الحمد لله ربنا ورب الحق والصلوة علي رسوله الذي خلق له الحق وعلي آله واصحابه ا لذي هم خير الحق.
মানুষকে ভালো কাজের আদেশ দেয়ার নাম ‘আমর বিল মা‘রূফ’। আর মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করার নাম ‘নাহী আনিল মুনকার’। উভয়টি দীনি দায়িত্ব। এ দীনের কথাগুলো অপরের নিকট পৌঁছানোর নামই হচ্ছে দাওয়াত ও তাবলীগ।
এ দাওয়াত-তাবলীগ অবস্থাভেদে কখনো ফরযে আইন, কখনো ফরযে কিফায়াহ। দাওয়াত-তাবলীগ দুই প্রকার।
ক. ইজতিমাঈ অর্থাৎ সম্মিলিতভাবে অপরের নিকট পৌঁছানো। যেমন কোনো ব্যক্তি লোক সমাবেশে বয়ানের মাধ্যমে দীনের কথা পৌঁচাচ্ছেন। এপ্রকার তাবলীগ ফরযে কিফায়া। যা কিছু লোক করলে অবশিষ্টরাও দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়। আর কেউ পালন না করলে সকলেই গুনাহগার হয়।
খ. ইনফিরাদী তাবলীগ। তা হচ্ছে, কাউকে মন্দ কাজে লিপ্ত দেখে তাকে ওই কাজ থেকে ফিরিয়ে আনা বা বাধা প্রদানে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করা। যা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরযে আইন। এ দায়িত্ব আদায় না করা নামায রোজা ছেড়ে দেয়ার মতো কবীরা গুনাহ। আর পালন করা-নামায আদায় করার মতো ফরয।
ইজতিমাঈ তাবলীগ যেকোনো লোকের করা সমুচিন নয়; এর জন্য ঐ পরিমাণ ইলম থাকা আবশ্যক যে পরিমাণ ইলম থাকলে কমপক্ষে ভুলের আশংকামুক্ত থাকা যায়।
হ্যাঁ, বড় কোনো আলেম বা মুরুব্বি তাকে যা শিখিয়ে দিবেন, অথবা বিজ্ঞ কোনো আলেমের তত্ত্বাবধানে থেকে বয়ান করতে পারবেন। কারণ তখন এ ব্যক্তি বিজ্ঞ আলেমের নিকট সবক শুনে সেই সবক পুনরায় শুনানোর মতোই বলে গণ্য হবে।
উপরোক্ত নীতিমালার পরিপূর্ণ অনুসরণ করেছেন তাবলীগ-জামাতের কেন্দ্রীয় মুরুব্বীগণ। তারা কুরআন সুন্নাহ অনুযায়ী ছয়টি উসূলের উপর ভিত্তি করে সকল বে-ইল্ম ভাইদেরকে মুখে মুখে সবকের মতো তা শিখিয়ে দিয়েছেন। তারা তা শিখে মানুষের সামনে বয়ান ও ওয়াজের মতো করে শুনিয়ে দিয়েছে। এদের শেখানো সবক শুনিয়ে দেওয়ার মধ্যে সাধারণত কোনো ভুল ভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয় না। আর যখন কোনো গায়রে আলেম নিজের পক্ষ থেকে বয়ানের মধ্যে উসূলের বাহিরে কথা পেশ করা আরম্ভ করেন, তখনই তার বক্তব্যে আপত্তি ওঠে।
রাসূল স. বলেন, “যে ব্যক্তি না জেনে কুরআনের তাফসীর সম্পর্কীয় কোনো কিছু বললো, সে যেন জাহান্নামকে নিজের ঠিকানা বানিয়ে নিল”।
রাসূল স. আরো বলেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাবের মাঝে নিজের অভিমত সংযোজন করলো, তা সঠিক হলেও ভুল”।
হাদিস দু’টি যদিও কুরআনের ব্যাখ্যা সম্পর্কে এসেছে, এ ক্ষেত্রে ইজতিমাঈ দাওয়াতে অপরকে যে দীনের কথা পৌঁছানো হয়, সেগুলোও কুরআনের বাহিরের কথা নয়। সব দীনী কথাই কুরআন-হাদীসের ব্যাখ্যার অন্তর্ভুক্ত।
এসব কথা তাবলীগের মুরুব্বীদের মোটেই অজানা নয়। তাই তারা সবক তৈরী করে তাবলীগের ভাইদের জন্য সিলেবাস বানিয়ে দিয়েছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা এ উসূলের উপর থাকবেন ও আছেন, ততোদিন তারা হকের উপরেই থাকবেন। এ উসূল থেকে সরে গেলেই বিপদের কারণ হবে।
আমি দেশ-বিদেশে যতো আলোচনা ও সমালোচনা শুনতে পেয়েছি, আমার কাছে মনে হয়েছে মাঝে মধ্যে কোথাও না কোথাও কিছু লোককে এ উসূলের বহির্ভূত দেখা গেছে। যাদের ভুল পদক্ষেপের কারণে বিভিন্ন ধরণের প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
অজ্ঞতা বা শত্র“তা যাই হোক, কিছু লোক এ পবিত্র জামাতটিকে মানুষের সামনে বদনাম করার চেষ্টায় লিপ্ত। তাদের জন্য হেদায়াতের দোয়া করছি। আর যেসব লোক বিভ্রান্তের শিকার, তাদের সংশয় সন্দেহ দূরিকরণই হচ্ছে, এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধটির মূল লক্ষ্য।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে হক পথে পরিচালিত করুন,আমীন।
দীনী দাওয়াতের রূপরেখা
মহান আল্লাহ মানবজাতীর হেদায়েতের জন্য রাসূল স. কে কিছু দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন।
পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে-
لَقَدْ مَنَّ اللَّهُ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ إِذْ بَعَثَ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْ أَنْفُسِهِمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلَالٍ مُبِينٍ (آل عمران ১৬৪)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের উপর অনুগ্রহ করেছেন। কেননা তিনি তাদের মধ্য হতেই একজনকে তাদের রাসুলরূপে প্রেরণ করেছেন; যিনি তাদেরকে আল্লাহর কথা পড়ে শোনান, তাদের পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন’। (সুরা আল ইমরান:১৬৪)
এক কথায় তিনি ছিলেন মুবাল্লিগ, মুআল্লিম, বিচারপতি, রাষ্ট্রনায়ক ও সমাজ সংস্কারক।
রাসূল স.-এর পর এসব দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া উলামায়ে উম্মতের কর্তব্য। যুগে যুগে এ দায়িত্বগুলো আঞ্জাম দিতে গিয়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংঘ ও জামায়াত আত্মপ্রকাশ করেছে। তাবলীগ জামাত, মাদরাসা, খানকাহ এ গুলোর অন্যতম। এ তিনটির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নিম্নে তুলে ধরা হলো।
তাবলীগ জামাত
তাবলীগ জামাত নতুন কোনো দল বা সংগঠনের নাম নয়; রাসূল স. এর পর সাহাবায়ে কেরাম রা. থেকে নিয়ে প্রত্যেক যুগেই অত্যন্ত সফলতার সাথে সম্মিলিত ও একাকীভাবে দাওয়াতের এ দায়িত্ব পালন হয়ে আসছিল। হযরত ইলিয়াছ র. সে কাজটিকেই আরো ব্যাপক আকারে সহজতর ও সংগঠিতরূপে আঞ্জাম দেয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র। আর তাঁর এ প্রচেষ্টা যে আশাতিত সাফল্য অর্জন করেছে তা স্পষ্ট।
মাদ্রাসা
শরীয়তের বিধিবিধান যথাযথ শিক্ষা দেয়া বা পৌঁছে দেয়ার অন্যতম নববী দায়িত্ব যারা পালন করে থাকেন তারা হলেন আহলে ইলম, এ দায়িত্ব পালন সামনে রেখে শিক্ষক-ছাত্র সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানগুলোই হল মাদ্রাসা। ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম মাদ্রাসা হল মসজিদে নববীর সুফ্ফা চত্বর। যার ছাত্রদেরকে আসহাবে সুফ্ফা নামে স্বরণ করা হয়। আর এ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন স্বয়ং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
খানকাহ
উম্মতের বাতেনী রোগ দূর করার প্রচেষ্টায় যারা মেহনত করেন তারা হলেন, হক্কানি পীর-মাশায়েখ। এ পীর-মাশায়েখগণ যেখানে তাদের এ নববী দায়িত্ব পালন করেন, সেই কেন্দ্রকে খানকাহ বলা হয়। শরীয়তের দৃষ্টিতে হক্কানি পীর-মাশায়েখদের গুরুত্ব অপরিসীম।
দীন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাবলীগ, মাদ্রাসা, খানকাহ কোনটির গুরুত্বই কম নয়। দাওয়াত ও তাবলীগ ছাড়া মাদ্রাসা ও খানকাহগুলো দুর্বল হয়ে পড়বে। কারণ মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র আসে তাবলীগ জামাতের মেহনতের বদৌলতে। এমনিভাবে মাদ্রাসাগুলোর অবর্তমানে দীনের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব নয়। কারণ সহীহ ইলম ব্যতীত দীনের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব নয়।
এই বাস্তবতা উপলপদ্ধি করেই তাবলীগের মুরুব্বীরা তাদের সন্তানদেরকে মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন। মাদ্রাসার আলেমগণও এ দাওয়াতের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন। হক্কানি পীর-মাশায়েখগণ ও এ দাওয়াতি আন্দোলনে বলিষ্ঠ সমর্থন যোগাচ্ছেন।
তাবলীগ জামাতের পটভূমি
তাবলীগ জামাতের মূলকেন্দ্র দিল্লির নেযামুদ্দীন এর নিকটবর্তী বড় একটি শহরের নাম মেওয়াত। তৎকালে এ শহরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বসবাস ছিল। পরিচয়ে এরা মুসলমান হলেও ইসলামের কোন আলামতই এদের মধ্যে ছিল না। চুরি, ডাকাতি, হত্যা, ধর্ষণ, মদ , জুয়া ও যাবতীয় অন্যায়ের অভয়ারণ্য ছিল এ শহর। মুসলিম, হিন্দু, বোদ্ধ খ্রিষ্টান-কোন ধর্মের মানুষের মাঝে পার্থক্যের উপায় ছিল না। এক কথায় ১৫শ বছর আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের নবরূপ ছিলো। শহরের এ অবস্থা হযরত ইলিয়াস র.-এর মনে চরমভাবে রেখাপাত করে। এর প্রেক্ষিতেই ১৯১২ সালে তিনি তাঁর শাইখ হযরত খলীল আহমাদ সাহারানপুরী র.-এর পরামর্শে দাওয়াতি মেহনত শুরু করেন। আর এখান থেকেই তাবলীগ জামাতের সূচনা।
সর্বপ্রথম তিনি তাদের বুনিয়াদি কিছু বিষয় শিক্ষা দেন, যার নামকরণ করা হয় ‘ছয় উসূল’। যার মাধ্যমে তারা ইসলামী আমলী জীবন গঠনে সক্ষম হয়ে উঠে।
তাবলীগের ছয় উসূল
১. সঠিকভাবে বুঝে কালিমা পড়া।
২. সঠিকভাবে নামায পড়া।
৩. শরীয়তের ইলম শিক্ষা করা।
৪. আল্লহর যিকির করা।
৫. প্রত্যেক মুসলমানের সম্মানের প্রতি লক্ষ্য রাখা।
৬. প্রত্যেক কাজ একমাত্র আল্লাহর জন্যই করা।
এরপর তিনি তাদের অহেতুক কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। দীন শেখা ও শেখানোর জন্য ঘর থেকে বের হওয়ার প্রতি উদ্ভুদ্ধ করেন। শুরুর দিকে অনেক বাধা বিপত্তি আসলেও এক সময় আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য আসে। মানুষের মনে এর উপকারিতার পরিষ্কার রূপ ফুটে ওঠে। তাদের এ বিষয়গুলোর উপলব্ধি হল যে, সমস্ত সৃষ্টির স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। বাহ্যিক এসব ইহজাগতিক উপকরণের কোনো শক্তি নেই। সমস্ত কিছু একমাত্র তাঁর ইশারাতেই ঘটে। আমাদের একদিন তাঁর কাছেই ফিরে যেতে হবে। কারো দ্বারা কিছু হয় না। যা কিছু হয় এক আল্লাহর হুকুমেই হয়। চাইতে হবে একমাত্র আল্লাহর কাছে, ইবাদত হবে এক আল্লাহর জন্যই। এভাবে দীনের এক জযবা তাদের অন্তরে সৃষ্টি হলো এবং তারা দলে দলে ঘর থেকে বের হয়ে দীন শেখা ও প্রচারের লক্ষে আল্লাহর রাস্তায় সফর শুরু করলো। প্রত্যেকে আপন ব্যস্ততা সেরে নিজ খরচে ছোট ছোট দলে বেরিয়ে পড়লো। দলের একজন আমীর হিসাবে দায়িত্ব পালন করলো। তিনি তাদের কালেমা, কুরআন শরিফের কিছু সুরা, নামাজ পড়ার পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। এভাবে তারা শিখতে লাগলো এবং যেখানেই তারা গেল সেখানে অন্যান্য মানুষের কাছে গিয়ে বিনয়ের সাথে তাদের শিখাতে লাগলো এবং নিজেদের দীনী-জযবা তাদের মাঝেও ছড়াতে লাগলো। সফরের এ দিনগুলোতে তারা নিয়মিত জামাতের সাথে নামায আদায়, সার্বক্ষণিক আল্লাহকে স্মরণ, মানুষের সাথে সৎ ব্যবহার, মদ-জুয়া থেকে বিরত থাকাসহ ভালো কাজগুলো করা ও খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করতো। ফলে সমাজে পরিবর্তন আসা শুরু করলো। মানুষ তাদের সঙ্গীদের এ আমূল পরিবর্তন দেখে নিজেরাও অনুপ্রাণিত হল। এভাবে ক্রমান্বয়ে এ কাজের সাফল্য ছড়াতে শুরু করলো। এক দু’জন থেকে শুরু করে বিশাল জামাত বের হতে লাগলো। একদিন দু’দিন থেকে শুরু করে একমাস, ৪০দিন, এক বছর সময় নিয়ে মানুষ সফর শুরু করলো। দিল্লির মেওয়াত থেকে ছড়িয়ে সারা ভারত উপমহাদেশে, আরব বিশ্ব ,আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকা সহ সারা বিশ্বে একাজের প্রসার লাভ করলো। ধনী, গরিব, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, কৃষক, শ্রমিক মোটকথা সর্বস্তরের অগণিত মানুষ একাজে অংশগ্রহণ করতে লাগলো। দীনের এ জামাতকে আল্লাহ কবুল করে নিলেন। এ জামাতের নাম হয়ে গেল “তাবলীগ জামাত”(ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ৫/৭৩)
তাবলীগ-এর মূল তত্ত্ব
তাবলীগের অর্থ
আভিধানিকভাবে তাবলীগ অর্থ পৌঁছানো। প্রচলিত তাবলীগকে তাবলীগ বলার কারণ হলো, তারাও রাসূল স.-এর রেখে যাওয়া দীনকে সহজ উপায়ে মানুষের নিকট পৌঁছে দেন। এ কাজের সাথে সংশ্লিষ্টদের বলা হয় ‘তাবলীগী জামাত’।
শাইখ যাকারিয়া র. বলেন, আমি হযরত মাওলানা ইলিয়াছ র.-এর একজন পুরোনো বন্ধুর সূত্রে হযরতের এ মন্তব্য শুনেছি যে, এ কাজের নাম “তাবলীগ” কিংবা ‘তাবলীগ জামাত’ আমি রাখিনি। এ বিষয়ে কখনো চিন্তাও করিনি। নিজে নিজেই এ নাম প্রচলিত হয়ে গেছে, এবং এমন প্রসিদ্ধি লাভ করেছে যে, অনেক সময় আমি নিজেও এ নাম নিয়ে থাকি। (তাবলীগী জামাত পর এ‘তেরাজাতকে জাওয়াবাত)
তাবলিগ জামাতের পরিচয়
বর্তমান প্রচলিত তাবলীগের পরিচয় দিতে গিয়ে মাওলানা মনজুর নো‘মানী রহ: বলেন, ‘তাবলীগ’ অর্থ একটি বিশেষ কর্মধারা। অর্থাৎ “দ্বীন ও দাওয়াতের বিশেষ পরিবেশে বিশেষ কতগুলো উসূলের মাধ্যমে, বিশেষ কিছু আমলের পাবন্দির সাথে, বিশেষ প্রোগ্রাম মোতাবেক জীবন পরিচালনা করা”। যাতে ঈমানী অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়, দীনের সাথে সম্পর্ক এবং ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি পায়, আমল আখলাকের কিছুটা সংস্কার সাধিত হয় এবং দীনের জন্য জান ও মাল কুরবান করার অভ্যাস হয়। (তাবলীগী জামাত পর এ‘তেরাজাত কে জাওয়াবাত)
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
শাইখ যাকারিয়া র. তাবলীগ জামাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেন, মানুষের জীবন থেকে বুনিয়াদি অনিষ্ট দুরীকরণের চেষ্টা করা এবং তাদের জীবনকে কল্পনাপ্রসুত পথের পরিবর্তে আল্লাহ কর্তৃক প্রতিশ্র“ত সুনিশ্চিত পথের উপর নিয়ে আসার চেষ্টা করা। (তাবলীগী জামাত পর এ‘তেরাজাত কে জাওয়াবাত)
আর এটাই ছিল আম্বিয়া কেরামের পদ্বতি। তাঁরা তাঁদের উম্মতকে এ দাওয়াতই দিয়েছিলেন যে, আল্লাহর ওয়াদার উপর পূর্ণ বিশ্বাস এবং ভরসা করে দীনের যাবতীয় শর্ত পূরণের চেষ্টা করো। আল্লাহর প্রতিশ্র“তি সম্পর্কে তোমাদের যেমন বিশ্বাস হবে তোমাদের সাথে আল্লাহর ব্যবহারও তেমন হবে।
হাদীসে কুদসীতে ইরশাদ হয়েছে,
حدثنا أبو كريب محمد بن العلاء حدثنا وكيع عن جعفر بن برقان عن يزيد بن الأصم عن أبى هريرة قال قال رسول الله -صلى الله عليه وسلم- ্র إن الله يقول أنا عند ظن عبدى بى وأنا معه إذا دعانى (مسلم : ২/৩৮১- رقم الحديث: ৭০০৫)
আমার বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা করবে আমাকে তেমনই পাবে।” (মুসলিম শরীফ ২/৩৪১ হা:২৬৭৫)
মোট কথা এই আমলী কার্যক্রমই হল তাবলীগ। এ জন্য ইলম আমল যত কমই হোক না কেন, প্রত্যেক মুসলমানকেই এ কাজের দাওয়াত দেয়া হয় এবং যথাসম্ভব আল্লাহর পথে টেনে আনার চেষ্টা করা হয় এবং সাথে নিয়ে তার উপর মেহনত করা হয়। তার একমাত্র কারণ হলো, জামাতের পরিবেশে এসে ইনশাআল্লাহ তার মাঝে পরিবর্তন ঘটবে এবং প্রকৃত হেদায়াত দানকারী ও মানুষের মন পরিবর্তন সাধনকারী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সকলের উপর অনুগ্রহ করবেন। এজন্যই দেখা যায়, তাবলীগ জামাতে সব ধরনের এবং সব শ্রেণীর লোকই রয়েছে।
তাবলীগ জামাত সম্পর্কিত কিছু সমালোচনা ও জবাব
সমালোচনাকারীকে শত্র“ নয় বরং আমরা তাকে শুভাকাংখিই ভেবে থকি। তাবলীগের উপর উত্থাপিত আপত্তিগুলো শুনে মনে হবে, তাবলীগ জামাতের বিরুদ্ধে যারা সমালোচনা করে থাকেন তারা কয়েক ধরণের:
এক. নিছক জেদের বশবর্তী হয়ে।
দুই. কোন মুবাল্লিগ ভাইয়ের সাথে ব্যক্তিগত কোন কোন্দলের কারণে ।
তিন. নিছক শোনা কথার ভিত্তিতে।
চার.আকাবীর ও বর্তমান ওলামায়ে কেরাম অনেকে ইসলাহের উদ্দেশ্যে সত্যিকারের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতেন। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে অনেকে সেগুলোকে মূল বানিয়ে সমালোচনা জুড়ে দেন।
যাহোক তাবলীগ জামাত সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো ও তার খণ্ডন নিম্নরূপ।
সমালোচনা ১
জিহাদ সংক্রান্ত হাদীসগুলো তাবলীগ জামাতের সাথে সংশ্লিষ্ট করা:
তাবলীগ জামাতের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ এই যে, এরা জেহাদ সংক্রান্ত আয়াতও হাদীসগুলো টেনে এনে তাবলীগের কাজের সাথে জুড়ে দেন।
কথাটি বাস্তব। প্রথমত এখানে দু‘টি বিষয় রয়েছে । একটি হচ্ছে ইসলামের শত্র“দের বিরুদ্ধে অস্ত্র দ্বারা জিহাদ করা। আর জিহাদ বলতে সাধারণত এটিকেই উদ্দেশ্য নেয়া হয়। আর অন্যটি হচ্ছে আল্লাহর দীন কে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য চেষ্টা করা। আর এ চেষ্টা সাধনার অনন্যোপায় হলো জিহাদ। তবে শুধু যুদ্ধ বিগ্রহই জেহাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; বরং দ্বীন প্রতিষ্ঠাই বড় কথা।
হাফেয ইবনে হাজার র. বুখারী শরীফের ব্যখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে লিখেছেন, ইলমে দীন শিক্ষা করা ও শিক্ষা দেয়া, সৎ কাজের আদেশ করা ও অসৎ কাজের নিষেধ করা, অনুরূপ দীনি বিষয়ে লেখালেখি করা, মাসায়েল বর্ণনা করা, ইসলামের শত্র“দের বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদের উত্তর দেয়া ইত্যাদি সকল কর্মকান্ড জিহাদের অন্তর্ভূক্ত। (ফাতহুল বারী : ৬/৬০)
ইমাম নববী র.জিহাদকে আরো ব্যাপক করে, তেরো প্রকারে ভাগ করেছেন। (ফাতহুল বারী : ৬/৬০)
কুরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
“ياأيها النبي جاهد الكفار والمنافقين.”
হে নবী ! আপনি কাফের ও মুনাফিকদের সাথে জিহাদ করুন। (সুরা তাওবা:৭৩)
এ আয়াতে কাফের ও মুনাফিকদের সাথে জেহাদের হুকুম দেয়া হয়েছে। কিন্তু মুনাফিকদের সাথে তরবারীর জিহাদের সুযোগ আসেনি। হ্যাঁ, দাওয়াতী জিহাদ অবশ্যই হয়েছে।
তাফসিরে ইবনে কাছীরে এ আয়াতের তাফসীর সম্পর্কে ইবনে আব্বাস রা. এর রেওয়ায়েত বর্ণনা করা হয়েছে যে,
قال ابن عباس (رض) في تفسير هذه الاية : امره الله تعالي بجهادالكفار بالسيف والمنافقين باللسان واذهاب الرفق عنهم. (تفسير ابن كثير: ৪/১০১)
তিনি বলেন আল্লাহ তায়ালা কাফেরদের সাথে তরবারীর জিহাদ আর মুনাফিকদের সাথে কথা ও তাদের সাথে কঠোরতা করার দ্বারা জিহাদের আদেশ করেছেন। (তাফসীর ইবনে কাছীর:৪/১০১)
কুরআনের অন্য জায়গায় আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-
والذين جاهدوا فينا لنهدينهم سبلنا (عنكبوت: ৬৯)
আর যারা আমার রাস্তায় কষ্ট সহ্য করেছে, আমি তাদেরকে আমার পথের দিকে অবশ্যই হেদায়েত করবো। (সুরা আনকাবুত:৬৯)
এখানে ও জিহাদ দ্বারা তরবারীর জিহাদ উদ্দেশ্য নয়। ‘তাফসীরে জাসসাসে’ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে, তোমরা আমার সন্তুষ্টির জন্য কাফেরদের সাথে জিহাদ করো।
ইমাম সুদ্দী ও অন্যান্য মুফাস্সিরগণ বলেন, এ আয়াতটি ক্বিতাল (যুদ্ধ) ফরয হওয়ার আগে অবতীর্ণ হয়েছে। (আল জামেউ লিআহকামিল কুরআন:৭/২২৩)
দি¦তীয়ত ‘খুরুজ ফি সাবিলিল্লাহ’ তথা আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার যে শব্দ কোরআন ও হাদীসের বিভিন্ন স্থানে এসেছে, এ শব্দটিও শুধু ক্বিতাল (যুদ্ধ)এর সাথেই সীমাবদ্ধ নয়।
ইমাম বুখারী র. বুখারী শরীফে জিহাদের অধ্যায়ে এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন,
مااغبرت قدما عبد في سبيل الله فتمسه النار.صحيح البخاري:( ১/৩৯৪-رقم الحديث: ২৭২৭)
যে বান্দার পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলি ধূসরিত হয় তা জাহান্নামে প্রবেশ করবেনা। (বুখারী শরীফ : ১/৩৯৪ হা:২৭২৭)
হুবহু এমন অর্থের আরেকটি হাদীস তিনি জুম‘আর অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, হাদীসটি হল,
من اغبرت قدماه في سبيل الله حرمه الله علي النار. (صحيح البخاري: ১/১২৪-رقم الحديث: ৮৯৭)
অর্র্থাৎ, যে বান্দার পা আল্লাহর রাস্তায় ধুলি ধূসরিত হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জাহান্নামের আগুনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন। (বুখারী শরীফ : ১/১২৪ হা:৮৯৭)
সুতরাং বুঝা গেলো জিহাদকে শুধু তরবারীর জিহাদের সাথে সিমাবদ্ধ করা ঠিক নয়।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ক্বিতাল তথা যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য রক্তপাত নয়; বরং দীনের প্রসার উদ্দেশ্য। আর তরবারীর যুদ্ধের আশ্রয় সেখানেই নিতে হবে যেখানে দ্বীন প্রচারে এমন বাধা আসবে যা দূর করা তরবারীর যুদ্ধ ব্যতীত সম্ভব নয়। আর এ জন্যই তরবারীর যুদ্ধের পূর্বে দাওয়াতের বিধান রাখা হয়েছে। দাওয়াত কবুল না করলে কর প্রদানের হুকুম দেয়া হবে। এদুটোর কোনটি মেনে না নেয়া হলে মূল উদ্দেশ্য তথা ‘দ্বীন প্রতিষ্ঠা’- এর ধারা টিকিয়ে রাখার জন্য নিরূপায় হয়ে তরবারীর আশ্রয় নেয়া হবে।
অতএব, এ বিষয়টি পরিস্কার হয়ে গেলো যে, মূল উদ্দেশ্য দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। আর তরবারীর যুদ্ধ তথা ক্বিতাল তার একটি মাধ্যম মাত্র। কাজেই মাধ্যম প্রয়োগের আমলের উপর যদি এত সওয়াব থাকতে পারে, তাহলে মূল উদ্দেশ্যের আমলের অন্য মাধ্যম দাওয়াতের উপর সওয়াব হবে না কেন?
বি.দ্র. এ কথা চির সত্য যে,কিছু কিছু আয়াত জিহাদ তথা কিতালের বিষয়ে বিশেষভাবে অবতীর্ণ হয়েছে,তেমনিভাবে অনেক হাদিসও এই মর্মেই বর্ণিত হয়েছে।এসব কুরআনি আয়াত ও হাদীসগুলোকে কিতালের অর্থের উপরেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। দাওয়াতি জিহাদ এসব ‘নস’ থেকে উদ্দেশ্য নেয়া হলে তা নিতান্তই ভুল হবে।এ ব্যাপারে যদি কাউকে দেখা যায় যে,এ বিষয়ের আয়াত-হাদীসকে জিহাদ তথা দাওয়াত ও তাবলীগের উপর প্রয়োগ করছে,তাহলে সে লোক হয়তো অজ্ঞতার কারণে করছে। যা অবশ্যই আপত্তিকর,অথবা দাওয়াতী জিহাদ দিয়ে আসলে সে ঐ আয়াত ও হাদীসের তাফসির/ব্যাখ্যা করছে না; বরং রূপক/ব্যাপক অর্থকে উদ্দেশ্য নিয়ে দাওয়াতী কাজের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত ও হাদিসে বর্ণনাস্বরূপ পেশ করেছেন। উপমা দেওয়া আর নসের উদ্দেশ্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করা এক কথা নয়। যদি কোথাও উপরোক্ত বিশ্লেষণের ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয় আমাদের দৃষ্টিতে তা নিঃশন্দেহে ভুল ও আপত্তিকর,যার সংশোধন হওয়া আবশ্যক। তাবলীগ জামাত ভুলের উর্দ্ধে এ কথা কেউ দাবি করেনি, করতে পারেও না।
সমালোচনা- ২
তাবলীগ জামাতের প্রচলিত পদ্ধতি
নবী করীম সা. এর যুগে এভাবে মুসলমানদেরকে লক্ষ্য করে জামাত পাঠানোর প্রচলন ছিলনা। তখন জামাত কাফেরদের জন্যই পাঠানো হত। সুতরাং এ পদ্ধতি বিদআত বৈ কিছু নয়। এ ধরনের প্রশ্ন কেউ কেউ তাবলীগ জামাতের প্রচলিত পদ্ধতির উপর করে থাকেন।
এ প্রশ্নের জবাব এই যে, ‘আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ এটি কুরআন হাদীস কর্তৃক অবশ্য পালনীয় একটি বিষয়। যা কারো অজানা নয়। তাছাড়া ইতিপূর্বের আলোচনা দ্বারা একথা স্পষ্ট হয় যে, দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে কোন প্রচেষ্টাই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত ।
এরপরও এ উক্তি করা যে, ‘এ পদ্ধতি নবী করীম সা. এর যুগে ছিলনা’ এমন উক্তি অজ্ঞতারই প্রমাণ বহন করে।
আর যদি মেনে নেয়াও হয় যে, নবী করীম সা. এর যুগে এ পদ্ধতির প্রচলন ছিল না , তবুও এ কথা তো স্বীকৃত যে, শরীয়তের কোন নির্দেশ পালনের ব্যাপারে যুগোপযুগি জায়েয মাধ্যমগুলোও শরিয়তের নির্দেশের আওতাভুক্ত । যেমন বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি , খানকার যাবতীয় কার্যক্রম, বই-পুস্তক রচনা, টিকা ও ব্যখ্যাগ্রন্থ রচনার এসব প্রচলন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত আবশ্যকীয় ও শরীয়ত সম্মত। কিন্তু বলুন তো; এসব পদ্ধতিগুলো ঠিক এভাবে নবী করীম সা. এর যুগে বিদ্যমান ছিল কি? অনুরূপ নবী করীম সা. এর যুগে তোপ কামানের যুদ্ধ ছিল না বলে এগুলোকে বিদআত বলে দিয়ে কাফেরদের জঙ্গিবিমান আর রাসায়নিক অস্ত্রের মোকাবেলা তরবারী নিয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার মত বোকামি কেউ কি করবে?
মেশকাতের ব্যাখ্যাগ্রন্থ মেরকাতে উল্লেখ আছে,
البدعة اما واجبة كتعليم النحو لفهم كلام الله وكتدوين اصول الفقه والكلام في الجرح والتعديل واما مندوبة كاحداث الربط والمدارس. (مرقات: ১/৩৩৭)
এখানে বিদআতকে কয়েকভাগে ভাগ করা হয়েছে। তন্মধ্যে প্রথম দু’ প্রকার হচ্ছেÑ ‘বেদ‘আতে ওয়াজিবাহ’ ও ‘বিদ‘আতে মানদুবাহ’। ‘বিদয়াতে ওয়াজিবাহ’ যেমন, কুরআন হাদীস বুঝার জন্য ইলমে নাহু, উসূলে ফিকহ ,উসূলে হাদীস ইত্যাদির জ্ঞান অর্জন করা। আর বিদআতে মানদুবা যেমন, মাদরাসা বা কোন দীনি প্রতিষ্ঠান করা এবং প্রত্যেক ভাল কাজ যা ইসলামের প্রথম যুগে ছিল না। ইমাম শাফেয়ী র. বলেন, নব আবিস্কৃত বিষয়াদি কোরআন হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হলে দোষনীয়, অন্যথায় তা দোষনীয় নয়। (মিরকাত:১/৩৩৭)
মৌলিকভাবে তাবলীগের হুকুম কোরআন-হাদীসেও উল্লেখ আছে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন:
ياأيها الرسول بلع ماأنزل اليك.
‘হে রাসুল, আপনার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে তাবলীগ করুন’। অথাৎ পৌঁছে দিন। (সুরা মায়েদাহ:৬৭)
রাসূল স. ইরশাদ করেন “ بلغوا عني ولو آية”তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী জানা থাকলেও তা পৌছে দাও। (মিশকাত পৃ:৩২ হা:১৯৮)
এ কথা মোটেই ঠিক নয় যে, নবী করীম সা. এর যুগে মুসলমানদের জন্য এভাবে জামাত প্রেরণের প্রচলন ছিল না। এ প্রসঙ্গে একবার দারুল উলুম দেওবন্দের সুযোগ্য ছাত্র মুফতী মাহমুদুল হাসান র. কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, রাসূল স. এর যুগে তো দীনের দাওয়াত নিয়ে কাফেরদের কাছে যাওয়া হত। এখনকার মত এভাবে মুসলমানদের কাছে জামাত যাওয়ার কোন প্রমাণ কি হাদীস শরীফে আছে? থাকলে প্রমাণসহ লিখুন।
জবাবে তিনি লিখেছেন, ‘ফতহুল কাদীর’ গ্রন্থের প্রথম খন্ডে উল্লেখ রয়েছে যে, সাহাবায়ে কিরাম দাওয়াতের উদ্দেশ্যে কুফা ও কারকীসিয়া গমন করেছেন। হযরত উমর রা. হযরত মা‘কিল বিন ইয়াসার ও হযরত আব্দুল্লাহ বিন মুগাফ্ফাল প্রমুখের এক জামাতকে সিরিয়ায় প্রেরণ করেছিলেন। এসব জামাত মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করেই প্রেরিত হয়েছিল (ইযালাতুল খাফা:২/৬)
এছাড়া ও দীনের দাওয়াতের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জায়গায় লোকজন একত্রিত করে সাহাবাদের বয়ানের কথাও হাদীসগ্রন্থের বিভিন্ন জায়গায় উল্লেখ আছে। যেমন বুখরী শরীফে উল্লেখ আছে,
كان عبد الله يذكر الناس في كل خميس، (رواه البخاري: ১/১৬)
রাসূল স. এর ওফাতের পর সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের নিকট লোকজন জমায়েত হত এবং তিনি তাদেরকে হাদীস শুনাতেন। (বুখারী শরীফ : ১/১৬)
হযরত আবু হুরায়রা রা. সপ্তাহে একবার মসজিদে নববীর মিম্বরের নিকট দাঁড়িয়ে লোকজনকে হাদীস শুনিয়ে তালিম করতেন।
হযরত তামীম দারী রা. প্রত্যেক জুমার দিন খুতবা শুরু করার পূর্বে হাদীস শুনিয়ে তালিম করতেন। হযরত উবাদা ও আবূ দারদা রা.-ও পৃথক পৃথকভাবে তাবলীগ করতেন। (ফতোয়ায়ে মাহমূদিয়া:৫/৬৭)
বিখ্যাত ইতিহাস ও সীরাত বিশারদ মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী র. তাঁর রচিত ‘সাওয়ানেহে দেহলুভীর ভূমিকায় লিখেছেন, রাসুলুল্লাহ স. এর জীবনের দাওয়াতের উল্লেখযোগ্য পদ্ধতিগুলোর একটি হল, ‘আরয’। অর্থাৎ কারো আগমনের অপেক্ষা না করে তিনি এবং তাঁর অন্যান্য দায়ীরা নিজেই লোকদের কাছে দাওয়াত নিয়ে পৌঁছে যেতেন। এমনকি অনেক সময় লোকদের বাড়ি পর্যন্ত হকের দাওয়াত নিয়ে পৌছে যেতেন।এতে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে,দাওয়াত ও তাবলীগ মুসলমানদেরও দেয়া হত।
কোনো কোনো বিশেষ জামাতের লোকেরা তাবলীগের এ দাওয়াতি আমলের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন যে, রাসূল স. এর এ দাওয়াতি মেহনতের ধরনতো মক্কী জীবনে ছিল। মাদানী জীবনে দাওয়াতের ধরন ছিল অন্যরকম তাহলে শুধু মক্কী জীবনের অনুসরণ কেন করা হয়?
এ প্রশ্নের জবাব হল, নবী করীম সা.-এর হিজরতপূর্ব দাওয়াতের আমল অর্থাৎ ‘লোকদের দুয়ারে দুয়ারে যাওয়া’ মদিনা পৌঁছার পর অনিবার্য কারণে অব্যাহত থাকেনি; বরং সেখানে গিয়ে তিনি একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করেন। কিন্তু এটি কখন হয়েছিল? যখন জামাত তৈরী হয়ে গিয়েছিল। তখন পরিস্থিতির দাবী ছিল যে, তিনি একটি নির্দিষ্ট স্থানে বসে এ কাজকে আঞ্জাম দিবেন এবং অন্যদের দ্বারাও দাওয়াত পৌঁছানোর কাজ নিবেন।
এর ভিত্তিতেই হযরত উমর রা. এর জন্য মদীনায় অবস্থান করা তখনই সংগত ছিল, যখন রোম ও ইরানে আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করার জন্য হাজার মর্দে মুজাহিদ তৈরী হয়ে গিয়েছিল । তখন পরিস্থিতির দাবী ছিল যে, একজন শাষক মারকাযে বসে এ হকের দাওয়াত ও আল্লাহর পথে জিহাদেও পূর্ণ বিষয়টি পরিচালনা করবেন।
কিছু টিভি চ্যানেলে কেউ কেউ এ প্রশ্নটিও করেন যে, নববী যুগে সাহাবাদের দাওয়াত ছিল কাফেরদের প্রতি আর তাবলীগের লোকেরা তো শুধু মুসলমানদেরকেই দাওয়াত দেয়?
এ প্রশ্নের জবাবে বলবো, কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ প্রশ্নকারীরা যদি একটু খোঁজ নিয়ে দেখেন তাহলে জানতে পারবেন, দেশে-বিদেশে শত শত অমুসলিম এদের দাওয়াতে ঈমান গ্রহণ করেছেন। যদি এ কথা মেনে নেয়া হয় যে,শুধু মুসলমানদের দাওয়াত দেয়া হয়, তাহলে বলবো কাফেরদের কাছেও হেদায়েতের উদ্দেশ্যে জামাত প্রেরণ করা হত। আর এও জানা কথা যে, অধুনা মুসলীম সম্প্রদায় দ্বীন ও হেদায়েত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কুফরির পর্যায়ে চলে গেছে, কোন কোন ক্ষেত্রে এর থেকেও অধম হয়ে গেছে। সুতরাং তাদেরকে হেদায়েতের দিকে আহবান করার প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে।
এ বিষয়টিও বোঝা দরকার যে, কাফের আর মুমিনদের দাওয়াতে ভিন্নতা রয়েছে। কাফেরদেরকে ঈমানের দাওয়াত আর মুমিনদের আহকামের দাওয়াত দিতে হবে।
সারকথা হল,কাফেরদেরকেও ঈমানের দাওয়াত দিতে হবে আর মুসলমানদেরকে ঈমান বৃদ্ধি তথা আহকামের দাওয়াত দিতে হবে। আর এ উভয় দাওয়াত কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। দাওয়াত শুধু কাফেরদের মাঝে নয় বরং মুসলমানদেরও আহকামের দাওয়াত দিতে হবে এ বিষয়ে কোরআনে কারীমে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে,
قل لعبادي الذين آمنوا يقيموالصلوة وينفقوا مما رزقنهم. (ابراهيم: ৩১)
‘হে রাসূল স. আপনি আমার মুমিন বান্দাদের বলে দিন, তারা যেন নামায কায়েম করে এবং আমার প্রদত্ত রিযিক থেকে দান করে’। (সুরা ইববরাহীম:৩১)
নবী করীম সা. ইরশাদ করেন:
افشوا السلام واطعموا الطعام وصلوا الارحام وصلوا باليل والناس نيام. (مشكاة: ص৩৩২-رقم : ৩৮২২)
‘তোমরা সালামের প্রসার করো,খানা খাওয়াও (গরিবদের কে) আত্মিয়তা রক্ষা কর, রাত্রি বেলায় যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে তখন নামাজ আদায় করো’। (মিশকাত : ৩৩২ হা:৩৮২২)
উপরোক্ত আলোচনার দ্বারা প্রমানিত হল, তাবলীগ নব আবিস্কিৃত কোন বিষয় নয় এবং শরীয়তের গন্ডির বাইরেও নয়; বরং শরীয়তের আলোকে নববী দাওয়াতের একটি প্রতিচ্ছবি মাত্র, যা যুুগোপযুগি,সহজতর,ব্যাপক ও অধিক ফলপ্রসু।
সমালোচনা ৩
মাদরাসা ও খানকার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার
তাবলীগ জামাতের সাথীরা মাদরাসা ও খানকাকে অপ্রয়োজনীয় বলে প্রচার করে থাকেন, এমন প্রশ্নও অনেকে করেন।
আসলে এ প্রশ্নের মূল উৎস হলো, ্তাবলীগ জামাত সম্পর্কে অজ্ঞতা কিংবা চিত্তের অনুদারতা। অন্যথায় তাবলীগ জামাতের মূল ছয়টি উসূলের অন্যতম উসূল হল ইলম ও যিকির। তাছাড়া এ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত ইলিয়াস রাহ. ও তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী হযরত ইউসুফ রাহ. এর জীবনের উপর আলোকপাত করলেই এ বিষয়টি জানা যাবে যে, তাঁরা এ বিষয়ের সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করতেন। হযরত ইলিয়াস রাহ. এর বক্তব্য অত্যন্ত সু-প্রসিদ্ধ যে, আমার এ আন্দোলনের জন্য ইলম ও যিকির দুটি ডানা তুল্য; তার একটিও ভেঙে গেলে পাখির জন্য ওড়া মুশকিল ।
‘সাওয়ানেহে ইউসুফী’ (হযরত মাও: ইউসুফ র. এর জীবন চরিত)-তে লিখা রয়েছে যে, তাওহীদ ও নামাযকে এ কাজের বুনিয়াদ মনে করতে হবে। তিনি তার এক গুরুত্বপূর্ণ চিঠিতে লিখেন, ইলম ও যিকির কাজের ডানাতুল্য। এর কোন একটিতে দুর্বলতা কিংবা অবহেলা মূল কাজের জন্য মারাত্মক হুমকি। প্রত্যেকটি স্ব-স্ব স্থানে একান্ত অপরিহার্য ও আবশ্যকীয় । ইলম ও যিকিরের মারকায বা মূল কেন্দ্র হল মাদ্রাসা এবং খানকাহ। আমরা আমাদের এ দুটি ডানাকে শক্তিশালী করার জন্য ওলামা-মাশায়েখদের সাথে সাক্ষাৎ করা,তাঁদের থেকে দুয়া নেয়া, তাঁদের সামনে তাবলীগের কার্যক্রম শুনানো, সৎ পরামর্শ নেয়া তাবলীগের মৌলিক নীতিমালার অন্যতম। আর কোরআন-হাদীসের আলোকেও এ কথা অস্বীকারের কোন উপায় নেই। রাসূল স. ইরশাদ করেন-
طلب العلم فريضة علي كل مسلم. (مشكاة : ص: ৩৮-رقم : ২১৮)
প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ইলম অšে¦ষণ করা ফরয (মেশকাত :পৃ ৩৪ হা:২১৮)
ইলমের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হল মাদ্রাসা। তাছাড়া সঠিক আকিদা-বিশ্বাস, উন্নত চরিত্র,নেক আমল এবং আধ্যাত্মিক রোগসমূহ দূর করা ও তার উন্নতি সাধন করা ফরয।
তাফসীরে মাযহারীতে সুরা তাওবার ১২২ নং আয়াতولينذروا قومهم اذا رجعوا اليهم.
‘যাতে তারা স্বীয় জাতিকে ভীতি প্রদর্শন করতে পারে যখন তারা তাদের নিকট ফিরে আসে’-এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে,
الفرض العين هوالعلم بالعقائد الصحيحة (الي قوله) واما العلم اللدني الذي ليسمون اهلها بالصوفية الكرام فهو فرض عين.
‘অর্থাৎ সঠিক আকিদার ইলম ও ইলমে তাসাউফ তথা সুফিয়ায়ে কেরামের ইলম ফরজে আইন’। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ দু প্রকার ইল্ম সকলের জন্য শিক্ষা করা ফরয এবং সাধ্যমত এ দুটি ইলমের প্রচার-প্রসারও আবশ্যক। (তাফসীরে মাযহারী:৪/২৯৯)
মেশকাত শরীফের ব্যখ্যাগ্রন্থ মেরকাতে রাসূল স.-এর হাদীস
(بلغوا عني ولو آية.)
অর্থাৎ তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বাণী জানা থাকলেও তা পৌঁছে দাও। (মেশকাত:পৃ:৩২ হা:১৯৮)
-এর ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে,
(بلغوا عني) أي انقلوا الي الناس وافيدوهم ما امكنكم او ما استطعتم الخ.
অর্থাৎ তোমরা মানুষের নিকট যাও এবং যথাসাধ্য তাদেরকে শেখাও। (মেরকাত:১/৪০৬)
কিন্তু দীন শেখানো ও পৌঁছানোর এমন কোন পদ্ধতি নির্দিষ্ট নেই যে, সকলকে সে পথেই চলতে হবে; বরং মাদরাসা, খানকাহ, ধর্মীয় বই-পুস্তক, ওয়াজ-নসিহত, তালিমের মজলিস এবং এগুলো ছাড়াও যত পন্থা রয়েছে যা দীনের জন্য উপকারী সেগুলো অবলম্বন করা যেতে পারে, যতক্ষন পর্যন্ত তাতে কোনো ক্ষতির আশংকা না থাকে। অতএব দীনের অন্যতম প্রধান দুটি কেন্দ্র মাদরাসা ও খানকার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তাই তাবলীগের মুরুব্বীগণ এগুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
তবে তাবলীগের উদ্দেশ্য দীনকে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেওয়া। তাই মাদরাসার ছাত্রদের ও খানকার সালেকগণ সাধ্যমতো তাবলীগ জামাতের সাথে এ কাজে সহযোগিতা করা উচিৎ। যদি তাঁরা তাদের মাঝে শরিয়তের নীতিবিরোধী কোনো বিষয় দেখেন তাহলে কল্যাণকামিতার উদ্দেশ্যে তাদেরকে উপদেশ দিবেন। এবং তাদের ভুলগুলো শুধরে দিবেন।
তাই জামাতের সাথীদের প্রতি মুরুব্বিদের উপদেশ হচ্ছে,তাবলীগ জামাতের সাথীদের উপর আবশ্যক যে, খানকাহও মাদরাসাকে পূর্ণ সম্মানের দৃষ্টিতে দেখবে, নিজেদের সংশোধনের জন্য তাদের সাথে পরামর্শ করবে। কখনোই তাদেরকে এ দাওয়াত দিবে না যে, আপনারা আপনাদের এই দীনি কাজ ছেড়ে আমাদের সাথে যোগ দিন।
কেননা, মাদরাসার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরী; নতুবা আলেমদের জন্ম বন্ধ হয়ে যাবে এবং দীনের কতৃত্ব মুর্খদের হাতে চলে যাবে। আর খানকার প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কেননা আমল ছাড়া ইলমের কোনো মূল্য নেই। আর ইখলাস ও আমলী উন্নতি তথা আত্মশুদ্ধির প্রধান কেন্দ্র হল খানকাহ। হযরত ইলিয়াছ র.,হযরত ইউসুফ র. এবং হযরত শাইখ যাকারিয়্যা র.-সহ তাবলীগের প্রধান মুরুব্বীগণ সবই ছিলেন আধ্যাত্মিক জগতের উজ্জল নক্ষত্র।
সমালোচনা ৪
আলেমদের বর্তমানে জাহেলদের আমীর নিযুক্তকরণ
তাবলীগ জমাতের উপর আরেকেটি লক্ষণীয় প্রশ্ন হল, অনেক সময় আলেমদের বর্তমানে জাহেলদের আমীর নিযুক্ত করা হয়। বাহ্যত প্রশ্নটি বেশ গুরুত্বের অধিকারী হলেও বাস্তব সত্য এই যে, কোন বিষয়ের নেতৃত্ব দানের জন্য শুধু ইলমই যথেষ্ট নয়, বরং পরিচালনার যোগ্যতা ও চিন্তা-ফিকিরের দক্ষতাও আবশ্যক। তাছাড়া উত্তম জনের বর্তমানে অনুত্তম জনকে আমীর নিযুক্ত করার প্রমাণ রাসুলুল্লাহ সা. এর যুগ থেকে চলে আসছে। যেমন হাদীস শরীফে এসেছে,
بعث النبي (ص) بعثا وامر عليهم اسامة بن زيد.
রাসূল স. উসামা বিন যায়েদ রা. কে বাহিনীর আমীর নিযুক্ত করেছেন। কিছু লোক এ বিষয়ে আপত্তি তুলে বসলো। রাসুলুল্লাহ সা. খুতবা দান করলেন। এবং হামদ ও সালাতের পর বললেন,
أن تطعنوا في امارته فقد كنتم تطعنون في امارة ابيه من قبل وايم الله ان كان لخليفا للامارة وان كان لمن احب الياس الي……….
‘তোমরা উসামার নেতৃত্বে আপত্তি তুলেছ, আর তোমরা ইতি পূর্বেও তাঁর পিতা যায়েদের নেতৃত্বে আপত্তি তুলেছিলে। আল্লাহর কসম ! সে নেতৃত্বের হকদার এবং আমার অধিক প্রিয়’। (বুখারী:১/৫২৮ হা:৩৫৯৫)
অনুরূপভাবে একবার রাসুর সা. জুহায়নিয়ায় প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন। তাতে হযরত আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ রা. কে আমীর নিযুক্ত করেন এবং ইরশাদ করেন, সে তোমাদের থেকে বেশী উত্তম নয়, তবে ক্ষুৎ-পিপাসায় অধিক ধৈর্যধারণকারী।
একবার হযরত আবূ বকর রা. তাঁর খেলাফত আমলে ইয়াযিদ বিন আবু সুফিয়ানকে আমীর নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর অধিনে ছিল ‘আমীনু হাযিহিল উম্মাহ’ (উম্মতের বিশ্বস্ত ব্যক্তি) হযরত আবূ উবায়দাহ রা.ও ‘ইমামুল উলামা’হযরত মুয়ায বিন জাবাল রা.।
এর দ্বারা বুঝা যায় আমীর নিযুক্ত করার ব্যাপারে নিছক শ্রেষ্ঠত্বই বিবেচ্য নয় ; বরং আরো অনেক কিছু দেখার রয়েছে। বস্তুত: আমীর হওয়ার জন্য শুধু বয়ো বৃদ্ধ, শ্রেষ্ঠ কিংবা বড় জ্ঞানী হওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং সবচে বেশী জরুরী বিশেষত: সফরের সময় সাহসিকতা, শক্তি এবং ধৈর্যধারণ ক্ষমতা ও কাজের নিয়মনীতির উপর দক্ষতা।
তাবলীগ জামাতে আমীর নিযুক্তের সময় বিশেষভাবে যে বিষয়টির প্রতি লক্ষ রাখা হয়-তা হলো, ইতিপূর্বে তিনি কখনো জামাতে সময় দিয়েছেন কি না? কেননা জামাতে যে একবার সময় দিয়েছে স্বভাবতই তার অভিজ্ঞতা অন্যদের তুলনায় বেশি হবে। প্রবাদ আছে سل المجرب لاتسأل الحكيم
প্রজ্ঞার অধিকারীকে নয় অভিজ্ঞতা সম্পুর্ণ ব্যক্তিকেই জিজ্ঞাসা করো’। এ জন্যই দেখা যায় অনেক অল্প ডিগ্রীধারী ডাক্তার অভিজ্ঞতার কারণে অধিক ডিগ্রীধারী ডাক্তারের চেয়ও বেশী পারদর্শী হয়ে থাকেন।
মোট কথা স্বল্প বয়স্ক বা স্বল্প ইলমের অধিকারী কিন্তু অভিজ্ঞ আমীরও অনেক সময় জামাতকে অধিক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। ফলে এক্ষেত্রে ইলমের চেয়ে অভিজ্ঞতাই অধিক লক্ষণীয়। তবে সাথে ইলম থাকাটা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
সমালোচনা-৫
মসজিদে অবস্থান
তাবলীগ জামাতের ব্যাপারে অনেকেই এ প্রশ্ন করে থাকেন যে, এরা মসজিদে অবস্থান করে, এবং সেখানে থাকা,খাওয়া,ঘুমানো,আসবাবপত্র রাখা ইত্যাদী কাজ করে থাকে। অথচ মসজিদ তো ইবাদতের স্থান?
প্রশ্নের উত্তর এই যে, মসজিদে খাওয়া,সোয়া মাকরুহ। অবশ্য কোন মুসাফিরের যদি থাকার কোনো জায়গা না থাকে বা কেউ যদি ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে থাকে, তবে ফুকাহায়ে কেরামের মতে এমন ব্যক্তির জন্য মসজিদে থাকার অনুমতি রয়েছে। ফতওয়ায়ে শামীতে:
“وكره اكل ونوم الا لمعتكف وغريب”
এ বাক্যের ব্যখ্যায় উল্লেখ রয়েছে যে, ‘মসজিদে খাওয়া,ঘুমানো মাকরুহ। তবে কেউ যদি অবস্থান করতে চায়, তরে তার উচিৎ ইতিকাফের নিয়ত করে মসজিদে প্রবেশ করা এবং ইতিকরফের সময়টুকুতে যিকির বা নামায আদায় করা এরপর অন্য কাজ করা। (রাদ্দুল মুহতার:২/৪৩৫)
এর দ্বারা বুঝা যায়,যদি কোন ব্যক্তি নফল ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে যায় এবং যিকির বা নামায আদায় করে তবে তার জন্য মসজিদে খাওয়া বা ঘুমানোর অনুমতি আছে। অথবা এমন মুসাফির যার থাকার জায়গা নেই ,সেও মসজিদে থাকতে পারে।
আর তাবলীগী সাথীরা যেহেতু দূর-দূরান্তে সফর করে থাকে তাই অধিকাংশ সময় মসজিদেই অবস্থান করতে হয়। মসজিদে প্রবেশ করে তারা নামায আদায় করে, দীনের তালীম করে, যিকির করে, রাতে অনেকেই তাহাজ্জুদের নামায পড়ে এবং অন্যান্য লোকদেরও এসব নেক কাজের দাওয়াত দেয়; উপরন্তু তারা নফল ইতিকাফেরও নিয়ত করে থাকে। তাই তাদের জন্য মসজিদে থাকা-খাওয়া দোষণীয় নয়। তবে মসজিদকে হোটেল বা বাবুর্চিখানার মত ব্যবহার করা উচিৎ নয়। এজন্য খানা পাকানো ও খানার সরঞ্জামাদি রাখা, এগুলো মসজিদের পাশে কোনো খালি জায়গায় ব্যবস্থা করা উচিৎ।
হাদীসের কিতাবে মসজিদে থাকার বৈধতার পক্ষে অনেক প্রমাণ রয়েছে । যেমন: বুখারী শরীফে আছে,
أخبرني عبدالله بن عمر أنه كان ينام وهو شاب أعزب لا اهل له في مسجد النبي (ص).
‘হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. অবিবাহিত ছিলেন। তিনি মসজিদে নববীতে ঘুমাতেন’। (বুখারী শরীফ:১/৬৩-হা:৪৩৫)
একবার হযরত আলী রা. হযরত ফাতেমা রা. এর সাথে অভিমান করে মসজিদে গিয়ে শুয়ে ছিলেন। তারপর নবী করীম সা. তাকে খুজে পাঠালেন। অতঃপর তাকে মসজিদে শোয়া অবস্থায় পাওয়া গেলো,তখন নবী করীম সা. তাঁকে বললেন; হে আবূ তুরাব ওঠ! হে আবু তুরাব ওঠ! (বুখারী শরীফ ১/৬৬ Ñহা:৪৩৬)
আসহাবে সুফ্ফার মসজিদে নববীতে ঘুমানোর কথাও হাদীসে উল্লেখ আছে। (বুখারী শরীফ ১/৬৩ Ñহা:৪৩৭)
হযরত আব্বাদ বিন তামীম তাঁর চাচা থেকে বর্ণনা করেন,তিনি একবার রাসূল স. কে মাসজিদে চিৎ হয়ে এক পা এর উপর আরেক পা রেখে শোয়া অবস্থায় দেখেছেন। (বুখারী শরীফ ১/৬৮ Ñহা:৪৭০)
এসকল হাদীসের আলোকে জানা গেল, মসজিদে শোয়ার অনুমতি রয়েছে। তবে অবশ্যই মসজিদের আদব রক্ষা করতে হবে। তাবলীগী সাথীদের উচিৎ মসজিদের আদব বজায় রেখে ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। আর জনগণ বা মসজিদ কমিটির উচিৎ তাদেরকে থাকার সুযোগ দেয়া। কেননা তারা সেখানে দীনের কাজই করছে। নিজ ঘর-বাড়ি ছেড়ে মানুষকে আল্লাহর পথে আনার জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে। অথচ এ দেশের কোথাও,ইউরোপ,আমেরিকা সহ বিশ্বের বহু দেশে এমন মসজিদও আছে যেখানে নামায পড়ার লোক নেই। আযানের ধ্বনি পর্যন্ত সেখানে উচ্চারিত হয় না। তাবলীগ জামাতের উসিলায় অন্তত এমন কিছু লোক তো পাওয়া যাচ্ছে যারা এসব বিরান মসজিদগুলোকে আবাদ করছে।
সমালোচনা-৬
তাবলীগ জামাতের লোকেরা ওলামা বিদ্বেষী
এ প্রশ্নও ব্যাপক শোনা যায় যে, তাবলীগ জামাতের লোকেরা ওলামায়ে কেরামের সাথে অসদাচরণ করে এবং সম্মান বজায় রাখেনা। এর জবাব হল, তাবলীগ জামাত ভিন্ন কোন দল নয়; বিভিন্ন শ্রেণী ও বিভিন্ন দলের লোক এখানে সমবেত হয়। আর এ ফেৎনা-ফাসাদের যুগে এমন অনেক দল ও শ্রেণী রয়েছে যাদের মাঝে ওলামা বিদ্বেষ রয়েছে। সুতরাং পূর্ব থেকেই ওলামা বিদ্বেষী এমন লোক যদি তাবলীগ জামাতে এসে যোগ দেয়, তাহলে কি এ কথা বলা সঙ্গত হবে যে, তাবলীগ জামাতের লোকেরা ওলামা বিদ্বেষী?
আর তাবলীগের মারকায থেকে এবং তাবলীগের মুরুব্বীদের পক্ষ থেকে সর্বদা এ বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করা এবং তাদের সাথে কোন প্রকার বে-আদবী না করা হয়। এরপরও যদি কারো আচরণ উচ্চারণ এর ব্যতিক্রম হয় তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অপরাধ।
খুব ভালো করে স্মরণ রাখতে হবে যে,তাবলীগের একটি গুরুত্বপূর্ণ উসূল হচ্ছে ইল্ম ও যিকির। আর এ ইলমের ধারকগণই হচ্ছেন আলেম ।তাদের অবমুল্যায়ন করা স্বয়ং উসূলের পরিপন্থি নয় কি?
এ প্রসঙ্গে হযরত ইলিয়াস র.-এর বাণী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, যদি কোন জায়গায় গিয়ে সেখানকার ওলামায়ে-কেরাম ও নেককারদের কাজের প্রতি অসহানুভূতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়, তাহলে তাঁদের প্রতি কুধারনা করা যাবে না,বরং এ কথা ভাবতে হবে যে,তাদের কাধে বহু দীনী গুরুদায়িত¦ ন্যাস্ত আছে। তা ছেড়ে কী করে তাঁরা দাওয়াতের এ কাজে চলে আসবেন?
তিনি আরো বলেন, আমাদের এ তাবলীগের কাজে সাধারণ মুসলমানকে সম্মান করা হয়। আর ওলামায়ে কেরামের সম্মান করা বুনিয়াদি বিষয়। সকল মুসলমানকে ইসলামের সুবাদে ইজ্জত করতে হবে। আর ওলামায়ে কেরামকে ইলমে দীনের কারণে সম্মান করতে হবে, ইল্ম ও যিকিরের ঘাটতি তখনই পূরণ হবে যখন তারা ওলাময়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েখদের সান্নিধ্যে থাকবে। (মালফুযাতে ইলিয়াস র.)
যা হোক একথা অস্বীকারের কোনই অবকাশ নেই যে, তাবলীগের মুরুব্বীরা এব্যপাওে যথেষ্ট সতর্ক। এরপরও যদি কোন আনাড়ীকে এ ধরণের কোন অসদাচরণ করতে দেখা যায়, তবে সেটা তার ভ্রান্তি যা সংশোধনের যোগ্য। সুতরাং তার এ ভুলের দায়ভার পুরো তাবলীগ জামাতের উপর বর্তায় না সেই ব্যক্তিই এ জন্য দায়ী?
এ প্রসঙ্গে হযরত থানবী র. এর সুন্দর একটি ঘটনা রয়েছে, একবার কোন এক মাদরাসার ছাত্র চুরি করলো। মালিক হযরতের কাছে অভিযোগ করলো যে, তালেবুল ইলমও চুরি করা শুরু করেছে। জবাবে হযরত থানবী র. বললেন, না; বরং চোর তালেবুল ইলম সেজেছে।
সমালোচনা -৭
চিল্লার সমালোচনা
এ প্রশ্নটিও অনেকের মুখে শোনা যায় যে, তাবলীগ জামাতের এ’চিল্লা’ কোত্থেকে এলো?
এর জবাব হল, তাবলীগ জামাতের কিছু কর্মপদ্বতি রয়েছে। তন্মধ্যে একটি হল চল্লিশ দিনের সফরে বের হওয়া। একে একচিল্লা বলা হয়। যে কাজে চল্লিশ দিন ব্যয় করা হয়, সে কাজের অনেক ভাল ফলাফল হয়ে থাকে। তাছাড়া চল্লিশ দিনে অনেক কাজের পূর্ণতা আসে। এটি কোন নব আবিস্কৃত বিষয় নয়। কোরআন হাদীসে এর প্রমাণ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন,
وواعدنا موسي ثلاثين ليلة واتممنا ها بعشر فتم ميقات ربه اربعين ليلة.
‘আমি মূসাকে প্রতিশ্র“তি দিয়েছি ত্রিশ রাত্রির। এবং সেগুলোকে পূর্ণ করেছি আরো দশ দ্বারা । বস্তুত:এভাবে চল্লিশ রাতের মেয়াদ পূর্ণ হয়ে গিয়েছে’। (সুরা আ‘রাফ : ১৪২)
তাফসীরে বয়ানুল কোরআনে হযরত হাকীমূল উম্মত থানবী র. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেন, সুফিয়ায়ে কেরামের মাঝে চিল্লার প্রচলন এখান থেকেই এসেছে। যাতে তারা অসংখ্য বরকত প্রত্যক্ষ করেছেন। (বয়ানুল কুরআন :২/৫১)
বুখারী শরীফে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, নবী করীম সা. ইরশাদ করেন,
ان احدكم يجمع في بطن امه اربعين يوما ثم علقة مثل ذلك ثم يكون مضغة مثل ذلك….
অর্থাৎ মানুষ তার সৃষ্টির (শুরুলগ্নে) মায়ের গর্ভে প্রথমত চল্লিশ দিন পর্যন্ত বীর্যরূপেই অবস্থান করে। তারপর চল্লিশ দিন পর্যন্ত রক্ত পিন্ড থাকে। তারপর চল্লিশ দিন পর্যন্ত গোশতের টুকরা থাকে। (খারী শরীফ:২/৯৭৬ হা: ৬৩৪২)
এ হাদীস দ্বরা পরিস্কার হয়ে গেল, মানুষের জীবনে পরিবর্তন সাধনের জন্য চল্লিশ দিনের গুরুত্ব অপরিসীম।
তিরমিযী শরীফে হযরত আনাস রা. এর বরাত দিয়ে উল্লেখ আছে রাসূল স. ইরশাদ করেন,
من صلي اربعين يوما في جماعة لم تفته التكبيرة الاولي كتب الله له براأتين، برائة من النار وبرائة من النفاق.
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ইখলাসের সাথে চল্লিশ দিন জামাতে তাকবীবে উলার সাথে নামায আদায় করবে, সে দুটি সনদ লাভ করবে। একটি সনদ জাহান্নাম থেকে মুক্তির অপরটি মুনাফেকী হতে মুক্তি লাভের। (তিরমিযী শরীফ : ১/৫৬)
এ ছাড়াও বিভিন্ন হাদীসে নবী করীম সা. চল্লিশটি হাদীস সংরক্ষণ করার ব্যপারে বিভিন্ন সু-সংবাদ দিয়েছেন। এর দ্বরাও চল্লিশ সংখ্যার গুরুত্ব প্রতীয়মান হয়। অর্থাৎ চল্লিশের সংখ্যাটির মধ্যে এমন উপকার থাকে যার দ্বারা বস্তুর মধ্যে আমূল পরিবর্তন পরিবর্ধনের গুন সাধিত।
বুঝা গেলো, তাবলীগ জামাতের চিল্লার তাৎপর্য অবশ্যই আছে, যা কোরআন -হাদীস থেকে প্রমাণিত।
সমালোচনা ৮
মহিলাদের তাবলীগ
তাবলীগে ‘জামাতে মাসতুরাত’ তথা দাওয়াতের উদ্দেশ্যে মহিলাদের ঘর থেকে বের হয়ে সফরে যাওয়ার ব্যপারে অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন । যে এভাবে দাওয়াতের জন্য মহিলাদের ঘর থেকে বের হওয়া কতটুকু শরীয়ত সম্মত ?
এর জবাব হল, আসলে তাবলীগ জামাতের উদ্দেশ্য হল নিজেরা দীন শেখা ও অন্যদেরকে দীন শেখানো। এই উদ্দেশ্যে তারা দুর-দুরান্তে সফর করে থাকেন।
পুরুষের যেমন দ্বীন শেখা আবশ্যক অনুরূপ মহিলাদের জন্যও এই দ্বীন শেখা ও শেখানো অত্যন্ত জরুরী।
হাদীস শরীফে নবী করীম স. ইরশাদ করেন-
طلب العلم فريضة علي كل مسلم وفي رواية مسلمة.
অর্থাৎ ইলম অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরয। (মিশকাত শরিফ : ৩৪)
তবে মহিলাদের ইলম শিক্ষার জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল, নিজ ঘরে স্বামী বা কোন মাহরাম পুরুষের নিকট থেকে ইলম অর্জন করা। তা সম্ভব না হলে স্বামী বা কোন মাহরাম পুরুষের সাথে দূরে সফর করার মাধ্যমে ইলেম অর্জন করবে কিনা এ ব্যাপারে বিজ্ঞ মুফতীদের মতবিরোধ রয়েছে। হযরত মুফতী রশীদ আহমাদ র. যিনি এ ব্যাপারে কঠোর বলে পরিচিত , তিনি দীর্ঘ আলোচনার পর বলেন, দীনি কাজে মহিলাদের মাহরামের সাথে ঘর থেকে বের হওয়ার নিষেধাজ্ঞা কুরআন- হাদীসে সু- স্পষ্ট ভাবে নেই। যুগ পরিস্থিতির নিরিখে শরীয়তের নীতিমালা সামনে রেখে ফুকাহায়ে কিরামের কেউ কেউ ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করেছেন। আবার অনেকে ফিৎনামুক্ত পরিবেশ পাওয়া যাওয়াসহ বেশকিছু শর্তের সাথে জায়েয বরং উত্তমও বলেছেন। এ দিকে মুফতী মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি র. ও মুফতী তাকী উসমানী দা.বা. বর্তমান যুগে বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে বৈধ বলেও ফতওয়া দিয়েছেন। এমনকি মুফতী রশীদ আহমাদ সাহেবও বেশ কিছু কড়া শর্তে ইলম অর্জনের লক্ষ্যে বের হওয়া বৈধ বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। (আহসানুল ফাতওয়া : ৮/৫৯)
অধমের দৃষ্টিতে ইনআমূল বারী ও ফাতওয়ায়ে উসমানীতে উল্লেখিত মুফতী তাকী উসমানী ও ফতওয়ায়ে মাহমুদীয়াতে উদ্বৃত মুফতী মাহমুদুল হাসান র. এর ফতওয়াই বর্তমান যুগের জন্য উপযোগী। বিশেষ করে এমতে যে, মূলত এটিকে মাসতুরাতের জামাত বলা হলেও মাহরাম পুরুষ তাদের সাথে রয়েছে। তারাই আমির থাকেন, মহিলাদের কেউ আমির হতে পারেন না। পুরুষ আমিরের পরামর্শ নিয়ে মহিলারা চলতে বাধ্য। তাই জামাতটি মূলত পুরুষের। মহিলারা মাত্র তাদের সাথে গিয়ে নিরাপদ ঘরে মহিলাদের মধ্যে দীনের কাজ করছে। তাই সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বনে মাসতুরাতের জামাতকে বৈধ বলা যেতে পারে।
তবে পুরোপুরি খেয়াল রাখতে হবে যাতে একাজে শরীয়তবিরোধি কোনো ব্যপার না ঘটে । অন্যথায় উপকারের চেয়ে ক্ষতির আশংকাই বেশি। সুতরাং এ বিশেষ বিবেচনায় শরীয়তের বিধি-নিষেধ সম্পূর্ণভাবে রক্ষা করে দ্বীন শেখা ও শেখানোর জন্য মহিলাদের দূর দুরান্তে সফর করা জায়েয ও প্রশংসনীয়। (ফতোয়ায়ে উসমানী: ১/২৪২,ফতোয়ায়ে মাহমুদীয়া: ৫/১৪২,আহসানুল ফাতাওয়া:৮/৫৯)
সমালোচনা – ৯
তাবলীগ জাহেলদের কাজ নয়
আরেকটি প্রশ্ন হল, তাবলীগ তো ওলামায়ে কিরামের কাজ। জাহেলরা তা নিয়ে মাথা ঘামাবে কেন?
বস্তুত তাবলীগ আর ওয়াজ দুটি ভিন্ন ব্যাপার। এ দুটির মাঝে পার্থক্য না জানাই এ প্রশ্নের মূল উৎস। ওয়াজ হল কোরআন ও হাদীসের আলোকে স্বীয় আলোচনা পরিবেশন করা যা অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজ। এর জন্য আলেম হওয়া আবশ্যক, যাতে কোরআন- হাদীসের পরিপন্থী কোন তথ্য পরিবেশিত না হয়।
অপর দিকে তাবলীগ হল কোনো নির্দিষ্ট বিষয় কে অন্যের কাছে পৌঁছে দেয়া মাত্র। আর শুধু এইটুকুর জন্য শুধু সে বিষয় সম্পর্কে ইলম থাকাই যথেষ্ট। কারণ সে ঐ বিষয়ের আলেম। এ কারণেই বিজ্ঞ আলেম মুরু্িব্বদের শিক্ষা দেয়া বিষয়ের বাহিরে তারা কথা বলে না। হাঁ আলেমের বিষয়টি স্বতন্ত্র,সুতরাং আকাবীরদের মধ্যে যাঁরা তাবলীগের জন্য আলেম হওয়ার শর্তারোপ করেছেন তারাঁ তাবলীগের ব্যাপক অর্থ নিয়ে শর্ত করেছেন।
অন্যথায় বর্তমান প্রচলিত তাবলীগে এ প্রশ্ন অর্থহীন। কেননা ,এতে শুধু সীমিত ছয়টি বিষয়ের উপর আলোচনা করা হয় এবং এ ছয়টি বিষয়ের মশক করানো হয় আর এ পয়গাম নিয়েই দেশ-বিদেশে সফর করানো হয়। এ কারণেই তাদের সকল বয়ানই এ ছয় উসুলের উপরে সীমাবদ্ধ।
হযরত হাকীমূল উম্মত থানবী র. বলেন, শরীয়তের দ্ব্যর্থহীন ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদিতে তাবলীগের জন্য আলেম হওয়া শর্ত নয়; বরং যে কোন ব্যক্তি এর প্রচার প্রসার করতে পারে।। অবশ্য ইলম ও ইজতিহাদি বিষয়ে আলোচনা করা শুধু মাত্র আলেমদের কাজ । সাধারণ মানুষ এসব বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে নিঃসন্দেহে ভুল করবে । (্আনফাসে ঈসা)
হাদীস শরীফে এবং সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্যে এর বহু প্রমাণ মিলে। যেমন নবী করীম সা. বিদায়ী হজ্বের সময় ঘোষণা করেছিলেন
الا فليبلغ الشاهد الغائب.
উপস্থিত সকলেই যেন অনুপস্থিতদেরকে (আমার বাণী) পৌছে দেয়। (বুখারী শরিফ : ১/১৬)
অথচ তখন তাঁর সামনে সোয়া লক্ষ সাহাবী ছিলেন। যাদের মধ্যে নিশ্চই সকলে আলেম ছিলেন না।
ইমাম বুখারী র. তাঁর সহীহ গ্রন্থে একটি শিরোনাম নিয়ে এসেছেন। তা হলো-
رب مبلغ اوعي من سامع.
অর্থাৎ অনেক স্বল্প জ্ঞানের অধিকারী অপেক্ষাকৃত অধিক জ্ঞানের অধিকারীর কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়ে থাকে। (বুখারী শরিফ:১/১৬)
এ ক্ষেত্রে কেউ এ আপত্তিও করেন যে, তাবলীগে এমন অনেক মূর্খ লোক আছে যারা নিজেরাও অনেক গুনাহের মধ্যে লিপ্ত।
সুতরাং তারা কীভাবে অন্যকে দাওয়াত দিতে পারে ?
এর জবাব হল, এমন ব্যক্তি তার তাবলীগের কারণে সাওয়াবের অধিকারী হবে আর ব্যক্তিগত গুনাহের কারণে গুনাহগার হবে। মুসলিম শরিফের টিকায় উল্লেখ আছে-
قال العلماء ولايشترط في الامر والناهي ان يكون كامل الحال………الخ
পুরো বাক্যটির সারমর্ম হলো, সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের জন্য নিজের পুরোপুরি সঠিক থাকা আবশ্যক নয়। বরং দায়িত্ব হল দু‘টি। নিজেকে পরিশুদ্ধ করা ও অন্যকে পরিশুদ্ধির চেষ্টা করার নিয়ত ও আগ্রহ থাকা । (মুসলিম :১/৫১)
সাধারণ মুসলমানের জেনে রাখা উচিৎ, শরীয়তের আহকামের তাবলীগ করা শুধু আলেম সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নয়; বরং প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। আহকাম সংক্রান্ত যতটুকু ইলম অর্জিত হয়েছে তা অন্যের নিকট পৌঁছে দেয়ার দ্বায়িত্ব সকলের। যেমন নামায যে ফরয এ কথা কারো অজানা নেই। সুতরাং বে-নামাযীকে নামাযের জন্য সতর্ক করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। অবশ্য ওয়ায ও তাফসিরের সুরতে তাবলীগ করা সাধারণ লোকদের জন্য অনুচিত। কেননা এ দায়িত্ব ওলামায়ে কেরামের । সাধারণ ব্যক্তির এতে ভুলের আশঙ্কাই বেশী। তাই সাধারণ লোকদের উচিৎ ওয়ায না করে শুধু নসীহতস্বরূপ একে অপরকে শরীয়তের আহকাম জানিয়ে দেয়া। কমপক্ষে এটুকু করা সমাজ সংস্কারের জন্য অপরিহার্য।
সমালোচনা -১০
জামাতে যাওয়ার ব্যাপারে জোর করা
আরেকটি অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে, তাবলীগ জামাতের লোকেরা জামাতে বের হওয়ার ব্যাপারে জোর জবরদস্তী করেন।
এর জবাব হল, জোর জবরদস্তী আর পীড়াপীড়ি ও অনুনয়-বিনয় এ দুয়ের মাঝে বেশ তফাত আছে। তাবলীগিরা জোর- জবরদস্তী করেনা, করে শুধু অনুনয় বিনয়।
তদূপরি তাবলীগের উসূলে যদিও জবরদস্তী করার নিয়ম নেই। তবে দীনের কাজের ব্যাপারে সামর্থ্য অনুযায়ী জোর জবরদস্তী হলেও তাতে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ কোরআনের বাণী; لااكراه في الدين.
দীনের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি নেই । (সুরা বাকারাহ :২০৬)
এটা তো কাফেরদের বেলায় প্রযোজ্য। মুসলমানের ব্যপারে নয়।
হাদীসে এসেছে;
من رأي منكم منكرا فليغيره بيده فان لم يستطع فبلسانه فان لم يستطع فبقلبه …….الخ
অর্থাৎ কোনো অবৈধ কাজ হতে দেখলে যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে হাতে (বল প্রয়োগের মাধ্যমে) বাধা প্রদান করবে। এর সামর্থ না থাকলে মুখে (ধমক দিয়ে) বাধা দিবে। এতটুকুরও সামর্থ্য না থাকলে অন্তরে ঘৃণা করবে। আর এটা ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।
(মেশকাত :৪৩৬ হা: ৫১২৯)
বুখারী শরীফের হাদীসে রয়েছে নবী করীম সা. ইরশাদ করেন-
مثلي كمثل رجل استوقد نارا……(مسلم: باب شفقته علي امته ومبالغته فيه)
অর্থাৎ আমার দৃষ্টান্ত হল, যেমন কোনো ব্যক্তি অগ্নি প্রজ্জলিত করলো এবং অগ্নি যখন বেশ উজ্জল হয়ে উঠলো, কীট- পতঙ্গগুলো তাতে এসে পড়তে লাগলো। আর লোকটি সেগুলোকে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সেগুলো বলপূর্বক অগ্নিতে ঢুকে পড়তে থাকে । অনুরূপভাবে আমি তোমাদেরকে কোমর ধরে অগ্নি থেকে সরাচ্ছি আর তোমরা তাতে ঢুকেই চলেছ ।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বে-নামাযীও বদদ্বীনরা জাহান্নামের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর তাবলীগী ভাইরা তাদেরকে জাহান্নাম থেকে টেনে আনছে। এটাও কি কোন অন্যায়।
আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
افنضرب عنكم الذكر صفحا ان كنتم قوما مسرفين.
আমি কি তোমাদের থেকে এ নসিহতনামা প্রত্যাহার করিনি, এ কারণে যে, তোমরা সীমাতিক্রমকারী? (অর্থাৎ তোমরা গ্রহণ কর আর না করো, আমি বরাবর নসিহত করেই যাবো। (সুরা যুখরুফ- ৫)
আল্লাহকে যারা ভুলে গিয়েছে, শরীয়তকে যারা উপেক্ষা করে বসে আছে, তারা বিরক্ত হবে, শুধু এই অজুহাতেই আমরা তাবলীগ ছেড়ে দিব? আমাদের তো লক্ষ্য হবে আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা। তার সন্তুষ্টিই হবে আমাদের একমাত্র কাম্য।
কয়েকটি জরুরী প্রশ্ন ও তার উত্তর
প্রশ্ন: তাবলীগের ভাইয়েরা বলেন যে, দীনের কাজে মাশওয়ারা করা ওয়াজীব আর দুনিয়াবী কাজে মাশওয়ারা করা সুন্নত।
উত্তর: মাশওয়ারা কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মাশওয়ারা মৌলিকভাবে সুন্নাহ হলেও যে বিষয়ে মাশওয়ারা করা হচ্ছে তার ভিন্নতায় হুকুমেও তারতম্য হবে।
তবে কুরআন সুন্নাহর অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ে মাশওয়ারা করা বৈধ নয়। যেমন : নামায , রোযা, ইত্যাদি আদায়ের ক্ষেত্রে।
সুতরাং প্রশ্নে বর্ণিত যে, ‘দীনী বিষয়ে মাশওয়ারা করা ওয়াজিব আর দুনিয়াবী বিষয়ে মাশওয়ারা করা সুন্নাত’। কথাটি সহীহ নয় বরং ঐ সকল বিষয়ে মাশওয়ারা করা সুন্নাত যার সুস্পষ্ট সমাধান শরীয়তে পাওয়া যায় না। চাই তা দ্বীনী বিষয়ে কিংবা দুনিয়াবী । আর রাষ্ট্রীয় যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সর্বসাধারণের সাথে সম্পৃক্ত এবং বিষয়টি গবেষণালব্ধ বা ইজতিহাদী, তা বিজ্ঞজনদের সাথে মাশওয়ারা করে আঞ্জাম দেয়া ওয়াজিব।
প্রশ্ন: তারা বলেন যে, হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, রাসূল স. হাউজে কাউসারের পানি পান করানোর পর দীনের দায়ীদের সাথে মুয়ানাকা বা কোলাকোলি করবেন। অন্যদের সঙ্গে নয়।
উত্তর : সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে,‘কিয়ামতের দিন রাসূল স. যখন হাউজে কাউছারের পানি পান করাবেন, কিছু লোক আসবে যারা ধর্মের মধ্যে রদবদল করেছিলো তাদের পান না করিয়ে দূরে সরিয়ে দিবেন। যারা দীনের উপর অটল ছিলো তাদের পান করাবেন।
কিন্তু হুজুর সা. দায়ীদের সাথে কোলাকুলি করবেন মর্মে কথিত উক্তির সপক্ষে সাধ্যমতো খোঁজাখুজির পরও কোনো হাদীস পাওয়া যায়নি। বিধায় বয়ানের মধ্যে এমন উক্তির উল্লেখ পরিহারযোগ্য।
প্রশ্ন: এবং জামাত চলাকালীন বাদ মাগরিব আওয়াবিন নামায পড়তে চাইলে বলে যে, বাদ মাগরিব বয়ান ইজতেমায়ী আমল আর আওয়াবিন ইনফিরাদী আমাল। ইজতেমায়ী আমাল ছেড়ে ইনফিরাদী আমাল নিষেধ, এবং তারা উদাহরণ দিয়ে থাকে ইজতেমায়ী আমল সমুদ্্েরর পানি সমতুল্য আর ইনফিরাদী আমল সমুদ্রের মধ্যে আঙ্গুল ডুবালে আঙ্গুলের মাথায় যে পানি থাকে তা সমতুল্য । মোটকথা তারা আওয়াবীনকে ছেড়ে বয়ানে বসতে বলে।
উত্তর: নফল পড়ার সর্বোত্তম স্থান হলো ঘর । তবে কেউ যদি মসজিদে আদায় করতে চায় তাকে বাধা দেয়া যাবে না। বা এমন কোনো কাজ করা যাবে না যাতে নামায আদায়ে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। সুতরাং প্রশ্নে বর্ণিত সূরতে আওয়াবিন পড়তে ইচ্ছুকদের বাসায় পড়াই উত্তম। তবে যদি মসজিদে পড়ে তাহলে তাবলিগী ভাইয়েরা তাদের বাঁধা দেয়া বা নামায পড়তে অসুবিধা হয় মতো কাজ করা বৈধ হবে না। আর তাবলীগের ভাইয়েরা যে বলেন, ‘মাগরিবের পর আওয়াবিন ইনফিরাদী আমল বয়ান ইজতিমায়ী আমল। তাই ইজতিমায়ী আমল বাদ দিয়ে ইনফিরাদী আমল নিষেধ’। এ কথা বলা শরিয়তবিরোধী। কেননা সাধারণত ইজতিমায়ী আমল ইনফিরাদী আমল থেকে উত্তম হলেও সর্বক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়। বরং যে সকল ক্ষেত্রে শরিয়তে ইজতিমার প্রতি কঠোর গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং ইনফিরাদী আমলটি ইজতিমায়ী আমলটির জন্য অন্তরায় হয়ে, সে ক্ষেত্রে ইজতিমায়ী আমল একাকী আমল থেকে উত্তম। আর বাদ মাগরিব আওয়াবিন আদায় করেও বয়ান করা সম্ভব । আওয়াবিন বয়ানের অন্তরায় নয়। তাই বর্ণিত অবস্থায় আওয়াবিন ইত্যাদি বয়ান থেকে উত্তম।
প্রশ্ন: তারা আমীরের আনুগত্যের কথা বলতে গিয়ে দলীল পেশ করেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ
অর্থাৎ তারা বলে যে, َأُولِي الْأَمْر হলো জামাতের আমীর। চাই সে আলেম হোক বা জাহেল তোমরা তার আনুগত্য করো।
উত্তর: প্রশ্নোক্ত আয়াতে ‘উলূল আমর’-এর ব্যাখ্যা অধিকাংশ উলামাদের মতে ‘বিজ্ঞ আলেম, ফকিহ যারা কুরআন সুন্নায় গবেষণার ক্ষমতা রাখেন, কোনো কোনো মুফাসিসরদের ব্যাখ্যা মতে তা ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত। তাতে তাবলিগের আমীরকেও বিজ্ঞ আলেম বা আমল হওয়ার শর্তে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। সুতরাং উলূল আমরের অনুকরণ কুরআন সুন্নাহ মোতাবেক হওয়ার শর্তে কেবল বিজ্ঞ আলেম আমীরের ক্ষেত্রে জরুরী বলা যায়। সব ধরনের আমীরের ক্ষেত্রে এ হুকুম বলবৎ নয়।
প্রশ্ন: তারা বলে ‘মসজিদ থেকে একটি ময়লা বাহির করা মানে একটি মরা গাধা বাহির করা এবং একটি ময়লা ঢুকানো মানে একটি মরা গাধা ঢুকানো’ এ উক্তিটি হাদীস কি না?
উত্তর: প্রশ্নে উল্লিখিত উক্তিটির স্বপক্ষে হাদীসের কিতাবে সাধ্যমতো খোঁজাখুঁজি করার পরও কোনো প্রমাণ মিলেনি। মসজিদের আদব সম্মানের উপর ফিকাহ-হাদীসে বিশাল অধ্যায় থাকার পরও এ ধরনের উক্তি অনুপস্থিত তাই এ জাতীয় কথা পরিহারযোগ্য।
প্রশ্ন: জামাতের ভাইদের বলতে শুনা যায় তারা বলেন, যে এলাকায় দীনের জামাত প্রবেশ করে সে এলাকার কবরের আযাব চল্লিশ দিনের জন্য মাফ হয়ে যায়। এ কথাটি সঠিক কি না এবং তা হাদীস কি না?
উত্তর: প্রশ্নে বর্ণিত উক্তিটি হাদীসের কোনো কিতাবে পাওয়া যায়নি। তবে এর কাছাকাছি অর্থে আরেকটি বাক্য মাউযুআতের কিতাবে পাওয়া যায়। ‘যে এলাকা দিয়ে দীনি ইলম অর্জনকারী গমন করে ওই এলাকার কবরের আযাব ৪০দিনের জন্য স্থগিত করা হয়।’ এটি হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও বাস্তবে রাসুল স. থেকে বর্ণিত কোনো গ্রহণযোগ্য হাদীস নয়। বরং জাল হাদীসের অন্তর্ভুক্ত বলে মুহাদ্দিসদের মত। তাই তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
প্রশ্ন: প্রচলিত তাবলীগ জামাতে ৩দিন, ১চিল্লা, ৩চিল্লা, ১সালকে অনেকে বিদআত বলে থাকেন, এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদীসের আলোকে মতামত জানতে চাই।
উত্তর : যেসব কাজ শরীয়তের চার দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়, বা রাসূল স. সাহাবা তাবেঈন, তাবে তাবেঈনের যুগে তার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। অথচ পরবর্তিতে তা ধর্মের কাজ বা দীনের অংশ মনে করা হয়, তাকেই বিদআত ব্েল। আর যেসব কাজের অস্তিত্ব ইসলামের স্বর্ণযুগে ছিলো এবং চার দলীল দ্বারাও প্রমাণিত, তাতে কমবেশী , সংযোজন বিয়োজন ব্যতীত ঠিক সে মোতাবেক অনুুকরণ করা হলে এগুলোকে সুন্নাত প্রকারান্তে মুস্তাহাব বরা হয়। পক্ষান্তরে যেসব কাজ, ইসলামের সোনালী যুগে ছিলো না এবং শরীয়ত কর্তৃক তার নিষেধাজ্ঞাও আসেনি, তবে পরবর্তিতে তা ধর্মীয় কাজ বা দীনের অংশবিশেষ নয়, বরং দীনের সহায়ক বা দ্বীন সংরক্ষণের একমাত্র উপায় বা মাধ্যম হিসেবে করা হয়। এগুলো সুন্নাতও নয়, বিদআতও নয়। বরং কাজের ব্যবধানে কোনটি মোবাহ (জায়েয), কোনটি ফরজে কিফায়া, আর কোনটি ওয়াজিব (লিগায়রিহী) হিসেবে গণ্য হয়।
দাওয়াত তাবলীগ (আমর বিল মারুফ নাহী আনিল মুনকার) কুরআন হাদীসের নির্দেশিত বিধান। রাসূল স. ও সাহাবাগণের যুগসহ সর্বকালের অতিগুরুত্বপূর্ণ আমল। তবে তার পদ্ধতি ও পন্থা যুগের পরিবর্তন ও মুসলিম উম্মাহর অবস্থার ব্যবধানে বিভিন্নরূপে তা পালিত হয়ে আসছে। এর মধ্যে হযরত ইলিয়াছ র.-ও একটি পথ পন্থার সূচনা করেছেন। এ পথ পদ্ধতিতে দাওয়াতের কাজটি ফলপ্রসূ ও বড় সহায়ক বলে সকলের ধারণা। বাস্তবতাও তাই।
পন্থাটি ধর্ম বা দীনের কোনো অংশ বিশেষ নয়। বিধায় ফিকাহবীদদের ঐক্যমতে দাওয়াত ইলাল্লাহ দীনের অংশ এবং ফরজে কিফায়া। তবে ইলিয়াছ র.-এর আবি®কৃত পন্থা-পদ্ধতিতে তা করা সুন্নাত, ওয়াজিব, বা ফরয এমনটি নয়; বরং উক্ত পদ্ধতিতে দাওয়াতের মতো দীনের গুরুত্বপূর্ণ অংশকে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুযোপযোগী বড় সহায়ক মাত্র। এ পদ্ধতির বিভিন্ন কর্মপন্থার মধ্যে রয়েছে তিন দিনের জন্য ঘর সংসার ত্যাগ করে দ্বীন শেখার জন্য বের হওয়া, চিল্লা লাগানো, সাল লাগানো ইত্যাদি দ্বীন শেখার বিভিন্ন কোর্সস্বরূপ মাত্র।
অতএব, তিন দিন, চিল্লা, সালের জন্য দ্বীন শেখার প্রচারে বের হওয়া দীনের অংশ সাব্যস্ত না হওয়ায় বিদআতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
উপরোক্ত এসব কর্মপন্থাগুলির পিছনে রয়েছে কুরআন হাদীসের বহু সমর্থন। যেমন: তিন দিন জাবালে ছাওরে (নুরে) রাসূল স.-এর আত্মগোপন, চল্লিশটি হাদীস হেফজ করা ও চল্লিশ ওয়াক্ত নামায তাকবীরে উলার সাথে আদায় করার ফযিলত, প্রতি চল্লিশ দিনে মানব সৃষ্টির স্তর পরিবর্তন , তুর পাহাড়ে হযরত মুসা আ.-এর চল্লিশ দিন অবস্থান, হযরত মুসআব বিন উমায়ের রা.কে ইসলাম শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে এক বছরের জন্য মদীনায় প্রেরণ ইত্যাদি। এসব দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে যে, এ সংখ্যাগুলোতে মানুষের গুণ পরিবর্তনের বিশেষ কারণ বিদ্যমান। এর অনুসরণের মাধ্যমে দাওয়াতি কাজকে ফলপ্রসূ করে তোলাই কর্মপন্থাগুলোর মূল লক্ষ্য।
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, কোনো কাজ ধর্মের বা দীনের অংশ হিসাবে করা, অথচ তা চার দলীলে প্রমাণিত নয়, স্বর্ণযুগেও ছিলো না। তার নাম বিদআত। আর চিল্লা দেয়া, সাল লাগানো, তিন দিনের জন্য দাওয়াত তথা দ্বীন শেখার জন্য বের হওয়া তার অংশ বিশেষ না হওয়ায় ফরয, ওয়াজিব, কিংবা সুন্নাত নয়; বরং নিজের গুণগতমান উন্নয়নের ব্যবস্থাস্বরূপ। যা দীনের বড় সহায়ক মাত্র।
যখন এগুলো ফরয , ওয়াজিব , সুন্নাতের অন্তর্ভুক্তই না এবং তা মনে করাও হয় না; তাই এগুলোকে বিদআত আখ্যা দেয়া শরীয়ত ও ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও মুর্খতা বৈ আর কী ? [সুরা আল ইমরান : ১০৪, সুরা বাকারা : ৫১, বুখারী শরীফ : ২/৯৭৬, হায়াতুস সাহাবা : ১/১৩৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ৩/১৮৩, ফাতওয়ায়ে মাহমুদিয়া : ৫/৩৩, ফাতওয়ায়ে হক্কানিয়া : ২/৪৪১]
শেষ কথা
তাবলীগ জামাত শুধু কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ইসলাহের জন্য নয়, বরং সম্পূর্ণ দীন জীবিত করা এবং গোটা মুসলিম উম্মাহর সংস্কারের জন্য।
আজকের দুনিয়ায় বহু আন্দোলন চলছে , তাবলিগও একটি আন্দোলন, একটি অনন্য আন্দোলন, যার কোনো তুলনা নেই। এতে কোনো ফিৎনা-ফ্যাসাদ, হৈ-হুল্লা নেই। এমন কেউ শুনেনি যে, কোথাও কোনো জামাত বিদ্রোহ করেছে। এতে না রয়েছে কোনো পদ,না কোনো কুরসি, না কোন মসনদ; বরং এখানে দীনের জন্য নিঃস্বার্থে নিজের জান-মাল ব্যয় করতে হয়।
এ যুগে দীনের হেফাজতের জন্য এ আন্দোলন একটি সুদৃড় আশ্রয়স্থল। বর্তমানে মুসলমানদের জন্য ৩টি আশ্রয়স্থল রয়েছে,
প্রথমটি হল দীনী মাদরাসা তথা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ।
দ্বিতীয়টি হচ্ছে, হকপন্থি পীর মাশায়েখদের খানকা।
তৃতীয়টি হচ্ছে এই তাবলীগ জামাত।
তবে এ কথা জেনে নিতে হবে যে দাওয়াত ও তাবলীগ যা কুরআন হাদীসের নির্দেশ তা ফরযে আইন নয়; বরং ফরযে কিফায়া। এবং তা প্রচলিত তাবলীগের সাথে নির্দিষ্ট নয়। যে কোন পন্থায় দাওয়াতের কাজ করা যায়। তবে প্রচলিত তাবলীগ যুগোপযোগী সহজ ও অধিক উপকারী এবং এ তাবলীগ জিহাদবিরোধী নয় বরং নিরব এক অনন্য সংস্কার আন্দোলন এবং জিহাদের ক্ষেত্র প্রস্তুতকারী। তাবলীগে আলেমদের অংশগ্রহণ অতিব জরুরী। এতে বিশ্ব জয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনা বিদ্যমান। একথা অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই, নবী রাসূল ছাড়া কেউ নিষ্পাপ নয়। কোনো দল বা সংগঠন যতই উন্নত কর্মসূচির ধারক বাহক হোক,তারা সমালোচনার উর্ধ্বে নয়। সুতরাং তাবলীগ জামাতের সাথীদেরও যে কোনো ভুল-ত্র“টি নেই এমনটি মোটেই নয়। এমনটি তাবলীগ জামাতের মুরুব্বিদের কেউ দাবী করেননি।
বিশেষত: যখন এ জামাতের অধিকাংশই নতুন নতুন সাথী এবং গ্রাম্য অশিক্ষিত ও অজ্ঞ। হযরত ইলিয়াস র. এর বক্তব্য মতে এতো ধোপাখানা। এতে নোংরা অপবিত্র কাপড় সবই রয়েছে। সুতরাং তাদের ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এও সত্য যে, এ ভুল ত্র“টিগুলো সংশোধন করার জন্য মারকায থেকে সর্বদা চেষ্টা করা হচ্ছে। তারপরও কিছুটা ভুলত্র“টি অবশ্যই থেকে যায়, সেটা সংশোধন করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে গোটা জামাতকে অভিযুক্ত করা এবং সমালোচনার ক্ষেত্র বানিয়ে নেয়া মোটেই সমীচিন নয়।
আল্লাহ তায়ালা সকলকে হক কথা বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।
Leave Your Comments