.
পূর্ববর্তী যুগের মানুষদের ঈসা(আঃ) কিংবা মুসা(আঃ) এর মুযিযাকে অস্বীকার করার একটা এক্সকিউজ ছিল। কারণ, তাদের মিরাকল তাদের দুনিয়া ত্যাগের পর পরবর্তী মানুষের কাছে স্রেফ একটা গল্পের মত ছিল। কিন্তু মুহম্মদ(সাঃ) এর মিরাকল সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি কিয়ামত পর্যন্ত এমন এক জীবন্ত নিদর্শন নিয়ে এসেছেন যা অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন যে কোন মানুষই বুঝতে পারবে।
.
যারা ১৪০০ বছর ধরে কুরআনের একটা চ্যালেঞ্জই মোকাবেলা করতে পারে না অথচ কুরআনকে অলীক রূপকথা বলতে চায়, তাদের জন্য আমরা কেবল করুণাই করতে পারি। 🙂
.
“আমি কোরআনে এমন বিষয় নাযিল করি যা রোগের সুচিকিৎসা এবং মুমিনের জন্য রহমত। জালিমদের তো এতে শুধু ক্ষতিই বৃদ্ধি পায়।” [১৭:৮২]
=============================
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন
Leave Your Comments