কুরআনের কিছু আয়াত কি আসলেই বকরীতে খেয়ে ফেলেছিল? – ২

কুরআনের কিছু আয়াত কি আসলেই বকরীতে খেয়ে ফেলেছিল? – ২
.
দ্বিতীয় যে আয়াত “হারিয়ে গেছে” বলে দাবি করা হয়, সেটি বয়স্কদের দশ ঢোক দুধপান সংক্রান্ত।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটিও মানসুখ বা রহিত আয়াত।সহীহ মুসলিমে এ সংক্রান্ত একটি বর্ণণা নিম্নরূপঃ
.
আয়িশা(রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরআনে নাযিল হয়েছিল যে, দশবার দুধপানে বিবাহ হারাম হওয়া/মাহরাম হওয়া সাবিত হয়। তারপর তা পাঁচবার দুধপান দ্বারা রহিত হয়ে যায়।তারপর রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ইন্তিকাল করেন আর সেগুলো তো কুরআনের আয়াত হিসাবে তিলাওয়াত করা হত।”
[সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ২৬৩৪]
.
পাঁচবার দুধপানের বিধানটিও একটি মানসুখ বা রহিত বিধান।এ ব্যাপারে স্বয়ং উম্মুল মু’মিনিন(রা)গণ থেকে একটি বর্ণণা রয়েছে।
“ সাহলা বিনত সুহাইল(রা) ছিলেন আমির ইবনে লুয়াই গোত্রের,তিনি রাসুল(ﷺ) এর কাছে আসলেন এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, সালিমকে আমরা পুত্ররূপে গ্রহন করেছিলাম। সে আমার কক্ষে প্রবেশ করে এই অবস্থায় যখন আমি একটি কাপড় পরিধান করে থাকি(অর্থ্যাৎ মাথা খালি থাকে)। আর আমার ঘরও মাত্র একটি। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
তখন রাসুল(ﷺ) বললেন এ বিষয়ে আমাদের কথা হল তাকে পাঁচবার দুধপান করাও।
.
… … …
… নবী(ﷺ) এর অন্যান্য সহধর্মিণী এই প্রকার দুধপানের দ্বারা কোন পুরুষের তাদের নিকট প্রবেশ করাতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করতেন। তারা বলতেন(আয়শা(রা) কে উদ্দেশ্য করে) আল্লাহর কসম, আমরা মনে করি রাসুল (ﷺ) সাহলা বিনতে সুহেইল (রা) কে যে অনুমতি দিয়েছিলেন তা কেবলমাত্র সালিম (রা) এর জন্য রাসুল (ﷺ) এর পক্ষ থেকে রুখসত ছিল। কসম আল্লাহর, এইরূপ দুধপান করানোর দ্বারা কেউ আমাদের নিকট প্রবেশ করতে পারবেনা। নবী করীম(ﷺ) এর সকল সহধর্মিণী এই মতের উপর অটল ছিলেন। ” [সুনান আবু দাউদ, অনুচ্ছেদ ১০৪, হাদিস ২০৫৭]
.
এই বিবরণগুলো দ্বারা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে পাঁচবার ও দশবার দুধপানের বিধান রহিত হয়েছিল।
.
কুরআনের মানসুখ বা রহিত আয়াতগুলো সম্পর্কে ইসলাম বিরোধীদের জবাবঃ– goo.gl/VvUwbP
.
এছাড়া উল্লেখ্য যে – যতদিন ধরে কুরআন সংকলন হয়েছে, আয়িশা(রা) তাঁর পূর্ণ সময় জীবিত ছিলেন। আবু বকর(রা) কর্তৃক সংকলন ও উসমান(রা) কর্তৃক সংকলন উভয় সময়েই আয়িশা(রা)কে একজন গুরুত্বপূর্ণ মতামত প্রদানকারী ছিলেন। বিশেষত উসমান(রা) কর্তৃক কুরআন সংকলনের সময়ে আয়িশা(রা) এর নিকট থেকে সংকলনকর্ম যাচাই করা হত। [দেখুনঃ তারিখুল মাদিনাহ, ইবন শাব্বা; পৃষ্ঠা ৯৯৭]
.
