ডকিন্স নামা [পর্ব ১ ও ২]
===================
.
মা বাপের ভবঘুরে সন্তান, মেডিক্যালে পড়তে গিয়ে ফেইল মারা ডারউইনের রূপকথা যখন মানুষ আস্তে আস্তে ধরতে পারছে ঠিক তখনি বনে বাদাড়ে ‘মলিকুলার বায়োলজি’র গবেষণা করা ডারউইনকে বাঁচাতে কলা-বিজ্ঞানীরা আরেক ‘নামধারী’ ‘সো কল্ড বিজ্ঞানী’ রিচার্ড ডকিন্সকে সামনে নিয়ে এসেছে। রিচার্ড ডকিন্স বলতে অজ্ঞান মানুষের সংখ্যা এই পৃথিবীতে নেহায়েত কম নয়।বানররা যাদের বাপ্ দাদা তাদের কাছে ডকিন্স ‘গড’। ডকিন্সের বাণীকে তারা ঐশ্বরিক বার্তার থেকে কোনো অংশে কম বিশ্বাস করে না বরং ধার্মিকরা অনেক সময় ধর্মের বিধি বিধান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও বানরের বংশধরেরা ডকিন্সের কথাকে অমোঘ বাণী হিসাবে মেনে নেয়। তাদের ভাষ্য মতে ডকিন্স এই পৃথিবীর মহাবিজ্ঞানীদের একজন!!! আমরা এবার দেখবো, ডকিন্স আসলেই কি বিশাল কোনো বিজ্ঞানী?
.
শিক্ষা জীবনের শুরুর দিকে বিজ্ঞান নিয়ে তার কারবার ছিল, পিএইচডি করেছেন প্রাণীবিদ্যার উপরে, আমেরিকাতে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন, পরে অক্সফোর্ডে ফিরে এসে কিছু দিন প্রাণীবিদ্যার প্রভাষক হিসাবে কাজ করেছেন, ব্যাস এর পরেই তার বিজ্ঞান চর্চার পথ অন্যদিকে মোড় নেয়। প্রথম জীবনে বিজ্ঞান করা লোক হটাৎ বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে অবৈজ্ঞানিক পথ ধরেন। ডকিন্স প্রথম থেকেই এটেনশন সিকার, আলোচনায় থাকতে সে পছন্দ করতো। বিজ্ঞান বাদ দিয়ে রাজনীতি ও অন্যান্য সামাজিক বিষয়ে তার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। বর্তমানে সে বিজ্ঞান গবেষণার পেশা ছেড়ে দিয়ে পাবলিকরে কিভাবে সাইন্স বোঝানো যায় সেই কাজ করে যাচ্ছে!!! গবেষণা কেন্দ্রিক পেশা ছাড়ার কারণ কি? এবার আসুন তার টিচিং এন্ড রিসার্চ ক্যারিয়ার নিয়ে আলোচনা করা যাক। উনি অক্সফোর্ডে ১৯৭০ সালে প্রাণীবিদ্যা বিভাগে লেকচারার হিসাবে যোগ দেন, ২০ বছর পরে, ১৯৯০ সালে ‘রিডার’ (অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর) হিসাবে পদোন্নতি পান। বলে রাখা ভালো, আনলাইক বাংলাদেশ পৃথিবীর বাকি দেশগুলোতে ইউনিভার্সিটি শিক্ষকদের পদোন্নতি অটোমেটিক্যালি হয়ে যায়না, পারফর্মেন্সের উপর সব নির্ভর করে।
.
ডকিন্স সাবের পারফর্মেন্স এতটাই ভালো ছিল যে লেকচারার থেকে রিডার হতে ২০ বছর সময় লেগে গেলো!!! একটা উদাহরণ দিলেই বুঝবেন কেন এইটা নিয়ে হাসি তামাশা করতেছি। ক্যামব্রিজে আমার ডিপার্টমেন্টের এক গবেষক ২০১০ সালের দিকে লেকচারার হিসাবে যোগ দেন ৫ বছর পরে, ২০১৫ সালে রিডার হয়ে যান। পারফর্মেন্স ভালো হলে অতি দ্রুত প্রমোশন হয়ে যায়। এবার দেখি বিজ্ঞানের শিক্ষক ও গবেষক হিসাবে যে সময় তিনি কর্মরত ছিলেন তখনকার সময়ে সে গবেষণায় কেমন সাফল্য লাভ করেছেন। বায়োলজি ও মেডিকেল সাইন্সের গবেষণার তথ্য পাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেটওয়ার্ক ও সার্চ ইঞ্জিন হলো ‘পাবমেড’, আমেরিকার স্বাস্থ্য সংস্থার ডাটা বেইজ। আপনি যদি মাঝারি মানেরও গবেষক হোন, পাবমেডে আপনার নামে ৩০-৫০টা গবেষণা পত্র খুঁজে পাওয়া উচিত। ডকিন্সের নাম সার্চ দিলে সংখ্যাটা লেস দ্যান টেন!!! যা আছে তাও গাল গপ্পে ভরপুর, কোনো এক্সপেরিমেন্টাল ওয়ার্ক নয়। গবেষকদের মানদণ্ড হলো গবেষণা ও গবেষণা পত্রের মান ও সংখ্যা। এই হিসাব করলে ডকিন্স বর্তমান পৃথিবীর সেরা ৫০০০০ গবেষকদের মধ্যেও পড়বে কিনা আমার সন্দেহ। ধূর্ত প্রাণী রিচার্ড ডকিন্স বুঝতে পেরেছিলো বিজ্ঞান গবেষণা করে সারা জীবন পার করলেও কেউ তাকে চিনবে না, তাই ঐখানে ব্যর্থ হয়ে সাধারণ সহজ সরল মানুষ ও অ-সহজ সরল কলা-বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানের নাম দিয়ে মগজ ধোলাইয়ের পদ্ধতি অবলম্বন করে নেইম, ফেইম, মানি সব একসাথে কামাইতেছে, আর আবালগুলা হুদাই তারে মহা বিজ্ঞানী মনে করে পূজা করতেছে।
.
এর আগে সংক্ষেপে জেনেছি একাডেমিক এন্ড রিসার্চ এসেসমেন্ট অনুযায়ী রিচার্ড ডকিন্স মেইনস্ট্রিম বায়োলজিক্যাল সায়েন্টিস্টের মধ্যে পড়ে না। বিজ্ঞান গবেষণা বাদ দিয়ে তিনি বিজ্ঞানকে সাধারণের মাঝে পৌছিয়ে দেয়ার যোগসূত্রের কাজ করছেন। যদিও এটাও বিজ্ঞান চর্চারই একটা অংশ, এই কাজটি করতে গিয়েও তিনি ভুল ব্যাখ্যা ও মনগড়া তথ্য দিয়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করে চলেছেন দিনের পর দিন। গবেষকদের প্রকাশনা স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষদের আন্ডারস্টেন্ডিংয়ের বাইরে, তাই ডকিন্সের মতো যারা গবেষণার ফলাফল ইন্টারপ্রেট করে জনসাধারণের মাঝে পৌঁছান তাদের ইমপ্যাক্ট সমাজে অনেক। সাধারণ মানুষ সত্যিকারের বিজ্ঞানীদের থেকে বিজ্ঞানের ইন্টারপ্রেটরদের বেশি বিশ্বাস করে, অনেকটা দোভাষীদের মতো। দোভাষী যদি কোনো ভুল অনুবাদ করে তার দায় যেমন মূলবক্তা নেয় না তেমনি ডকিন্সের বিজ্ঞানের ভুল ব্যাখ্যার দায়ও বিজ্ঞানীদের দেয়া অবিচারমূলক।
.
ডকিন্সের এই মাত্রাতিরিক্ত ভুল ব্যাখ্যার জের ধরে সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের মতামত সন্বলিত একটা গবেষণাপত্র যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত রাইস ইউনিভার্সিটি থেকে “Responding to Richard: Celebrity and (Mis)representation of Science” শিরোনামে ‘পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অফ সাইন্স’ নামে একটি পিয়ার রিভিউড জার্নালে ছাপা হয়েছে। জরিপটিতে বিশ্বের ৮ টি দেশের মোট ২০০০০ বিজ্ঞানীর মতামত নেয়া হয়েছে এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের ১৫৮১ জন বিজ্ঞানীও আছেন। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীদের মধ্যে ১৩৭ জন ডকিন্সের ব্যাপারে বিশদভাবে কথা বলেন। এদের ৮০ ভাগ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন ডকিন্স তার বইয়ে ও জনসম্মুখে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কর্মের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। এসব বিজ্ঞানীদের মধ্যে অধিকাংশই নন-রিলিজিয়াস তাই এখানে রিলিজিয়াস বায়াসনেস থাকার কোনো সুযোগ নাই। প্রবন্ধটির মূল ইনভেস্টিগেটর যেটা বলতে চেয়েছেন তা হলো, ডকিন্স বিজ্ঞানের তত্ত্বের সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভুল ব্যাখ্যা করেন, মানে হলো নিজের মনগড়া কথাকে বিজ্ঞান বলে চালিয়ে দেন। একজন নন-রিলিজিয়াস ফিজিসিস্ট বলেছেন, ডকিন্স খুব শক্তভাবে ধর্মকে বাতিল করে দেন, অথচ একজন বিজ্ঞানী অনেক খোলামেলা, ধর্ম বা অন্য কোনো কিছুকে ডিনাই করতে হলে সেটা বিজ্ঞানের স্কোপের মধ্যে রেখেই করতে হয়। বিজ্ঞানের স্কোপের মধ্যে না থাকলে সেটা নিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকে। হার্ভার্ড প্রফেসর এও উইলসন, ডকিন্সকে বিজ্ঞানীই মনে করেন না, তার ভাষায় ডকিন্স একজন সাম্বাদিক, যে নিজে কোনো বিজ্ঞান গবেষণা করে না, অন্যের গবেষণার ফল প্রচার করাই তার কাজ!!!
.
প্রবন্ধটির শেষে গবেষকরা ডকিন্সকে একটা উপদেশ দিয়েছেন, তা হলো, সবচেয়ে ভালো বৈজ্ঞানিক যোগাযোগ হচ্ছে কাউকে অপমান না করা ও দাম্ভিকতা প্রকাশ না করা। এইগুলা না করলে সাধারণ মানুষদের মাঝে বিজ্ঞানের প্রতি কৌতূহল জন্মাবে, মনের প্রশস্ততা ও গুণগ্রহীতা বাড়বে। তাই এসব অবৈজ্ঞানিক কাজ ভেবে চিন্তে করাই বাঞ্চনীয়।
.
সায়েন্টিফিক কমিউনিটি ডকিন্সের দীর্ঘদিন ধরে কৃত হটকারী আচরণে বিরক্ত হয়েই এই প্রবন্ধটি প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। বিজ্ঞানীদের কষ্টের গবেষনা নিজের মতো ব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষদের মনে বিজ্ঞানের প্রতি বিতশ্রদ্ধা সৃষ্টি করা প্রকারান্তে বিজ্ঞান চর্চার পথে মহাপ্রতিবন্ধকতা তৈরি করার শামিল। ধর্মীয় কোনো কারণে নয়, শুধুমাত্র সঠিক বিজ্ঞান চর্চার জন্যই ডকিন্সের উল্টাপাল্টা লেখনী ও বক্তব্য প্রদান বন্ধ হওয়া উচিত।
.
লেখকঃ সাইফুর রহমান [ফেসবুক id: Saifur Rahma
Leave Your Comments