কুরআনের কিছু আয়াত কি আসলেই বকরীতে খেয়ে ফেলেছিল? – ১
.
সুনান ইবন মাজাহতে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত ব্যবহার করে খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক-মুক্তমনারা দাবি করতে চায় যেঃ কুরআনের কিছু আয়াত চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে কেননা সেগুলো যে পৃষ্ঠায় লেখা ছিল, সেটিকে একটি বকরী খেয়ে ফেলেছিল। কুরআনের সংরক্ষণকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ইসলামবিরোধীরা যেসব (অপ)যুক্তি দাঁড় করায়, তার মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত(অথবা কুখ্যাত) যুক্তি এটি। এই নোটে সেই রেওয়ায়েতটিকে বিশ্লেষণ করে সত্য উন্মোচন করা হবে ইন শা আল্লাহ।
.
ইবন মাজাহ এর রেওয়ায়েতটি হচ্ছেঃ
.
আয়িশা(রা) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, “রজমের ও বয়স্কদের দশ ঢোক দুধপানের আয়াত নাযিল হয়েছিল এবং সেগুলো একটি সহীফায় (লিখিত) আমার খাটের নিচে সংরক্ষিত ছিল। যখন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ইন্তিকাল করেন এবং আমরা তাঁর ইন্তিকালে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম, তখন একটি বকরী এসে তা খেয়ে ফেলে।” [সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং ১৯৪৪]
.
রেওয়ায়েতটির বিশুদ্ধতা কতটুকুঃ
.
কোন দাবি পেশ করতে হলে সবার আগে যাচাই করা জরুরী যে এর দলিল হিসাবে পেশকৃত রেওয়ায়েতের বিশুদ্ধতা কতটুকু।
.
মুহাদ্দিসদের মতে রেওয়ায়েতটিতে কিছু সমস্যা আছে।এই রেওয়ায়েতের একজন বর্ণণাকারী মুহাম্মাদ বিন ইসহাক এটি বর্ণণা করছেন عن(থেকে) শব্দ ব্যবহার করে যে কারণে বর্ণণাটি যঈফ(দুর্বল) হয়ে গেছে।কেননা তিনি একজন তাদলিসকারী। {{যেসব বর্ণণাকারী তাদের ঊর্ধ্বতর বর্ণণাকারীর পরিচয়ের ব্যাপারে ভুল তথ্য দেন তাদেরকে তাদলিসকারী বলা হয়। তাদলিসের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ http://www.islamic-awareness.org/Hadith/Ulum/asb4.html}} [মুফতি তাকি উসমানী, ‘তাকমালা ফাতহুল মুলহিম’ ১/৬৯, দারুল আহইয়া আত তুরাছুল ‘আরাবী, বৈরুত]
.
মুসনাদ আহমাদেও একই রেওয়ায়েত পাওয়া যায়। শায়খ শু’আইব আরনাউত(র) তাঁর মুসনাদ আহমাদের তাহকিকে একে যঈফ(দুর্বল) বলে মন্তব্য করেছেন। [দেখুনঃ মুসনাদ আহমাদ ৬/২৬৯, হাদিস নং ২৬৩৫৯]
.
এই সনদ কোন উপায়েই কুরআনের বিশুদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নাঃ
.
এই রেওয়ায়েতটি যদি সহীহও হত, তাহলেও এ দ্বারা প্রমাণ হত না যে কুরআন সংরক্ষিত নেই।
.
কারণঃ
.
১। এই রেওয়ায়েত অনুসারে দাবিকৃত ‘হারিয়ে যাওয়া’ আয়াত দু’টির ১টি আয়াত ছিল রজমের ব্যাপারে। {{বিবাহিত পুরুষ কিংবা মহিলা ব্যাভিচার করলে তাদেরকে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড প্রদানকে ‘রজম’ বলে।}}
.
কিন্তু অন্য একাধিক বর্ণণাতে আমরা দেখি যে, রজমের ব্যাপারে হুকুম নাজিল হয়েছিল কিন্তু নবী(ﷺ) সেটিকে কুরআনের অংশ হিসাবে লিপিবিদ্ধ করতে নিষেধ করেছিলেন।এ থেকে বোঝা যায় যে এটি কুরআনের অবিচ্ছেদ্য কোন অংশ ছিল না।
.
বর্ণণাগুলো নিম্নরূপ—
.
ক) কাসির বিন সালত থেকে বর্ণিতঃ যাঈদ(বিন সাবিত) বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) কে বলতে শুনেছি যে, “যখন কোন বিবাহিত পুরুষ অথবা মহিলা ব্যাভিচার করে, তাদের উভয়কে রজম কর।”
.
(এটি শুনে)আমর বলেন, “যখন এটি নাজিল হয়েছিল, আমি নবী(ﷺ) এর নিকট আসলাম এবং এটি লিপিবদ্ধ করব কিনা তা জানতে চাইলাম। তিনি{নবী(ﷺ)} তা অপছন্দ করলেন।” [মুসতাদরাক আল হাকিম, হাদিস ৮১৮৪; ইমাম হাকিম(র) একে সহীহ বলেছেন]
.
খ) এই আয়াতের ব্যাপারে কাসির বিন সালত বলেনঃ তিনি(কাসির), যাঈদ বিন সাবিত ও মারওয়ান বিন হাকাম আলোচনা করছিলেন কেন একে কুরআনের মুসহাফসমূহে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।উমার বিন খাত্তাব(রা) তাদের সঙ্গে ছিলেন এবং তাদের আলোচনা শুনছিলেন।তিনি বললেন যে তিনি এ ব্যাপারে তাদের থেকে ভালো জানেন।তিনি তাদের বললেন যে তিনি{উমার(রা)} রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর নিকট গিয়েছিলেন এবং জিজ্ঞেস করেছিলেন-
.
“হে আল্লাহর রাসুল, আমাকে রজমের আয়াতটি লিখে দেওয়া হোক।তিনি{রাসুলুল্লাহ(ﷺ)} বললেন, আমি তা করতে পারব না।”
[সুনানুল কুবরা বাইহাকী ৮/২১১ এবং সুনানুল কুবরা নাসাঈ হাদিস নং ৭১৪৮। আলবানী(র)এর মতে সহীহ]
.
যদি আলোচ্য আয়াত স্থায়ীভাবে কুরআনের অংশ হিসাবে নাজিল হত, তাহলে কেন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তা লিখিয়ে দিতে বললেন না? এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এটি ছিল সেই সমস্ত মানসুখ বা রহিত আয়াতের একটি যা কোন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অস্থায়ীভাবে নাজিল হয়েছিল। এটি রহিত হয়েছে, যা স্বয়ং আল্লাহর রাসুল(ﷺ) দ্বারা অনুমোদিত হয়েছে। কাজেই সাহাবীগণ বা উম্মুল মু’মিনীনগণ এই আয়াত ‘হারিয়ে ফেলেছেন’ তা নিতান্তই অসার কথা।
.
(ইন শা আল্লাহ আগামী পর্বে সমাপ্য)
==========================
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রাহমান মিনার
Leave Your Comments