যদি সত্যি সত্যিই কুরআনের আয়াত হারিয়ে যাবার মত এমন মহা দুর্ঘটনা ঘটতো (!!), তাহলে আয়িশা (রা) অবশ্যই সে ব্যাপারে সাহাবীগণের (রাঃ) দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। সে সময়ে প্রচুর পরিমাণে হাফিজ সাহাবী জীবিত ছিলেন যাঁরা স্বয়ং রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর কাছ থেকে কুরআন শিখেছেন। কিন্তু আয়িশা(রা) কখনোই এমন কিছু করেননি।
.
আর যদি এমনও হয়ে থাকে যে—কুরআনের কিছু আয়াত আসলেই আয়িশা(রা) এর খাটের নিচ থেকে বকরীতে খেয়ে ফেলেছিল এবং আয়িশা(রা) সে ব্যাপারে কোন সাহাবীরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেননি বরং চেপে গিয়েছেন, (নাউযুবিল্লাহ) [এমন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব কোন কোন খ্রিষ্টান মিশনারী প্রচার করে থাকেন] তাহলেও এর দ্বারা “কুরআনের কিছু আয়াত হারিয়ে গেছে” এই তত্ত্ব প্রমাণ করা সম্ভব না। কারণ—কুরআন মূলতই লিখিত বই নয় বরং অগণিত মানুষের মুখস্থ বই। অবতরণের পর থেকেই মুহাম্মাদ(ﷺ) ও সাহাবীগণ তা মুখস্থ করেছেন। মুহাম্মাদ(ﷺ) রমজান মাসের শুরু থেকে তাহাজ্জুদে, তারাবীহে ও তিলাওয়াতে অগণিতবার খতম করেছেন। সকল যুগেই একই অবস্থা। কুরআনের লিখিতরূপ শুধু সহায়ক মাত্র। কুরআন প্রথম অবতরণ থেকেই প্রতিটি মুমিনের প্রতিদিনের পাঠ্য বই। প্রতিদিন নিজের নামাযে, জামাতে নামাযে ও সাধারণভাবে প্রত্যেক মুমিন তা তিলাওয়াত করেন বা শোনেন।
.
বর্তমান সময়ের চেয়ে সাহাবীদের যুগে কুরআন মুখস্থ করার আগ্রহ অনেক বেশি ছিল। হাজার হাজার হাফিজ সাহাবী-তাবিয়ী মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে ছিলেন। সুতরাং ২-১টি আয়াত কেন, কুরআনের সকল আয়াতও যদি বকরীতে খেয়ে ফেলত, তাহলেও একটি আয়াতও “হারিয়ে যাওয়া” সম্ভব ছিল না। কেননা হাজার হাজার হাফিজ সাহাবী ও তাবিয়ী ঐ যুগে ছিলেন যাঁদের স্মৃতিতে পূর্ণ কুরআন সংরক্ষিত ছিল। সেই যুগ থেকে আজ পর্যন্ত একই অবস্থা। কাজেই বকরীতে খাওয়ার ফলে কিছু আয়াত চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে—তা নিতান্তই হাস্যকর অভিযোগ।
.
আজও যদি কুরআনের সকল লিখিত পাণ্ডুলিপি, পিডিএফ কপি, অনলাইন কুরআন, কুরআনের মোবাইল এ্যাপস—এ সকল কিছুও ধ্বংস করে ফেলা হয়, তাহলেও কুরআনের একটি অক্ষরও হারিয়ে যাবে না।কেননা কোটি কোটি কুরআনের হাফিজ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছেন।তাঁদের স্মৃতি থেকে আবারও সম্পূর্ণ কুরআন পুনরুদ্ধার করা যাবে।
.
আল্লাহ তা’আলা প্রিয় নবী (ﷺ)কে বলেনঃ
.
“আমি তোমার উপর কিতাব নাজিল করেছি যা পানি দ্বারা ধুয়ে যাওয়া সম্ভব নয়” [সহীহ মুসলিম হাদিস নং ৭২০৭]
.
পানি দ্বারা সেই জিনিস ধুয়ে যাওয়া সম্ভব যা কাগজের উপর কালি দ্বারা লেখা হয়। যা স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকে, তার পক্ষে ধুয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এবং আল্লাহ ভালো জানেন।
.
=============================
তথ্যসূত্র ও কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ
◉ http://icraa.org/
◉ http://www.letmeturnthetables.com/
◉ কিতাবুল মোকাদ্দস, ইঞ্জিল শরীফ ও ঈসায়ী ধর্ম – খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(র)
=============================
.
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রাহমান মিনার

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *