যুক্তির আঘাতে মুক্ত করি চেতনার জট

যুক্তির আঘাতে মুক্ত করি চেতনার জট
.
বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
.
মূল এজেন্ডা গোপন রেখে ধাপে ধাপে কাজ করাটা শাইত্বানের একটা কমন হাতিয়ার। যেমন আদাম ‘আলাইহিসসালাম-কে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ানোর জন্য সে বলে নি “যাও আল্লাহকে অমান্য কর।” সে বলেছে “এটা খেলে তুমি ফেরেশতা হয়ে যাবে, অমর হয়ে যাবে।” সূরাহ আ’রাফ(৭)এর ২০ আয়াত দ্রষ্টব্য। এছাড়া মূর্তিপূজার প্রচলন ঘটাতে শাইত্বান প্রথমে পূর্ববর্তী নেক ব্যক্তিদের সম্মানার্থে মূর্তি তৈরি করায়, কালক্রমে এসবের পূজা শুরু হয়। সূরাহ নূহ(৭১)এর ২৩ আয়াতে আছে এমনই কিছু ব্যক্তি তথা মূর্তির নাম- ওয়াদ্দ, ইয়াগুস, নাস্র।
.
নাস্তিকতা নামক ধর্মটি তার ভ্রূণাবস্থায় এমনই ছিল। ধর্মের কথাগুলোকেই অদ্ভুতভাবে ঘোরাতো তারা। রবার্ট ব্রাউনিং রচিত Fra Lippo Lippi শিরোনামের একটা কবিতায় দেখা যায় লিপো একজন চার্চ-সন্ন্যাসী যাকে জোর করে চার্চে আনা হয়েছে। ধর্মীয় পেইন্টিং আঁকা তার কাজ। একসময় সে বেশ্যালয়ে গমন করে, সাধু-সন্তু না এঁকে নারী আঁকতে শুরু করে। যুক্তি দেয় “নারীদেহ তো গডেরই সৃষ্টি। নারীদেহ এঁকে আমি গডের মহিমা খুঁজে পাই।” (উল্লেখ্য, এমনটা ধরে নেয়া ঠিক না যে কবির নিজস্ব মতও এটাই)
.
এভাবেই শুরু। তারপর এই ধারণা প্রচারিত হতে শুরু করে যে পরম সত্য বলে কিছু নেই, সবই interpretation (খেয়াল করবেন, নিজেকেই পরম সত্য বলে দাবি করাটা কিন্তু ধর্মের বৈশিষ্ট্য). ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোকে চ্যালেন্জ করার একটা ভিত্তি এভাবে দাঁড়ালো। কিছু বৈজ্ঞানিক অনুমান যখন নাস্তিকতার পক্ষে এলো, তখন থেকে আত্মবিশ্বাসের সহিত নাস্তিকতা একটি ধর্ম হিসেবে আবির্ভূত হলো।
.
অদ্ভুত ব্যাপার হলো, নাস্তিকতা একসময় ধরেই নিলো যে সে সত্য। অন্যান্য যে কোনো ধর্মের মত সে নিজেও যে প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়, তা বেমালুম চেপে গেল। নাস্তিকদের কথাবার্তা থেকেই তা স্পষ্ট হয়। ধরুন কেউ বললো “আমি ফেমিনিজম নিয়ে একটা লেকচার দিচ্ছিলাম, কিন্তু শ্রোতা তার ধর্মান্ধতার জন্য শুনতেই চাইলো না।” হতেও তো পারে বক্তার কথা ভুল, শ্রোতার ধর্মবিশ্বাসই ঠিক। কিন্তু বক্তা ধরেই নিয়েছে নাস্তিক হওয়ার কারণে সে-ই সঠিক (উল্লেখ্য, ফেমিনিজম মানেই নাস্তিকতা নয়। কেবল উদাহরণ দেয়া হয়েছে)।
.
মুসলিমরা যদি নিজেদের ‘শান্তিকামী’ পরিচয় দেয়, তাহলে সেটা ‘মুসলিমে’র প্রতিস্থাপক হবে না। কারণ এতে পক্ষপাতিত্ব হয়। মুসলিমরা শান্তিকামী হলে অমুসলিমরা কি অশান্তিকামী? অথচ নাস্তিকরা দিব্যি নিজেদেরকে ‘প্রগতিশীল’, ‘মুক্তমনা’ বলে বেড়ায়। ধর্মগুরুদের নিয়ে চটি লিখে অনলাইন ভরিয়ে ফেলা নাস্তিকেরাও নাকি প্রগতিশীল, এমনকি মিডিয়াতেও এসব শব্দই ব্যবহৃত হয়! এসব শব্দ বলতে হয় কারণ ‘নাস্তিক’ কথাটাই গালির মত শোনায়। ‘প্রতিবন্ধী’ বা disableকে যেভাবে শুদ্ধ করে বলা হয় ‘specially able’, নাস্তিকদের প্রগতিশীলতাও এমনই।
.
নাস্তিকতার যেহেতু লিখিত বিধিবিধান নেই, এটা একেক জায়গায় একেকটা ঢাল ব্যবহার করে। যেমন বিজ্ঞান। এদের ধারণা বিজ্ঞান এদের নিজস্ব সম্পত্তি। মরিস বুকাইলির লেখা “বাইবেল কোরআন ও বিজ্ঞান” বইটা পড়ে তসলিমা নাসরিন দাঁত কিড়মিড়িয়ে লিখেছিলো “মোল্লারাও আজকাল বিজ্ঞান চর্চা করে।” এত শত কোটি নাস্তিকের মাঝে কয়জন আর বিজ্ঞানী? অনেকেই আর্টস কমার্স পড়ে। বিজ্ঞানের ব্যাপারে এদের জ্ঞান খুব সরলীকৃত। বৈজ্ঞানিক সত্য আর তত্ত্বের পার্থক্য অনেকেই করতে পারে না। কিছু শুনলেই বলে “বিজ্ঞান বলে…।” আচ্ছা বিজ্ঞান তো কোনো ব্যক্তি না। বিজ্ঞান বলে মানে বিজ্ঞানীরা বলেন। বিবর্তনবাদের জটিল আলাপে গেলাম না। একজন মুসলিম বলবে “শাইত্বানের প্ররোচনাই হাই ওঠে।” নাস্তিক বলবে, “কিন্তু বিজ্ঞান তো বলে অক্সিজেনের অভাবে হাই ওঠে।” উইকিপিডিয়ায় গিয়ে দেখেন এই তত্ত্ব বহু আগেই ভুল প্রমাণিত। হাই ওঠার আসল কারণ কী, একজনের দেখাদেখি আরেকজনের হাই ওঠে কেন এ সব আজও এক রহস্য।
.
এবার আসুন নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে। এটা নাস্তিকদের জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর ফীল্ডগুলোর একটি। এখানে তারা দেখে কোনটা মানলে ধর্মীয় বিধানের বিপরীতটা করা যায়। তাই তারা ইসলামের প্রাণের বদলে প্রাণ নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ইশ্যুতে এসে লেগেছে প্যাঁচ। অনেকে বলেছিল এই একটা মৃত্যুদন্ডই তারা চায়, তারপর আর না। তসলিমা নাসরিন বলেছিল সে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চায় না। বাঙালিরা তখন আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে তাকে ধুয়েছে। আরজ আলি আর হুমায়ুন আজাদরা মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। কখনো ভেবে দেখেছেন সব নাস্তিক কেন ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি’? কারণ পাকিস্তান ইসলামকে ঢাল বানিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করলে তাই ধর্মকে পঁচানোর একটা সুযোগ পাওয়া যায়। নরওয়ে বা জার্মানি আর বাংলাদেশ মিলে যদি এক দেশ হতো, তারপর ভাষার প্রশ্নে বাংলাদেশ যদি আলাদা হতো, তখন রাজাকারদের দাড়ি টুপি না-ও থাকতে পারতো। দেশ-কাল-পাত্র নির্বিশেষে নৈতিকতার কথাও ধরুন। সমকামিতা তাদের কাছে ব্যক্তিস্বাধীনতা কেন? কারণ ধর্ম এটা নিষিদ্ধ করেছে। অপেক্ষা করুন। অজাচার, মৃতকামিতা, পশুকামিতাও শীঘ্রই ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়ে যাবে।
.
নাস্তিকদের অন্ধবিশ্বাসের আরেকটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। ধার্মিকদেরকে তারা বলে জন্মগত ধার্মিক, বাবা মা আস্তিক বলে সন্তানও আস্তিক। আর তারা বুদ্ধি বিবেচনা করে নাস্তিক। বাবা মা থেকে আলাদা হওয়াটাই যদি বুদ্ধি বিবেচনার লক্ষণ হয় তাহলে তো হুমায়ুন আজাদের ছেলেও অন্ধবিশ্বাসী, বাপের দেখাদেখি নাস্তিক। বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়েই কি কেউ বাপ মায়ের ধর্ম বেছে নিতে পারে না?
.
‘প্রগতিশীলতা’র তাসের ঘর ফুঁ দিলেই পড়ে যায়। চটকদার শব্দশৈলীতে ঘাবড়ে না গিয়ে ফুঁ-টা দিতে হয়। শাইত্বানের চক্রান্ত অতিশয় দুর্বল।
====================================
লেখকঃ নিলয় আরমান

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *