তারাবীহর নামায সুন্নাত। গোটা ইসলামী দুনিয়ায় রাসূল স. সাহাবাদের স্বর্ণযুগ থেকে চলে আসা নীতি অনুযায়ী সব জায়গায় সর্ব যুগে সকল মসজিদে তারাবীহ ২০ রাকাত এবং বিতর তিন রাকাতই পড়া হয়েছে। মাঝখানে ইমাম মালেক র. এর যুগে এবং তার ভক্তদের কিছু যুগ পর্যন্ত ৩৬ রাকাত বা ৩৮ রাকাত পড়া হয়েছিল। তবে ২০ রাকাতের কম তারাবীহর নামায কখনো কোথাও পড়া হয়নি। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে ১২৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরবাদ থেকে একজন লা-মাযহাবী আলেম ২০ রাকাত তারাবীহকে বিদআত ও ৮ রাকাতকে সুন্নাত বলে ফতোয়া জারী করেন। ওলামাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই ফতোয়া অকার্যকর হয়ে গেলে তার এক বছর পর তাদের আরেকজন মাও. মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে উক্ত ফতোয়ার পুনরাবৃত্তি করেন। তার এ ফতোয়ার বিরুদ্ধে অন্যান্য আলেমদের পাশাপাশি লা-মাযহাবীদের বিখ্যাত আলেম মাও. গোলাম রাসূল ‘রিসালাতুত তারাবীহ’ (رسالة التراويح) নামক গ্রন্থ লিখে ফতোয়াটির দাঁতভাঙ্গা জবাবের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ গ্রন্থটি ১২৯০ হি. তে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলেম মাও. মুবারকপুরী, হাফেজ আব্দুল্লাহ প্রমুখ উক্ত ফতোয়াটিকে পূনরায় প্রচার ও প্রসার করতে গেলে লোকদের মধ্যে তারাবীহর রাকাতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। এদের প্রচারিত ফতোয়ার দলিল ভিত্তিক জবাব দিয়ে সব চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করেছেন ওলামায়ে দেওবন্দের অভিভাবকগণ। যথাক্রমে- আল্লামা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, আল্লামা কাসেম নানুতুবীসহ আরো অনেকে। এ বিষয়ে সর্বশেষ কলম ধরেন ভারতের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী র.।
কিন্তু চক্রান্তকারীরা থেমে নেই, স্বয়ং আরবের মাটিতেও কিছু আলেম এ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। যেখানে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র হারামাইন শরীফাইনে ১৪ শত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ২০ রাকাত তারাবীহ চলে আসছে। সে পবিত্র ভূমিতে সম্ভবত সর্বপ্রথম তারাবীহ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির জন্যে আট রাকাতের ফতোয়া জারি করেন ‘শেখ নসীব রেফায়ী’। তারাবীহ ৮ রাকাত প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। কিন্তু ওলামায়ে আরবের প্রতিবাদের মুখে সে ফতোয়াটিও টিকেনি। তাই উক্ত ফতোয়ার পক্ষে সমর্থনসহ জোরালো ভূমিকা রাখেন আরবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসীরুদ্দিন আলবানী র.। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত ফতোয়া ও তার সমর্থনকারী আলবানী সাহেবদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে আরব জাহানের কয়েক জন আলেম “আল ইসাবা ফিল ইনতেসার লিল খুলাফা-য়ির রাশিদীন ওয়াস সাহাবা” (الإصابة فى الانتصار للخلفاء الراشدين و الصحابة) নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব রচনা করেন। যেখানে উক্ত ফতোয়ার সকল দিক আলোচনা পূর্বক দলিল ভিত্তিক খণ্ডন করে ২০ রাকাত তারাবীহ সুন্নাত হওয়ার দালীলিক প্রমাণ পেশ করা হয় । এই কিতাবের ৬১নং পৃষ্ঠায় তারা লিখেছেন :
(ولم يشذ أحدهم عنها غير هذه الشرذمة القليلة التى ظهرت فى زماننا كاالشيخ ناصر و إخوانه.)
অর্থাৎ আমাদের যামানায় আত্মপ্রকাশ কারী নাসীরুদ্দিন আলবানী ও তার অনুসারীদের ক্ষুদ্র একটি দল ছাড়া আর কেউ অনুরূপ ফতোয়া দিয়ে (তারাবীহ ৮ রাকাত) উম্মত থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেন নি। অর্থাৎ এর পূর্বে কেউ ৮ রাকাতের মত ব্যক্ত করেননি; বরং সকল আলেম ফকীহ ২০রাকাতের উপর একমত ছিলেন। এরপর ১৩৭৭ ইং সালে আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেব আল ইসাবা কিতাবটির জবাবে تسديد الإصابة)) ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি বই রচনা করেন। এ বইতে তিনি ইনসাফ ভিত্তিক দলিল পেশ না করে উসূলে হাদীস, উসূলে ফিকাহ, রিজাল শাস্ত্র এবং জরাহ্ তা’দীল সম্পর্কিত সর্ব স্বীকৃত মূলনীতির ব্যাপারে স¤পূর্ণ অপরিপক্কতা ও দৈন্যতার আশ্রয় নিয়ে ২০ রাকাত তারাবীহর বিপক্ষে এবং আট রাকাতের পক্ষে যেভাবে কলম ধরেছেন তা তার মতো হাদীস বিশারদের পক্ষে কল্পনা করাও মুশকিল। এমন পক্ষপাতপুষ্ট হয়েও তিনি ইসলামের প্রায় সাড়ে বার শত বছরের ইতিহাস থেকে সাহাবা, তাবেয়ী ও সালাফে সালেহীনের ৮ রাকাত তারাবীহ পড়ার উপর একটি প্রমাণও পেশ করতে পারেননি। তেমনিভাবে এ দীর্ঘ ইতিহাসে একটি মসজিদও দেখাতে পারেননি যেখানে ৮ রাকাত তারাবীহ পড়া হতো বা হয়েছিল। তবে তিনি ওই পুস্তিকায় হযরত ইমাম মালেক র. এর দিকে ৮ রাকাতের বিষয়টি সম্পৃক্ত করে বসেন। অথচ মালেকী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্থ (المدونة) ‘আল মুদাওয়ানা’ কিতাবটি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যেতো যে, তিনি বিতরসহ ৩৯ রাকাতের তারাবীহ পড়তেন এবং তৎকালিন মদীনার গভর্নর তারাবীহর রাকাত সংখ্যা কমাতে চাইলে ইমাম মালেক তার অনুমতি প্রদান করেননি বরং নিষেধ করেছেন। (আল মুদাওয়ানা : ১/২০৮-১০)
আমার ধারণা, তিনি ইমাম মালেকের দিকে কথাটি সম্বোধন করার সময় জানতেন যে কথাটি গবেষণার কষ্টিপাথরে মোটেও টিকবেনা; কিন্তু নিজের পক্ষপাতিত্ব রক্ষার জন্য গায়ের জোরেই কথাটি চালিয়ে দিলেন। আর দলিল স্বরূপ ‘জুরী’ নামক এক শাফেঈ লোকের বরাত দিয়ে এ ভিত্তিহীন কথাটি উল্লেখ করলেন। যার সূত্রের ধারাবহিকতা ও কোন পরিচিতি নেই। বরং লোকটি মাজহুল (مجهول) এবং সনদ মুনকাতি’ (منقطع) যা অন্তত আলবানী সাহেব থেকে কল্পনা করা যায় না।
মোট কথা: ৮ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহ এর নামায নব আবিষ্কৃত সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেয়ী যুগ এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত কোন মুহাদ্দিস ও ফকীহ থেকে প্রমাণিত নয় যে আট রাকাতই যথেষ্ঠ, বিশ রাকাত বিদআত। বরং বর্তমান শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী যিনি আরব জাহানের শীর্ষ আলেম ও শাইখদেরও উস্তাদ তিনি ‘রাকাআতুত তারাবীহ’ (ركعات التراويح) নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন যে, ভারতবর্ষে ১২৮০ হি. এবং আরবের নসীব রেফায়ির পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বারশ বছরের ইতিহাসে আট রাকাত তারাবীহর উপর একটি প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেনা। তিনি তার কিতাবে প্রত্যেক শতাব্দীর উম্মার সম্মিলিত ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা (الأعمال المتوارثة) দেখিয়েছেন যে সব যুগে তারাবীহ বিশ রাকাতই ছিল। বিশ রাকাতকে বিদআত বা আপত্তি করার মতবাদ কোনো শতাব্দীতে ছিলনা। কিতাবটি প্রকাশ হয়েছে প্রায় অর্ধ শতবছর হয়ে গেলেও এ চ্যালেঞ্জের জবাব স্বয়ং আলবানীও দিতে পারেননি। আলবানী সাহেব তার বইতে যা কিছু লিখেছেন তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন সৌদি আরবের সুপ্রসিদ্ধ গবেষক শাইখ ইসমাঈল আন্সারী। তিনি বড় মূল্যবান একটি কিতাব রচনা করেন। যার নামই তার পরিচয়।
تصحيح أحاديث صلاة التراويح عشرين ركعة و الردعلى الألبانى فى تضعيفه
এ কিতাবে আলবানী সাহেব বিশ রাকাতের হাদীসকে অমূলকভাবে কলমের জোরে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা চালিয়েছেন তার দলিল ভিত্তিক জবার দিয়ে দৃঢ়ভাবে হাদীস সহীহ বলে প্রমাণ করেছেন। উপরন্তু আমার সরাসরি উস্তাদ মসজিদে নববীর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মাদীনার শরয়ী আদালতের কাজী শায়খ আতিয়্যা সালেম التراويح أكثر من ألف عام নামে একটি গ্রন্থ লিখে প্রমাণ করেছেন যে, হারামাইন শরীফাইনের ইতিহাসে কখনো বিশরাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়নি।
অন্য একজন বিখ্যাত আলেম আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আলী সাবুনীও এবিষয়ে التراويح عشرون ركعة নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব গ্রন্থের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন যে, উম্মতের সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা হতে প্রমাণিত বিশ রাকাত তারাবীহই সুন্নাত। এর উপরই সকলের “আমলে মোতাওয়ারাছাহ” প্রতিষ্ঠিত। আট রাকাতের বিষয়টি সাড়ে বারশত বৎসর পরে ভারতে উদ্ভব হয়। অতপর রেফায়ী ও আলবানীদের মাধ্যমে আরবেও এর প্রকাশ ও প্রচার ঘটে ।
লা-মাযহাবী বন্ধুরা ভেবে দেখুন! আপনারা কার অনুসরণে আজ মুসলিম উম্মার মাঝে এ নিয়ে ফিৎনা সৃষ্টি করছেন। উম্মতের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা কার উকালতি ?
দু’টি মৌলিক কথা
আলোচ্য বিষয়টি বুঝার জন্য দুটি কথা আলোচনা খুবই প্রয়োজন।
ক) প্রথম কথা: কুরআনুল কারীমের পর শরীয়তের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হচ্ছে সুন্নাহ। আর রাসূল স. এর শিক্ষা ও নির্দেশনাবলীকেই সুন্নাহ বলা হয়। এই সুন্নাহ কয়েক প্রকার –
১. রাসূল স. এর শিক্ষা ও নির্দেশনা অনেক সময় মৌখিকভাবে বর্ণনা হয় এবং পরষ্পরার মাধ্যমে আমাদের নিকট তা পৌঁছে থাকে। তখন এইসব মৌখিক বর্ণনাসূত্রে পাওয়া রেওয়ায়েতগুলোকে সুন্নাহর পাশাপাশি হাদীস বলা হয়। এর নাম- الحديث القولى কাওলি তথা মৌখিক হাদিস।
২. রাসূল স.-এর শিক্ষা ও নির্দেশনার মৌখিক বর্ণনাস্থলে অনেক সময় শুধু কর্মের ধারাবাহিকতায় আমাদের কাছে পৌঁছে থাকে অর্থাৎ রাসূল থেকে কর্মের মাধ্যমে সাহাবা রা. গ্রহণ করেছেন তাদের থেকে তাবেঈন এবং তাদের থেকে তাবে-তাবেঈন গ্রহণ করেছেন এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরী তার পূর্বসূরী থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে রাসূলর সে শিক্ষা ও নির্দেশনাকে গ্রহণ করেছেন। এটাকে আমলী হাদিস (الحديث العملى) বা সুন্নাতে মুতাওয়ারিছা বলা হয়।
উল্লেখ্য, যেসব বিষয় কর্মের মাধ্যমে পৌঁছেছে, তা অনেক সময় রাসূলর মৌখিক বর্ণনাসমূহে হয়তো পাওয়া নাও যেতে পারে বা পাওয়া গেলেও সে মৌখিক বর্ণনাটি সূত্রের দিক দিয়ে ‘যয়ীফ’ও হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে উক্ত নবীজির শিক্ষার এধারাটি সাধারণ মৌখিক বর্ণনা ধারার তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে থাকে এ কারণে মৌখিক বর্ণনায় তা পাওয়া না গেলে বা যয়ীফ সূত্রে পাওয়া গেলে তা কখনো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
৩. সুন্নাহ তথা নবীর শিক্ষা ও নির্দেশনার একটি অংশ এমনও আছে যা আমাদের নিকট সাহাবাদের রা. শিক্ষা নির্দেশনার মাধ্যমে সংরক্ষিত তবে বিষয়টির ভিত্তি কিয়াস ও ইজতিহাদের উপর নয় বরং রাসূল স.-এর কোনো মৌখিক বর্ণনা বা কর্মধারাই তার ভিত্তি। সাহাবাগণ তার এধারা থেকেই তা গ্রহণ করেছেন কিন্তু অন্যকে তা শিখানোর সময় সাহাবাগণ এর উদ্ধৃতি দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ প্রেক্ষাপট থেকেই একথা স্পষ্ট ছিল যে তারা রাসূলর শিক্ষা নির্দেশনার (সুন্নাহ) ভিত্তিতেই এ বিষয়টি অন্যকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমন সুন্নাহকে مرفوع حكمي ‘মারফুয়ে হুকমী’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য এ মারফুয়ে হুকমীর ভিত্তি যেহেতু কোন কিয়াস বা ইজতিহাদ নয় বরং মারফুয়ে হাকীকী তথা স্পষ্ট মারফু হাদীসই তার ভিত্তি, কিন্তু এটা জরুরী নয় যে সে স্পষ্ট মারফু হাদীসটি সহীহ সনদে বিদ্যমান থাকবে। বরং হতে পারে তা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এ জাতীয় মারফুয়ে হুকমী হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করা স্পষ্ট মারফু দ্বারা দলিল পেশ করার নামান্তর। সুতরাং এর সনদ সহীহ হলে তার পিছনে কোনো সহীহ স্পষ্ট মারফু হাদীস আছে কি না তা দেখার প্রয়োজন নেই। মারফুয়ে হুকমী সহীহসূত্রে প্রমাণিত হওয়াই শরয়ী দলিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৪. নবীর শিক্ষা ও নির্দেশনার আরেকটি অংশ হচ্ছে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ (سنة الخلفاء) যার ব্যাখ্যা হচ্ছে, রাসূল স. ওহীর মাধ্যমে জেনে ছিলেন যে, খুলাফায়ে রাশেদার জারীকৃত সুন্নাহসমূহ অবশ্যই নবীর শিক্ষা ও নির্দেশনারই অনুগামী হবে। এবং এর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি বিদ্ব্যমান থাকবে। তাই রাসূল স. স্বীয় উম্মতকে ব্যাপক ও স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা দিয়ে যান যে –
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين . عضوا عليها بالنواجذ
“তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাতকে আঁকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং প্রাণপণ শক্ত করে ধরবে”। (ইবনে মাজা : পৃ.৫ নং ৪২)
সুতরাং যখন উম্মতের সামনে চার খলীফার যে কোনো খলীফার একটি সুন্নাত প্রমাণিত হয়ে যাবে, তখন তার অনুসরণের জন্য রাসূল উপরোক্ত ঘোষণাই যথেষ্ট। এর জন্য রাসূল স. থেকে স্বতন্ত্র কোনো দলিল/হাদীসের প্রয়োজন নেই। তাই খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষ।
এটাকে দলিলস্বরূপ গ্রহণ করতে এ কথা ভাবার প্রয়োজন নেই যে তাদের এই সুন্নাতের ভিত্তি কী ? তারা এটা নবীজীর কোন শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন ?
খ. দ্বিতীয় কথা : শরীয়তের একটি বিশেষ উৎসের নাম ইজমা। এর বিভিন্ন প্রকার ও ধরণ আছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক সহীহ ও শক্তিশালী প্রকার হচ্ছে ‘ইজমায়ে সাহাবা’ (إجماع (الصحابة। এই ইজমা যদি ব্যাপকভাবে অবিচ্ছিন্ন এবং সম্মিলিতরূপে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে তবে তা শরীয়তের অনেক শক্তিশালী ও অকাট্য দলিল হিসেবে গন্য করা হবে। কোন বিষয়ে এধরণের দলিল বিদ্যমান থাকলে তা অনুসরণ ও পালনের ক্ষেত্রে অন্য কোন দলিলের প্রয়োজনই পড়েনা।
উল্লেখ্য, ইজমা শরীয়তের এমন দলিল যার ভিত্তি অবশ্যই রাসূল স. এর শিক্ষা নির্দেশনার উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে তা অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। কেননা শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলিল বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং বর্ণিত হয়েছে যে যাদের মাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় এরা কখনো গোমরাহীর উপর একমত হতে পারে না। বিশেষ করে তারা যদি আনসার মুহাজির সাহাবা বা আশারায়ে মুবাশ্শারা হন।
স্বয়ং কুরআনে তাদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে, যারা তাদের পথ থেকে বিমুখ হবে তারা জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত হবে।
প্রিয় পাঠক, আমাদের আলো”্য বিষয় (তারাবীহর রাকাত সংখ্যা) উপরোক্ত সকল শরয়ী দলিল দ্বারাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। তারাবীহর রাকাত সংখ্যা বিশ এর পক্ষে প্রমাণিত দলিল সমূহ-
১. মারফুয়ে হাকীকী তথা স্পষ্ট মারফু হাদীস।
২. মারফুয়ে হুকমী। ৩. খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। ৪. মুহাজিরীন ও আনসার সাহাবীগনের ইজমা। ৫. সুন্নাত মুতাওয়ারাসাসহ সব প্রকারের দলিল দ্বারা তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। যারা তা অমান্য করবে, বিদআত বা ভিত্তিহীন মনগড়া বলে মন্তব্য করবে তারা যে শরীয়ত, কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা সবই অমান্য করলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমীন ॥
প্রথম অধ্যায় :
২০ রাকাত তারাবীহর দলিলসমূহ
মারফু হাদীস-
ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা স্বীয় কিতাব ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা’তে উল্লেখ করেন:
حدثنا يزيد ابن هارون قال آخبرنا ابراهيم بن عثمان ، عن ابن عباس رضي الله عنه أن رسول الله صلي الله عليه وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة و الوتر ،، (مصنف لابن أبي شيبة ২৮৮/২)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. সূত্রে বর্ণিত রাসূল স. রমযান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতর পড়তেন।
এ হাদীসটি বায়হাকী (খ. ২ প.৪৯৬)। ইমাম তাবরানীর আল-মুজামুল কাবীর (খ:১১ পৃ:৩১)। আল-আওসাত তাবরানী (খ:১ পৃ:৪৪৪)। আল ইসতিযকার (খ:৫ পৃ: ১৫৬) ইত্যাদি সহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য বহু কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে রাসূল স. এর তারাবীহর নামায বিশ রাকাত ছিল।
হাদীসটির মান ঃ একদল মুহাদ্দিস এ হাদীসের সনদকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন। কেননা, এর সনদে إبراهيم بن عثمان ‘ইব্রাহীম বিন উসমান’ নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, যিনি দুর্বল। তবে তিনি চরম দুর্বল বা মাতরুক (পরিত্যাজ্য) নন।
কিন্তু আমাদের জানা মতে সাড়ে বারশত বছর যাবত হাদীসটিকে কেউ মাউযু (জাল) বলেননি। বর্তমানে লা-মাযহাবী বন্ধুরা এ হাদীসটি দেখা মাত্র মাওযু বা জাল আখ্যা দিয়ে থাকেন। আর অনুসন্ধানে দেখা গেছে এ বন্ধুরা তাদের মত-পথের বিপরীত হাদীস সহীহ হলেও বলবেন যয়ীফ। তাই তাদের কথা মানা যায় না। আর হাদীসটি আসলে যয়ীফ হলেও জাল/মাওযু বলতে তারা দ্বিধা করে না। এটাই তাদের হাদীস নিয়ে চাতুরী। অথচ যয়ীফ ও জালের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। কেননা জালতো হাদীসই না বরং চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন কারণে নিজেরা বানিয়ে হাদীসের নামে চালিয়ে দিয়েছে। আর যয়ীফ মানে হলো হাদীসটি বানানো না। তবে বর্ণনা সূত্রে দুর্বলতা পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে- যয়ীফ হাদীস ২০ রাকাত তারাবীহর ক্ষেত্রে দলিল হয় কী করে ?
উত্তর ঃ সহীহ যয়ীফ এগুলো হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা। মুহাদ্দিসগণের মূলনীতি বুঝা ছাড়া এগুলোর মাহাত্ব বুঝা বড় কঠিন। দেখুন, যে মুহাদ্দিসগণ এটাকে যয়ীফ বলেছেন তাদেরই মূলনীতিতে যয়ীফ হাদীস দু’প্রকার।
ক) হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি সারমর্ম ও বক্তব্য শরীয়তের দৃষ্টিতেও আপত্তিকর। কারণ এ বক্তব্যের অনুকুলে শরয়ী কোন দলীলের সমর্থন তো নেই-ই বরং এর বিপরীতের দলিল পাওয়া যায়।
খ) হাদীসটি যয়ীফ সনদে বর্ণিত হলেও তার বক্তব্যের সমর্থনে অন্যান্য দলিল প্রমাণ বিদ্যমান। বিজ্ঞ মুহাদ্দিস ও সকল ফকীহর সিদ্ধান্ত হলো এ ধরণের হাদীস সনদ ও সূত্রের দিক থেকে যয়ীফ হলেও বক্তব্য ও মর্মের বিচারে কিন্তু সহীহ ও সঠিক। অতএব, আমাদের আলোচ্য হাদীসটিকে একদল মুহাদ্দিস যয়ীফ তো বলেছেন। কিন্তু কোন্ প্রকারের যয়ীফ তার উল্লেখ নেই। আমরা সামনে আলোচনা করবো (ইনশাআল্লাহ)। উক্ত হাদীসের সমর্থনে মারফুয়ে হুকমী, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত, ইজমায়ে সাহাবা এবং সুন্নাতে মুতাওয়ারাছার মত বহু শক্তিশালী প্রমাণাদি বিদ্যমান রয়েছে। তাই শাস্ত্রীয় পরিভাষায় এ ধরণের যয়ীফকে الضعيف المتلقى بالقبول অর্থাৎ সনদের বিবেচনায় যয়ীফ তবে এর বক্তব্য ও মর্ম সাহাবা যুগ থেকে নিয়ে সকল উম্মতের আমলের মাধ্যমে অনুসৃত। এ পর্যায়ের হাদীসের ব্যাপারে হাদীস শাস্ত্রের অভিজ্ঞজনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- আমলের ক্ষেত্রে তা সর্বাধিক শক্তিশালী সহীহ হাদীস। যা সাধারণ মৌখিক সহীহ হাদীসের তুলনায় অনেক মর্যাদাবান।
একারণেই হানাফী ফকীহগণ হাদীসটিকে ২০ রাকাত তারাবীহর স্বপক্ষে দলিল স্বরূপ পেশ করেন।
লা-মাযহাবী বন্ধুগণ! আমাদের উপরোক্ত পর্যালোচনায় হয়তো নাক চিটকাতে শুরু করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, উপরোক্ত নীতিমালাটি আমরা আবিষ্কার করিনি; বরং এটি সকল হাদীস বিশারদ, ফকীহ ও উসুলীদের একটি সর্বস্বীকৃত নীতির উপর ভিত্তিশীল। আপনারা তা অমান্য করলে নিরেট অজ্ঞতার বহি:প্রকাশ ঘটবে। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি উক্তি উসূলে হাদীসের কিতাব থেকে তুলে ধরছি।
১. লা-মাযহাবীদের মান্যবর ইমাম হাফেজ ইবনুল কায়্যিম র. ‘কিতাবুর রুহ’ গ্রন্থে এক যয়ীফ হাদীসের উপর মন্তব্য করেন:
فهذا الحديث وإن لم يثبت فاتصال العمل به فى سائر الامصار و الاعصار من غير نكير كاف فى العمل به-
এ হাদীসটি (সনদের দিক থেকে) সহীহ প্রমাণিত না হলে অর্থাৎ যয়ীফ হলেও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শহরে কোনরূপ আপত্তি ছাড়াই এর উপর (সকলের ) আমল প্রতিষ্ঠিত থাকায় হাদীসটি আমলযোগ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (দ্র:পৃ:১৬)
২. মুহাদ্দিস ইমাম যারকাশী র. হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক কিতাব ‘আন্নুকাত’-এ লিখেছেন-
إن الحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول عمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر (৩৯০:১)
‘যয়ীফ’ হাদীস যখন ব্যাপকভাবে মুসলিম উম্মার নিকট সমাদৃত হয়, তখন হাদীসটি আমলযোগ্য হবে এটাই মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধ মত। এমনকি তখন যয়ীফ হাদীসটি হাদীসে মুতাওয়াতির (বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) এর পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়।
৩. হাফেজুদ্দুনিয়া আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী র. লিখেন-
ومن جملة صفات القبول أن يتفق العلماء على العمل بمدلول الحديث ، فإنه يقبل حتى يجب العمل به وقد صرح بذلك جماعة من أئمة الأصول- ( الإفصاح على نكت إبن الصلاح .( ৪৯৪:১)
হাদীস গ্রহণগোগ্য হওয়ার নিদর্শন সমূহের একটি নিদর্শন হলো, ফুকাহা বা ইমামগণ তার মর্মার্থের উপর আমল করার ক্ষেত্রে একমত পোষণ করা। এমতাবস্থায় হাদীসটি গ্রহণ যোগ্য হবে; বরং তার উপর আমল অপরিহার্য বলে গণ্য হবে। উসূলের অনেক ইমামগণের এবিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
৪. আল্লামা শামছুদ্দিন আস সাখাবী র. ‘ফাতহুল মুগীছ’ কিতাবে লিখেছেন-
وكذا إذا تلقت الأمة الضعيف بالقبول بعمل يعمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر فى أنة ينسخ المقطوع به، ولهذا قال الشافعى رح فى حديث “لا وصية لوارث” إنه لا يثبته أهل الحديث ولكن العامة تلقته بالقبول و عملوا به حتى جعلوه ناسخا لأية الوصية –( فتح المغيث ৩২৩:১)
উম্মাহ যখন ‘যয়ীফ’ হাদীসকে আমলীভাবে ব্যাপকহারে গ্রহণ করে নেয় তখন সঠিক মতানুসারে তা আমলযোগ্য হয়ে যায়। এমনকি এমন হাদীস অকাট্য বিধান রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে মুতাওয়াতির দলিলের মানোত্তীর্ণ হয়। একারণেই ইমাম শাফেয়ী র. “لا وصية لوارث” হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন: হাদীস বিশারদগণ এটাকে (সনদের দিক দিয়ে সহীহ প্রমাণিত মনে না করলেও ব্যাপকহারে আলেমগণ এটাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন ও তদানুযায়ী আমল করেছেন। এমনকি তারা এটিকে ওসিয়তের আয়াতের বিধান রহিতকারী আখ্যা দিয়েছেন। ( দ্র: খন্ড:১/পৃ:৩৩৩)
৫. হাফেজ জালালুদ্দিন সুয়ূতী র. তার ‘তাদবীর’ কিতাবে লিখেছেন-
يحكم للحديث بالصحة إذا تلقاه الناس بالقبول وان لم يكن له اسناد صحيح.
সনদের বিবেচনায় সহীহ না হলেও যে হাদীস মানুষ গ্রহণ করে নিয়েছে তাকে সহীহ বলা হবে।
৬. আল্লামা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী র. বলেছেন-
كان الاسناد لئلا يدخل فى الدين ما ليس منه ، لا ليخرج من الدين ما ثبت منه من عمل أهل الإسناد-
অর্থাৎ সনদের কাজ হচ্ছে যাতে দীনের বহির্ভূত কোন কাজ দীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ না ঘটে। দীনের অধীন বিষয়কে বহির্ভূত করার জন্য নয়। (আল-আজবিবাতুল ফাযেলা পৃ : ২৩৮)
সারকথাা : আলোচ্য হাদীসটি যঈফের দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভূক্ত। যা সহীহ এর মানোত্তীর্ণ হয়েছে। কারণ, সাহাবাদের রা. যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সকল উম্মাহর ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন আমল অনুযায়ী চলে আসছে। তাই উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে এটি অবশ্যই শক্তিশালী সহীহ ও আমলযোগ্য হাদিস। এটাকে যারা ‘জাল’ আখ্যা দিয়ে আমল অযোগ্য বলে মন্তব্য করবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে।
তথাকথিত আহলে হাদীসদের হাদীসের ব্যাপারে অবিচার
আহলে হাদীসের বর্তমান শতাব্দীর বরেণ্য মনীষী আল্লামা নাসীরুদ্দিন আলবাণী সাহেব ২০ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণিত হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে ৮ রাকাতের পক্ষের উকালতী করেছেন। অথচ ১৩’শ বছর যাবত কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ‘‘যয়ীফ তবে আমলযোগ্য” এর অতিরিক্ত কিছুই বলেন নি।
তিনি ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসটি মনগড়া ভাবে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে দাবির স্বপক্ষে কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন। যা নিম্নরূপ-
১. উক্ত হাদীসটি হযরত আয়েশা রা. ও হযরত জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসদ্বয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি সহীহ হলেও তা তাহাজ্জুদের বিবরণ সম্বলিত। যার সাথে তারাবীহর কোন সম্পর্ক নেই। বিস্তারিত আলোচনা আমরা পরে করবো। (ইনশাআল্লাহ)
সুতরাং উভয় হাদীসের সাথে আলোচ্য হাদীসের সংঘর্ষ কোথায়?
দ্বিতীয়ত: আয়েশা রা. এর বর্ণিত হাদীসে এগার রাকাতের কথা উল্লেখ থাকলেও আয়েশা রা. থেকে আরেকটি সহীহ হাদীসে তের রাকাত উল্লেখ আছে।
হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক এদুটি বর্ণনার মাঝে যে বৈপরীত্য আছে তার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা ২০ রাকাতের হাদীসের ব্যাপারে একই ব্যাখ্যা দেয়া হলে সংঘর্ষ থাকলো কোথায় ? আসল কথা আয়েশা রা.এর হাদীসের মধ্যে তাহাজ্জুদের বিবরণ। ইবনে আব্বাস রা.এর হাদীসে তারাবীহর বিবরণ। অথবা বলুন, তারাবীহর নামায এগার, তের, বিশ রাকাত সবধরনের আমল রাসূলের ছিল। সাহাবগণ বিশ রাকাতের উপর (ইজমা) ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় উম্মাহ এর উপর আমল করেছেন। তাহলে এটা বিদআত বা মনগড়া হয় কী ভাবে ?
থেকে যায়, আলবানী সাহেবের উক্তি। হাদীসে জাবের রা. উক্ত হাদীসের বিপরীত হওয়া আলবানী সাহেব ভাল করেই জানেন বহুবিদ কারণে হাদীসে জাবের যয়ীফ বলে সর্ব স্বীকৃত (যার বিশ্লেষণ পরে আসবে)। এরপরও এমন যয়ীফ হাদীসকে ইবনে আব্বাসের হাদীসের বিপরীত দাড় করানো কমপক্ষে আলবানীর মত লোকের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এটা একমাত্র অন্যায়ভাবে পক্ষপাতের মানষিকতায় তিনি তা বলেছেন বলে আমাদের ধারণা।
২. দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আলবাণী সাহেব বলেন যে, উক্ত হাদীসের সনদে (أبو شيبة إبراهيم بن عثمان) আবু শায়বা ইব্রাহীম বিন উসমান রয়েছেন। ইমাম শা’বী র. তাকে মিথ্যুক বলেছেন। কোন হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যুক হলে হাদীসটি জাল হয়ে যায়।
অথচ আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে এবর্ণনাকারীর কারণেই মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন ‘মউজু’ বা ‘জাল’ নয়। ‘যয়ীফ’ ও এমন যা হালকা ‘যয়ীফ’ (ضعيف خفيف) একারণে হাদীসটি আমলযোগ্য। ইজমায়ে সাহাবা ও খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত উম্মতের ধারাবাহিক আমলের কারণে হাদীসটি শক্তিশালী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শু’বা কি তাকে মিথ্যুক বলেছেন ? জবাব হলো না, তিনি মিথ্যুক বলেননি। তিনি বা যারা বলেছেন এখানে তার অর্থ হচ্ছে ভুল করেন। কেননা, শু’বা ছাড়া বিজ্ঞ হাদীস বিশারদগণ তার ব্যাপারে কোন কঠিন মন্তব্য করেন নি; বরং অনেকে তার প্রশংসা করেছেন।
যেমন-
* ইমাম বুখারী র. তার ব্যাপারে বলেন- سكتوا عنه অর্থাৎ তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন।
* আল্লামা ইবনে আদী র. তার ‘কামিল’ গ্রন্থে বলেন যে, له أحاديث صالحة وهو خير من إبراهيم بن عثمان أبو حية অর্থাৎ ইব্রাহীম বিন উসমানের কিছু গ্রহণযোগ্য হাদীস রয়েছে। তিনি ইব্রাহীম ইবনে আবু হাইয়্যার চেয়ে অধিক উত্তম। (তাহযীব দ্র:খ:১/পৃ:১৪৫)
* ইমাম বুখারী র. এর উস্তাদেরও উস্তাদ এবং স্বয়ং আবু শাইবা (ইব্রাহীম বিন উসমান) এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ইয়াযীদ ইবনে হারুন র. বলেন-ما قضى على الناس رجل يعنى فى زمانه أعدل قضاء منه অর্থাৎ আমাদের যুগে তাঁর (ইব্রাহীম বিন উসমান আবু শাইবা) চেয়ে বড় ন্যায়পরায়ণ বিচারক কেউ ছিলেন না। (তাহযীব:খ:১/পৃ:১৪৫)
এসব বিজ্ঞজনের মন্তব্যের কারণেই ইমাম (শু’বা র. যে كذب বলেছেন তার অর্থ ‘মিথ্যুক’ বলেননি বরং ‘ভুল করেন’ এ অর্থই স্বর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। একারণেই হাদীস বিশারদদের শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ ইমাম আল্লামা যাহাবী র. ميزان الاعتدال গ্রন্থে শু’বার মন্তব্যকে অগ্রাহ্য বলেছেন। (খ:১/পৃ:৪৭)
সার কথাঃ ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসের সনদে আবু শাইবা নামক যে বর্ণনকারী আছেন তিনি মিথ্যুক বলে কেউ মন্তব্য করেননি। শু’বা করে থাকলেও তা ইমাম যাহাবী অগ্রাহ্য করেছেন অথবা তিনি ‘কাযাবা’ বলে ক্ষ্যান্ত করেছেন। যার অর্থ ভুল করা, মিথ্যা বলা নয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়! জনাব আলবানী সাহেব হাদীসটি ‘জাল’ আখ্যা দেয়ার জন্য আবু শাইবার ব্যাপারে শু’বার মন্তব্যটি ‘মিথ্যুক’ অর্থে চালিয়ে দেন। যারা তার ব্যাপারে ভাল মন্তব্য করেছেন তাদের কথা যেমন: ইমাম ইবনে আদী ইয়াযীদ ইবনে হারুন ও আল্লামা যাহাবী। এদের কথাগুলো উল্লেখ করেননি। এতেই তার মনগড়া উক্তির রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে গেছে এবং এরকম উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মন্তব্য করে একটি গ্রহণযোগ্য মজবুত হাদীস কে জাল বানিয়ে দিলেন فأين المشتكى؟ অথচ এ যাবতকাল পর্যন্ত কেউ হাদীসটি ‘জাল’ বলেননি বরং ইমাম বায়হাকী ও তাবরানী স্ব স্ব গ্রন্থে বিশ রাকাত তারাবীহর অনুচ্ছেদে উক্ত হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করেছেন।
৩. জনাব আলবানী সাহেব ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসটি কে ‘জাল’ প্রমাণ করার তৃতীয় কারণ হিসেবে বলেন যে, আবু শাইবা তথা ইবনে আব্বাসের রা. হাদীসে নাকি বিশ রাকাত তারাবীহ রাসূল সা. রমজান মাসে জামাত ছাড়া আদায় করার বিবরণ রয়েছে। যা হযরত আয়েশা ও জাবের রা. এর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। তাই উক্ত হাদীসটি ‘জাল’ নাউযুবিল্লাহ এমন কথা আমরা আলবানী সাহেব থেকে আশা করিনি।
প্রথম কারণ, উক্ত হাদীসটি আবু শাইবা থেকে তিনজন রাবী বর্ণনা করেছেন।
(ক) ইয়াযীদ বিন হারুন।
(খ) আলী ইবনুল জাদ।
(গ) মানসুর বিন আবু মুযাহীর।
এ তিনজনের মধ্যে প্রথম দুজন রাবী মানসুরের তুলনায় অত্যন্ত শক্তিশালী। মানসুর তাদের তুলনায় দুর্বল। বায়হাকী শরীফে মানসুরের বর্ণনায় ‘জামাত ছাড়া পড়তেন’ কথাটি উল্লেখ আছে। হাদীসটির ভাষ্য এ রকম-
عن إبن عباس قال :كان النبى ص فى شهر رمضان فى غير جماعة بعشرين ركعة والوتر( بيهقى : رقم ৪৬১৫)
তবে আবু শাইবার শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুজন রাবী হাদীসটির বর্ণনা অনুসারে প্রাধান্য পাবে। তাহলে এবর্ণনাটি আয়েশা রা. ও জাবের রা. হাদীসের বিরোধী হলো কোথায়? বিষয়টি আলবানী সাহেবের অজানা নয় বরং শুধু পক্ষপাতিত্ব রক্ষা হচ্ছে এ সবের মূল কারণ।
দ্বিতীয়তঃ তাছাড়া ‘জামাত ছাড়া’ কথাটি ধরে নিলেও তা বিরোধী বলার প্রয়োজন কী ? রাসূল স. জামাতের সাথেও কয়েক রাকাত তারাবীহ পড়েছেন জামাত ছাড়াও পড়েছেন। আবার এক হাদীসের বর্ণনায় দেখা যায় কিছু নামায জামাতের সাথে পড়ার পর যখন দেখলেন মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মাঝখানে জামাত ছেড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন অবশিষ্ট তারাবীহ ঘরেই পড়লেন। সুতরাং সব হাদীসে একই ঘটনার বিবরণ থাকতে হবে তা না আয়েশা ও জাবের এর বর্ণনায় (আলবানীর কথা মত) জামাতের তারাবীহর বিবরণ এসেছে। আর না ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় জামাত ছাড়া যে তারাবীহ পড়েছেন সে তারাবীহ এর বিবরণ বিবৃত হয়েছে। এমতাবস্থায় পরষ্পর হাদীসগুলো বিরোধপূর্ণ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
উপরোক্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ একথাটি মনগড়া নয়। হাফেজুল হাদীস আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী র. বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন: والظاهر إن هذا فى قصة أخرى (فتح البارى ৮:৩)
অর্থাৎ বাহ্যত এটা ভিন্ন কোন ঘটনা হয়ে থাকবে। হাদীসে আয়েশা ও হাদীসে ইবনে আব্বাসের ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন।
তৃতীয়তঃ অধিকন্তু জাবের রা.এর হাদীস যা আলবানী সাহেব বার বার ইবনে আব্বাসের হাদীসের সাথে বিরোধী বলে পেশ করেছেন, এটি ‘যয়ীফ’ হাদীস। যা ইবনে আব্বাসের হাদীসের সাথে বিরোধীতা করার শক্তি রাখেনা। আর হযরত আয়েশার হাদীসটি তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত, তারাবীহর ব্যাপারে নয়।
চতুর্থঃ হাদীসটিতে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ার কথা বিষয়টি উল্লেখ নেই বরং হাদীসটির মধ্যে বহু প্রমাণ বিদ্যমান যে তা হযরত আয়েশার ঘরের নামায ছিল, মসজিদের নয়। (এব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি) তাহলে দুই হাদীসে বিরোধ কোথায় ? বিরোধ না হলে আলোচ্য ২০ রাকাতের হাদীসটি ‘জাল’ হলো কোথায় আর বিরোধ হলেও সামাঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা হাদীস বিশারদের থেকে পাওয়ার পরও আমলযোগ্য মজবুত হাদীসটি ‘জাল’ হবে কিভাবে ? আসলে আলবানী সহেব যা বললেন অন্তত তাঁর মুখে এটা কখনো শোভা পায়না।
দ্বিতীয় দলিল খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত
প্রথমত ঃ খুলাফায়ে রাশেদীন তথা চার খলীফা আবুবকর, ওমর, উসমান, ও আলী রা.এবং সাহাবায়ে কিরামের আমল ও কর্মধারা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এরা হচ্ছেন নবী স. ও তার পরবর্তী উম্মতের মাঝে সেতুবন্ধন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে এবং রাসূল স. তাঁর হাদীসের মাধ্যমে সাহাবায়ে কিরামকে সত্যের মাপকাঠি ঘোষণা করে তাদের মত ও পথের অনুসরণ অনুকরনের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- أمنو كما امن الناسতোমরা ঈমান আনয়ণ কর লোকেরা (সাহাবারা) যেভাবে ঈমান এনেছে। (সুরা বাকারা:১৩)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- فان أمنو بمثل ما أمنتم به فقد اهتدوا তোমরা (সাহাবারা) যেভাবে ঈমান এনেছো তারা যদি সেরূপে ঈমান আনে নিশ্চিত তারা হেদায়াত পাবে।(সুরা বাকারা)
রাসূল স. ইরশাদ করেন-
تفرق أمتي علي ثلاث و ستون ملة كلهم في النار الا ملة واحدة قالوا من هي يا رسول الله قال ما انا عليه واصحابي ( ترمذي:২/৯৩)
অর্থাৎ আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। প্রতিটি দলই জাহান্নামে যাবে শুধু একটি দল নাজাত পাবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, কারা সেই নাজাত প্রাপ্ত দল ? রাসূল স. বললেন ‘আমি এবং আমার সাহাবাগণ যে পথ ও মতাদর্শের উপর ছিল ওই আদর্শের অনুসারীরাই নাজাতপ্রাপ্ত দল। (তিরমিযী খ:২/পৃ:৯৩)
বিশেষ করে সাহাবাদের মধ্যে রাসূলের চার খলীফার সুন্নাত আদর্শ ও আমল এবং আকীদাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার প্রতি রাসূল স. জোর তাকিদ দিয়ে বলেন-
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌগ্ধ(سنن ابي داود: ৪/২০০،رقم: ৪৬০৭)
অর্থাৎ আমারপরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে অচিরেই বিভিন্ন মত বিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত এবং আদর্শের অনুসরণ করবে। তা কঠোর ভাবে আঁকড়ে ধরবে। (আবুদাউদ:৪/২০০(৪৬০৭) তিরমিযী,ইবনে মাজাহ)
দেখুন, উপরোক্ত পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সকল সাহাবা র. কে সত্যের মানদণ্ড এবং শরীয়তের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণকে অপরিহার্য এবং তাঁদের সুন্নাত বিশেষত খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে নবীজী নিজের সুন্নাতের সমপর্যায়ের ঘোষণা দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত ঃ আমরা ভূমিকায় বলেছি যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূল সা. এটা জেনেছিলেন যে, তাদের জারীকৃত যেকোন আমল বা সুন্নাত নবীজী স. এর বাণী সুন্নাতেরই অনুগামী হবে। একারণে নবীজী স. খুলাফাদের সুন্নাতকে মজবুতভাবে আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কাজেই উম্মতের সামনে যে কোন একজন খলীফায়ে রাশেদের সুন্নাত সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলে তা অনুসরণের ক্ষেত্রে ভিন্ন কোন দলীলের প্রয়োজন হবে না; বরং নবীজীর উপরোক্ত নির্দেশমূলক হাদীসই যথেষ্ট হবে। এ ব্যাপারে খলীফায়ে রাশেদের সুন্নাতটি নবী স. এর শিক্ষা বা সুন্নাতের কোন্ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাও দেখার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে রাসূল স. এর এক হাদীসে আছে-
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الخِلاَفَةُ فِي أُمَّتِي ثَلاَثُونَ سَنَةً، ثُمَّ مُلْكٌ بَعْدَ ذَلِكَ. (ترمذي: ২২২৬)
অর্থাৎ খেলাফতের মেয়াদ আমার ইন্তেকালের পর ত্রিশ বৎসর চলবে। (তিরমিযী ২২২৬)
এ ভবিষ্যদ্বানী হিসেবে খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন তথা আবুবকর রা. ওমর রা. উসমান রা. এবং আলী রা.
উল্লেখ্য আলীর রা. শাহাদাত হয়েছে রাসূলের ত্রিশ বৎসর পর অর্থাৎ ৪০ হিজরীতে।
খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওমর রা. এর মর্যাদা
এ চারজনের মধ্যে হযরত আবু বকর রা. এর পরেই হযরত ওমর রা. এর স্থান। নবীজী স. বিভিন্ন হাদীসে হযরত ওমর রা. এর মান ও মর্যাদা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ جَعَلَ الحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ وَقَلْبِهِ.
অর্থাৎ রাসূল স. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা হক ও সত্যকে ওমরের মুখ ও অন্তরে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। তিরমীযী-৩৬৮২
অপর হাদীসে রাসূল স. বলেন,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: ্রإِنَّ اللَّهَ وَضَعَ الْحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ يَقُولُ بِهِ. (ابوداود: ২৯৬২) باب في تدوين العطاء.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা সত্যকে ওমরের মুখে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। তিনি সর্বদা সত্যই বলে থাকেন। (আবু দাউদ-২৯৬২)
অন্য হাদীসে রয়েছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْ كَانَ نَبِيٌّ بَعْدِي لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الخَطَّابِ. (سنن الترمذي: ৩৬৮৬، باب في منافب ابي حفص عمر)
নবীজী স. বলেন, যদি আমার পরে কেউ নবী হতো তাহলে উমরই হতো। (তিরমিযী-নং ৩৬৮৬)
এসকল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা সাহাবাদের রা. মধ্যে বিশেষভাবে হযরত উমর রা. কে হক ও সত্য বলার বিশেষ যোগ্যতা প্রদান করেছিলেন। তাই সভাবগতভাবেই তিনি সর্বদা সত্য বলতেন এবং তার সকল কাজ ও সিদ্ধান্ত সঠিক ও আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অনুপাতেই হতো। একারণে প্রায় সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হযরত উমর রা. এর মতকে স্বয়ং ওহীর মাধ্যমে সত্যতার সনদ দিয়েছেন। হযরত উমরের প্রশংসা এখানে সামান্য আলোচনা এজন্য করলাম যে, বিশ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহর নামাযে একই ইমামের ইক্তিদায় জামাতের সহিত মসজিদে নববীতে ধারাবাহিক হযরত উমরই রা. চালু করেছেলেন। সকল সাহাবা রা. তার এই পদ্ধতিকে সমর্থন দেয়ায় এর উপর সাহাবা রা. দের (ইজমা) ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর উসমান ও আলী রা. এ ধারাবাহিকতা বহাল রেখে বিশ্বের সকল উম্মতের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক আমল(سنة متوارثة) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সুতরাং উমর রা. থেকে আরম্ভ করে খুলাফায়ে রাশেদার ধারাবাহিক সুন্নাত ইজমায়ে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত সকল উম্মতের ধারাবাহিক অবিচ্ছিন্ন আমলের মাধ্যমে তারাবীহ বিশ রাকাত সুন্নাহ হিসেবে গৃহীত। আমাদের জন্যও বিশ রাকাতের উপর আমল করা অপরিহার্য। একে যারা বিদআত বা মনগড়া আমল বলবে এবং বিশ রাকাতের কম পড়বে তারাই পথভ্রষ্ট এবং তাদের এ আমল সুন্নাত পরিপন্থি বলেই সাব্যস্ত হবে।
রাসূল সা. এর যুগে এবং খলীফা হযরত আবু বকর রা. এর যুগে তারাবীহর নামাযের অবস্থা ও তার ইতিকথা
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস এবং অন্যান্য হাদীসের কিতাবে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল স. কখনো কখনো তারাবীহর নামায জামাতে পড়িয়েছেন, আবার কখনো কখনো এমন হয়েছে যে কয়েক রাকাত জামাতের সাথে পড়ে রুমে চলে গেছেন এবং একাকী নামায আদায় করেছেন।(দ্র:মুসলিম:১১০৪)
আবুদাউদ শরীফসহ বিভিন্ন কিতাবের হাদীস দ্বারা বুঝাযায় এক রমযানে রাসূল স. শুধু ২০,২৩,২৫ এবং ২৭ রমজান এ তিন রাত্র জামাতের সাথে তারাবীহ পড়িয়েছেন। প্রথম রাত্রে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত, দ্বিতীয় রাত্রে অর্ধরাত পর্যন্ত এবং তৃতীয় রাত্রে সাহরী পর্যন্ত তারাবীহ পড়িয়েছিলেন। অবশিষ্ট রাত্রগুলোতে একাকী-ই পড়েছেন এবং অধিকাংশ সময় জামাতে না পড়ার কারণটিও বলে দিয়েছেন خشية أن تفترض عليكم. অর্থাৎ জামাতের সাথে নিয়মিত তারাবীহ পড়লে এ নামাযটিও উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। এতে বুঝা যায় জামাতের সহীত পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু উপরোক্ত কারণে পড়েননি।
আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী র. বলেন- তারাবীহর নামায রাসূল স. এর কখনো জামাতের সাথে বা কখনো এককীভাবে গুরুত্ব সহকারে পড়া এবং রাসূলের মৌখিক হাদীস “سننت لكم قيامه” “আমি কিয়াম তথা তারাবীহকে সুন্নাত করেছি” দ্বারাই তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হওয়ার প্রমাণবহন করে।
আর তারাবীহ জামাতের সাথে পড়া সুন্নাত কি না এ ব্যাপারে ফকীহদের দুটি মত রয়েছে-
ক) সুন্নাতে মুআক্কাদা। খ) সুন্নাতে যায়েদা।
যারা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেন তাদের দলিল হচ্ছে- নবীজী স. যদিও প্রায় সময় একাকীই পড়েছেন, জামাতে পড়েননি। তবে জামাতে পড়ার অধিক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তা পড়তে পারেননি। জামাতে পড়ার আগ্রহটি আমলীভাবে জামাতের গুরুত্ব বুঝায়। বিধায় তা আমলে দায়েমীর অন্তর্ভূক্ত। (حكمي عمل دائمي) তাই জামাতে তারাবীহ পড়াও সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। পক্ষান্তরে অনেক ফকীহ গবেষকগণ জামাতে পড়াকে সুন্নাতে মুআক্কাদা বলেন না; বরং সুন্নাতে যায়েদাহ বলেন। কেননা, নবীজী স. এর পক্ষ থেকে জামাতে পড়ার ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় না। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ হলে রাসূল স. কখনো জামাত ত্যাগ করতেন না।
এ কারণে দেখা যায় রাসূল স. এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম রা. এক ইমামের পিছনে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ার গুরুত্ব দিতেন না। তারাবীহ ব্যক্তিগত পর্যায়ের আমল ছিল। কখনো একাকী, কখনো জামাতে পড়লেও পুরা নামায জামাতে পড়তেন না। কখনো পুরা পড়লেও জামাতের গুরুত্ব বা বাধ্যবাধকতা ছিলনা। এসব কারণে তারাবীহ রাসূল স. এবং তাঁর যুগে সাহাবা রা. কত রাকাত পড়তেন এ ব্যাপারে আলোচনা গবেষণা করার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়নি। একারণেই মূলত সরাসরি রাসূল স.এর পক্ষ থেকে মারফু হাদীস (মৌখিক বা আমলী) ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়নি। হযরত ইবনে আব্বাস রা. সহ মাত্র কয়েকজন সাহাবী থেকে যে কয়টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা আলোচনায় না আসায় প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর রা. ও উমর রা. এর খেলাফতের প্রথম কয়টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। সকলেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে তারাবীহ আদায় করতেন। এক ইমামের ইক্তিদায় জামাতে পড়ার কোন পাবন্দী করতেন না। উমরের খেলাফতকালে যখন এক ইমামের পিছনে মসজিদে নববীতে জামাতের সাথে তারাবীহ গুরুত্বসহকারে আরম্ভ হলো তখনই রাকাতের বিষয়টি আলোচনায় আসলো এবং সাহাবীগণ ইবনে আব্বাসের হাদীসটির ভিত্তিতে বিশ (২০) রাকাতের উপর একমত হয়ে তারাবীহ পড়া আরম্ভ করলেন।
খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর রা. এর যুগে তারাবীহ
রাসূল সা. এর দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এর খেলাফতের প্রথম ছয় বছর ছিল ইসলামী বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ভভ সকল ফিতনা দমনের কাল। পুরা ইসলামী জগত রোম ও ইরানের আক্রমণ থেকে নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃঙ্খল করে শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে মনযোগ দেন।
রমযানের একরাতে তিনি মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় জামাতের সাথে তারাবীহ পড়া হচ্ছে। তিনি সকলকে একত্রিত করে এক ইমামের পিছনে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দিলেন এবং উবাই বিন কা’ব রা. কে ইমামতির দায়িত্ব দিলেন। ‘আদ্দুরুল মানছুর’ (الدر المنثور) কিতাবে সূরা কদর এর তাফসীরে উল্লেখ আছে যে, হযরত উমর রা.তারাবীহর এ নিয়ম চালু করার ক্ষেত্রে হযরত আলী রা. এর সাথে পরামর্শ করেছেন।
প্রথম দিকে হযরত ওমর রা. লম্বা কেরাত তিলাওয়াতের মাধ্যমে সাহরীর পূর্ব পর্যন্ত নামাজের জামাত চালাতে নির্দেশ দিয়েছেলেন এবং ইমামকে এগার (১১) রাকাত পড়ানোরও পরামর্শ দেন। যা ‘মুয়াত্তা মালেক’ গ্রন্থের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। (দ্র: পৃ:৪০) ধারণা এই ছিল যে, রাসূল স. রমযানের রাতে যে নামায জামাতের সাথে মাঝে মধ্যে পড়েছেন বা একাকী পড়েছেন তা তাহাজ্জুদই ছিল। এতএব, তাহাজ্জুদ ভিন্নভাবে পড়ার দরকার নেই। অতপর এহাদীসে পরিলক্ষিত হলো যে, নবীজী স. রমযানের রাতে ২/৩ দিন যে নামাযটি জামাতের সাথে পড়িয়েছিলেন তাতে তিনি বিশ রাকাত পড়িয়েছিলেন। যেমন ‘আল-তালখীসুল হাবীর’ ও ‘বায়হাকী শরীফে’র হাদীসে এসেছে। তাই হযরত উমর কেরাতকে সংক্ষিপ্ত করে রাকাতের সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিশ রাকাত পড়ানোর নির্দেশ দিলেন। এবং রাতের প্রথম অংশেই নামায শেষ করে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ ভিন্নভাবে পড়ার নির্দেশও প্রদান করলেন। সহীহ বুখারী হাদীস নং ২০১০ এ পাওয়া যায় যে, সর্বশেষ নামাযের নিয়ম চালুর নির্দেশ প্রদানের পর একদা হযরত উমর রা. মসজিদে নববীতে আসেন এবং দেখেন যে উবাই বিন কা’বের ইক্তিদায় সমস্ত মুসলমান জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ছেন। তা দেখে তিনি অতি মূল্যবান অর্থবহ বাক্য উচ্চারণ করলেন-
قَالَ عُمَرُ: ্রنِعْمَ البِدْعَةُ هَذِهِ، وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِي يَقُومُونَগ্ধ يُرِيدُ آخِرَ اللَّيْلِ وَكَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ أَوَّلَهُ (صحيح البخاري: ২০১০) باب فضل من قام رمضان.
অর্থাৎ তারাবীহর এ নতুন নিয়মটি কতই না চমৎকার। মূলত হযরত উমর রা. এই বাক্য দ্বারা দুটি সংশয়ের জবাব দিয়েছেন।
১. হযরত উমর রা. এক ইমামের পিছনে জামাতের সাথে পুরা রমযান তারাবীহর নামায চালু করলেন। ইতোপূর্বে কেউ জামাতের প্রতি এমন গুরুত্ব প্রদান করেন নি। তাহলে এ নতুন নিয়মটি বিদআত হচ্ছে কি না?
২. এ নামাযটি রাতের প্রথম অংশেই শেষ হয়ে যায় এটা হয়তো তাহাজ্জুদের নামায।
আর তাহাজ্জুদই যদি হয় তাহলে তার সময় তো রাতের শেষাংশে অথচ প্রথমাংশে
পড়া হচ্ছে এ নিয়মটি বিদআত নয় তো ?
এসব নিয়ে কিছু গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত উমর রা. উপরোক্ত বাক্য দ্বারা উভয় সংশয়ের জবাব এ ভাবে দিলেন যে, যদি কেউ মনে করে জামাতে এক ইমামের সাথে তারাবীহর নিয়ম চালু করা বিদআত। হ্যাঁ আমি এটি জেনে শুনেই করেছি কারণ, এটি নতুন নিয়ম হলেও রাসূল স. এর শিক্ষাই তার ভিত্তি বা আসল। আর তা হচ্ছে, ২/৩ দিন যাই হোক রাসূল স. সকলকে নিয়ে তারাবীহর জামাত করেছেন। যদিও ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তার ধারাবাহিকতা রাখেন নি। এখন ওহীর পথ খোলা নেই, আসবেনা নতুন কোনো শরীয়ত। তাই যে আশঙ্কা রাসূল স. এর জীবনে বিদ্ব্যমান ছিল তা এখন আর নেই। এ কারণে এটা আভিধানিক অর্থে বিদআত তথা নতুন কাজ হতে পারে; কিন্তু শরয়ী পারিভাষিক অর্থে বিদআত নয় বরং খুবই ভাল ও চমৎকার কাজ। (نِعْمَ البِدْعَةُ هَذِه) তেমনিভাবে যারা বলছেন তাহাজ্জুদকে সময়ের পূর্বে রাতের প্রথমাংশে পড়ার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে যা রাসূলের যুগে ছিল না। তাদের সংশয়ের জবাবে উমর রা. বলেন- وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِي يَقُومُونَ অর্থাৎ তাহাজ্জুদকে প্রথমাংশে আনা হয়নি। কেননা, এটা তাহাজ্জুদ নয় এটা (قيام الليل) তারাবীহ। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে হবে যা (صلوة الليل). সালাতুল লাইল। এদুটি ভিন্ন ভিন্ন নামায এক নয়। তাই আপনারা এখন জামাতের সাথে যে নামায পড়ছেন তার থেকে অধিক ফযীলতপূর্ণ ঐ নামায যা আদায় না করে শেষরাতে অনেকে সাহরী খেয়ে ঘুমিয়ে যান। বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় উমর রা. এর বক্তব্যে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে তারাবীহ আর তাহাজ্জুদ এক নয় স¤পূর্ণ ভিন্ন নামায। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আব্দিল বার র. মুয়াত্তা মালেকের সু-খ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আল-তামহীদে’ উল্লেখ করেন যে, উমর রা. এখানে নতুন কিছুই করেন নি বরং তিনি তা-ই করেছেন যা স্বয়ং রাসূল স. পছন্দ করতেন। রাসূল স. উম্মতের উপর তারাবীহ ফরয হওয়ার আশঙ্কায় অধিক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও জামাতে ধারাবাহিকভাবে করতে পারেন নি। সে পছন্দের কাজটি উমর রা. করেছেন (কেননা রাসূল স. এর ওফাতের পর আর ঐ আশঙ্কা বিদ্যমান নেই) দ্র: খ:৮/পৃ:১০৮
হাফেজ ইবনে আব্দিল বার র. উপরোক্ত ঘটনা (উমর প্রথমে এগার (১১) রাকাত চালু করেছিলেন পরে বিশ রাকাত চালু করলেন এবং কেরাত সংক্ষিপ্ত করতে বললেন) এর সমর্থনে বলেন:
قال ابن عبد الله روي مالك في هذا الحديث احدي وعشرين وهو صحيح ولا اعلم احدا قال فيه احدي عشرة الا مالكا ويحتمل أن يكون ذلك اولا ثم خفف عنه طول القيام ونقلهم الي احدي وعشرين.
তারাবীহ একুশ (২১) রাকাতের কথাই সহীহ ও সঠিক। কারণ এগার রাকাতের কথা ইমাম মালেক ছাড়া অন্য কেউ বলেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, প্রথমে এগার (১১) রাকাত চালু করেছিলেন (খুব দীর্ঘ কেরাতের সাথে) পরে দীর্ঘ কেরাত সংক্ষেপ করে এগার (১১) রাকাতকে বিশ (২০) রাকাতে পরিণত করা হয়েছে। (ফাতহুল মূলহিম:২/৩০)
অবশেষে হযরত উমর রা. এর বিশ (২০) রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহর জামাত চালু করার নির্দেশের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা র. এর মন্তব্য-
وَرَوَى أَسَدُ بْنُ عَمْرٍو عَنْ أَبِي يُوسُفَ قَالَ: سَأَلْتُ أَبَا حَنِيفَةَ عَنِ التَّرَاوِيحِ وَمَا فَعَلَهُ عُمَرُ؟ فَقَالَ: التَّرَاوِيحُ سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ وَلَمْ يَتَخَرَّصْهُ عُمَرُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ مُبْتَدِعًا، وَلَمْ يَأْمُرْ بِهِ إِلَّا عَنْ أَصْلٍ لَدَيْهِ وَعَهْدٍ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، وَلَقَدْ سَنَّ عُمَرُ هَذَا وَجَمَعَ النَّاسَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّاهَا جَمَاعَةً وَالصَّحَابَةُ مُتَوَافِرُونَ (الاختيار للموصلي: ১/৭৪، باب صلاة التراويح)
ইমাম আবু ইউসুফ বলেন- আমি ইমাম আবু হানীফা র. কে তারাবীহ এবং উমর রা. এর নিয়ম চালুর নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং উমর রা. তা নিজের পক্ষ থেকে অনুমান করে নির্ধারণ করেন নি। নতুন কিছু আবিষ্কারও করেননি; বরং তার কাছে এর দলিল ছিল এবং রাসূল স. থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনার ভিত্তিতেই এ আদেশ দিয়েছেন। (আল ইখতিয়ার: খ:১ পৃ:৭৪)
সার কথা: হযরত উমর রা. যে নতুন কাজের সূচনা করছিলেন তথা জামাতের ইহতিমাম করা, বিশ রাকাত পড়তে বলা, রাতের প্রথমাংশে তারাবীহ শেষ করা, সবগুলো রাসূলের হাদীস ও তার নির্দেশনার ভিত্তিতেই করেছেন।
খলীফা উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত
প্রথম হাদীস :
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: ” كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً ” (السنن الكبري للبيهقي: ২/৮৯৬، رقم: ৪২৮৮)
অর্থাৎ: সায়েব বিন্ ইয়াযীদ রা. বলেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম রা. রমযান মাসে বিশ রাকাত (তারাবীহ) পড়তেন। (বায়হাকী, সুনানে কুবরা: খ:২ পৃ:৮৯৬)
পর্যালোচনা: এ হাদীসটিতে ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা নামে একজন রাবী রয়েছেন। ইমাম বায়হাকী থেকে রাবী ইয়াযীদ বিন খুসায়ফা পর্যন্ত দুটি সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। এক সনদে হাদীসটি সুনানে কুবরায় উল্লেখ করেছেন যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। অপর সনদটি তিনি আসসুনানুল কুবরাসহ আল-মা’রিফা গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। যার ইবারত-
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: ্রكُنَّا نَقُومُ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرِগ্ধ (معرفة السنن: ৫৪০৯)
সুনানে কুবরার উপরোক্ত সনদের হাদীসটিকে যারা সহীহ বলেছেন তারা হচ্ছেন ইমাম নববী র., আল্লামা ইরাকী র., হাফেজ আইনী র., হাফেজ জালাল সুয়ুতী র. এবং আল্লামা নিমাভী র. প্রমুখ। আর অপর সনদ তথা আল-মা’রিফা গ্রন্থের হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন- তাজুদ্দীন সুবকী র. এবং মোল্লা আলী আল-কারী র. প্রমুখ। সুতরাং হাদীসটি তার উভয় সনদের দিক দিয়ে বিশিষ্ট হাদীস বিশারদদের দৃষ্টিতে সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য।
সহীহ হাদীস কে লা-মাযহাবীদের যয়ীফ বলার চক্রান্ত
লা-মাযহাবীরা মিযানুল ই’তেদাল ও তাহযিবুত তাহযীব গ্রন্থের বরাতে ভিত্তিহীন ভাবে মনগড়া মন্তব্য করে হাদীসটিকে যয়ীফ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা বলেন যে, উক্ত হাদীসের সনদে ১নং রাবী (আবু উসমান বাসরী) ২নং রাবী (খালিদ বিন মাখলাদ) এবং ৩নং রাবী (ইয়াযীদ বিন খুসায়ফা) অস্বীকৃত, যয়ীফ ও প্রত্যাখ্যাত।
অথচ এদের মধ্যে খালেদ ও ইয়াযীদ দুজনই বুখারী ও মুসলিমের রাবী। তাদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত হলে বুখারী মুসলিমে তাদের রেওয়ায়েতগুলো আসল কীভাবে ? তাহলে বুখারী ও মুসলিমের এ হাদীসগুলো কি প্রত্যাখ্যাত ? তদুপরী তারা যে দুটি কিতাবের বরাতে এদের সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন কিতাবগুলো খুলে দেখুন উক্ত রাবীর ব্যাপারে এধরণের কোনো সমালোচনা এসব কিতাবে পাওয়া যাবে না। এটাই লা-মাযহাবীদের আসল চেহারা। মনমতো না হলে বুখারীর হাদীসকেও যয়ীফ বা প্রত্যাখ্যাত বলতে দ্বিধা করেনা।
১. খালিদ বিন মাখলাদ র. সম্পর্কে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস উসমান বিন আবী শাইবা র. সালেহ বিন মুহাম্মদ র. ইবনে হিব্বান র. ইবনে শাহীন র.সহ অনেকে বলেছেন তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। ইবনে মঈন বলেছেন তার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। আবু দাউদ এবং ইবনে হাজার বলেছেন তিনি সত্যবাদী। ইবনে আদী বলেছেন তার মধ্যে কোন রকম সমস্যা নেই, ইমাম বুখারী তার সরাসরি ছাত্র।
হ্যাঁ, শুধু ইমাম আহমদ একটি ব্যতিক্রম মন্তব্য করেছেন যে, (له مناكير) তার কিছু কিছু বর্ণনা আপত্তিকর।
উল্লেখ্য, ইমাম আহমদের মন্তব্যে তার বর্ণনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়বেনা। কারণ তিনি ইমাম বুখারীর উস্তাদ। বুখারী মুসলিমে তার হাদীস রয়েছে। তা ছাড়া হাদীসের বিজ্ঞ মণিষীগণ তার প্রশংসা করেছেন এদের মোকাবেলায় ইমাম আহমদ র. এর মন্তব্য ধর্তব্য নয়।
উপরন্তু তার কিছু বর্ণনা ইমাম আহমদের কথা অনুসারে আপত্তিকর হলেও আমাদের আলোচ্য হাদীসটি তার আওতাভূক্ত নয়।
কারণ, এ হাদীসটি বিভিন্ন সনদে তিনি ছাড়া আরো অনেক বিশ্বস্ত রাবীদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।
২. ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা র. এর ব্যাপারে হাদীস বিশারদদের মন্তব্য নিম্নরূপ:
ইমাম আবু হাতিম আবরাজী র. ইমাম নাসায়ী র. ও ইমাম ইবনে সা’দ র. তাকে ‘সিকাহ’ নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইমাম ইবনে মাঈন র. বলেছেন (ثقة حجة) অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও দলিলযোগ্য। ইমাম আহমদ র. থেকে তার সম্পর্কে দু ধরণের মন্তব্য পাওয়া যায়। এক, তিনি ‘সিকাহ’ নির্ভরযোগ্য। দুই. তিনি ‘মুনকারুল হাদীস’ অর্থাৎ তার কিছু হাদীস আপত্তিকর। এটা বাক্যটির অনুবাদ; কিন্তু ইমাম আহমদের পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে তিনি কোন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে একক ও নিঃসঙ্গ। (দ্র: মুকাদ্দামায়ে ফাতহুল বারী)
৩. আবু উসমান র. তার নাম আমর ইবনে আব্দুল্লাহ। তিনি বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবু তাহির ও হাসান ইবনে আলী র. এর উস্তাদ। তারা বহু হাদীস তার থেকে গ্রহণ করেছেন। তার ব্যাপারে (متروك) প্রত্যাখ্যাত বা যয়ীফ বলে কোন মুহাদ্দিস মন্তব্য করেনি। লা-মাযহাবী বন্ধুরা তার ব্যাপারে যা বলেছেন সবই মনগড়া। এধরণের বহু রাবীর হাদীস বুখারীতেও আনা হয়েছে তাছাড়া আমাদের আলোচ্য হাদীসটি আবু উসমান ব্যতিত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবীদের সনদেও বর্ণিত হয়েছে। এ ছিল লা-মাযহাবীদের চক্রান্তের উপর সামান্য পর্যালোচনা।
সারকাথা: হযরত উমর রা. যে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ার নিয়ম চালু করেছিলেন এবং সাহাবায়ে কিরাম যে ওই যুগে বিশ রাকাত তারবীহ পড়তেন এনিয়ে সায়েব বিন ইয়াযীদ র. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সকল মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে সহীহ এবং অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাই এ হাদীস ও তার সমর্থনে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হলো যে উমর রা. এর যুগেই আনসার ও মুহাজির সকল সাহাবা মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এতে তাদের কেউ আপত্তি করেন নি। আম্মা আয়েশা রা. এর হুজরা মোবারকের সামনেই বিশ রাকাতের আমল যুগ যুগ ধরে চালু ছিল তিনি ও কোন আপত্তি করেন নি। কেননা তিনি জানতেন যে, বুখারীতে বর্ণিত “এগার (১১) রাকাতের বেশী পড়েন নি” মর্মে যে, হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন তা তাহাজ্জুদ সম্পকীয়। তারাবীহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। একেই সাহাবীগণের ইজমা বা সম্মিলিত কর্মধারা বলা হয়।
২নং হাদীস তাবেঈনদের বর্ণনা
ক. হযরত ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. এর হাদীস-
عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ؛ أَنَّهُ قَالَ: كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ (১) عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، فِي رَمَضَانَ، بِثَلاَثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً (موطأ لامام مالك: رقم: ৩৮০)
উমর রা. এর যুগে মানুষ (সাহাবা ও তাবেঈন) রমযানে তেইশ রাকাত (তারাবীহ ২০ রাকাতা বিতর ৩ রাকাত) পড়তেন। (মুয়াত্তা মালেক ৪০ নং ৩৮০, আসসুনানুল কুবরা বায়হাকী: ২/৪৯৬)
খ. তাবেয়ী হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-আনসারী র. এর হাদীস :
عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، ্রأَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّي بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَةًগ্ধ (مصنف ابن ابي شيبة:২/২৮৫،رقم: ৭৬৮২)
হযরত উমর রা. এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত (তারাবীহ) আদায় করেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা:খ:২/পৃ:২৮৫)
গ. তাবেয়ী হযরত আব্দুল আযীয ইবনে রুবাই র. এর হাদীস:
عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ قَالَ: ্রكَانَ أُبَيُّ بْنُ كَعْبٍ يُصَلِّي بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ بِالْمَدِينَةِ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَيُوتِرُ بِثَلَاثٍগ্ধ (مصنف ابن ابي شيبة: ২/২৮৫،رقم: ৭৭৬৬)
হযরত উমর রা. কর্তৃক নিয়োজিত ইমাম উবাই বিন কা’ব রা. সম্পর্কে ইবনে কা’ব র. বলেন যে, তিনি রমযানে মদীনা শরীফে লোকদেরকে(সাহাবা ও তাবেঈন) নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (দ্র: মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : খ:২/ পৃ:২৮৫/ হা:৭৭৬৬)
ঘ. তাবেয়ী মুহাম্মদ বিন কা‘ব আল কুরাযী র. এর হাদীস :
্রكَانَ النَّاسُ يُصَلُّونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً يُطِيلُونَ فِيهَا الْقِرَاءَةَ وَيُوتِرُونَ بِثَلَاثٍগ্ধ (قيام الليل للمروزي: ৯১)
মুহাম্মদ ইবনে কা‘ব আল কুরাযী র. বলেন, হযরত উমর এর যুগে রমযানে লোকেরা (সাহাবা ও তাবেয়ী) বিশ রাকাত পড়তেন। তাতে তারা দীর্ঘ কেরাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (কিয়ামূল লায়ল: পৃ:৯১)
এ হলো তাবেঈন কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের আলোকে হযরত উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহর প্রমাণ।
এ ধরণের আরো বহু হাদীস পাওয়া যায়। যেগুলোর সারমর্ম এক ও অভিন্ন। তাই এগুলোর মূল বক্তব্য সহীহ ও মুতাওয়াতিরের পর্যায়ের। সুতরাং হযরত উমর রা.-এর যুগ থেকে সাহাবা ও তাবেয়ীর ধারাবাহিক আমল যে বিশ রাকাত তারাবীহর উপর ছিলো তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। যাতে কোনো দ্বিধা দ্বন্দের অবকাশ নেই।
খলীফায়ে রাশেদ: হযরত উমর রা.-এর সুন্নাতের ব্যাপারে লা-মাযহাবীদের দ্বিমুখী বক্তব্য
লা-মাযহাবীরা এ ব্যাপারে স্ববিরোধী কথা বলে থাকেন। যেমন: এক সময় বলেন যে, বিশ রাকাত তারাবীহ হযরত উমর রা. থেকে প্রমাণিত নয়। এ ব্যাপারে যেসব হাদীস উপরে পেশ করা হলো এগুলো ‘যয়ীফ’ তথা আমল অযোগ্য। আবার কখনো বলেন, এটা হযরত উমরের কর্ম ও আমল যার পিছনে উমর রা.-এর অনুমোদন ছিলো না। আবার বলেন যে, হযরত উমর নিজেই উবাই ইবনে কা‘বকে এগার রাকাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইত্যাদি।
আমরা বলতে চাই, মেনে নিলাম তিনি এগার রাকাতের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবার বলুনতো তার আদেশ লঙ্ঘন করে কারা বিশ রাকাত তারাবীহর নির্দেশ চালু করেছিলেন ? যার কারণে সাহাবা তাবেয়ী সকলেই যুগ যুগ ধরে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ে আসছেন। আর হযরত উমর রা.-এর আমলের ভিত্তি যদি রাসূলের কোনো সমর্থনই না থেকে থাকে তাহলে বলুনতো (عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين) অর্থাৎ তোমরা আমার সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত শক্ত হাতে আকঁড়ে ধরো। এ হাদীসের উদ্দেশ্য কী ? দেখুন, আল্লামা ইবনুল হুমাম কী চমৎকার কথা বলেছেন:
وَكَوْنُهَا عِشْرِينَ سُنَّةُ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ وَقَوْلُهُ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – ্রعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَগ্ধ نَدْبٌ إلَى سُنَّتِهِمْ. (فتح القدير: ১/৪৮৬)
বিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। আর রাসূলের বাণী “তোমরা আমার সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরো” দ্বারা তাদের সুন্নাতের প্রতি গুরুত্বারোপ ও উৎসাহিত করা হয়েছে। (দ্র: ফাতহুল কাদীর ১/৪৮৬)
থেকে যায় তাবেয়ীন কর্তৃক উপরোল্লিখিত বর্ণনা বা হাদীসগুলো ‘যয়ীফ’ তথা মান্য করার অযোগ্য হওয়ার বিষয়টি।
তাবেয়ীনদের বর্ণনাগুলো ‘যয়ীফ’ বা অগ্রহণযোগ্য নয় কেন ?
উপরে ক. থেকে ঘ. পর্যন্ত যে কয়টি তাবেয়ীদের বর্ণনা পেশ করা হয়েছে এদের অনেকেই হযরত উমর রা.-এর যুগ পাননি। আবার কার থেকে বর্ণনা করলেন তাও তারা বলেননি। এসব কারণে হাদীসগুলো মুনকাতি (منقطع) বা মুরসাল (مرسل) তথা সূত্র বিচ্ছিন্ন বলা হয়। কিন্তু এ ধরণের তাবেয়ীর উস্তাদ পর্যায়ে যেহেতু কোনো দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলো না বললেই চলে তাই তাদের মুরসাল হাদীসগুলো গ্রহণযোগ্য। তদুপরি হাদীসটি একাধিক তাবেয়ী থেকে বর্ণিত এবং একটি সহীহ হাদীসও এ বক্তব্যের সমর্থনে বিদ্যমান। তাই এগুলো অগ্রহণযোগ্য বলা হাদীস শাস্ত্রের বিধান লঙ্ঘন। তা ছাড়া মূল হাদীস তো সাহাবী ‘সায়েব ইবনে ইয়াযীদ’ কর্তৃক বর্ণিত। আর এগুলো ওই হাদীসের সমর্থক বা অতিরিক্ত সাক্ষী হিসেবে গণ্য। উপরন্তু তাবেয়ীদের এসব বর্ণনাগুলোর সমর্থনে (تعامل امت) তথা “উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন সম্মিলিত কর্মধারা” বিদ্যমান থাকায় এগুলো প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য। হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরণের মুনকাতি বা মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপর কারো কোনো দ্বিমত নেই। এগুলোকে লা-মাযহাবীরা যয়ীফ বলে আখ্যা দেয়া তাদের মারাত্মক অজ্ঞতার বহি:প্রকাশ ও হাদীসের ব্যাপারে জালিয়াতি। তাছাড়া এসব হাদীসকে কোনো মুহাদ্দিস যয়ীফ বলেননি।
দেখুন- এব্যাপারে লা-মাযহাবীদেরই মান্যবর শীর্ষ আলেম শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. কী বলেছেন-
قال ابن التيمية: المرسل الذي ما يوافقه أو الذي عمل به السلف حجة باتفاق الفقهاء. (مجموع الفتاوي، منهاج السنة)
তিনি বলেন, যে মুরসালের (সূত্রবিচ্ছিন্ন) অনুকূলে অন্য কোনো প্রমাণ পাওযা যায় কিংবা পূর্বসূরীগণ যার অনুসরণ করে থাকেন। তাহলে তা ফকীহগণের সর্বসম্মতিক্রমে দলিল হিসেবে গৃহীত হবে। (মাজমূউল ফতোয়া খ.২৩ পৃ. ২৭১ মিনহাজুস সুন্নাহ খ.৪/১১৭)
‘মাজমুউল ফতোয়া’ গ্রন্থে তিনি উমর রা.-এর যুগে মসজিদে নববীতে যে বিশ রাকাত তারাবীহ হতো এ সম্পর্কে বলেন-
فَإِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنَّ أبي بْنَ كَعْبٍ كَانَ يَقُومُ بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً فِي قِيَامِ رَمَضَانَ وَيُوتِرُ بِثَلَاثِ. فَرَأَى كَثِيرٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ أَنَّ ذَلِكَ هُوَ السُّنَّةُ؛لِأَنَّهُ أَقَامَهُ بَيْن الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَلَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ.(مجموع الفتاوي: ২৩/১১২-১৩)
এ বিষয়টি প্রমাণিত যে, উবাই বিন কা‘ব রা. (যিনি উমরের নিযুক্ত ইমাম ছিলেন) রমযানে তারাবীহতে মুসল্লিদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। তাই অসংখ্য আলেমের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এটাই সুন্নাত। কেননা, তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই তা আদায় করেছিলেন অথচ কেউ তাতে আপত্তি করেনি। (দ্র: মাজমাউল ফতোয়া Ñ ২৩/১১২-১১৩)
ইবনে তাইমিয়া আরো বলেন-
قال ابن التيمية: ثبت من سنة الخلفاء الراشدين وعمل المسلمين. (مجموع الفتاوي)
অর্থাৎ (বিশ রাকাত তারাবীহ ) খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং মুসলিম জাতির সম্মিলিত কর্মধারায় এটি প্রমাণিত। (দ্র. খ.২৩/১১৩)
হযরত আবুল আলিয়া র. থেকে বর্ণিত-
عَنْ أَبِي الْعَالِيَةِ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ أَنَّ عُمَرَ أَمَرَ أُبَيًّا أَنْ يُصَلِّيَ بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ فَقَالَ إِنَّ النَّاسَ يَصُومُونَ النَّهَار وَلَا يحسنون أَن (يقرؤا) فَلَوْ قَرَأْتَ الْقُرْآنَ عَلَيْهِمْ بِاللَّيْلِ فَقَالَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ هَذَا (شَيْءٌ) لَمْ يَكُنْ فَقَالَ قَدْ عَلِمْتُ وَلَكِنَّهُ أَحْسَنُ فَصَلَّى بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَة (إِسْنَاده حسن) (مسند احمد بن منيع، المختارة لضياء المقدسي)
হযরত উমর রা. উবাই রা.কে রমযানে লোকদের নিয়ে নামায পড়তে আদেশ দিলেন এবং এ কথা বললেন যে, লোকরা দিনভর রোযা রাখে তারপর সুন্দরভাবে কুরআন পড়তে পারে না। তাই আপনি যদি রাতে তাদেরকে নিয়ে কুরআন পড়তেন। তিনি তখন বললেন, আমি জানি যে এটা অনেক ভালো কাজ। এরপর উবাই রা. লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়লেন। (দ্র. আল মুখতারা ১১৬১)
হাদিসটির মান: ‘হাসান’ এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, জামাতে পড়ার ক্ষেত্রে তিনি আপত্তি করলেও কিন্তু বিশ রাকাতের ব্যাপারে কোনো আপত্তি উবাই রা. করেননি। অথচ বিশ রাকাতের বিষয়টি শরীয়তের বিষয়। যা কেউ নিজ থেকে নির্ধারণ করতে পারে না। বুঝা গেলো, হযরত উমর রা. কর্তৃক বিশ রাকাত তারাবীহ রাসূলের পরোক্ষ নির্দেশেই হয়েছে এবং বিশ রাকাত যে মসজিদে নববীর ইমাম উবাই পড়তেন তাও সর্বস্বীকৃত। এ হাদীস দ্বারা তাবেয়ীদের উপরোক্ত হাদীসগুলোর জোরালো সমর্থন পাওয়া গেলো। আর উমর রা.-এর যুগে যে বিশ রাকাত তারাবীহর নিয়ম চালু হয়েছিলো তাতে স্বয়ং উবাইও আপত্তি করেননি।
এসব দলিল প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, বিশ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহ হযরত উমর রা-এর যুগে পড়া হতো। সাহাবাগণ ও তাবেয়ীগণ সকলেই পড়েছেন। একথা কিছু লা-মাযহাবি ছাড়া সারা পৃথিবীর সকল আলেম ও ফকীহ মুহাদ্দিস এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।
হযরত উসমান রা. এর যুগ
১৪ হিজরি থেকে উমর রা. এর শাহাদাত বরণ পর্যন্ত দশ বছর উসমানের রা. উপস্থিতিতেই তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া হয়েছে। তিনি তারাবীহর রাকাত সংখ্যা নিয়ে আপত্তি করেন নি। যা তার সম্মতির লক্ষণ। তাছাড়া তিনি যদি তার
খেলাফতকালে নতুন নির্দেশ জারি করতেন তাহলে তা অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত থাকতো।
হযরত আলী রা. এর যুগ
হযরত আলী রা. বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং লোকদেরকেও বিশ রাকাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দুটি বর্ণনা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়।
ক.
عن أبي عبد الرحمن السلمي عن على رضي الله عنه قال : دعا القراء في رمضان فأمر منهم رجلا يصلي بالناس عشرين ركعة قال وكان علي رضي الله عنه يوتر بهم
অর্থ: আবু আব্দুর রহমান সুলামী র. হযরত আলী রা. সম্পর্কে বলেন, তিনি রমযানে হাফেজদেরকে ডাকলেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহর নামায পড়ার নির্দেশ দিলেন। আলী রা. নিজে তাদেরকে নিয়ে বিতর পড়তেন। (বায়হাকী: ২/৪৯৬)
খ.
عن أبي الحسناء : أن عليا أمر رجلا يصلي بهم في رمضان عشرين ركعة.
আবুল হাসনা বলেন, আলী রা. একজনকে নির্দেশ দিয়েছেন রমযানে তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহর নামায পড়তে। (ইবনে আবী শাইবা: ৫/২২৩-নং৭৭৬৩)
এসমস্ত হাদীস দ্বারা খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া প্রমাণিত হয়। আর তাদের আমল আমাদের জন্য অনুসরণীয়। কারণ রাসূল স. ইরশাদ করেছেন-
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين. عضوا عليها بالنواجذ. وإياكم والأمور المحدثات. فان كل بدعة ضلالة
অর্থাৎ, তোমাদের জন্য আমার সুন্নাত ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ জরুরি। তোমরা তা পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরো। (ইবনে মাজা: পৃ:৫, আবু দাউদ)
এ হাদীসে রাসূল স. ও সাহাবাদের আদর্শকে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে যারা তা গ্রহণ করবেনা তাদেরকে বিদআতী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হযরত আলী রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহর উপরোক্ত দুটি হাদীস যথাত্রমে আব্দুর রহমান আস সুলামী র. ও আবুল হাসনা র. এর বর্ণনাকে লা-মাযহাবী বন্ধুরা ‘যয়ীফ’ অগ্রহণযোগ্য বলেছেন।
মূলকথা: আবু আব্দুর রহমান সুলামীর হাদীসটি ইমাম বায়হাকী র. অন্য একটি হাদীসকে সমর্থন ও শক্তিশালী করার জন্য এনেছেন। এতে প্রমাণ বহণ করে যে, বায়হাকীর নিকট হাদীসটি সহীহ। নচেৎ অন্য হাদীসকে শক্তিশালী করবে কিভাবে? তাছাড়া আস সুলামীর হাদীসকে ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. মিনহাজুস সুন্নাহ গ্রন্থে এবং ইমাম যাহাবী র. আল মুনতাকাহ গ্রন্থে দলিলস্বরূপ পেশ করে প্রমাণ করেছেন যে, হযরত আলী রা. তারাবীহর জামাত এবং রাকাত সংখ্যার বিষয় হযরত উমর রা. এর নীতিই অনুকরণ করেছিলেন। এতে আবার প্রমাণিত হলো যে, হাদীসটি ইবনে তাইমিয়া ও আল্লামা হাফেজ যাহাবীর দৃষ্টিতেও সহীহ, আমলযোগ্য।
আর আবুল হাসনা র. এর হাদীসটি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় উদ্ধৃত। এ হাদীস সম্পর্কে আলবানী ও মুবারকপুরী র. এর বরাতে লা-মাযহাবীরা বহু কটুক্তি করে থাকেন। তারা বলেন আবুল হাসনা মাজহুল ও মাতরুক (পরিত্যক্ত)। তাই এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যাত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ‘আবুল হাসনা’ নামক দুই জন রাবী ছিলেন।
একজন হলেন, হযরত আলী রা. এর সরাসরি ছাত্র এবং আমর ইবনে কাইস ও আবু সা’দ আল বাক্কালের উস্তাদ। তিনি ইবনে হাজারের মত মুহাদ্দিসদের শ্রেণী নির্ণয় অনুপাতে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর মুহাদ্দিস। পক্ষান্তরে অপর ‘আবুল হাসনা’ হলেন, আলী রা. এর ছাত্রের ছাত্র। হাকিম বিন উতায়বার শাগরেদ এবং শরীফ নাখায়ী নামক ব্যক্তির উস্তাদ। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে উভয় আবুল হাসনা এক ব্যক্তি নন;বরং ভিন্ন ব্যক্তি। আলোচ্য হাদীসে যে আবুল হাসনা রয়েছেন তিনি (সিকাহ রাবী) গ্রহণযোগ্য ও আলী রা. এর ছাত্র। তার ব্যাপারে ইবনে হাজারসহ কেউ মাজহুল (অজ্ঞাত) মাতরুক (পরিত্যক্ত) বলেননি এবং তার বর্ণনাকৃত হাদীসকেও কেউ প্রত্যাখ্যাত বলেননি। এগুলো সবই লা-মাযহাবীদের অজ্ঞতা বা জালিয়াতির বহি:প্রকাশ। হ্যাঁ, আবুল হাসনার হাদীসকে অধিকন্তু মাসতুর (مستور) বলা যেতে পারে। কারণ যদিও তার শিষ্যদের মধ্যে একাধিক বর্ণনাকারী রয়েছে কেউ কিন্তু তার ব্যাপারে সূ-খ্যাতি বর্ণনা করেনি। আর মাসতুর রাবীর বর্ণনা হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে অধিকাংশ মুহাদ্দিসদের নিকট নি:শর্তে গ্রহণযোগ্য। কেউ কেউ একটি শর্ত জুড়িয়ে দিয়েছেন যে, উক্ত হাদীসের সমর্থনে অন্য হাদীস বর্ণিত থাকা চাই। আলোচ্য আবুল হাসানা র. এর হাদীস উভয় মতানুসারে গ্রহণযোগ্য।
কারণ এ বর্ণনার সমর্থনে আবু আব্দুর রহমান আস সুলামীর হাদীস বিদ্যমান।
উপরন্তু হযরত আলী রা. যে বিশ রাকাত তারাবীহর শিক্ষা/নির্দেশ দিয়েছেন তার আরো প্রমাণ হচ্ছে, হযরত আলী রা. এর বিশিষ্ট শাগরেদ শুতাইর ইবনে শাকল র. আব্দুর রহমান বিন আবু বকর র. সাঈদ বিন আবুল হাসানা র. সুয়াইদ ইবনে গাফালাহ র. এবং আলী ইবনে রাবীয়া র. প্রমুখ সকলেই বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং পড়াতেন।
সারকথা- বিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। হযরত ওমর রা. ও হযরত আলী রা. এর যুগে তাদের আদেশক্রমে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া হতো। হযরত উসমান রা. হযরত উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত পড়েছেন ও সমর্থন দিয়েছেন। আর নিজের খেলাফতকালেও তার ব্যতিক্রম করেননি। হযরত আবু বকর রা. থেকে বিশ রাকাতের বিরুদ্ধে কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। যদিও সঠিক কত রাকাত পড়া হতো তার স্পষ্ট বর্ণনাও মিলে না।
শরীয়তের যে কোন বিষয় কোন এক খলীফার সুন্নাত হিসেবে প্রমাণিত হলে তা সকল উম্মতের জন্য নবী সা. এর হাদীসের আলোকেই অনুসরণীয় ও অনুকরনীয় সাব্যস্ত হয় এবং এর বিরোধীতা করা গুনাহ। বিশ রাকাত তারাবীহ তিন খলীফার সুন্নাত প্রমাণিত হওয়ায় এটা কেমন গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত সাব্যস্ত হলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অতিরিক্ত বিশ রাকাতের বিষয়টি রাসূল সা. এর মারফু হাদীস দ্বারাও সমর্থিত। এর পরও যদি কেউ তা প্রত্যাখ্যান করে ভিত্তিহীন দলিল দ্বারা ৮ রাকাতকেই সুন্নাত বললে নি:সন্দেহে তা হবে নব আবি®কৃত বিদআত। যা সকল যুগের উম্মাহর জন্য গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।
৩য় দলিল : ইজমায়ে সাহাবা
মুহাজির আনসারসহ সকল সাহাবায়ে কিরামের ইজমা
সাহাবায়ে কিরামকে কুরআনুল কারীম হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং অনুসরণযোগ্য সাব্যস্ত করেছে এবং মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের অনুসরণের আদেশ দিয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা সাহাবাদের পথকে “সাবীলুল মু’মিনীন” আখ্যা দিয়ে তাদের অনুকরণকে জান্নাতি হওয়ার মানদণ্ড সাব্যস্ত করেছেন। এ ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অধ্যায় আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করেছি। এখানে মাত্র একটি আয়াত পেশ করছি-
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন –
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (১১৫)
যে কেউ রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধাচরণ করে তার কাছে হেদায়েতের পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সকল মু’মিনের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ওই দিকেই ফিরিয়ে দেব। আর সে যে দিকটি অবলম্বন করবে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থল। (সুরা নিসা ১১৫)
এ আয়াতে মু’মিনের অনুসৃত পথ বলতে সাহাবায়ে কিরামের পথ বুঝানো হয়েছে।
অন্যদিকে রাসুল সা. উম্মতকে জান্নাতী ও নাজাতপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য সাহাবাদেরকে মাপকাঠি এবং মানদণ্ড সাব্যস্ত করে বলেন,ماانا عليه واصحابى “আমার ও আমার সাহাবাদের আদর্শ অনুকরণকারী দলই হচ্ছে নাজাতপ্রাপ্ত দল। সুতরাং সাহাবাদের জামাত সত্যের মাপকাঠি, নাজাতপ্রাপ্ত জামাত। তাদের আদর্শ ও কর্মধারাই উম্মতের জন্য পালনীয় ও অনুসরণীয়।
অন্যদিকে ইসলামী শরীয়া যে চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত (কুরআন হাদীস ইজমা ও কিয়াস) তার তৃতীয়টি হচ্ছে ইজমা। শরীয়তে এ ইজমার যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামের বেশ কিছু বিধান এই ইজমার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন, আবু বকর রা. নবীর প্রথম খলীফা সাব্যস্ত হওয়ার বিধান, তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হওয়ার বিধান, জুমআর দুই আযানের বিধান ইত্যাদি। ইজমার অনেকগুলো প্রকার রয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মুহাজির, আনসার সাহাবাসহ অন্যান্য সাহাবাগণের ইজমা। সুতরাং ইজমা যদি ব্যাপকভাবে অবিচ্ছিন্ন ও সম্মিলিতরূপে উম্মাহর নিকট পৌঁছে তবে তা শরীয়তে অকাট্য দলিল হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এ দলিল বিদ্যমান থাকলে ঐ বিষয়ে অন্য কোনো দলীলের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ইসলামী শরীয়া ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে। তাই ইজমা দ্বারা যে বিধান প্রমাণিত তা স্পষ্ট হাদীস না পাওয়া গেলেও বিধানটিকে অমান্য করার কোন সুযোগ বাকী থাকেনা। আমাদের আলোচ্য বিশ রাকাত তারাবীহর বিষয়টিও ইজমায়ে সাহাবা ও আনসার-মুহাজির দ্বারা প্রমানিত।
মসজিদে নববীতে প্রায় ১৪ হিজরী থেকে উমর রা. এর নির্দেশে উবাই বিন কা‘বের ইমামতিতে বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতে পড়ার নিয়ম চালু হলো। ওই জামাতে শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কিরাম, আনসার ও মুহাজিরগণ রা. মুক্তাদী হয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন। এরা সকলেই নবী সা. এর অবর্তমানে পুরা উম্মতকে কুরআন, হাদীস, ও শরীয়া শিক্ষা দিতেন। যারা মদীনার বাহিরে মক্কা, কুফা, বসরা ইত্যাদিতে অবস্থান করছিলেন। সকলেই মদীনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে খলীফায়ে রাশেদের কর্ম ও সিদ্ধান্ত অনুকরণ করেই চলতেন।
মদীনাসহ বিশ্বের যত শহরে ওই যুগে রাসূল স. এর সাহাবাদের পবিত্র জামাত ছিলো সকলেই তারাবীহ বিশ রাকাতই পড়েছেন। একজন সাহাবী সম্পর্কে কেউ দেখাতে পারবেনা যে বিশ রাকাত তারাবীহ নিয়ে কোন আপত্তি তুলেছিলেন। এটাই ইজমায়ে সাহাবা, ইজমায়ে আনসার ও মুহাজির। তার কিছু প্রমাণ এখানে তুলে ধরছি :
ক. বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে আবী রাবাহ মক্কী র. বলেন-
عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: ্রأَدْرَكْتُ النَّاسَ وَهُمْ يُصَلُّونَ ثَلَاثًا وَعِشْرِينَ رَكْعَةً بِالْوِتْرِগ্ধ(مصنف ابن ابي شيبة: ৭৬৮৮)
আমি লোকদেরকে (সাহাবী ও তাবেয়ী) দেখেছি তারা বিতরসহ তেইশ রাকাত (তারাবীহ) পড়তেন। ( মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : খ:২, পৃ:২৮৫)
সুতরাং এটা ইজমায়ে সাহাবা।
খ. ইমাম আব্দুল বার র. ‘ইসতিযকার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
وَهُوَ الصَّحِيحُ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ (مِنْ غَيْرِ خِلَافٍ مِنَ الصَّحَابَةِ (الاستذكار: ৫/১৫৭)
এটিই (বিশ রাকাত তারাবীহ) উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত এবং এতে সাহাবীগণের কোন ভিন্নমত নেই। (ইসতিযকার: ৫/১৫৭)
এখানে কারো কোন ভিন্ন মত নেই এর অর্থ হচ্ছে সবাই একমত ছিলেন। এটাই ইজমায়ে সাহাবা।
গ. ইমাম আবু বকর কাসানী র. বলেন-
وَالصَّحِيحُ قَوْلُ الْعَامَّةِ لِمَا رُوِيَ أَنَّ عُمَرَ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ – جَمَعَ أَصْحَابَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فِي شَهْرِ رَمَضَانَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّى بِهِمْ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَلَمْ يُنْكِرْ أَحَدٌ عَلَيْهِ فَيَكُونُ إجْمَاعًا مِنْهُمْ عَلَى ذَلِكَ.(بدائع الصنائع: ১/৬৪৪)
অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম যা বলেছেন তা-ই সঠিক। (অর্থাৎ তারাবীহ বিশ রাকাত) কারণ হযরত উমর রা. রমযান মাসে সাহাবায়ে কিরাম রা.কে উবাই বিন কা‘ব রা. এর ইমামতিতে একত্র করেন এবং উবাই বিন কা‘ব রা. তাদের নিয়ে প্রতি রাতে বিশ রাকাত (তারাবীহ) পড়তেন এবং তাদের একজনও এ ব্যাপারে কোন আপত্তি তুলেননি। সুতরাং এ ব্যাপারে (বিশ রাকাতের ব্যাপারে) তাদের (সাহাবাগণ) সকলের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয় (দ্র: বাদায়েউস সানায়ে খ:১,পৃ:৬৪৪)
ঘ. ইমাম ইবনে কুদামা মাকদেসী হাম্বলী র. বলেন-
لَوْ ثَبَتَ أَنَّ أَهْلَ الْمَدِينَةِ كُلَّهُمْ فَعَلُوهُ لَكَانَ مَا فَعَلَهُ عُمَرُ، وَأَجْمَعَ عَلَيْهِ الصَّحَابَةُ فِي عَصْرِهِ، أَوْلَى بِالِاتِّبَاع. (المغني لابن قدامة: ২/৬০৪)
উমর রা. যা করেছেন (জামাতের সাথে বিশ রাকাত তারাবীহ) এবং তার খেলাফত কালে অন্যান্য সাহাবীগণ যে ব্যাপারে একমত হয়েছেন তাই অনুসরণের সর্বাধিক উপযুক্ত। (আলমুগনী :২/৬০৪)
ঙ. লা-মাযহাবীদের মান্যবর শীর্ষ আলেম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. ইজমার কথাটি ভিন্ন ভাষায় এভাবে বলেন-
إِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنَّ أبي بْنَ كَعْبٍ كَانَ يَقُومُ بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً فِي قِيَامِ رَمَضَانَ وَيُوتِرُ بِثَلَاثِ. فَرَأَى كَثِيرٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ أَنَّ ذَلِكَ هُوَ السُّنَّةُ؛ لِأَنَّهُ أَقَامَهُ بَيْن الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَلَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ.(مجموع الفتاوي: ২৩/১১২-১৩)
অর্থাৎ এটা প্রমাণিত যে উবাই বিন কা‘ব রা. রমযানে তারাবীহতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাতই পড়তেন। তাই অধিকাংশ আলেম এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, এটাই (বিশ রাকাত) সুন্নাত। কেননা উবাই বিন কা‘ব রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই বিশ রাকাত পড়িয়েছেন এবং কেউ তাতে আপত্তি উত্থাপন করেননি। (দ্র: মাজমুউল ফাতাওয়া: খ: ২৩,পৃ:১১২-১১৩)
সারকথা : সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র যুগে তারাবীহ বিশ রাকাতের বিষয়টি সকলের ঐক্যমতেই সুপ্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোন সাহাবীর এ ব্যাপারে দ্বিমত ছিলনা। কেউ এর উপর আপত্তিও তোলেনি। তাহলে এটাই নাজাতপ্রাপ্ত জামাতের মত-পথ। কুরআনের ভাষায় এটাই সাবিলুল মু‘মিনীন (سبيل المؤمنين) তথা মুমিনগণের মত। এরা কেউ বিশ রাকাতকে নাজায়েযও বলতেন না বিদআতও আখ্যা দিতেন না। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধীও বলতেন না। এগুলো নাজাতপ্রাপ্ত জামাতের পরিচয়। আজ যারা ২০ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলছে, সুন্নাতের খেলাফ বলে প্রচার করছে তারা মুমিনগণের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
আর সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতের বরাতে পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, মুমিনগণের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে যারা চলবে তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান। আল্লাহ সকলকে হেদায়াত দান ও হিফাজত করুন। আমীন।
৪র্থ দলিল : মারফুয়ে হুকমী
‘মারফুয়ে হুকমী’ বলা হয়- সাহাবাদের এমন কথা বা কাজকে, যাতে ইজতিহাদ ও কিয়াসের সুযোগ নেই। উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহের মূলনীতি অনুযায়ী ‘মারফুয়ে হুকমী’ মারফু হাদীস (নবীজীর কথা ও কাজ)-এরই একটি প্রকার। কারণ এটা তো স্পষ্ট যে, যেসব বিষয়ে যুক্তি ও ইজতিহাদ চলে না ঐ সব ক্ষেত্রে সাহাবারা রাসূল সা. থেকে না শুনে কোনো কাজ করতেন না। (মুকাদ্দামাতুশ শায়খ : পৃ: ১, মুকাদ্দামা ইবনে সালাহ : পৃ.৭৬-৭৭)
ইতোপূর্বে বিশ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত, মুহাজির-আনসারসহ অন্যান্য সাহবীদের ইজমা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো তো স্বতন্ত্র দলিল। পাশাপাশি মারফুয়ে হুকমীও আরেক দলিল। কারণ নামাযের রাকাত সংখ্যা কিয়াস দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। সাহাবা ও তাবেঈনরা যুগ যুগ ধরে বিশ রাকাত পড়েছেন। তারা নিশ্চয়ই ২০ রাকাত তারাবীহকে রাসূলের সা. আদর্শ হিসাবে জানতেন। তাই তারা এর উপরই আমল করেছেন।
এ বিষয়টি ইমাম আবু হানীফা র.-এর কথায চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে-
روى أسد بن عمرو عن أبي يوسف قال سألت أبا حنيفة عن التراويح وما فعله عمر رضي الله عنه فقال : التراويح سنة مؤكدة ولم يتخرصه عمر من تلقاء نفسه ولم يكن فيه مبتدعا ولم يأمر به إلا عن أصل لديه وعهد من رسول الله صلى الله عليه و سلم ،ولقد سن عمر هذا وجمع الناس علي ابي بن كعب فصلاها جماعة والصحابة متوافرون منهم عثمان وعلي وابن مسعود والعباس وابنه وطلحة والزبير ومعاذ وابي وعيرهم من المهاجرين والانصار ومارد عليه واحد منهم بل ساعدوه ووافقوه وامروا بذلك.
“আবু ইউসুফ র. বলেন, আমি আবু হানীফা র.কে তারাবীহ ও এব্যাপারে উমরের রা. কর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। উমর রা. অনুমান করে নিজের পক্ষ থেকে এটা নির্ধারণ করেননি। এক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছুও উদ্ভাবন করেননি। তিনি তাঁর নিকট বিদ্যমান ও রাসূল স. থেকে প্রাপ্ত কোনো নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই আদেশ দিয়েছেন। তাছাড়া উমর রা. যখন উবাই বিন কা‘বের রা. ইমামতিতে লোকদেরকে জমা করে এই প্রথা চালু করলেন, তখন বিপুল পরিমাণ সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত উসমান, আলী, ইবনে মাসউদ, আব্বাস, ইবনে আব্বাস, তালহা, যুবাইর, মুআয ও উবাই রা. প্রমুখ মুহাজির ও আনসার সাহাবা ছিলেন। তাদের কেউই এর উপর আপত্তি করেননি। বরং সকলেই তাকে সমর্থন করেছেন, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন এবং অন্যদেরও এই আদেশ দিয়েছেন।” (আল ইখতিয়ার লি তা‘লীলিল মুখতার : ১/৯৪)
৫ম দলিল : সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা
সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা তথা তাআমুলে উম্মত
শরীয়তের একটি মৌলিক দলিল হচ্ছে- (تعامل امت) তথা মুসলিম উম্মার ব্যাপক ও অবিচ্ছিন্ন সম্মিলিত কর্মধারা। এটাকে সুন্নাতে মুতাওয়ারাসাও বলে। এটি হাদীস ও সুন্নাহর একটি উন্নত প্রকার। যার গ্রহণযোগ্যতা মৌখিক বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত হাদীস থেকেও অনেক শক্তিশালী । এ প্রসঙ্গে খতীব বাগদাদী র. الفقيه والمتفقه কিতাবে باب القول فيما يرد به الخبر الواحد অনুচ্ছেদে মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত তাব্বা মালেকীর কথা উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন যে,
كل حديث جائت عن النبي (ص) لم يبلغك احدا من اصحابه فعله فدعه. ০ج১/১৩২)
অর্থাৎ- তোমার নিকট নবীজীর কোনো সহীহ হাদীস পৌঁছলেও যদি তার উপর সাহাবীদের কাউকে আমল করতে না দেখ তাহলে তা ছেড়ে দাও। (১/১৩২)
* ইমাম যাহাবী র. হাদীস সহীহ সূত্রে বর্ণিত হলেও তা আমলযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে এক নীতির পর্যালোচনায় বলেন-
لَكِنْ بِشَرْطِ أَنْ يَكُونَ قَدْ قَالَ بِذَلِكَ الحَدِيْثِ إِمَامٌ مِنْ نُظَرَاءِ الإِمَامَيْنِ مِثْلُ مَالِكٍ، أَوْ سُفْيَانَ، ……….و أَمَّا مَنْ أَخَذَ بِحَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَقَدْ تنكَّبَهُ سَائِرُ أَئِمَّةِ الاِجتهَادِ، فَلاَ. (سير اعلام النبلاء: ১৬/৪০৪)
মর্মার্থ : হাদীসকে সহীহ পেলেও আমল করার জন্য মালেক ও সুফিয়ান র. এর মতো মুজতাহিদ ইমামগণ তা গ্রহণ করেন কিনা তা দেখতে হবে। যে ব্যক্তি হাদীস সহীহ পাওয়া মাত্র গ্রহণ করেন অথচ ইমামে মুজতাহিদগণের কেউ তা গ্রহণ করলো না তা মানা সঠিক হলো না। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৬/৪০৪)
* ইমাম আওযায়ী র. বলেন-
كنا نسمع الحديث فنعرضه علي اصحابنا كما يعرض الدرهم الزائف فما عرفوا منه اخذناه وما انكروا تركناه. (المحدث الفاضل للمروزي: ৩১৮)
মর্মার্থ : আমরা হাদীস শুনতাম অত:পর তা মুজতাহিদ ইমামগণের নিকট পেশ করতাম। যেমনিভাবে খাইটযুক্ত দিরহাম যাচাই করা হয়। তারা যদি তা মানার যোগ্য বলতেন তাহলে তা মেনে নিতাম। অন্যথায় তার উপর আমল করা থেকে বিরত থাকতাম। (আল মুহাদ্দিসুল ফাযিল পৃ:৩১৮)
* ইমাম মালেক র. কাজী মুহাম্মাদ বিন হাযম কর্তৃক আদালতের ফয়সালা বাহ্যিকভাবে সহীহ হাদীস এর বিপরীত হলে তার ব্যাখ্যার ব্যাপারে মন্তব্য করেন:
ما اجمع عليه العلماء المدينة يريد بأن العمل بها اقوي من الحديث. (الاثر الحديث الشريف للعوام: ص৯২)
মর্মার্থ : মদীনার ওলামায়ে কিরাম যার উপর ঐক্যবদ্ধ তা সহীহ হাদীসের উপর আমল করা থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। (আছরুল হাদীস আশশরীফ পৃ৯২)
* ইমাম ইবনে আবী যাইদ কাইরাওয়ানী র. আহলে সুন্নাত ওয়াল হকের আলামতস্বরূপ বলেন-
والتسليم للسنن لاتعارض برأي ولا تدافع بقياس وما تأوله منها السلف الصالح تأولناه وما عملوا به عملناه وما تركوه تركناه. (كتاب الجامع: ص১১৭)
অর্থাৎ সুন্নাত হাদীসকে মানতে হবে। কোনো রায় বা কিয়াস দ্বারা হাদীস অমান্য করা যাবে না। সালাফে সালেহীন হাদীসের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেন সে ব্যাখ্যা অনুপাতেই আমল করবো। তারা যেভাবে আমল করেছেন আমরাও তার উপর আমল করবো। আর তারা যেটাকে আমলের ব্যাপারে বিরত রয়েছেন তার উপর আমরা আমল করবো না। (আল জামে ১১৭)
উপরোক্ত কয়েকজন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের মন্তব্য পেশ করলাম যার সারমর্ম হচ্ছে, সাহাবা, তাবেয়ী এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ধারাবাহিক আমল যা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারারূপে প্রমাণিত তা কোনো সহীহ হাদীসের বিপরীত মনে হলেও গ্রহণযোগ্য। কারণ হাদীসটির মর্ম উদ্ঘাটনে তারাই সর্বাধিক অভিজ্ঞ (وهو اعلم الناس بمعاني الحديث) কেননা এ সম্মিলিত নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রমাণিত ও বিদ্যমান কর্মধারা যাকে সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা বলে তা খবরে ওয়াহিদ (الخبر
الواحد) থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী।
আমাদের আলোচ্য বিষয় “বিশ রাকাত তারাবীহ”র ব্যাপারে ইতি মধ্যে উল্লেখ করেছি যে, এর ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম মুহাজির আনসারসহ সকলের আমলী ঐক্যমত রয়েছে। খুলাফায়ে রাশেদীনের (তিন খলীফা) ঐক্যবদ্ধ কর্মধারা বা আমল, বিভিন্ন শহরের ফকীহ ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা দ্বারা প্রমাণিত। তাই এটা যে সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা ও তাআমুলে উম্মত তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। মূলত বিশ রাকাত তারাবীহর ক্ষেত্রে এটাই মৌলিক দলিল যা সকল উম্মতের জন্য পালনীয়। এর বিপরীত কোনো সহীহ হাদীস নেই। যে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হয় এগুলো অত্যন্ত দুর্বল (যা পরে আলোচনা করা হবে)। এমতাবস্থায় এমন শক্তিশালী দলিলকে উপেক্ষা করে আট রাকাত পড়াকে সুন্নাত আর ততোধিক পড়াকে নাজায়েয বা বিদআত বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং এটা হবে নবীর সকল ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর বিরুদ্ধাচরণ যা মারাত্মক গোমরাহী বৈ কী।
তারাবীর বিশ রাকাত যে, তাআমুলে উম্মত বা সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত তার যথেষ্ঠ প্রমাণ ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে।এখানে কয়েকটি প্রমাণ পেশ করছি:
* সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকারক ইমাম নববী র. লিখেন-
الْأَفْضَلُ صَلَاتُهَا جَمَاعَةً كَمَا فَعَلَهُ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ وَالصَّحَابَةُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَاسْتَمَرَّ عَمَلُ الْمُسْلِمِينَ عَلَيْهِ لِأَنَّهُ مِنَ الشَّعَائِرِ الظَّاهِرَةِ. (شرح النووي علي مسلم: ৬/৩৯،رقم: ৭৫৯)
উত্তম হচ্ছে তারাবীহ জামাতের সাথেই আদায় করা। যেমনটি উমর রা. ও সাহাবায়ে কিরাম করেছিলেন (এবং তা বিশ রাকাতই ছিলো) আর মুসলিম উম্মার সর্ব যুগের আমল ও কর্মধারা এরূপই ছিলো। (শরহে মুসলিম- ৬/৩৯)
তিনি আরো লিখেন-
اعلم أن صلاة التراويح سُنّة باتفاق العلماء، وهي عشرون ركعة، يُسَلِّم من كل ركعتين. (الاذكار: ص৮৩)
তারাবীহর নামায সুন্নাত হওয়ার বিষয়ে সকল উলামা একমত। এ নামায বিশ রাকাত। যার প্রতি দু’রাকাতেই সালাম ফেরাতে হয়। (শরহুল মুসলিম, আল আযকার পৃ.৮৩)
ক. মক্কাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل مكة
* ইমাম শাফেয়ী র. মক্কাবাসীর আমল বা তাআমুল সম্পর্কে বলেন:
وَأَحَبُّ إلَيَّ عِشْرُونَ؛ لِأَنَّهُ رُوِيَ عَنْ عُمَرَ وَكَذَلِكَ يَقُومُونَ بِمَكَّةَ وَيُوتِرُونَ بِثَلَاثٍ.(الأم للشافعي: ص১৪২)
তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া আমার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়। কারণ উমর রা. থেকে এরূপই বর্ণিত হয়েছে। মক্কাবাসীও তারাবীর নামায এভাবেই (বিশ রাকাত) আদায় করতেন। আর তারা বিতর নামায তিন রাকাত পড়ে থাকেন। (কিতাবুল উম্ম লিশ শাফেয়ী)
ইমাম তিরমিযী র. সকল মুজতাহিদ ইমামগণের মতামত ব্যক্ত করার পর ইমাম শাফেয়ী কর্তৃক মক্কাবাসীর আমল এভাবে তুলে ধরেন-
وَأَكْثَرُ أَهْلِ العِلْمِ عَلَى مَا رُوِيَ عَنْ عُمَرَ، وَعَلِيٍّ، وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَهُوَ قَوْلُ الثَّوْرِيِّ، وَابْنِ المُبَارَكِ، وَالشَّافِعِيِّ ” وقَالَ الشَّافِعِيُّ: ্রوَهَكَذَا أَدْرَكْتُ بِبَلَدِنَا بِمَكَّةَ يُصَلُّونَ عِشْرِينَ رَكْعَةًগ্ধ (سنن الترمذي: ১/১৬৬)
অধিকাংশ আহলে ইলম ওই মতই পোষণ করেন যা উমর রা. আলী রা. এবং অন্যান্য সাহাবীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে তথা তারাবীহ বিশ রাকাত ৩৬ রাকাত নয়। যেমন ইমাম মালেক পড়তেন। সুফিয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক ও ইমাম শাফেয়ীর মতও তাই। ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, আমি মক্কাবাসীকে মক্কা শরীফে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তে দেখেছি। (জামে তিরমিযী ১/১১৬)
মক্কার অধিবাসী বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা বিন আবি রাবাহ র. বলেন-
– حَدَّثَنَا ابْنُ نُمَيْرٍ، عَنْ عَبْدِ الْمَلِكِ، عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: ্রأَدْرَكْتُ النَّاسَ وَهُمْ يُصَلُّونَ ثَلَاثًا وَعِشْرِينَ رَكْعَةً بِالْوِتْرِগ্ধ (مصنف ابن ابي شيبة: رقم: ৭৬৮৮)
আমি লোকদের (মক্কাবাসী) বিতরসহ তেইশ রাকাত পড়তে দেখেছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৭৬৮৮)
মক্কার কাযী ও মুয়ায্যিন ইবনে আবী মুলাইকাহ র. সম্পর্কে হযরত নাফে বিন উমর র. বলেন-
كان ابن ابي مليكة يصلي بنا في رمضان عشرين ركعة. (اثار السنن : ص২৯২)
তিনি আমাদের নিয়ে রমযানে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। (আসারুস সুনান পৃ.২৯২)
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মক্কাবাসীর তাআমুল تعامل اهل مكة বিশ রাকাত । আর এটাই সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা।
খ. মদীনাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل مدينة
চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, মদীনাবাসীও সর্বদা তারাবীহর নামায বিশ রাকাতই পড়েছেন; বর্তমানেও তাই। তবে কিছু উদ্যমী মানুষ মক্কাবাসীকে বিশ রাকাতের পাশাপাশি চারটি তাওয়াফ ও তাওয়াফ পরবর্তী আট রাকাত নামায আদায় করতে দেখে চার তাওয়াফের পরিবর্তে আট রাকাত এবং তাওয়াফের আট রাকাত এর বিনিময় আরো আট রাকাত মোট ষোল রাকাত বৃদ্ধি করে সর্বমোট ৩৬ রাকাত তারাবীহ পড়া আরম্ভ করেন। অত:পর তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এতে ৩৯ রাকাত হয়ে যেতো। তবে এদেরও মূল তারাবীহ হতো বিশ রাকাত। অতিরিক্ত ১৬ রাকাত মুস্তাহাব বা ফযীলত অর্জন তথা মক্কাবাসীর সমান সওয়াব পাওয়ার লক্ষেই পড়া হতো । এ ব্যাপারে ইমাম সুয়ূতী র.-এর বিশ্লেষণ নিম্নরূপ-
وَذَكَرَ السُّيُوطِيُّ فِي رِسَالَتِهِ أَنَّهُ يُسْتَحَبُّ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ سِتًّا وَثَلَاثِينَ رَكْعَةً تَشْبِيهًا بِأَهْلِ مَكَّةَ، حَيْثُ كَانُوا يَطُوفُونَ بَيْنَ كُلِّ تَرْوِيحَتَيْنِ طَوَافًا وَيُصَلُّونَ رَكْعَتَيْهِ، وَلَا يَطُوفُونَ بَعْدَ الْخَامِسَةِ، فَأَرَادَ أَهْلُ الْمَدِينَةِ مُسَاوَاتَهُمْ، فَجَعَلُوا مَكَانَ كُلِّ طَوَافٍ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ، وَلَوْ ثَبَتَ عَدَدُهَا بِالنَّصِّ لَمْ تَجُزْ الزِّيَادَةُ عَلَيْهِ، وَلَأَهْلُ الْمَدِينَةِ وَالصَّدْرُ الْأَوَّلُ كَانُوا أَوْرَعَ مِنْ ذَلِكَ.(مرقاة المفاتيح: ৩/১৯৩، باب قيام شهر رمضان)
অর্থাৎ মক্কাবাসী তারাবীহর প্রতি চার রাকাত পর (বিশ্রামের সময়) তাওয়াফ করে নিতেন এবং দুই রাকাত নামাযও পড়তেন। তবে শেষ বৈঠকে এমনটি করতেন না। মদীনাবাসী এটা দেখে তাদের সামঞ্জস্যতার লক্ষে প্রতি তারবীহর পরিবর্তে (তাওয়াফ ও নামাযসহ) চার রাকাত নফল পড়তেন। এভাবে ৪দ্ধ৪=১৬ রাকাত বৃদ্ধি হয়ে যায়।
কিন্তু সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলেম মসজিদে নববীর সুখ্যাত মুদাররিস ও শরীয়া আদালতের কাযী (আমার সরাসরি উস্তাদ) শায়খ আতিয়্যাহ সালিম ‘মসজিদে নববীর হাজার বছরের তারাবীহর ইতিহাস’ নামক আরবীতে তার লেখা একটি কিতাবে প্রমাণ করেছেন যে, বিশ রাকাত তারাবীহই ছিলো মসজিদে নববীর ধারাবহিক তাআমুল।
তিনি তার কিতাব (التراويح اكثرمن الف عام) এ স্ববিস্তারে তা পেশ করেছেন।
প্রথম শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
উপরোক্ত আলোচনায় সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন অনুচ্ছেদে দেখেছেন যে হযরত উমর রা. এর যুগ থেকে শুরু করে খিলাফতে রাশেদার পূর্ণ যুগ এবং তারপরও সাহাবাদের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তারাবীহ বিশ রাকাতই পড়া হতো।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
শায়খ আতিয়্যাহ বলেন,
مضت المائة الثانية والتراويح ست وثلاثون وثلاث وتر ودخلت السنة الثالثة وكانت المظنون أن فظل علي ماهي عليه تسع وثلاثون بما فيه الوتر. (التراويح اكثر من الف عام: ص৪১)
দ্বিতীয় শতাব্দিতে তারাবীহ ছত্রিশ রাকাত পড়া হতো এবং বিতর পড়া হতো তিন রাকাত। তৃতীয় শতাব্দীতেও তদরূপ বিতরসহ উনচল্লিশ রাকাতই পড়া হতো।
চতুর্থ ,পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে মসজিদে তারাবীহ
তিনি লিখেন,
عادت التراويح في تلك الفطرة كلها الي عشرين ركعة فقط بدلا من ست وثلاثني في السابق. ص৪২
এই তিন শতাব্দীতে ছত্রিশ এর পরিবর্তে পূনরায় বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া আরম্ভ হয়।
অষ্টম, নবম, দশম, ও একাদশ শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
তিনি লিখেন,
فكان يصلي التراويح أول الليل بعشرين ركعة على المعتاد. ثم يقوم آخر الليل في المسجد بست عشرة ركعة. (ص৪৭)
প্রথম রাতে যথারীতি তারাবীহর নামায বিশ রাকাতই পড়া হতো। তবে শেষ রাতে ষোল রাকাত নামাজ মসজিদেই পড়া হতো।
দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও অনুরূপ ছিলো (আত তারাবীহ পৃ.৪৭)
চতুর্দশ শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
তিনি লিখেন:
دخل القرن الرابع عشر والتراويح في المسجد النبوي على ما هي عليه من قبل وظلت إلى قرابة منتصفه.(ص৫৮)
চৌদ্দতম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত মসজিদে নববীতে তারাবীহর নামায পূর্বের মতোই অব্যাহত ছিলো। (বিশ রাকাত প্রথম রাতে শেষ রাতে ষোল রাকাত)
এ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের ব্যাপারে তিনি লিখেন :
ثم جاء العهد السعودي فتوحدت فيه الجماعة في المسجد النبوي وفي المسجد الحرام للصلوات الخمس وللتراويح. أما عدد الركعات وكيفية الصلاة فكانت عشرين ركعة بعد العشاء وثلاثا وترا، وذلك طيلة الشهر……… وعليه فتكون التراويح قد استقرت على عشرين ركعة على ما عليه العمل في جميع البلاد وعليه المذاهب الثلاثة. (التراويح اكثر من الف عام: ص৬৫)
অর্থাৎ এ সময় সৌদি শাসনামলের সূচনা হয় এবং মক্কা মদীনার পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও তারাবীহর ব্যবস্থাপনা অধিক সুসংহত করা হয়। এ সময় পুরো রমযানে এশার পর বিশ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিতর পড়া হতো। এতে প্রতীয়মান হয়, বিশ রাকাত তারাবীহ-ই ছিলো মসজিদে নববীর সর্বযুগের আমল। মদীনা ছাড়া অন্যান্য ভূখণ্ডেও এ নিয়ম জারী ছিলো। (আত তারাবীহ আকসার মিন আলফে আম পৃ.৬৫)
(অধম লিখক) বলছে, ১৯৮৩ সাল তথা চতুর্দশ হিজরীর শেষ দিকে আমি ইমাম মোহাম্মদ বিন সাউদ ভার্সিটিতে অধ্যায়নকালে বিতর সম্পর্কে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি। বিশ রাকাত তারাবীহর পর বিতর পড়া হতো। আবার শেষ রাতে ১০রাকাত পড়া হতো এবং এরপর পুনরায় বিতর পড়া হতো তিন রাকাত। সর্বমোট তের রাকাত। বিতর একাধিকবার পড়ার ওপর কিছু আলেম আপত্তি করলে প্রথমে ইমাম পরিবর্তন করা হয়। যিনি প্রথম রাতে বিতর পড়াতেন তিনি শেষ রাতে পড়াতেন না। অবশেষে যা বর্তমান সময়েও জারি আছে তা হলো- এশার পর বিশ রাকাত তারাবীহ পড়িয়ে বিতর পড়া থেকে বিরত থাকতেন এবং শেষ রাতে ১০রাকাতের পর তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। মক্কা ও মদীনাতে একই নিয়ম এখনো চালু রয়েছে।
গ. কুফাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل كوفة
কুফাবাসীর আমলও মক্কা মদীনাবাসী সাহাবা ও তাবেয়ীগণের আমল থেকে ব্যতিক্রম ছিলো না। কুফা ছিলো হযরত আলী রা.-এর রাজধানী। তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দিয়ে তারাবীহর নিয়ম চালু করার কথা পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা.ও কুফাতেই বসবাস করতেন,হাদীস ও ফিকহের দরস দিতেন। তিনিও বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন (দ্র. কিয়ামুল লাইল পৃ.৯১)
আরো যেসব প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কুফাতে ছিলেন এবং বিশ রাকাত তারাবীহ পড়িয়েছেন তাদের মধ্যে আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ র. সুয়াইদ ইবনে গাফালাহ র. আলী ইবনে রাবীআ র. সাঈদ ইবনে যুবাইর র. সুফিয়ান ছাওরী র. ইমাম আবু হানীফা র. প্রমুখ ছিলেন অন্যতম।
ঘ. বসরাবাসীর তাআমুল
সাহাবা ও তাবেয়ীর যুগে ইরাকের বসরা নগরী ইলম ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী ছিলো। বহু সাহাবা ও তাবেয়ী এ শহর আবাদ করেছিলেন। হাদীসের দরসের পাশাপাশি ফিকহের দরসও অবিরাম চালু ছিলো। মুহাদ্দিস ও ফুকাহায়ে তাবেয়ীর সকলেই বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এর কমে পড়ার কোনো প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। এ শহরের বিশিষ্ট তাবেয়ী যারা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আব্দুর রহমান বিন আবু বকর র. সাঈদ বিন আবুল হাসান র. ইরান আবদী র. যুরারা ইবনে আবু আওফা র. প্রমুখ।
ঙ. বাগদাদবাসীর তাআমুল
বাগদাদ শহরে জন্ম নিয়েছেন ইসলামের যুগশ্রেষ্ঠ মনিষীগণ। তাদের ইমাম আহমদ বিন হাম্বল র. প্রথম সারির ফকীহ ছিলেন। যিনি হাম্বলী মাযহাবের ইমাম। তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করতেন, এটাই তার মাযহাব ছিলো। দেখুন এই মাযহাবের কিতাবসমূহ।
এরপর যাহেরী মাযহাবের ইমাম দাউদ যাহেরী র. ও বাগদাদের অধিবাসী। তিনিও তারাবীহ বিশ রাকাতের পক্ষে ছিলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক র. তিনিও বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। ইসহাক বিন রাহ্ওয়াই র. তিনিতো ৪১রাকাত পর্যন্ত পড়তেন। (দ্র. কিয়ামুল লাইল পৃ.৯২)
পরিশিষ্ট
একটি প্রশ্ন ও তার খণ্ডন
সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা বা তাআমুলে সাহাবা ও তাবেয়ীন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় প্রমাণিত হলো যে, বিশ রাকাত তারাবীহ সারা বিশ্বে সাহাবাযুগ থেকে সর্বকালের উলামা ও উম্মতের এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক আমল। এটি সাধারণ সহীহ হাদীস থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- হাদীস থেকেও বেশী শক্তিশালী হয় কীভাবে ?
এর সংক্ষিপ্ত জবাব-
এ ধরণের ব্যাপক সম্মিলিত কর্মধারার পেছনে মূলত রাসূল সা.-এর শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা অবশ্যই বিদ্যমান যা অনেকের হয়তো জানার বাইরে। কেননা নবী স.-এর সকল সাহাবা, তাবেয়ী নবীর স্পষ্ট সহীহ হাদীস ও শিক্ষার বিপরীতে তার অন্য কোনো নির্দেশনা ছাড়া মন মতো শরীয়তের বিষয়ে আমলী সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন তা কল্পনাতীত।
দেখুন, আমাদের আলোচ্য বিষয়টিতে যদি তারাবীহর নামায আট রাকাত এ ব্যাপারে রাসূল সা.-এর থেকে সুস্পষ্ট সহীহ হাদীস বিদ্যমান থাকতো, এর বিপরীতে বিশ রাকাতের ব্যাপারে নবীজীর কোনো দিকনির্দেশনা না থাকতো, তাহলে হযরত উমরের যুগ থেকে নিয়ে সর্বকালের সাহাবা তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদ এমনিতে বিশ রাকাত তারাবীহর উপর একমত হয়ে তা আমলীভাবে গ্রহণ করে শরীয়তের বিধানটি চালু করে নিয়েছেন এ কথা কোনো বিবেকহীন বিশ্বাস করতে পারে না।
বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য হযরত উবাই বিন কা‘বের বর্ণনাটি পড়ে দেখুন- (যা পূর্বেও পেশ করা হয়েছে)
عن أبي بن كعب أن عمر بن الخطاب أمره أن يصلي بالليل في رمضان فقال: إن الناس يصومون النهار ولا يحسنون أن يقرأوا فلو قرأت عليهم بالليل، فقال: يا أمير المؤمنين هذا شيء لم يكن، فقال: قد علمت ولكنه حسن فصلى بهم عشرين ركعة.(كنز العمال: ৮/৪০৯،رقم: ২৩৪৭০)
অর্থাৎ হযরত উমর রা. উবাই বিন কা‘বকে রমযানে লোকদের নিয়ে নামায পড়ার আদেশ দিতে গিয়ে বলেন, তারা দিনে রোযা রাখে কিন্তু রাতের বেলায় সুন্দরভাবে কোরআন পড়তে পারে না। আপনি যদি তাদের নিয়ে কুরআন পড়েন (অর্থাৎ জামাতে নামায আদায় করতেন) উত্তরে উবাই বলেন, আমীরুল মুমিনীন এ বিষয়টি (জামাতে তারাবীহ) আগে করা হতো না। উত্তরে উমর রা. বলেন, তা আমি ভালো করে জানি;তবে এটা ভালো কাজ। এরপরই উবাই রা. তাদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া আরম্ভ করেন। (হাদীসটির মান হাসান)
এ হাদিসে দেখার বিষয় হচ্ছে- কয়েকটি ছোট ছোট দলকে নিয়ে জামাতের সাথে একত্রিত করে এক ইমামের পিছনে নামাজ আদায় করার নিয়ম বানানো একটি ব্যবস্থাপনাগত বিষয় ছিল। আর তিন বার হলেও রাসূল স. তা নিজেই আমল করেছিলেন তথাপি উবাই রা. এ ব্যাপারে নিজের সংশয়ের কথা প্রকাশ করলেন (هذا شيئ لم يكن) কিন্তু তিনি তারাবীহ যে বিশ রাকাত পড়তে আরম্ভ করলেন এ ব্যাপারে তো কোনো সংশয় পেশ করলেন না ?
অথচ তারাবীহর রাকাত সংখ্যা তো কোনো ব্যবস্থাপনাগত বিষয় ছিলো না; বরং শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। যা কিয়াস করে নিজে নিজেই নির্ধারণ করার বিষয় নয়। এরপরও কেন তিনি আপত্তি বা সংশয় প্রকাশ না করে বিশ রাকাত পড়ে দিলেন? আচ্ছা তার সাথে যারা নামাজ আদায় করেছেন- আশারায়ে মুবাশশারাহ (আবু বকর ছাড়া) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম তারাও কি কোনো আপত্তি তুলেছিলেন ?
সবাই এমন একটি শরয়ী বিধানকে একবাক্যে মেনে নেয়া বিশেষ করে হযরত উবাইয়ের তাতে প্রশ্ন না তোলা প্রমাণ করে, বিশ রাকাতের উপর সকলের আমল ও তাআমুল এর পিছনে রাসূল সা.-এর অবশ্যই কোনো দিকনির্দেশনা ছিলো। যা হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে মারফু দ্বারা প্রমাণিত। তা না হলে প্রাণ যেতেও সাহাবারা শুধু হযরত উমরের কথায় বিশ রাকাতের উপর একমত হতেন না। কিংবা হযরত উমর রা. এর মত বিদআত বিরোধী শক্ত মেজাযের মানুষ আট রাকাতের শিক্ষা বিদ্যমান থাকতে বিশ রাকাত পড়ার কথা বলতেন না।
এ বিষয়টিই ইমাম আবু হানীফা র. এর ভাষায়-
فَقَالَ: التَّرَاوِيحُ سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ وَلَمْ يَتَخَرَّصْهُ عُمَرُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ مُبْتَدِعًا، وَلَمْ يَأْمُرْ بِهِ إِلَّا عَنْ أَصْلٍ لَدَيْهِ وَعَهْدٍ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ. (الاختيار لتعليل المختار للموصلي: ১/৭০)
“তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং উমর রা.তা নিজের পক্ষ থেকে অনুমান করে নির্ধারণ করেননি; বরং তিনি দলীলের ভিত্তিতে এবং নবীজী থেকে প্রাপ্ত কোনো নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই আদেশ প্রদান করেছেন।”
ষষ্ট দলিল : ইজমায়ে উম্মত
বিশ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে সাহাবা, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীসহ পুরো উম্মতের ইজমা সংগঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য আলেম-ফকীহদের মত এবং গ্রহণযোগ্য কিতাবসমূহের ইবারত তুলে ধরা হলো-
(১) মোল্লা আলী আল-কারী র. বলেন- أجمع الصحابة علي أن التراويح عشرون ركعة.
অর্থাৎ ‘সাহাবারা ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, তারাবীহ ২০ রাকাত।’ (মিরকাত ৩/৩৪৬-মাকতাবা আশরাফিয়া)
(২) আল্লামা আইনী র. ইবনে আব্দুল বার র.-এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন-
وهو قول جمهور العلماء وبه قال الكوفيون و الشافعى وأكثر الفقهاء ، وهو الصحيح عن أبى بن كعب من غير خلاف من الصحابة –
“এ মত পোষণ করেন কুফাবাসী, ইমাম শাফেয়ী র. ও অধিকাংশ ফুকাহা। আর
সাহাবাদের থেকে মতানৈক্য ছাড়া ২০ রাকাত প্রমাণিত। (উমদাতুল কারী : ৮/২৪৬-মাকতাবা যাকারিয়া)
(৩) কাযীখান র. তার স্বীয় ফাতওয়া গ্রন্থে লিখেন-
وهو المشهور من الصحابة والتابعين-
“সাহাবা ও তাবেয়ী থেকে এটাই (২০ রাকাত পড়া) প্রসিদ্ধ।”(ফাতাওয়া কাযীখান : ১/২০৬)
(৪) ইবনে হাজার মাক্কী র. বলেন, ২০ রাকাতের উপর সাহাবাদের ইজমা রয়েছে। (ইনারাতুল মাসাবীহ : পৃ.১৮)
(৫) আব্দুল হাই লাখনবী র. লিখেন-
ثبت اهتمام الصحابة على عشرين فى عهد عمر و عثمان وعلى فمن بعدهم-
“হযরত উমর, উসমান, আলী রা.-এর যুগে এবং পরবর্তীতে সাহাবাদের ২০ রাকাতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রমাণিত।”(হাশিয়ায়ে শরহে বেকায়া : ১/১৭৫- আশরাফী বুক ডিপো)
(৬) ‘ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন’ নামক কিতাবে আছে-
وبالإجماع الذى وقع فى زمن عمر أخذ أبو حنيفة و الشافعى وأحمد و الجمهور.
‘উমর রা.-এর যুগে যে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা-ই গ্রহণ করেছেন আবু হানীফা, শাফেয়ী, আহমাদ র. ও অধিকাংশ আলেম-ফকীহ।’ (৩/৪২২)
ইবনে কুদামা র. মুগনীতে (২/৩৬৪), শামসুদ্দীন র. শরহে মুকান্নাতে (১/৮৫২), আ. হাই লাখনবী র. আত তা‘লীকুল মুমাজ্জাদে (পৃ:৫৩), মোল্লা আলী আল-কারী র. শরহে নেকায়াতে (পৃ.১০৪) এবং নবাব সিদ্দীক হাসান খান (যিনি গায়রে মুকাল্লিদদের গুরু) আওনুল বারীতে (২/৩০৭)। ২০ রাকাত তারাবীহর উপর ইজমা উল্লেখ করেছেন।
উপরন্তু (১২-১৩) ইমাম নববী র. “باتفاق المسلمين” শব্দ দ্বারা (আল আযকার পৃ. ৮৩) আর ইবনে তাইমিয়া র. فلما “جمعهم” عمر علي ابي بن كعب. বাক্য দ্বারা (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ১১/৫২০) ইজমা নকল করেছেন।
(১৪-১৫) তাহতাবী র. হাশিয়ায়ে তাহতাবীতে (১/২৯৬-মাকতাবা রশীদিয়া,কোয়েটা) আর শারাম্বুলালী র. মারাকীউল ফালাহতে (পৃ.৮১) “متوارث” শব্দ দ্বারা ইজমা উল্লেখ করেছেন।
(১৬-২৪) ইবনে হুমাম র. ফাতহুল কাদীরে (১/৪৮৫), আন্ওয়ার শাহ্ কাশ্মীরী র. আল আরফুশ শাযীতে (হাশিয়ায়ে তিরমিযী : ১/১৬৬), ইবনে নুজাইম র. বাহরুর রায়েকে (২/১১৭-যাকারিয়া), আল্লামা শামী র. রদ্দুল মুহতারে (২/৪৫-সাঈদ), কাসানী র. বাদায়েতে (২/২৭২-দারুল হাদীস), আ. হক মুহাদ্দিসে দেহলবী র. ‘মা সাবাতা বিস সুন্নাহ’ গ্রন্থে (পৃ.২১৭), হালাবী র. শরহে মুন্য়াতে (পৃ.৪০৬), সুয়ূতী র. মাসাবীহ গ্রন্থে (পৃ.১৬) এবং সুবকী র. মাসাবীহতে (পৃ.১৬) “ثم استقر الامر علي هذا” ইত্যাদি বাক্য দ্বারা ইজমা উল্লেখ করেছেন। কোনো আলেম বা ফকীহ এগুলোর উপর আপত্তি করেননি। উপর্যুক্ত দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হলো, বিশ রাকাত তারাবীহর উপর পুরো উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া র.-এর অভিমত
২০ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে গায়রে মুকাল্লিদদের মান্যবর ইমাম আরববিশ্বের অন্যতম গবেষক ইবনে তাইমিয়া র.-এর মতামত তুলে ধরা হলো। তিনি লিখেন-
قد ثبت ان ابي بن كعب رضي الله عنه كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان ويوتر بثلاث فرأي كثيرمن العلماء ان ذلك هو السنة لانه اقامه بين المهاجرين والانصار ولم ينكره منكر.
অর্থ : একথা প্রমাণিত যে, উবাই বিন কা‘ব রা. রমযানে তারাবীহতে লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। তাই বহু আলেমের সিদ্ধান্ত এটাই সুন্নত। কেননা তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের উপস্থিতিতেই তা আদায় করেছিলেন। কেউ তাতে আপত্তি করেননি। (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ১২/৬৮-মাকতাবা আবীকান; ২৩/৬৫-দারুল হাদীস)
তিনি আরো লিখেন-
ثبت (التراويح عشرون ركعة) من سنة الخلفاء الراشدين وعمل المسلمين.
অর্থাৎ, খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত ও মুসলিম জাতির আমল দ্বারা ২০ রাকাত তারাবীহ প্রমাণিত । (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ২৩/৬৬-দারুল হাদীস)
অন্যত্রে তিনি বলেন-
كما أن نفس قيام رمضان لم يوقت النبى صلى الله عليه وسلم فيه عددا معينا….. فلما جمعهم عمر علي ابي بن كعب ، كان يصلي بهم عشرين ركعة ويوتر بثلاث …. ثم كانت طائفة من السلف يقومون باربعين ركعة ويوترون بثلاث وآخرون قاموا بست وثلاثين واوتروا بثلاث، وهذا كله سائغ. فكيفما قام فى رمضان من هذه الوجوه فقد أحسن-
অর্থ: “তারাবীহর ব্যাপারে রাসূলের সা. পক্ষ থেকে কোনো সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি। হযরত উমর রা. যখন সাহাবাদেরকে উবাই বিন কা‘ব রা.-এর পিছনে তারাবীহর জন্য একত্রিত করেন তখন উবাই রা. তাদেরকে ২০ রাকাত তারাবীহ ও ৩ রাকাত বিতর পড়ান। পরবর্তীতে অনেকে ৩৯ রাকাত, অনেকে ৩৬ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এর প্রত্যেকটিই বৈধ। এর যে কোনো একটি পড়লেই তারাবীহ আদায় হবে। (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ২২/৪৯৫-দারুল হাদীস)
সুতরাং বুঝা যায় যে, ইবনে তাইমিয়া র.-এর মতে তারাবীহর নামায বিশ রাকাতের অধিক বৈধ হলেও বিশের কমে ৮ রাকাত তারাবীর কোনো নযীর নেই।
হারামাইনের চৌদ্দ শ’ বছরের তারাবীহর ইতিহাস
আরববিশ্বের প্রখ্যাত আলেম মদীনার শরয়ী আদালতের বিচারপতি, মসজিদে নববীর দীর্ঘকালের স্বনামধন্য উস্তাদ শাইখ আতিয়্যা সালেম র. এ বিষয়ে “التروايح من اكثر الف عام” নামে একটি তথ্যবহুল বই লিখেছেন। এতে তিনি মসজিদে নববীর তারাবীহর ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, সুদীর্ঘ (প্রায়) দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে মসজিদে নববীতে ২০ রাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়নি। সাহাবা ও তাবেয়ী ২০ রাকাত পড়েছেন। ২য় ও ৩য় শতাব্দীতে কিছু অতি উৎসাহী লোক ৩৬ রাকাত পড়েছেন। এরপর চতুর্থ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত মদীনাতে ২০ রাকাত তারাবীহর নামায পড়া হচ্ছে।
قال الشيخ عطية سالم رح: مضت المائة الثانية والتراويح ست وثلاثون وثلاث وتر ودخلت المائة الثالثة وكان المظنون أن تظل ما هي عليه تسع وثلاثون بما فيه الوتر.
উপসংহারে তিনি বলেন, যখন এ দীর্ঘকালে উল্লেখযোগ্য এমন একজনও পাওয়া যায় না যিনি বলেছেন তারাবীহর নামাজ আট রাকাতের বেশি পড়া জায়েয নেই বা রাসূল সা.-এর মসজিদে কোনো এক দিন জামাতের সাথে আট রাকাত পড়া হয়েছে। তারপরও যারা আট রাকাতের উপর অটল আছেন এবং অন্যদের সেদিকে দাওয়াত দিচ্ছেন তাদেরকে শুধু এটুকু বলার আছে যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পুরো মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক আমলের বিরোধীতা করার চেয়ে অনুসরণ করাই অধিক শ্রেয়। (আত তারাবীহ আকসারু মিন আলফি আম :পৃ.৪১-৪২-৪৭-৪৮-৬৫-১০৮-১০৯)
দ্বিতীয় অধ্যায়
তারাবীহ ৮ রাকাতের পক্ষের দলিল ও তার খণ্ডন
আমরা এ পর্যন্ত বিশ রাকাত তারাবীহর পক্ষে সবধরণের অত্যন্ত শক্তিশালী দলিল পেশ করলাম। অথচ লা-মাযহাবী বন্ধুরা এসব দলীলের বিরোধীতা করে বর্তমানে পুরো মুসলিম উম্মাহকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত করে রেখেছেন। আর তাদের মত মুমিনগণের অনুসৃত পথ থেকে যে সম্পূর্ণ বিচ্যুত তা পূর্বের আলোচনাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
আমরা এ অধ্যায়ে তাদের দাবীর পক্ষে দলিলগুলো যাচাই করে দেখবো। তবে তারপূর্বে ভূমিকা স্বরূপ একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন, তা হলো-
নবীজী স. কত রাকাত তারাবীহ পড়েছেন ?
রাসূল স. রমযানের রাতসমূহে কী পরিমাণ নামায আদায় করতেন এ নিয়ে হযরত আয়েশা রা. হতে দু’ধরণের বিবরণ পাওয়া যায়।
ক. রাসূল স. সারা বৎসরের তুলনায় রমযান মাসে খুব বেশী ইবাদত করতেন এবং অধিক পরিমাণে রাতে নামায পড়তেন। যেমন:
* মুসলিম শরীফের বর্ণনা-
قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا: ্রكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ. (صحيح مسلم: رقم: ১১৭৫، باب الاجتهاد في العشر)
“নবী স. রমযানের শেষ দশকে ইবাদত বন্দেগীতে এত অধিক সময় মনোনিবেশ করতেন, যা বছরের অন্য কোনো সময়ে করতেন না।” (মুসলিম শরীফ: ১/৩৭২)
* বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে-
عن عائشة رضي الله تعالي عنها قالت كان رسول الله صلي الله عليه وسلم اذا دخل رمضان احي الليل وايقظ اهله وشد المئزر. (صحيح البخاري)
“আয়েশা রা. বলেন, রমযানের শেষ দশকে রাসূল স. নিজেও রাত জাগতেন আপন পরিবারকেও জাগাতেন এবং ইবাদত বন্দেগীর জন্য কোমর বেঁধে নিতেন।”
* হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন-
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: ” كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ تَغَيَّرَ لَوْنُهُ، وَكَثُرَتْ صَلَاتُهُ، وَابْتَهَلَ فِي الدُّعَاءِ، وَأَشْفَقَ مِنْهُ. (شعب الايمان: رقم ৩৩৫৩، فضائل شهر رمضان)
“রমযান মাস আসলে নবী স. এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো, তিনি অধিক পরিমাণে নামায আদায় করতেন এবং কাকুতি-মিনতি ও অনুনয়-বিনয়ের সাথে খুব বেশী দোয়া করতেন এবং তাঁর তরে খোদাভীতিও বেড়ে যেতো” (শুয়াবুল ঈমান-নং৩৩৫৩)
এসব হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, রমযানের রাত্রীকালিন নামায বছরের অন্যান্য রাত্রের তূলনায় অনেক বেশী ছিল। যদিও কত রাকাত তার কোন সংখ্যা এতে উল্লেখ নেই।
খ. পক্ষান্তরে হযরত আয়েশা রা. থেকেই অপর এক বর্ণনায় এর বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায়। যেমন-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ؟ فَقَالَتْ: ্রمَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلاَ فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًاগ্ধ (صحيح البخاري: ১/১৫৪،২০১৩)
অর্থাৎ হযরত আবু সালামা র. আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন রমজান মাসে নবী স. এর নামাজ কী রূপ ছিল ? উত্তরে হযরত আয়েশা বলেন নবী স. রমযানে এবং রমযানের বাইরে কখনো ১১ রাকাতের বেশী পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত (এক নিয়তে) পড়তেন এতো দীর্ঘ ও সুন্দর নামায পড়তেন যার বিবরণ দেয়া প্রায় অসম্ভব। পূনরায় একইভাবে অতি দীর্ঘ ও সুন্দর করে চার রাকাত পড়তেন। অতপর তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (সহীহুল বুখারী:১/১৫৪)
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রমযানের রাতেও বছরের অন্যান্য রাতের মত ১১ এগার রাকাতই পড়তেন, এর বেশী পড়তেন না।
গ: মুসলিম শরীফে রয়েছে, আবু সালামা র. আয়েশা রা. কে রাসূল সা. এর নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، قَالَ: سَأَلْتُ عَائِشَةَ، عَنْ صَلَاةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: ্রكَانَ يُصَلِّي ثَلَاثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي ثَمَانَ رَكَعَاتٍ، ثُمَّ يُوتِرُ، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ وَهُوَ جَالِسٌ، فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ قَامَ فَرَكَعَ، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ بَيْنَ النِّدَاءِ وَالْإِقَامَةِ مِنْ صَلَاةِ الصُّبْحِগ্ধ.(صحيح مسلم: ১/২৫৪، رقم: ১২৬)
অর্থাৎ তিনি তের রাকাত নামাজ পড়তেন। (প্রথমে) আট রাকাত পড়তেন এরপর (তিন রাকাত) বিতর পড়তেন। এরপর দুই রাকাত নামায বসে পড়তেন। (মুসলিম:১/২৫৪)
এই হাদীসগুলো দ্বারা বুঝা গেল:
ক. নবী স. রমযানে অনেক বেশী নামাজ পড়তেন।
খ. সারা বছরও একই রকম নামায পড়তেন এবং তা এগার রাকাতই ছিল এর বেশী কখনো পড়তেন না।
গ. তের রাকাত পর্যন্ত পড়তেন।
এসব হাদীসকে বাহ্যিকভাবে পরষ্পরবিরোধী মনে হয়। অন্যদিকে উক্ত নামায তারাবীহ ছিল নাকি তাহাজ্জুদ ছিলো তার স্পষ্ট বিবরণ নেই। লা-মাযহাবীদের উক্তিমত যদি (খ) এর হাদীসটিকে তারাবীহই গণ্য করা হয় যদিও আসলে তা তাহাজ্জুদের নামায) তাহলে তারবীহর রাকাত সংখ্যা সহীহ হাদীসে আট রাকাতই প্রমাণ হবে। অথচ (ক) এর হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাকাতের কোন সংখ্যাই রাসূল স. থেকে নির্ধারিত ছিল না।
মোট কথা : হযরত আয়েশা রা. থেকে বিভিন্ন প্রকারের বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনানুযায়ী রাকাতের সংখ্যা অনির্ধারিত। অপর বর্ণনা মতে রাকাত সংখ্যা আট বা দশ (এগার বা তিন)। এসব কারণে রাসূল স. এর তারাবীহ সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামা থেকেও দু’ধরণের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এক শ্রেণীর আলেম মনে করেন, নবী স. কত রাকাত তারাবীহ পড়েছেন এটা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এদের মধ্যে রায়েছেন- ১. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ২. আল্লামা তাজুদ্দিন সুবকী, ৩. জালালুদ্দীন সূয়ুতী, ৪. ইমাম শাফেয়ী, ৫. আল্লামা শাওকানী, ৬. নবাব সিদ্দিক হাসান খান প্রমুখ।
অপর শ্রেণীর উলামায়ে কিরামের মন্তব্য হচ্ছে নবী স. বিশ রাকাতই তারাবীহ পড়েছেন যা ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণিত হাদীসে বিধিত রয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছেন ১) আল্লামা রাফেয়ী আশশাফেয়ী। ২) ইমাম তাহাবী আলহানাফী। ৩) আল্লামা কাযী খান। ৪) ইমাম শাহ আব্দুল আযীয র. প্রমুখ
যারা বিশ রাকাত তারাবীহ রাসূল স. থেকে নির্ধারিত এবং তিনি পড়িয়েছেন বলে মনে করেন তাদের দলিল আমরা ইতোপূর্বে প্রথম দলিল হাদীসে মারফু অধ্যায়ে স্ব-বিস্তারে পেশ করেছি।
যারা রাকাতের সংখ্যা রাসূল স. থেকে নির্ধারিত নেই বলে মন্তব্য করেন তাদের কয়েকটি বিবরণ এখানে পেশ করছি :
১. আহলে হাদীসের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ পুরুষ নবাব সিদ্দিক হাসান খান বলেন-
{إن صلاة التراويح سنة بأصلها لما ثبت أنه (ص) صلاها في ليالي ثم ترك شفقة علي الامة أن لاتجب علي العامة أو يحسبوها واجبة ولم يأت تعين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة ولكن يعلم من حديث كان رسول الله (ص) يجتهد في رمضان مالا يجتهد في غيره أن عددها كان كثيرا.} رواه مسلم.
অর্থাৎ তারাবীহর নামায মৌলিকভাবে সুন্নাত। কেননা হাদীসে প্রমাণ আছে যে নবী স. কয়েক রাত তারাবীহ পড়েছেন। অতপর এ আশঙ্কায় ছেড়ে দেন যে, উম্মতের উপর হয়তো ফরয হয়ে যাবে। কিংবা উম্মত সেটাকে ফরয ধারণা করে বসবে। তবে কোনো মারফু সহীহ হাদীসে তারাবীহর নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা বর্ণিত নেই। হ্যাঁ, মুসলিম শরীফের এক হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, রাকাত সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
উল্লেখ্য, বুখারীতে হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত এগার রাকাতের হাদীস যদি তারাবীহর সাথে সম্পৃক্ত হতো সেটা কি সহীহ মারফু নয় ? তাহলে কীভাবে এ মন্তব্য করা হবে ? হ্যাঁ, তিনিও জানেন আয়েশা রা. এর হাদীসটি তাহাজ্জুদের; তারাবীর নয়।
২. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. বলেন-
{من ظن ان قيام رمضان فيه عدد معين موقط عن النبي (ص) لا يزيد ولا ينقص فقد اخطأ. (الانتقاض الرجيح: ৬৩)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই ধারণা করে যে, নবী স. রমযানে নির্দিষ্ট সংখ্যায় তারাবীহ পড়েছেন। কখনো কম বেশি করেননি, তাদের ধারণা ভুল।
৩. আল্লামা শাওকানী র. বলেন-
وَالْحَاصِلُ أَنَّ الَّذِي دَلَّتْ عَلَيْهِ أَحَادِيثُ الْبَابِ وَمَا يُشَابِهُهَا هُوَ مَشْرُوعِيَّةُ الْقِيَامِ فِي رَمَضَانَ، وَالصَّلَاةُ فِيهِ جَمَاعَةً وَفُرَادَى، فَقَصْرُ الصَّلَاةِ الْمُسَمَّاةِ بِالتَّرَاوِيحِ عَلَى عَدَدٍ مُعَيَّنٍ، وَتَخْصِيصُهَا بِقِرَاءَةٍ مَخْصُوصَةٍ لَمْ يَرِدْ بِهِ سُنَّةٌ.(نيل الاوطار: ৩/৬৬)
অর্থাৎ এ সম্পর্কীয় সবগুলো হাদীস মিলিয়ে দেখলে বুঝা যায় যে, রমযানের রাত্রি জাগরণ এবং নামায পড়া প্রমাণিত। এই নামায জামাতেও পড়া যায়, একাকীও পড়া যায়। সুতরাং নামাযকে নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং নির্দিষ্ট সূরা কেরাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ব্যাপারে কোনো (সহীহ) হাদীস পাওয়া যায়না। (নাইলুল আওতার- ৩/৬৬)
এখানে লা-মাযহাবীদের তিনজন আদর্শ পুরুষের মন্তব্য তুলে ধরলাম। এরা সবাই দ্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, তারাবীহ সম্পর্কে রাসূল স. থেকে সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যাই সহীহ হাদীসে বর্ণিত নেই। অন্যদিকে উপরোল্লিখিত মুসলিম শরীফের হাদীস দ্বারা বুঝাযায় যে, রাকাত সংখ্যা অনেক বেশী ছিলো। আবার বেশ কিছু ফকীহ ও মুহাদ্দিসের মন্তব্য হচ্ছে, তারাবীহর সংখ্যা বিশ রাকাত ছিলো। কিন্তু তারাবীহর সংখ্যা আট রাকাত ছিলো’ এ মন্তব্য কোথাও কেউ করতে দেখা যায়নি। হাজার বছর পর এসে আলবানী ও তার অনুসারী লা-মাযহাবীরা তাদের আদর্শ পুরুষ ইবনে তাইমিয়া, নবাব সিদ্দিক হাসান ও ইমাম শাওকানীর স্পষ্ট ঘোষণার বিরুদ্ধে রাকাতের সংখ্যা আট বলে দাবী করে বসলেন। প্রমাণস্বরূপ বুখারীতে বর্ণিত হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক তাহাজ্জুদের হাদীসটি পেশ করলেন। বিচারের ভার পাঠকদের কাছে ছেড়ে দিলাম। বলুন! এতে প্রতীয়মান হয়না যে, তারবীহ আট রাকাত বলার মতামতটি নব আবি®কৃত ফিতনা। হাজার বছর যাবত কেউ একথা বলেননি, বুখারীতে বর্ণিত আয়েশা রা. এর হাদীসকে কেউ তারাবীহর হাদীসও বুঝেন নি। আল্লাহ তাদের সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন॥
লা-মাযহাবীদের আট রাকাতের দলিল
বিশ রাকাত তারাবীহর সবগুলো দলিলকে উপেক্ষা করে লা-মাযহাবীরা আহলে সুন্নাতের অনুসৃত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আট রাকাতকেই সুন্নাত এবং এর বেশী পড়াকে বিদআত আখ্যা দিয়ে ফিৎনার সৃষ্টি করছেন। তাঁরা আট রাকাতে তারাবীহ সীমাবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত দলিল গুলো পেশ করে থাকেন-
১ নং দলিল :
উ¤মূল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. এর বর্ণনা-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ، كَيْفَ كَانَتْ صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ؟ قَالَتْ: مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلَا فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلَا تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلَا تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلَاثًا، فَقَالَتْ عَائِشَةُ: فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ أَتَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوتِرَ، فَقَالَ: ্রيَا عَائِشَةُ إِنَّ عَيْنَيَّ تَنَامَانِ، وَلَا يَنَامُ قَلْبِيগ্ধ (صحيح مسلم: ১/২৫৪،رقم: ১২৫، باب صلاة الليل والوتر)
অর্থাৎ আবু সালামা হযরত আয়েশা রা.কে জিজ্ঞেস করলেন, রমযানে রাসূল স. এর নামায কীরূপ হতো ? তিনি বললেন- রমযান ও অন্য সময়ে তিনি এগার রাকাতের বেশী আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে চার রাকাত আদায় করতেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসা করোনা। অতপর চার রাকাত আদায় করতেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে বিতির পড়ার পূর্বেই ঘুমিয়ে পড়েন ? তিনি বললেন- আয়েশা! আমার চোখ ঘুমায় তবে আমার হৃদয় জাগ্রত থাকে। (সহীহ মুসলিম:২৫৪)
এ হাদীসটি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। অথচ এ হাদীস তাহাজ্জুদ নামাযের ব্যাপারে এসেছে। তারা এর অপব্যাখ্যা করে তারাবীহর ব্যাপারে প্রয়োগ করেছে। আর এ প্রয়োগকে বৈধতা দেয়ার জন্য তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম বলে প্রচার চালিয়েছে এবং বলে, যে নামাযটি এগার মাস যাবত তাহাজ্জুদ থাকে তা-ই রমযানে এসে তারাবীহ হয়ে যায়। বাহ্ কী চমৎকার কথা ! কিন্তু এ পর্যন্ত তারা তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ যে এক নামাযের দুই নাম এবং তাহাজ্জুদ আট রাকাতের বেশী পড়া যায়না তা সহীহ তো দূরের কথা কোনো যয়ীফ হাদীস দ্বারাও প্রমাণ করতে পারেনি। বাংলাদেশে উত্তর বঙ্গের এক বিশাল সমাবেশে তারা দুই লক্ষ টাকার পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন। আমি তাদেরকে দশ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। আজ পর্যন্ত এর জবাব মিলেনি।
দলিলটি খণ্ডন
মূলত অনেকগুলো দলিল দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, আলোচ্য হাদীসটি তারাবীহ বিষয়ক নয়; বরং তাহাজ্জুদের সাথে সম্পৃক্ত। এর মমার্থ হচ্ছে, বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এসেছে যা আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি যে, রাসূল স. রমযান মাসে ইবাদত ও নামাযে বেশি নিমগ্ন থাকতেন তাই সম্ভাবনা ছিলো রমযানে তাহাজ্জুদ নামাযের রাকাত সংখ্যা অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি হবে। এ কারণেই আবু সালামা শুধু রমযানের তাহাজ্জুদের অবস্থা সম্পর্কে হযরত আয়েশা রা. থেকে জানতে চাইলেন। তাই হযরত আয়েশা রা. জানিয়ে দিলেন যে, তাহাজ্জুদের রাকাত সংখ্যা রমযান মাসেও অন্যান্য মাসের মতো অপরিবর্তিত থাকতো। প্রশ্ন শুধু রমযানের ব্যাপারে থাকলেও উপরোক্ত কারণেই জবাবে (لا في رمضان ولافي غيره) রমযান ও গাইরে রমযানের বাক্যটি উল্লেখ করেছেন। সুতরাং হাদীসটি যে তাহাজ্জুদ সম্পর্কে তা সুস্পষ্ট।
এর প্রমাণ স্বয়ং হাদীসটি বর্ণনার ধরণেই বিদ্যমান। যেমন-
১Ñ এ হাদীসে ওই নামাযের কথাই বলা হয়েছে, যা রমযান ও অন্যান্য মাসে পড়া হতো। সর্বস্বীকৃত কথা হচ্ছে তারাবীহ একমাত্র রমযান মাসেই পড়া হয়ে থাকে; সব মাসে নয়। বুঝা গেলো এ নামাযটি তারাবীহ নয়; বরং তাহাজ্জুদ।
২Ñ এ নামাযের বিবরণে স্পষ্ট আছে أربعا)) চার রাকাত চার রাকাত করে পড়েছেন। মাও. মুবারকপুরী আহলে হাদীসের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও তিরমিযীর ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, এর অর্থ হচ্ছে এক সালামে চার রাকাত পড়া হয়েছিলো। বিতরের তিন রাকাতও এক সালামে পড়া হয়েছে। সবারই জানা কথা, তাহাজ্জুদ চার রাকাত করে যেমন পড়া যায়, দুই রাকাত করেও পড়া যায়। কিন্তু তারাবীহর নামায এক সালামে চার রাকাত পড়ার পক্ষে স্বয়ং আলবানী সাহেবও নন। কেউ এটাকে জায়েযও মনে করেন না। তাহলে প্রতীয়মান হলো, এ হাদীস তাহাজ্জুদের ব্যাপারে বর্ণিত।
৩. এ হাদীসে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তাতে রাসূল স. নামায শেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন এবং পরে ঘুম থেকে উঠে বিতর পড়তেন। অথচ তারাবীহর ক্ষেত্রে নামায শেষে ঘুমের পূর্বেই বিতর পড়া হয়ে থাকে অথবা বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে গেলে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তাহাজ্জুদ তারপর বিতর পড়ার নিয়ম ছিলো, এখনো আছে। সুতরাং যে নামাযের পর ঘুমিয়ে অত:পর উঠে শুধু বিতর পড়া হয় তা একমাত্র তাহাজ্জুদ নামায হওয়া সম্ভব; তারাবীহ হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। একথা বলারও সুযোগ নেই যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামায। একটু পরেই আমরা আলোচনা করবো যে, এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন নামায।
৪. এ হাদীসে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তা হযরত আয়েশা রা.এর ঘরে একাকী নামায ছিলো। যা হাদীসের শেষাংশে হযরত আয়েশা রা.এর প্রশ্ন ও রাসূল স. এর উত্তর থেকে স্পষ্ট। আর বলা বাহুল্য, তাহাজ্জুদই নির্জনে একাকী পড়া হয়ে থাকে পক্ষান্তরে তারাবীহ তো জামাতের সাথে পড়া হয়।
৫. এ স্পষ্ট সহীহ হাদীসে আট রাকাতের নামাযটি যদি তারাবীহ হতো, তাহলে সাহাবায়ে কিরামের পক্ষে তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া আদৌ সম্ভব ছিলো না। কেননা, সাহাবারা ছিলেন রাসূলের সুন্নাত ও আদর্শের প্রতি সবচেয়ে বেশী আসক্ত। এক একটি সুন্নাতের জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত, তাদের পক্ষে এমন অকাট্য সুস্পষ্ট আট রাকাতের হাদীস থাকতে বিশ রাকাত পড়ার মতো দুঃসাহস কল্পনাও করা যায় না।
৬. স্বয়ং হযরত আয়েশা রা. যিনি এ হাদীসের বর্ণনাকারী, তিনিও হাদীসটিকে তারাবীহ বিষয়ক মনে করতেন না। অন্যথায় তার চোখের সামনে তারই হুজরার পাশে মসজিদে নববীতে চল্লিশ বছর যাবত বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ে স্পষ্ট রাসূলের আদর্শবহির্ভূত কাজ সাহাবারা করবেন, আর তিনি চুপ করে তা মেনে নিবেন- কল্পনাও করা যায় না। এমন ধারণা স্বয়ং হযরত আয়েশা রা.এর সম্মানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার নামান্তর।
৭. মুহাদ্দিসগণও এই হাদীসকে তারাবীহ নয় বরং তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রেই মনে করতেন। এ কারণে ইমাম মুসলিম র., আবু দাউদ র., তিরমিযী র., নাসায়ী র., ইমাম মালেক র., দারমী র., আবু আওয়ামা র. ও ইবনে খুযায়মা র. প্রমুখ এদের কেউই এ হাদীসটিকে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি। শুধু ইমাম বুখারী র. ও ইমাম মুহাম্মদ র. এ হাদীসকে তারাবীহর নামায বিষয়ক মনে করতেন বরং যথা সম্ভব তারা উভয় অধ্যায়ে হাদীসটি এনেছেন তাহাজ্জুদের নামায হিসেবে। তাহাজ্জুদ এবং তারাবীহর অধ্যায় এনেছেন একথা বুঝানোর জন্য যে রাতের নামায যেনো তারাবীহর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং তাহাজ্জুদও যেনো পড়া হয়।
এতে প্রমাণ হলো মুহাদ্দিসগণও এ হাদীসকে তারাবীহ সংক্রান্ত বলে মেনে নেননি।
৮. বিশ্বের কোনো ফকীহও এ হাদীস থেকে তারাবীর নামায বুঝেনি। নচেৎ কোনো না কোনো ফকীহ এমন সুস্পষ্ট হাদীস দ্বারা তারাবী আট রাকাত বলে মত ব্যক্ত করতেন। অথচ তাদের কেউ তারাবীহ আট রাকাতের মত পোষণ করেননি। ইমাম তিরমিযী র. তার হাদীস গ্রন্থে প্রত্যেক মাসআলাতে ফকীহগণের মত উল্লেখ করে থাকেন। এটা সুনানে তিরমিযীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি একইভাবে তারাবীহর অধ্যায়ে রাকাতের সংখ্যার বিষয়ে বহু মত পেশ করেছেন। বিশ রাকাত থেকে সর্বোচ্চ ৪১রাকাতের মতও পেশ করেছেন। কিন্তু কোনো ফকীহ তারাবীহর নামায আট রাকাত বলে মনে করেন- এমন কোনো মতামত তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি অন্যত্রে বলেছেন, (كذلك قال الفقهاء وهم أعلم بمعاني الحديث) “এব্যাপারে ফকীহগণ অনুরূপ বলেছেন, আর হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই সর্বাধিক অবগত ছিলেন।”
প্রমাণ হলো, হাদীস সম্পর্কে সব চেয়ে অভিজ্ঞ উলামায়ে কিরামও আলোচ্য হাদীসকে তারাবীহ সংক্রান্ত বলে মেনে নেননি।
৯. আলবানী সাহেবদের কথামতো আলোচ্য হাদীসটি তারাবীহ সম্পর্কে হলে তাদেরই মান্যবর উলামা ইবনে তায়মিয়া র. আল্লামা শাওকানী র. এবং নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান র. তারাবীহর রাকাতের সংখ্যা সম্পর্কে কেন বললেন যে,
لم يأت تعيين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة، ولم تردبه سنة، فقد أخطأ.
“এ ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই, এমন ধারণা যে করবে সে ভুল করবে।” বলুন ! এ হাদীসটি বুখারীতে এসেছে এটা কি সহীহ না ? আসলে এরাও হাদীসটিকে তারাবীহ সংক্রান্ত মনে করতেন না।
মোটকথা, এসব দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আয়েশা রা.-এর হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে , তারাবীহ সম্পর্কে নয়। যদি তারাবীহ সম্পর্কে হতো তাহলে সাহাবায়ে কিরামের পক্ষে বিশ রাকাত পড়ার উপর ঐক্যমত হওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। অনুরূপভাবে রাসুল স. থেকে বিশ রাকাতের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা না থাকলে তাও তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ সম্পূর্ণ ভিন্ন নামায
তারা এমনও বলে থাকেন- তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম। গাইরে রমযানে যাকে তাহাজ্জুদ বলে, রমযানে তা তারাবীহ হয়ে যায়। (قيام الليل)কিয়ামুল লাইল ও (قيام رمضان) কিয়ামে রমযান এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং আয়েশা রা.-এর হাদীস তাহাজ্জুদের সাথে সম্পৃক্ত। আর তাহাজ্জুদই তারাবীহ।
অতএব, এ হাদীসকে তারাবীহরও বলা চলে, পড়তে হবে আট রাকাত। এর বেশী পড়া হবে বিদআত। এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। তা হচ্ছে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামায হলে তা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করুন? কষ্মিনকালেও সক্ষম হবেন না। আর তাহাজ্জুদ আট রাকাতের বেশী পড়লে বিদআত হবে এ কথাও হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে তাহাজ্জুদের জন্য কোনো নির্ধারিত রাকাত সংখ্যা নেই। দুই দুই রাকাত চার চার রাকাত করে যতো ইচ্ছা পড়া যাবে।
আর রাসূল স. ইরশাদ করেন-
اوتروا بخمس أو بسبع أو بتسع أو باحدي عشرة أوباكثر من ذلك .
তোমরা রাতের নামায (তাহাজ্জুদবিতর সহকারে) পাঁচ রাকাত পড়, সাত রাকাত পড়, নয় রাকাত পড়, এগারো রাকাত পড় কিংবা তার চেয়ে বেশী পড় (সবই সঠিক)। (বি. দ্র. সহীহ ইবনে হিব্বান, ২৪২৯, মুস্তাদরাক ১১৭৮)
হাদীসটি মুহাদ্দিসগণের নিকট সহীহ। (দেখুন আততালযীম ২-১৪ নাইলুন আওতার ৩/৪৩)
উপরন্তু আলোচ্য হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল স. রাতের নামায এগারো রাকাত থেকে বেশী পড়তেন না। অন্যদিকে স্বয়ং হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনাতেই পাওয়া যায়, রাসূল স. তাহাজ্জুদের নামায (ফজরের সুন্নাত ছাড়া ) বিতরসহ তেরো রাকাতও পড়েছেন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং১১৬৪)
পূর্বে আমরা হাদীসটি উল্লেখ করেছি। অন্যান্য সহীহ হাদীসে তাহাজ্জুদের নামাযের সংখ্যা বিতরসহ সতেরো রাকাত এবং তদাধিকও পাওয়া যায়। (নাইলুল আওতার, শাওকানী)
এখন লা-মাযহাবীদের প্রতি জিজ্ঞাসা হলো, একদিকে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদকে এক নামায সাব্যস্ত করবেন, অপরদিকে তারাবীহ আট রাকাতের চেয়ে বেশী পড়াকে বিদআতও বলবেন, অথচ উপরোক্ত আলোচনায় দেখলেন যে, সহীহ হাদীসেই তাহাজ্জুদ বেশী পড়ারও প্রমাণ রয়েছে। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়ালো। আপনারা হাদীসকে অমান্য করেও আহলে হাদীস, স্ববিরোধী কথা বলেও বড় পণ্ডিত? আসলে حفظت شيأ وغابت عنك الاشياء অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর। বড়দের মানার মেজায থাকলে এমনটি হয়না। অজ্ঞ হয়েও মুজতাহিদ সাজলে এমনই হয়।
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহর মাঝে পার্থক্য
তথাকথিত আহলে হাদীসগণ দাবি করেন যে, তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ একই নামায। তাদের এদাবি ভুল। তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ আলাদা নামায। কারণ:-
১. তাহাজ্জুদের মাঝে ডাকাডাকি জায়েয নেই,কিন্তু তারাবীহতে জায়েয আছে।
২. তারাবীহর সময় হলো ঘুমানোর পূর্বে আর তাহাজ্জুদের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। তবে উত্তম সময় হলো ঘুম থেকে উঠার পর।
৩. মুহাদ্দিসগণ তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ কে পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।
৪. তাহাজ্জুদের নামায প্রথমে ফরয ছিলো তারপর ফরযের বিধান রহিত হয়ে গেছে। ফলে দ্বিতীয়বার ফরয হওয়ার সম্ভাবনা ছিলোনা। অথচ রাসুল সা. কিয়ামে রমযানের জামা‘আত নিয়মিত করেননি তা ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। এর দ্বারা বুঝা গেলো,তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ এক নয়।
৫. তাহাজ্জুদের বিধান কুরআনে আছে- (ক) ومن الليل فتهجد به نافلة لك. (সূরা বনী ইসরাঈল:৭৯) (খ)ياايها المزمل قم الليل الا قليلا …الخ (সূরা মুয্যাম্মিল : ১-৪)। আর তারাবীহর বিধান আছে হাদীসে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন- (গ) وسننت لكم قيامه (নাসায়ী:১/৩০৮;৪/১৫৮)
৬. তাহাজ্জুদের হুকুম মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে, আর তারাবীহর বিধান মদীনায়।
৭. হাদীসে তারাবীহর আলোচনা ‘কিয়ামে রমাযান’ আর তাহাজ্জুদের আলোচনা ‘কিয়ামূল লাইল’ নামে এসেছে। এটাও একটা দলিল যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ এক নয়। কারণ তাহাজ্জুদ রমযানের সাথে খাস নয়।
৮. তাহাজ্জুদের নির্দিষ্ট রাকাত রাসূল স. থেকে বর্ণিত আছে অর্থাৎ বিতরসহ সর্বোচ্চ ১৩ রকাত আর সর্বনিম্ন ৭ রাকাত। অপরদিকে তারাবীহর ব্যাপারে গাইরে মুকাল্লিদরাও বলে থাকেন যে, এব্যাপারে রাসূল স. থেকে নির্দিষ্ট কোনো রাকাত প্রমাণিত নেই। (আহসানুল ফাতাওয়া:৩/৫৩১-৩২)
দ্বিতীয় দলিল:
حدثنا عبد الأعلى حدثنا يعقوب عن عيسى بن جارية حدثنا جابر بن عبد الله قال : جاء أبي بن كعب إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال : يا رسول الله إن كان مني الليلة شيء ـ يعني في رمضان ـ قال : وما ذاك يا أبي ؟ قال : نسوة في داري قلن : إنا لا نقرأ القرآن فنصلي بصلاتك قال : فصليت بهن ثمان ركعات ثم أوترت قال…. (قيام الليل: رقم: ১৮০১)
অর্থাৎ উবাই বিন কা‘ব রা. রমযানে রাসূল স.এর কাছে এসে বললেন, “গত রাতে আমাকে ঘরের নারীরা বললো, আমরা তো কুরআন পড়তে পারিনা । তাই আমরা তোমার পেছনে নামায পড়বো। আমি তাদের নিয়ে আট রাকাত ও বিতর নামায পড়লাম।” রাসূল স. কিছু বললেন না। (কিয়ামূল লাইল: হা: নং ১৮০১)
আট রাকাত তারাবীহর
দ্বিতীয় হাদীসের পর্যালোচনা
এ হাদীসটি নিম্নে বর্ণিত কিতাব সমূহে এসেছে-
১. মুসনাদে আবী ইয়া’লা। ২. কিয়ামূল লাইল লিল মারওয়াযী পৃ:৯০, মুজামুল আওসাত লিত তাবারানী (৩৭৩১), যাওয়ায়েদে মুসনাদে আহমদ (৫/১১৫ হাদীস নং ২১৪১৫), মাজমাউয যাওয়ায়িদ লিল হায়ছামী ২/১৭৯। এরা সকলেই একই সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
১ নং জবাব:
হাদীস বিশারদদের বিবেচনায় এ হাদীসটি এতই দুর্বল যা কোনো শরয়ী মাসআলার ক্ষেত্রে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করার অবকাশ নেই।
এর কারণ নিম্নরূপ-
* এহাদীসের সনদে “عيسي بن جارية”ঈসা বিন জারিয়া আছেন, তিনি মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে ‘যয়ীফ’। তার সূত্রে বর্ণিত হাদীস প্রমাণযোগ্য নয়।
* তার সম্পর্কে ইমাম ইবনে মাঈন র. বলেন “ليس حديثه بذات” তার হাদীস মজবুত নয়। অন্য বর্ণনায় বলেছেন “ليس شيئ” তিনি কোন বস্তুই নন। অপর বর্ণনায় আছে “عنده مناكير” তার নিকট অনেক আপত্তিকর হাদীস আছে।
* ইমাম নাসায়ী র. বলেন “منكر الحديث” তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। অপর বর্ণনায় আছে “متروك الحديث” তার বর্ণিত হাদীস বর্জনীয়।
* ইমাম আবু দাউদ র. বলেছেন তিনি “منكر الحديث” তার বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য।
* ইমাম আদী র. বলেছেন- “احاديثه غير محفوظة” তার হাদীস সঠিক ভাবে সংরক্ষিত নয়।
* ইমাম উকাইল র. তাকে যয়ীফ রাবীদের দলভূত করেছেন।
* ইমাম ইবনুল জাওযী র. তাকে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়েছেন (তাহযীবুল কামাল ১৪/৫৩৩,মিযানুল ইতিদাল;১/৩১১)
মোট কথা: ঈসা ইবনে জারিয়া একজন ‘যয়ীফ’ রাবী। যার বর্ণনা দলিল বা সমর্থক দলিল কোন ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুহাদ্দিসদের নিকট তিনি অনেক সময় ভুল ও আপত্তিকর কথাকে হাদীস স্বরূপ ভুলবশত: বা ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ণনা করেন একারণে অনেকে তাকে “منكر الحديث” বলেছেন।
২ নং জবাব –
এহাদীসের মূলভাষ্য ভাল করে পড়ে দেখুন, কোথাও তারাবীহ শব্দ উল্লেখ নেই। হাদীসের ভাষা তারাবীর জন্য “কিয়ামূল লাইল” বা “কিয়ামে রমযান” ব্যবহৃত হয়েছে, এখানে এ জাতীয় কোন শব্দ নেই।
সুতরাং এহাদীস দ্বারা আট রাকাত তারাবীহর প্রমাণ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই; বরং এ বর্ণনায় বলা হয়েছে যে এটি রমযানের এক রাতের ঘটনা। তাহাজ্জুদের নামায জামাতের সাথে হতোনা, এক রাতে তিনি ঘরের মহিলাদের অনুরোধে আট রাকাত পড়িয়ে দিয়েছেন। তাই রাসূল স. এর নিকট তা প্রকাশ করেছেন। সব আলামত দ্বারা বুঝা যায় হযরত উবাই রা. মহিলাদের নিয়ে যে আট রাকাত পড়িয়েছেন তা তাহাজ্জুদ হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
৩ নং জবাব-
অনুসন্ধানে দেখা যায় উপরোক্ত হাদীসটি তারাবীহ সংক্রান্ত হওয়াতো দূরের কথা রমযানের ঘটনা সম্পর্কেও পরিস্কার নয়। কারণ হাদীসটি যাওয়ায়েদ, মুসনাদে আহমদ এবং আওসাতে তাবারানীতে বর্ণিত হাদীসে রমযান শব্দ থাকলেও মূল হাদীসে রমযান শব্দ নেই; বরং রাবীর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা স্বরূপ “يعني في رمضان” এসেছে। এটা মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় (مدرج) মুদ্রাজ। যা সম্ভবত ঈসা বিন জারিয়া যিনি অনেক সময় বর্ণনায় ভুল করেন তার বা অন্য কোন রাবীর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা স্বরূপ সংযোগ হয়েছে। কিয়ামূল লাইল কিতাবে সরাসরি রমযান থাকলেও উপরোক্ত কেউ তা মূল হাদীসের অংশ মনে করে বর্ণনা করেননি। সুতরাং যদি ঘটনাটা রমযানেরই না হয় (যা পূর্বে আলোচনায় অনুমান হলো) তাহলে তারাবীহর নামায আট রাকাতের দলিল স্বরূপ পেশ করা ব্যর্থ অপচেষ্টা বৈ কী।
৪. নং জবাব-
যদি ধরে নেয়া হয় যে, উক্ত হাদীসটি সহীহ। তাহলে বিরাট প্রশ্ন জাগে যে, উবাই রা. তারাবীহ আট রাকাত পড়ে রাসূল স. থেকে স্বীকৃতি নিলেন অথচ তিনি হযরত উমর রা. এর যুগে বিনা কথায় জামাতের সাথে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে গেলেন কেন ? তিনি তো তখন এ হাদীস দ্বারা হযরত উমর রা.সহ সকল সাহাবীর সামনে আট রাকাত তারাবীহর পক্ষেই প্রমাণ পেশ করার কথা ছিল। হাদীসের ভাণ্ডার খুলে দেখুন, এমন কোনো ঘটনা কি কেউ দেখাতে পারবে ? তাছাড়া হাদীসটির বর্ণনা হযরত জাবের রা.ও করেছেন। তিনি হযরত উমর রা. যুগে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন কেন ? তিনিও তো এহাদীস দিয়ে আট রাকাতের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করলেন না কেন ?
আসল কথা : এহাদীসের রাবী ‘ঈসা বিন জারিয়া’ তিনি স্বরণশক্তি দুর্বলতার কারণেই বিকৃত বিবরণ বর্ণনা করে হযরত উবাই বিন কা‘ব এর দিকে সম্বোধন করে দিয়েছেন।
আলোচ্য হাদীসটি ‘কিয়ামূল লাইল’ কিতাবের সনদে আরেকজন রাবী আছেন (محمد بن حميد) মুহাম্মদ বিন হুমায়দ রাযী র.।
* ইমাম বুখারী র. তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, فيه نظر তার ব্যাপারে আপত্তি আছে।
* হাফেজ ইবনে হাজার র. বলেছেন- তিনি حافظ ضعيف দুর্বল হাফেজে হাদীস।
* ইমাম যাহাবী র. তার কাশেফ গ্রন্থে বলেছেন- اولي تركه তাকে বর্জন করাই শ্রেয়। সম্ভবত এ দুর্বল রাবীর কারণেই কিয়ামূল লাইল গ্রন্থে হাদীসটি মূল ভাষ্যে رمضان রমযান শব্দটিও যোগ হয়েছে। নচেৎ অন্যান্য বর্ণনায় রমযান শব্দটি হাদীসে নেই। থাকলেও ব্যাখ্যা স্বরূপ এসেছে।
এসব কারণে এধরণের একটি মুনকার এবং অতি দুর্বল হাদীস দ্বারা উপরোক্ত অকাট্য বহু দলিল দ্বারা প্রমাণিত বিশ রাকাত তারাবীহর বিরোধীতা করা এক মাত্র শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের পক্ষেই সম্ভব।
আট রাকাত তারাবী হওয়ার
তৃতীয় দলিল
হযরত জাবের রা.এর বর্ণনা-
عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ لَيْلَةً ثَمَانِ رَكَعَاتٍ وَالْوِتْرَ فَلَمَّا كَانَ مِنَ الْقَابِلَةِ اجْتَمَعْنَا فِي الْمَسْجِدِ وَرَجَوْنَا أَنْ يَخْرُجَ إِلَيْنَا فَلَمْ نَزَلْ فِيهِ حَتَّى أَصْبَحْنَا قَالَ: ্রإِنِّي كَرِهْتُ وَخَشِيتُ أَنْ يُكْتَبَ عَلَيْكُمُ الْوِتْرُগ্ধ (مختصر قيام الليل: ص৯০)
রাসূল স. আমাদেরকে নিয়ে রমযানে আট রাকাত ও বিতর পড়েছেন। পরে রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হলাম এবং আশা করলাম তিনি (স.) বের হয়ে আমাদের নিকট আসবেন; কিন্তু সকাল পর্যন্ত আমরা মসজিদে (অপেক্ষমান) থাকলাম (তিনি আর বের হলেন না)। (কিয়ামূল লাইল পৃ:৯০)
হাদীসটির জবাব-
এ হাদীসটিও পূর্বের হাদীসের ন্যায় নিতান্ত ‘যয়ীফ’ অপ্রমাণযোগ্য। কারণ:
১. এ হাদীসের সনদেও ওই পূর্বোক্ত সমালোচিত রাবী ‘ঈসা ইবনে জারিয়া’ আছেন। যার ব্যাপারে পূর্বের হাদীসে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তিনি ‘মুনকারুল হাদীস’ ‘মাতরুক’ তার অধিক বর্ণনাই ‘যয়ীফ’।
২. হাদীসটি সহীহ বলে মেনে নেয়া হলেও এ সম্ভাবনা প্রবল যে, রাসূল স. আট রাকাত সকলকে নিয়ে পড়েছেন। মানুষের ভিড় লক্ষ করে ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঘরে প্রবেশ করেন এবং অবশিষ্ট নামায ঘরেই একাকী আদায় করেন। এর স্বপক্ষে দলিল মুসলিম শরীফের সহীহ হাদীস।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে- একরাতে রাসূল স. সকলকে নিয়ে নামায পড়েছিলেন। মানুষের আগমনের অবস্থা দেখে জামাত ছেড়ে ঘরে চলে যান। অত:পর রাবী বলেন- ثم صلي صلاة لم يصلها عندنا. অর্থাৎ রাসূল স. এরপর হুজরায় গিয়ে একাকী নামায পড়েছেন। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং : ১১০৪)
সুতরাং এ রাতে সকলকে নিয়ে আট রাকাত পড়া এবং অবশিষ্ট নামায হুজরাতে গিয়ে একাকী আদায় করা প্রমাণ করেনা যে, তারাবীহ শুধু আট রাকাত।
৩. ঈসা বিন জারিয়া সূত্রে বর্ণিত হযরত জাবের রা. এর হাদীসটি রাসূল স. যে কয়েক রাতে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়িয়েছেন তারই বিবরণ। আর একাধিক সহীহ হাদীসে বিভিন্ন সাহাবী থেকে ওই রাতগুলোর তারাবীহর বিবরণ সংকলন হয়েছে। কোন একটি রেওয়ায়েতে নামাযের সংখ্যার উল্লেখ নেই। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াসহ অনেকে একারণেই বলেছেন, যারা মনে করবে রাসূল স. থেকে নির্দিষ্ট কোন তারাবীহর সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে তারা ভুল করবে।
সুতরাং কোন সহীহ হাদীসে রাকাত সংখ্যার উল্লেখ নেই। অথচ জাবের রা. এর এ হাদীসে আট রাকাতের কথা উল্লেখ আছে। আর হাদীসটি ঈসা বিন জারিয়ার কারণে মুনকার ও অধিক দুর্বল। এমন দুর্বল হাদীস সহীহ একাধিক হাদীসের বিপরীত হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য নয়।
* এমর্মে যেসব সহীহ হাদীস একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নে দেয়া হলো-
ক. হযরত আয়েশা রা.এর হাদীস (দ্র: বুখারী:৯২৪ ও মুসলিম:৭৬১) খ. হযরত আনাস রা.এর হাদীস (মুসলিম:১১০৪) গ. হযরত যায়েদ বিন সাবিত রা.এর হাদীস (দ্র: বুখারী: ৭৩১ও মুসলিম:৭৮১) ঘ. হযরত আবু যর রা. এর হাদীস (দ্র: আবু দাউদ ১৩৭৫ ও তিরমিযী:৮০৬) ঙ. নুমান বিন বাশীর রা.এর হাদীস (দ্র: নাসায়ী:১৬০৬)।
চতুর্থ দলিল
حَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ يُوسُفَ عَنْ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ أَنَّهُ قَالَ أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُومَا لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
অর্থ: সায়েব বিন ইয়াযীদ র. বলেন, উমর রা. উবাই ও তামিম দারী রা.কে লোকদেরকে নিয়ে এগার রাকাত নামায পড়তে আদেশ দিলেন । (মুওয়াত্তা মালেক: ৯৮ হা: নং ৩৭৯)
জবাব-১
এই হাদীসটি একটি ভুল বিবরণ। একজন রাবী হযরত উমর রা. এর যুগের তারাবীহর বিবরণ দিতে গিয়ে ভুলক্রমে বিশ রাকাতের স্থলে এগার রাকাত উল্লেখ করেছেন। অথচ হযরত উমরের যুগে যে তারাবীহ বিশ রাকাত হতো এতে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। পূর্বে আমরা বহু সহীহ হাদীস, ইজমা ও ব্যাপক কর্মধারার মাধ্যমে তা প্রমাণ করেছি। ইমাম ইবনে আব্দিল বার র.সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, এটা বর্ণনাকারীর ভুল। ইবনে আব্দিল বারের মন্তব্য নিম্নরূপ-
قال ابن عبد البر: روي مالك في هذا الحديث احد وعشرون وهو صحيح ولا اعلم احدا قال فيه احدي عشرة الي مالكا ويحتمل ان يكون ذلك اولا ثم خفف عنه طول القيام ونقلهم الي احدي وعشرين الا ان الاغلب عندي ان قوله احدي عشرة وهم. (اعلاء السنن: ৭/৪৮)
অর্থাৎ- ইমাম মালেক র. এই হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে কখনো ১১ রাকাত কখনো ২১ রাকাতের কথা বলেছেন এবং ২১ রাকাতের কথাটিই সহীহ ও সঠিক। কারণ, এগার রাকাতের কথা ইমাম মালেক র. ছাড়া আমার জানামতে অন্য কেউ বলেন নি। তবে এসম্ভাবনা আছে যে, হযরত উমর রা. এর যুগে প্রথমে এগার রাকাত ছিলো, পরে দীর্ঘ কেরাত সংক্ষেপ করে রাকাত বৃদ্ধি করে একুশ রাকাত করা হয়েছে। তবে আমার প্রবল ধারণা এগার রাকাতের কথাটি বর্ণনাগত ভুল।
সুতরাং এ হাদীসের মতনে اضطرابরয়েছে। এর অন্য সনদে তের ও একুশ রাকাত বর্ণিত আছে। তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। (ইলাউস সুনান: ৭/৪৮)
জবাব-২
ইতোপূর্বে হযরত উমর রা.এর নির্দেশ সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে বিশ রাকাতের কথা আছে। তাই এটি আমলযোগ্য নয়।
জবাব-৩
ইমাম মালেক র. নিজেও এর উপর আমল করেননি।
জবাব-৪
মুয়াত্তা মালেকেই বিশ রাকাতের রেওয়ায়েত আছে। (পৃ: ৪০)
জবাব-৫
রাবী সায়েব বিন ইয়াযিদ থেকেই বিশ রাকাতের বর্ণনা রয়েছে। (বায়হাকী: ১/২৬৭ও ২/৪৯৬)
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, লা-মাযহাবীদের পেশ করা দলিলগুলো অগ্রহণযোগ্য। তাই বিশ রাকাত তারাবীহই আদায় করতে হবে।
সর্বশেষ কথা
লা-মাযহাবীদের দলিলের সংখ্যা উপরোক্ত চারটি। তন্মধ্যে একটি হাদীস সহীহ যা মূলত তাহাজ্জুদের বর্ণনা সম্বলিত। আর এটাকে তারা তারাবীহর ক্ষেত্রে প্রমাণ করা ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। আর দু‘টি মুনকার ও অতি দুর্বল হাদীস, যা প্রমাণযোগ্যই নয়। মূল বিষয়েও অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে। আর সর্বশেষ হাদীসটি একজন রাবীর ভুল বিবরণ। এধরণের ভিত্তিহীন দুর্বল হাদীস এবং একটি সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা দ্বারা অকাট্য বহু সহীহ হাদীস এবং সাহাবাদের ইজমা, সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদাসহ তাওয়াতুরে আমলীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিশ রাকাতের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছে তাদের এ কর্মকাণ্ড গোটা মুসলিম মিল্লাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল।
ক্স মাহে রমযানে আল্লাহ তা‘আলার অসীম রহমত ও বরকত বান্দার জন্য অবধারিত। এমাসে এক রাকাত সুন্নাতের গুরুত্ব ফরযের সমতুল্য। এক রাকাত ফরযের সাওয়াব কমপক্ষে সত্তর গুন হয়ে থাকে। অত:পর প্রত্যেকের ইখলাস ও খুশু-খুযু অনুযায়ী তার সাওয়াব সাত’শ গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। একারণে হাদীসে এসেছে, রমযান এলে রাসূল স.এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো। তিনি অধিক পরিমাণে নামায আদায় করতেন। (বায়হাকী) রমযানের শেষ দশকে নিজেও রাত জাগতেন, আপন পরিবারকেও জাগাতেন। অধিক পরিমাণে ইবাদত বন্দেগী করতেন। (বুখারী,মুসলিম) কোন মুসলমানের পক্ষে এ অমূল্য সময়ে দলগত বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়ে এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া মোটেই সমীচীন হবেনা।
ক্স পবিত্র মক্কা মদীনায় হারামাইন শরীফের হাজার বছরের ইতিহাসে কখনো কি বিশ রাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়েছিল? কোন সাহাবী, খলীফায়ে রাশেদ কি কখনো বিশ রাকাতের কম পড়েছিলেন ? তারা কি কেউ হযরত আয়েশা রা.কর্তৃক বর্ণিত তাহাজ্জুদের হাদীসটিকে তারাবীহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে ধারণা করেছিলেন ?
তাহলে ভিত্তিহীন কিংবা অপ্রাসঙ্গিক কয়েকটি বর্ণনা দ্বারা যারা মনগড়াভাবে উম্মতের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক কর্মধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, আট রাকাতের নামে এ পবিত্র মাসের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত করার জন্য মসজিদে মসজিদে ফিৎনা সৃষ্টি করছে, তাদের পাতানো ষড়যন্ত্রের জালে পড়া কি মুসলমানের জন্য সঠিক হবে ?
তারাবীহতে কুরআন খতম করার হুকুম
তারাবীহর নামাযে একবার কুরআন খতম করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা। তাই মানুষের অলসতার কারণে কুরআন খতম করা থেকে বিরত থাকা যাবে না মর্মেই অধিকাংশ ফুকাহার মত। (দুররে মুখতার ও শামী : ২/৪৯৭)
অনেক ফকীহর মতে (আমাদের যুগে) মুসল্লিদের অবস্থা বিবেচনা করে কেরাত পড়া উত্তম। তাই ইমাম ওই পরিমাণ কেরাত পড়বে, যাতে মুসল্লিরা বিরক্ত না হয়, এবং তাদের জন্য কষ্টকর না হয়। কারণ দীর্ঘ কেরাত থেকে জামাআতের লোকসংখ্যা বাড়ানো উত্তম। (বাদায়ে: ১/৬৪৬)
আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. লিখেছেন, এটা একদম অপারগ অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমাদের যুগে এমন অপারগতা নেই, যার ফলে এই সুন্নাত বর্জন করতে হবে। বরং বর্তমানে হাফেজের সংখ্যাও অনেক আর সব মসজিদেই কুরআন খতম করা হয়। মুসল্লীরাও আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে খতমে তারাবীহতে অংশগ্রহণ করে কুরআন শুনে থাকে। (ফাতাওয়ায়ে উসমানী: ১/৪৬৭)
অনেকে বলেন, ২৭তম রাতে খতম করা মুস্তাহাব । কারণ এতে শবে কদর পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। (শামী: ২/৪৯৭) এমনিভাবে অন্য বেজোড় রাতেও খতম করা যাবে। আবু হানীফা র. থেকে বর্ণিত- প্রতি রাকাতে দশ আয়াত করে পড়বে। এতে কুরআনও খতম হবে যা সুন্নাত, আবার লোকদের জন্য কষ্টকরও হবে না। (শামী: ২/৪৯৭) খতম শেষ হওয়ার পর বাকি রাতগুলোতেও তারাবীহ পড়তে হবে। এতে যে কোনো কেরাত পড়া যাবে। (ফাতহুল কদীর : ১/৬৪৬, বাদায়ে: ১/৬৪৬)
তারাবীহর নামাযের সময়
অধিকাংশ ফকীহর মতে তারাবীহর সময় হলো ইশার পরে বিতরের আগে ফজর পর্যন্ত। এটা সাহাবাদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। ইশা ও বিতরের পরে যদি তারাবীহ পড়া হয় তাহলে সহীহ মতানুসারে তারাবীহ হয়ে যাবে। যদি মাগরিবের পরে ইশার আগে তারাবীহ আদায় করা হয় তাহলে অধিকাংশ ফকীহর মতে তা যথেষ্ট হবে না। অবশ্য কিছু হানাফী আলেমের মতে তা যথেষ্ট হবে। হানাফীদের মতে তারাবীহ রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বা অর্ধেক পর্যন্ত বিলম্ব করা মুস্তাহাব। (শামী: ২/৪৯৩-৯৪ যাকারিয়া, মওসুআতুল ফিকহিয়্যা: ২৭/১৪৭-৪৮)
তারাবীহর কাযা
যদি কারো তারাবীহ ছুটে যায় তাহলে সহীহ মতানুসারে তা কাযা করতে হবে না। তবে কেউ যদি কাযা আদায় করে, তাহলে তা নফল হবে তারাবীহ হবে না। অনেকের মতে, কেউ যদি সময়ের মধ্যে তারাবীহ পড়তে না পারে তাহলে সে একাকী তা কাযা করবে, আরেক তারাবীহর সময় হওয়ার আগে। কেউ কেউ বলেন, রমযান মাস অতিবাহিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাযা করতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৯৫, মওসুআ: ২৭/১৪৯)
তারবীহা (চার রাকাত পরপর বিশ্রাম)
তারবীহা তথা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করা মুস্তাহাব। অনেকে এটাকে সুন্নাতও বলেছেন। চার রাকাত পড়তে যতটুকু সময় লাগে ততক্ষণ বিশ্রাম করা উত্তম। চুপ থাকা, তেলাওয়াত করা, তাসবীহ পাঠ বা একাকী নামাযও পড়া যাবে। উচ্চস্বরে কিছু পড়া যাবে না। সম্মিলিতভাবে দুআ করা যাবে না। এ সময়ের জন্য কোনো দুআকে নির্দিষ্ট করা যাবে না। কোনো দুআর উপর বারংবার পড়তে বলা বা পীড়াপীড়ি করাও উচিত নয়। সবাই নিজের ইচ্ছামতো আমল বা দুআ করবে। (দুররে মুখতার ও শামী : ২/৪৯৬-৯৭, বাদায়ে: ১/৬৪৮, মওসুআ: ২৭/১৪৪)
নফল নামাযের জামাআত
তারাবীহ, ইস্তিসকা ও কুসুফের নামাযের জন্য জামাআত বৈধ। অন্যান্য নফল নামাযের জামাআত যদি تداعي ডাকাডাকির সাথে হয় তাহলে তা মাকরুহে তাহরীমী। চাই এনামায রমযানে পড়া হোক বা অন্য সময়ে হোক। এটাই ফুকাহাদের অভিমত। বাদায়েতে আছে-
اذا صلوا التراويح ثم ارادواأن يصلوها ثانيا يصلون فرادي لا بجماعة لان الثانية تطوع مطلق، والتطوع المطلق بجماعة مكروه.
অর্থাৎ তারাবীহর নামায পড়ার পর আবার পড়তে চাইলে একাকী পড়তে হবে। জামাআতের সাথে নয়। কারণ দ্বিতীয়টি নফল আর নফল নামায জামাআতের সাথে পড়া মাকরুহ। (খ.১ পৃ.২৪০) বাহরুর রায়েকে আছে-
ولوصلوا التراويح ثم ارادوا أن يصلوها ثانيا يصلون فرادي.
তারাবীহর নামায কেউ দ্বিতীয়বার পড়তে চাইলে সে যেন একাকী পড়ে।
‘কিয়ামে রমযান’-এর মিসদাক
অনেকের মতে, হাদীসে উল্লিখিত কিয়ামে রমযান দ্বারা তারাবীহ উদ্দেশ্য নয়; বরং যে কোনো নফল নামাযই কিয়ামে রমযান। সুতরাং রমযানে নফল নামাযের জামাআত করা যাবে। এই মতটি সঠিক নয়। ফুকাহা ও মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় কিয়ামে রমযান দ্বারা তারাবীহই উদ্দেশ্য।
খতম তারাবীহ পড়িয়ে বিনিময় গ্রহণ করা
বর্তমান যুগে তারাবীহতে কুরআন খতম করে বিনিময় নেওয়ার গর্হিত প্রথা চালু হয়েছে। হাফেজ সাহেবরা কুরআনকে উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। নিজেদের এলাকা ছেড়ে যেখানে টাকা বেশি পাওয়া যায় সেখানে চলে যায়। যা অত্যন্ত দু:খজনক।
যারা কুরআনকে উপার্জনের মাধ্যম বানায় তাদের ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে কঠোর নিন্দা ও কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। এক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হলো- আল্লাহর আনুগত্য বা ইবাদতমূলক কোনো কাজের পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যাবে না। তবে দীনী স্বার্থে পরবর্তী ফকীহগণ যে গুলোর উপর দীন টিকে থাকা নির্ভর করে এমন কয়েকটি বিষয়কে এর ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করেছেন। যেমন-তা‘লীম তথা দীনী শিক্ষা প্রদান, ইমামতি,আযান দেওয়া প্রভৃতি। কারণ পারিশ্রমিক ছাড়া কারো পক্ষে বেশিদিন এসব কাজে লেগে থাকা সম্ভব নয়। ফলে সব সময় এসব কাজের জন্য লোক পাওয়া যাবে না। এতে দীনের অনেক বড় ক্ষতি হবে। তাই প্রয়োজনের ভিত্তিতে এসব ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক গ্রহণকে বৈধ বলা হয়েছে। (দুররে মুখতার:৯/৮৬)
কিন্তু যেখানে এমন শরয়ী প্রয়োজন নেই সেখানে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হবে না। যেমন কুরআন তেলাওয়াত করে এবং ঈসালে সওয়াব করে টাকা নেওয়াকে ফুকাহারা নাজায়েয বলেছেন। (শামী:৯/৭৭-৭৮)
তেমনি তারাবীহতে কুরআন খতম করা দীনী কোনো প্রয়োজন নয়। এটি সুন্নত মাত্র, তাই কোথাও যদি হাফেয পাওয়া না যায়, সেখানে সূরা তারাবীহ পড়ে নিলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং শুধু কুরআন খতমের জন্য কুরআন বিক্রি করার অনুমতি ও বৈধতা কীভাবে হতে পারে ?
أجرة علي الطاعة (ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ)-এ মাসআলার উপর ভিত্তি করে বর্তমান সময়ের মুফতীগণ খতম তারাবীহ পড়িয়ে বিনিময় গ্রহণ ও বিনিময় প্রদানকে নাজায়েয বলেছেন। চাই এটা চুক্তিভিত্তিক হোক বা প্রচলন হিসাবে হোক। উভয় অবস্থায় হারাম। তাই কোথাও ফী-সাবিলিল্লাহ পড়ানোর মতো হাফেজ পাওয়া না গেলে সূরা তারাবীহ পড়ে নিবে।
কোনো হাফেজ যদি স্বেচ্ছায় ফী-সাবিলিল্লাহ পড়ায় আর তার টাকা নেওয়ার ইচ্ছা না থাকে, তারপরও কোনো মুসল্লি হাদিয়াস্বরূপ তাকে কিছু দেয় তাহলে তা গ্রহণ করার অবকাশ আছে। তবে শর্ত হলো- সেখানে এধরণের কিছু দেওয়ার প্রথা না থাকতে হবে।
খতম তারাবীহর বিনিময় নাজায়েয হওয়ার দলিল
১. কুরআন:- ولاتشتروا بآياتي ثمنا قليلا.
‘তোমরা আমার আয়াতকে (পার্থিব) সামান্য বস্তুর বিনিময়ে বিক্রি করো না। (সূরা বাকারা:৪১)
২. হাদীস:- اقرءوا القرآن ولا تأكلوابه
‘তোমরা কুরআন পড়ো; কিন্তু এর মাধ্যমে উপার্জন করো না’। (নাসবুর রায়া:৪/৩২৬)
ফিকহের বহু কিতাবে এ বিষয়টি উদ্বৃত হয়েছে। কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করছি।
৩. রদ্দুল মুহতার:৯/৭৬-৭৭ যাকারিয়া।
৪. আলমগীরী:৪/৪৪৮-যাকারিয়া।
৫. আল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ : ৩/১৮
৬. তাবয়ীনুল হাকায়েক: ৬/১১৭
৭. হাশিয়ায়ে তাহতবী: ৪/৩০
৮. ফাতহুল কাদীর: ৯/৯৮-৯৯
৯. ফাতওয়া উসমানী : ১/৫০৪-৫-৬
১০. ইমদাদুল ফাতাওয়া:১/৪৭৪
১১. ইমদাদুল আহকাম : ১/৬৫৪-৬৬৪
১২. ফাতাওয়া রহীমিয়্যা:৬/২৪৫
১৩. ফাতাওয়া মাহমুদিয়া:১১/৪০৪
১৪. কিফায়াতুল মুফতী:২/৪১-৩/৪০৯
১৫. আহসানুল ফাতাওয়অ: ৩/৫১৪
১৬. নেযামুল ফাতাওয়া : ৬/৮৩-৮৫
১৭. ফাতাওয়া রশীদিয়া: ৩৯১।
যাতায়াত ভাড়া ও খাওয়ার খরচ
কোনো হাফেজ সাহেব যদি আসা-যাওয়া করে পড়ায় তাহলে তার যাতায়াত খরচ দেওয়া যাবে। এমনিভাবে খাওয়া-দাওয়ার জন্যও কিছু দেয়া যাবে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই খরচটা যুক্তিসঙ্গত ও প্রয়োজনমাফিক হতে হবে। অন্যথায় (অতিরিক্ত দিলে) এটাও নাজায়েয হয়ে যাবে।
একটি হীলা বা কৌশল: নাজায়েয বিনিময় গ্রহণ থেকে বাঁচতে অনেক জায়গায় একটি হীলা অবলম্বন করা হয়। তা হলো, হাফেজ সাহেবকে নায়েবে ইমাম বানিয়ে তাকে ইমামতির বেতন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে হাফেজ সাহেব ২/৩ ওয়াক্ত নামায পড়ান। এমন হীলা অবলম্বন বৈধ। তবে শর্ত হলো, শুরুতেই তার ইমামতির বেতন নির্ধারণ করতে হবে, আর তা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। অন্যথায় এটাও খতমের বিনিময় হয়ে যাবে। (রহীমিয়া: ৬/২৩৫, মাহমুদিয়া: ২৫/২০৯, নেযামূল ফাতাওয়া: ৬/৮২-৮৩, কিফায়াতুল মুফতী: ৩/৪১০-দারুল এশা‘আত,করাচী)
শেষ কথা- রমযান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমল তারাবীহর নামায। ছাওয়াব লাভ ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হয় তারাবীহর নামায আদায়ের মাধ্যমে। তাই সবার উচিত যথাযথভাবে তারাবীহ আদায় করে এই সুযোগ কাজে লাগানো। তারাবীহ হতে হবে রাসূল স. ও সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণে এবং ফকীহদের নির্দেশিত পদ্ধতিতে। বিশেষ করে পুরো উম্মতের ঐক্যমতপূর্ণ আমল বিশ রাকাত তারাবীহকে আট রাকাত বলে অপপ্রচার করে নিজের ও অন্যদের আমল নষ্ট করা সম্পূর্ণ অনুচিত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সীরাতে মুস্তাকীম তথা সরল-সঠিক পথের উপর থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন ॥
শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ঢাকা বাংলাদেশ
-এর কেন্দ্রীয় ফাতওয়া বিভাগ কর্তৃক গবেষণালব্দ প্রবন্ধ সমাহার
তারাবীহর রাকাত সংখ্যা
তত্ত্বাবধানে
মুফতী মিযানুর রহমান সাঈদ
মারকাযুশ শাইখ যাকারিয়া লিল্ বুহুসিল ইসলামিয়া ঢাকা
(শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, ঢাকা)
িি.িসঁভঃরসরুধহ.পড়স, ঊসধরষ-সঁভঃরসরুধহ@মসধরষ.পড়স
সূচী
তারাবীহর রাকাত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্যের ইতিকথা …………………………….
দু’টি মৌলিক কথা ……………………………………………………………….
প্রথম অধ্যায়
২০ রাকাত তারাবীহর দলিলসমূহ ………………………………………………..
তথাকথিত আহলে হাদীসদের হাদীসের ব্যাপারে অবিচার ………………………..
দ্বিতীয় দলিল খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত ……………………………………….
খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওমর রা. এর মর্যাদা ……………………………………
রাসূল স. এর যুগে এবং খলীফা হযরত আবু বকর রা. এর যুগে তারাবীহর নামাযের অবস্থা ও তার ইতিকথা …………………………………………………………..
খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর রা. এর যুগে তারাবীহ ……………………………
খলীফা উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত …………..
সহীহ হাদীস কে লা-মাযহাবীদের যয়ীফ বলার চক্রান্ত ……………………………
খলীফায়ে রাশেদ: হযরত উমর রা.-এর সুন্নাতের ব্যাপারে লা-মাযহাবীদের দ্বিমুখী বক্তব্য …………………………………………………………………………..
তাবেয়ীনদের বর্ণনাগুলো ‘যয়ীফ’ বা অগ্রহণযোগ্য নয় কেন ? …………………..
হযরত উসমান রা. এর যুগ ………………………………. …………………..
হযরত আলী রা. এর যুগ ………………………………. ……………………..
৩য় দলিল : ইজমায়ে সাহাবা …………………………………………………..
মুহাজির আনসারসহ সকল সাহাবায়ে কিরামের ইজমা …………………………
৪র্থ দলিল : মারফুয়ে হুকমী ……………………………………………………
৫ম দলিল : সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা ……………………………………………..
সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা তথা তাআমুলে উম্মত ……………………………………
ক. মক্কাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل مكة ………………………………………….
খ. মদীনাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل مدينة ……………………………………….
প্রথম শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ …………………………………….
দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ …………………………
চতুর্থ ,পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে মসজিদে তারাবীহ ……………………………..
অষ্টম, নবম, দশম, ও একাদশ শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ …………
চতুর্দশ শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ ………………………………….
গ. কুফাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل كوفة ……………………………………….
ঘ. বসরাবাসীর তাআমুল ……………………………………………………….
ঙ. বাগদাদবাসীর তাআমুল …………………………………………………….
পরিশিষ্ট ………………………………. ………………………………………
একটি প্রশ্ন ও তার খণ্ডন ……………………………………………………….
ষষ্ট দলিল : ইজমায়ে উম্মত ……………………………………………………
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া র.-এর অভিমত ……………………………………..
হারামাইনের চৌদ্দ‘শ বছরের তারাবীহর ইতিহাস ……………………………..
দ্বিতীয় অধ্যায়
তারাবীহ ৮ রাকাতের পক্ষের দলিল ও তার খণ্ডন ……………………………..
রাসূল স. কত রাকাত তারাবীহ পড়েছেন ? …………………………………..
লা-মাযহাবীদের আট রাকাতের দলিল …………………………………………
দলিলটি খণ্ডন ………………………………. ………………………………..
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ সম্পূর্ণ ভিন্ন নামায ………………………………………
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহর মাঝে পার্থক্য ………………………………………….
দ্বিতীয় দলিল: ……………………………… ………………………………..
আট রাকাত তারাবীহর দ্বিতীয় হাদীসের পর্যালোচনা ………………………….
আট রাকাত তারাবী হওয়ার তৃতীয় দলিল …………………………………….
হাদীসটির জবাব- ……………………………………………………………..
চতুর্থ দলিল ……………………………………………………………………
সর্বশেষ কথা …………………………………………………………………..
তারাবীহতে কুরআন খতম করার হুকুম ………………………………………..
তারাবীহর নামাযের সময় ………………………………………………………
তারাবীহর কাযা ……………………………………………………………….
তারবীহা (চার রাকাত পরপর বিশ্রাম) …………………………………………
নফল নামাযের জামাআত ……………………………………………………..
‘কিয়ামে রমযান’-এর মিসদাক ………………………………………………..
খতম তারাবীহ পড়িয়ে বিনিময় গ্রহণ করা …………………………………….
খতম তারাবীহর বিনিময় নাজায়েয হওয়ার দলিল …………………………….
যাতায়াত ভাড়া ও খাওয়ার খরচ ………………………………………………
একটি হীলা বা কৌশল: ……………………………………………………….
শেষ কথা: ………………………………. ………………………………….
ভূমিকা
তারাবীহর রাকাত সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্যের ইতিকথা
তারাবীহর নামায সুন্নাত। গোটা ইসলামী দুনিয়ায় রাসূল স. সাহাবাদের স্বর্ণযুগ থেকে চলে আসা নীতি অনুযায়ী সব জায়গায় সর্ব যুগে সকল মসজিদে তারাবীহ ২০ রাকাত এবং বিতর তিন রাকাতই পড়া হয়েছে। মাঝখানে ইমাম মালেক র. এর যুগে এবং তার ভক্তদের কিছু যুগ পর্যন্ত ৩৬ রাকাত বা ৩৮ রাকাত পড়া হয়েছিল। তবে ২০ রাকাতের কম তারাবীহর নামায কখনো কোথাও পড়া হয়নি। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাসে ১২৮৪ হিজরীতে ভারতের আকবরবাদ থেকে একজন লা-মাযহাবী আলেম ২০ রাকাত তারাবীহকে বিদআত ও ৮ রাকাতকে সুন্নাত বলে ফতোয়া জারী করেন। ওলামাদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে সেই ফতোয়া অকার্যকর হয়ে গেলে তার এক বছর পর তাদের আরেকজন মাও. মুহাম্মদ হুসাইন বাটালবী পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে উক্ত ফতোয়ার পুনরাবৃত্তি করেন। তার এ ফতোয়ার বিরুদ্ধে অন্যান্য আলেমদের পাশাপাশি লা-মাযহাবীদের বিখ্যাত আলেম মাও. গোলাম রাসূল ‘রিসালাতুত তারাবীহ’ (رسالة التراويح) নামক গ্রন্থ লিখে ফতোয়াটির দাঁতভাঙ্গা জবাবের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ গ্রন্থটি ১২৯০ হি. তে প্রকাশিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কয়েকজন প্রসিদ্ধ আলেম মাও. মুবারকপুরী, হাফেজ আব্দুল্লাহ প্রমুখ উক্ত ফতোয়াটিকে পূনরায় প্রচার ও প্রসার করতে গেলে লোকদের মধ্যে তারাবীহর রাকাতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি ও মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। এদের প্রচারিত ফতোয়ার দলিল ভিত্তিক জবাব দিয়ে সব চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করেছেন ওলামায়ে দেওবন্দের অভিভাবকগণ। যথাক্রমে- আল্লামা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী, আল্লামা কাসেম নানুতুবীসহ আরো অনেকে। এ বিষয়ে সর্বশেষ কলম ধরেন ভারতের যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী র.।
কিন্তু চক্রান্তকারীরা থেমে নেই, স্বয়ং আরবের মাটিতেও কিছু আলেম এ নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। যেখানে সমগ্র পৃথিবীর প্রাণকেন্দ্র হারামাইন শরীফাইনে ১৪ শত বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ২০ রাকাত তারাবীহ চলে আসছে। সে পবিত্র ভূমিতে সম্ভবত সর্বপ্রথম তারাবীহ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির জন্যে আট রাকাতের ফতোয়া জারি করেন ‘শেখ নসীব রেফায়ী’। তারাবীহ ৮ রাকাত প্রমাণ করার জন্য তিনি একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন। কিন্তু ওলামায়ে আরবের প্রতিবাদের মুখে সে ফতোয়াটিও টিকেনি। তাই উক্ত ফতোয়ার পক্ষে সমর্থনসহ জোরালো ভূমিকা রাখেন আরবের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা নাসীরুদ্দিন আলবানী র.। এরই পরিপ্রেক্ষিতে উক্ত ফতোয়া ও তার সমর্থনকারী আলবানী সাহেবদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিতে আরব জাহানের কয়েক জন আলেম “আল ইসাবা ফিল ইনতেসার লিল খুলাফা-য়ির রাশিদীন ওয়াস সাহাবা” (الإصابة فى الانتصار للخلفاء الراشدين و الصحابة) নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি কিতাব রচনা করেন। যেখানে উক্ত ফতোয়ার সকল দিক আলোচনা পূর্বক দলিল ভিত্তিক খণ্ডন করে ২০ রাকাত তারাবীহ সুন্নাত হওয়ার দালীলিক প্রমাণ পেশ করা হয় । এই কিতাবের ৬১নং পৃষ্ঠায় তারা লিখেছেন :
(ولم يشذ أحدهم عنها غير هذه الشرذمة القليلة التى ظهرت فى زماننا كاالشيخ ناصر و إخوانه.)
অর্থাৎ আমাদের যামানায় আত্মপ্রকাশ কারী নাসীরুদ্দিন আলবানী ও তার অনুসারীদের ক্ষুদ্র একটি দল ছাড়া আর কেউ অনুরূপ ফতোয়া দিয়ে (তারাবীহ ৮ রাকাত) উম্মত থেকে বিচ্ছিন্নতা অবলম্বন করেন নি। অর্থাৎ এর পূর্বে কেউ ৮ রাকাতের মত ব্যক্ত করেননি; বরং সকল আলেম ফকীহ ২০রাকাতের উপর একমত ছিলেন। এরপর ১৩৭৭ ইং সালে আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেব আল ইসাবা কিতাবটির জবাবে تسديد الإصابة)) ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি বই রচনা করেন। এ বইতে তিনি ইনসাফ ভিত্তিক দলিল পেশ না করে উসূলে হাদীস, উসূলে ফিকাহ, রিজাল শাস্ত্র এবং জরাহ্ তা’দীল সম্পর্কিত সর্ব স্বীকৃত মূলনীতির ব্যাপারে স¤পূর্ণ অপরিপক্কতা ও দৈন্যতার আশ্রয় নিয়ে ২০ রাকাত তারাবীহর বিপক্ষে এবং আট রাকাতের পক্ষে যেভাবে কলম ধরেছেন তা তার মতো হাদীস বিশারদের পক্ষে কল্পনা করাও মুশকিল। এমন পক্ষপাতপুষ্ট হয়েও তিনি ইসলামের প্রায় সাড়ে বার শত বছরের ইতিহাস থেকে সাহাবা, তাবেয়ী ও সালাফে সালেহীনের ৮ রাকাত তারাবীহ পড়ার উপর একটি প্রমাণও পেশ করতে পারেননি। তেমনিভাবে এ দীর্ঘ ইতিহাসে একটি মসজিদও দেখাতে পারেননি যেখানে ৮ রাকাত তারাবীহ পড়া হতো বা হয়েছিল। তবে তিনি ওই পুস্তিকায় হযরত ইমাম মালেক র. এর দিকে ৮ রাকাতের বিষয়টি সম্পৃক্ত করে বসেন। অথচ মালেকী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্থ (المدونة) ‘আল মুদাওয়ানা’ কিতাবটি দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যেতো যে, তিনি বিতরসহ ৩৯ রাকাতের তারাবীহ পড়তেন এবং তৎকালিন মদীনার গভর্নর তারাবীহর রাকাত সংখ্যা কমাতে চাইলে ইমাম মালেক তার অনুমতি প্রদান করেননি বরং নিষেধ করেছেন। (আল মুদাওয়ানা : ১/২০৮-১০)
আমার ধারণা, তিনি ইমাম মালেকের দিকে কথাটি সম্বোধন করার সময় জানতেন যে কথাটি গবেষণার কষ্টিপাথরে মোটেও টিকবেনা; কিন্তু নিজের পক্ষপাতিত্ব রক্ষার জন্য গায়ের জোরেই কথাটি চালিয়ে দিলেন। আর দলিল স্বরূপ ‘জুরী’ নামক এক শাফেঈ লোকের বরাত দিয়ে এ ভিত্তিহীন কথাটি উল্লেখ করলেন। যার সূত্রের ধারাবহিকতা ও কোন পরিচিতি নেই। বরং লোকটি মাজহুল (مجهول) এবং সনদ মুনকাতি’ (منقطع) যা অন্তত আলবানী সাহেব থেকে কল্পনা করা যায় না।
মোট কথা: ৮ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহ এর নামায নব আবিষ্কৃত সাহাবী, তাবেঈ, তাবে-তাবেয়ী যুগ এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত কোন মুহাদ্দিস ও ফকীহ থেকে প্রমাণিত নয় যে আট রাকাতই যথেষ্ঠ, বিশ রাকাত বিদআত। বরং বর্তমান শতাব্দীর প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী যিনি আরব জাহানের শীর্ষ আলেম ও শাইখদেরও উস্তাদ তিনি ‘রাকাআতুত তারাবীহ’ (ركعات التراويح) নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলেছেন যে, ভারতবর্ষে ১২৮০ হি. এবং আরবের নসীব রেফায়ির পূর্ব পর্যন্ত প্রায় সাড়ে বারশ বছরের ইতিহাসে আট রাকাত তারাবীহর উপর একটি প্রমাণও কেউ দেখাতে পারবেনা। তিনি তার কিতাবে প্রত্যেক শতাব্দীর উম্মার সম্মিলিত ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা (الأعمال المتوارثة) দেখিয়েছেন যে সব যুগে তারাবীহ বিশ রাকাতই ছিল। বিশ রাকাতকে বিদআত বা আপত্তি করার মতবাদ কোনো শতাব্দীতে ছিলনা। কিতাবটি প্রকাশ হয়েছে প্রায় অর্ধ শতবছর হয়ে গেলেও এ চ্যালেঞ্জের জবাব স্বয়ং আলবানীও দিতে পারেননি। আলবানী সাহেব তার বইতে যা কিছু লিখেছেন তার দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন সৌদি আরবের সুপ্রসিদ্ধ গবেষক শাইখ ইসমাঈল আন্সারী। তিনি বড় মূল্যবান একটি কিতাব রচনা করেন। যার নামই তার পরিচয়।
تصحيح أحاديث صلاة التراويح عشرين ركعة و الردعلى الألبانى فى تضعيفه
এ কিতাবে আলবানী সাহেব বিশ রাকাতের হাদীসকে অমূলকভাবে কলমের জোরে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার যে অপচেষ্টা চালিয়েছেন তার দলিল ভিত্তিক জবার দিয়ে দৃঢ়ভাবে হাদীস সহীহ বলে প্রমাণ করেছেন। উপরন্তু আমার সরাসরি উস্তাদ মসজিদে নববীর প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস মাদীনার শরয়ী আদালতের কাজী শায়খ আতিয়্যা সালেম التراويح أكثر من ألف عام নামে একটি গ্রন্থ লিখে প্রমাণ করেছেন যে, হারামাইন শরীফাইনের ইতিহাসে কখনো বিশরাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়নি।
অন্য একজন বিখ্যাত আলেম আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ আলী সাবুনীও এবিষয়ে التراويح عشرون ركعة নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব গ্রন্থের মাধ্যমে তারা প্রমাণ করেছেন যে, উম্মতের সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা হতে প্রমাণিত বিশ রাকাত তারাবীহই সুন্নাত। এর উপরই সকলের “আমলে মোতাওয়ারাছাহ” প্রতিষ্ঠিত। আট রাকাতের বিষয়টি সাড়ে বারশত বৎসর পরে ভারতে উদ্ভব হয়। অতপর রেফায়ী ও আলবানীদের মাধ্যমে আরবেও এর প্রকাশ ও প্রচার ঘটে ।
লা-মাযহাবী বন্ধুরা ভেবে দেখুন! আপনারা কার অনুসরণে আজ মুসলিম উম্মার মাঝে এ নিয়ে ফিৎনা সৃষ্টি করছেন। উম্মতের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি করা কার উকালতি ?
দু’টি মৌলিক কথা
আলোচ্য বিষয়টি বুঝার জন্য দুটি কথা আলোচনা খুবই প্রয়োজন।
ক) প্রথম কথা: কুরআনুল কারীমের পর শরীয়তের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হচ্ছে সুন্নাহ। আর রাসূল স. এর শিক্ষা ও নির্দেশনাবলীকেই সুন্নাহ বলা হয়। এই সুন্নাহ কয়েক প্রকার –
১. রাসূল স. এর শিক্ষা ও নির্দেশনা অনেক সময় মৌখিকভাবে বর্ণনা হয় এবং পরষ্পরার মাধ্যমে আমাদের নিকট তা পৌঁছে থাকে। তখন এইসব মৌখিক বর্ণনাসূত্রে পাওয়া রেওয়ায়েতগুলোকে সুন্নাহর পাশাপাশি হাদীস বলা হয়। এর নাম- الحديث القولى কাওলি তথা মৌখিক হাদিস।
২. রাসূল স.-এর শিক্ষা ও নির্দেশনার মৌখিক বর্ণনাস্থলে অনেক সময় শুধু কর্মের ধারাবাহিকতায় আমাদের কাছে পৌঁছে থাকে অর্থাৎ রাসূল থেকে কর্মের মাধ্যমে সাহাবা রা. গ্রহণ করেছেন তাদের থেকে তাবেঈন এবং তাদের থেকে তাবে-তাবেঈন গ্রহণ করেছেন এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরী তার পূর্বসূরী থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে রাসূলর সে শিক্ষা ও নির্দেশনাকে গ্রহণ করেছেন। এটাকে আমলী হাদিস (الحديث العملى) বা সুন্নাতে মুতাওয়ারিছা বলা হয়।
উল্লেখ্য, যেসব বিষয় কর্মের মাধ্যমে পৌঁছেছে, তা অনেক সময় রাসূলর মৌখিক বর্ণনাসমূহে হয়তো পাওয়া নাও যেতে পারে বা পাওয়া গেলেও সে মৌখিক বর্ণনাটি সূত্রের দিক দিয়ে ‘যয়ীফ’ও হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে উক্ত নবীজির শিক্ষার এধারাটি সাধারণ মৌখিক বর্ণনা ধারার তুলনায় অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে থাকে এ কারণে মৌখিক বর্ণনায় তা পাওয়া না গেলে বা যয়ীফ সূত্রে পাওয়া গেলে তা কখনো অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
৩. সুন্নাহ তথা নবীর শিক্ষা ও নির্দেশনার একটি অংশ এমনও আছে যা আমাদের নিকট সাহাবাদের রা. শিক্ষা নির্দেশনার মাধ্যমে সংরক্ষিত তবে বিষয়টির ভিত্তি কিয়াস ও ইজতিহাদের উপর নয় বরং রাসূল স.-এর কোনো মৌখিক বর্ণনা বা কর্মধারাই তার ভিত্তি। সাহাবাগণ তার এধারা থেকেই তা গ্রহণ করেছেন কিন্তু অন্যকে তা শিখানোর সময় সাহাবাগণ এর উদ্ধৃতি দেয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কারণ প্রেক্ষাপট থেকেই একথা স্পষ্ট ছিল যে তারা রাসূলর শিক্ষা নির্দেশনার (সুন্নাহ) ভিত্তিতেই এ বিষয়টি অন্যকে শিক্ষা দিয়েছেন। এমন সুন্নাহকে مرفوع حكمي ‘মারফুয়ে হুকমী’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য এ মারফুয়ে হুকমীর ভিত্তি যেহেতু কোন কিয়াস বা ইজতিহাদ নয় বরং মারফুয়ে হাকীকী তথা স্পষ্ট মারফু হাদীসই তার ভিত্তি, কিন্তু এটা জরুরী নয় যে সে স্পষ্ট মারফু হাদীসটি সহীহ সনদে বিদ্যমান থাকবে। বরং হতে পারে তা যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং এ জাতীয় মারফুয়ে হুকমী হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করা স্পষ্ট মারফু দ্বারা দলিল পেশ করার নামান্তর। সুতরাং এর সনদ সহীহ হলে তার পিছনে কোনো সহীহ স্পষ্ট মারফু হাদীস আছে কি না তা দেখার প্রয়োজন নেই। মারফুয়ে হুকমী সহীহসূত্রে প্রমাণিত হওয়াই শরয়ী দলিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট।
৪. নবীর শিক্ষা ও নির্দেশনার আরেকটি অংশ হচ্ছে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ (سنة الخلفاء) যার ব্যাখ্যা হচ্ছে, রাসূল স. ওহীর মাধ্যমে জেনে ছিলেন যে, খুলাফায়ে রাশেদার জারীকৃত সুন্নাহসমূহ অবশ্যই নবীর শিক্ষা ও নির্দেশনারই অনুগামী হবে। এবং এর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি বিদ্ব্যমান থাকবে। তাই রাসূল স. স্বীয় উম্মতকে ব্যাপক ও স্পষ্টভাবে এ ঘোষণা দিয়ে যান যে –
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين . عضوا عليها بالنواجذ
“তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাদের সুন্নাতকে আঁকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং প্রাণপণ শক্ত করে ধরবে”। (ইবনে মাজা : পৃ.৫ নং ৪২)
সুতরাং যখন উম্মতের সামনে চার খলীফার যে কোনো খলীফার একটি সুন্নাত প্রমাণিত হয়ে যাবে, তখন তার অনুসরণের জন্য রাসূল উপরোক্ত ঘোষণাই যথেষ্ট। এর জন্য রাসূল স. থেকে স্বতন্ত্র কোনো দলিল/হাদীসের প্রয়োজন নেই। তাই খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষ।
এটাকে দলিলস্বরূপ গ্রহণ করতে এ কথা ভাবার প্রয়োজন নেই যে তাদের এই সুন্নাতের ভিত্তি কী ? তারা এটা নবীজীর কোন শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন ?
খ. দ্বিতীয় কথা : শরীয়তের একটি বিশেষ উৎসের নাম ইজমা। এর বিভিন্ন প্রকার ও ধরণ আছে। তন্মধ্যে সর্বাধিক সহীহ ও শক্তিশালী প্রকার হচ্ছে ‘ইজমায়ে সাহাবা’ (إجماع (الصحابة। এই ইজমা যদি ব্যাপকভাবে অবিচ্ছিন্ন এবং সম্মিলিতরূপে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছে তবে তা শরীয়তের অনেক শক্তিশালী ও অকাট্য দলিল হিসেবে গন্য করা হবে। কোন বিষয়ে এধরণের দলিল বিদ্যমান থাকলে তা অনুসরণ ও পালনের ক্ষেত্রে অন্য কোন দলিলের প্রয়োজনই পড়েনা।
উল্লেখ্য, ইজমা শরীয়তের এমন দলিল যার ভিত্তি অবশ্যই রাসূল স. এর শিক্ষা নির্দেশনার উপর প্রতিষ্ঠিত। তবে তা অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই। কেননা শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলিল বলে ঘোষণা দিয়েছে এবং বর্ণিত হয়েছে যে যাদের মাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় এরা কখনো গোমরাহীর উপর একমত হতে পারে না। বিশেষ করে তারা যদি আনসার মুহাজির সাহাবা বা আশারায়ে মুবাশ্শারা হন।
স্বয়ং কুরআনে তাদের অনুসরণের নির্দেশ দিয়ে বলা হয়েছে যে, যারা তাদের পথ থেকে বিমুখ হবে তারা জাহান্নামী বলে আখ্যায়িত হবে।
প্রিয় পাঠক, আমাদের আলো”্য বিষয় (তারাবীহর রাকাত সংখ্যা) উপরোক্ত সকল শরয়ী দলিল দ্বারাই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত। তারাবীহর রাকাত সংখ্যা বিশ এর পক্ষে প্রমাণিত দলিল সমূহ-
১. মারফুয়ে হাকীকী তথা স্পষ্ট মারফু হাদীস।
২. মারফুয়ে হুকমী। ৩. খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। ৪. মুহাজিরীন ও আনসার সাহাবীগনের ইজমা। ৫. সুন্নাত মুতাওয়ারাসাসহ সব প্রকারের দলিল দ্বারা তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। যারা তা অমান্য করবে, বিদআত বা ভিত্তিহীন মনগড়া বলে মন্তব্য করবে তারা যে শরীয়ত, কুরআন, সুন্নাহ এবং ইজমা সবই অমান্য করলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আল্লাহ তায়ালা সকলকে সরল সঠিক পথ প্রদর্শন করুন। আমীন ॥
প্রথম অধ্যায় :
২০ রাকাত তারাবীহর দলিলসমূহ
মারফু হাদীস-
ইমাম আবু বকর ইবনে আবী শাইবা স্বীয় কিতাব ‘মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা’তে উল্লেখ করেন:
حدثنا يزيد ابن هارون قال آخبرنا ابراهيم بن عثمان ، عن ابن عباس رضي الله عنه أن رسول الله صلي الله عليه وسلم كان يصلي في رمضان عشرين ركعة و الوتر ،، (مصنف لابن أبي شيبة ২৮৮/২)
হযরত ইবনে আব্বাস রা. সূত্রে বর্ণিত রাসূল স. রমযান মাসে বিশ রাকাত তারাবীহ ও বিতর পড়তেন।
এ হাদীসটি বায়হাকী (খ. ২ প.৪৯৬)। ইমাম তাবরানীর আল-মুজামুল কাবীর (খ:১১ পৃ:৩১)। আল-আওসাত তাবরানী (খ:১ পৃ:৪৪৪)। আল ইসতিযকার (খ:৫ পৃ: ১৫৬) ইত্যাদি সহ হাদীসের নির্ভরযোগ্য বহু কিতাবে উল্লেখ রয়েছে।
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে রাসূল স. এর তারাবীহর নামায বিশ রাকাত ছিল।
হাদীসটির মান ঃ একদল মুহাদ্দিস এ হাদীসের সনদকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন। কেননা, এর সনদে إبراهيم بن عثمان ‘ইব্রাহীম বিন উসমান’ নামক একজন বর্ণনাকারী রয়েছেন, যিনি দুর্বল। তবে তিনি চরম দুর্বল বা মাতরুক (পরিত্যাজ্য) নন।
কিন্তু আমাদের জানা মতে সাড়ে বারশত বছর যাবত হাদীসটিকে কেউ মাউযু (জাল) বলেননি। বর্তমানে লা-মাযহাবী বন্ধুরা এ হাদীসটি দেখা মাত্র মাওযু বা জাল আখ্যা দিয়ে থাকেন। আর অনুসন্ধানে দেখা গেছে এ বন্ধুরা তাদের মত-পথের বিপরীত হাদীস সহীহ হলেও বলবেন যয়ীফ। তাই তাদের কথা মানা যায় না। আর হাদীসটি আসলে যয়ীফ হলেও জাল/মাওযু বলতে তারা দ্বিধা করে না। এটাই তাদের হাদীস নিয়ে চাতুরী। অথচ যয়ীফ ও জালের মধ্যে আকাশ পাতাল ব্যবধান। কেননা জালতো হাদীসই না বরং চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন কারণে নিজেরা বানিয়ে হাদীসের নামে চালিয়ে দিয়েছে। আর যয়ীফ মানে হলো হাদীসটি বানানো না। তবে বর্ণনা সূত্রে দুর্বলতা পাওয়া গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে- যয়ীফ হাদীস ২০ রাকাত তারাবীহর ক্ষেত্রে দলিল হয় কী করে ?
উত্তর ঃ সহীহ যয়ীফ এগুলো হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষা। মুহাদ্দিসগণের মূলনীতি বুঝা ছাড়া এগুলোর মাহাত্ব বুঝা বড় কঠিন। দেখুন, যে মুহাদ্দিসগণ এটাকে যয়ীফ বলেছেন তাদেরই মূলনীতিতে যয়ীফ হাদীস দু’প্রকার।
ক) হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি সারমর্ম ও বক্তব্য শরীয়তের দৃষ্টিতেও আপত্তিকর। কারণ এ বক্তব্যের অনুকুলে শরয়ী কোন দলীলের সমর্থন তো নেই-ই বরং এর বিপরীতের দলিল পাওয়া যায়।
খ) হাদীসটি যয়ীফ সনদে বর্ণিত হলেও তার বক্তব্যের সমর্থনে অন্যান্য দলিল প্রমাণ বিদ্যমান। বিজ্ঞ মুহাদ্দিস ও সকল ফকীহর সিদ্ধান্ত হলো এ ধরণের হাদীস সনদ ও সূত্রের দিক থেকে যয়ীফ হলেও বক্তব্য ও মর্মের বিচারে কিন্তু সহীহ ও সঠিক। অতএব, আমাদের আলোচ্য হাদীসটিকে একদল মুহাদ্দিস যয়ীফ তো বলেছেন। কিন্তু কোন্ প্রকারের যয়ীফ তার উল্লেখ নেই। আমরা সামনে আলোচনা করবো (ইনশাআল্লাহ)। উক্ত হাদীসের সমর্থনে মারফুয়ে হুকমী, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত, ইজমায়ে সাহাবা এবং সুন্নাতে মুতাওয়ারাছার মত বহু শক্তিশালী প্রমাণাদি বিদ্যমান রয়েছে। তাই শাস্ত্রীয় পরিভাষায় এ ধরণের যয়ীফকে الضعيف المتلقى بالقبول অর্থাৎ সনদের বিবেচনায় যয়ীফ তবে এর বক্তব্য ও মর্ম সাহাবা যুগ থেকে নিয়ে সকল উম্মতের আমলের মাধ্যমে অনুসৃত। এ পর্যায়ের হাদীসের ব্যাপারে হাদীস শাস্ত্রের অভিজ্ঞজনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে- আমলের ক্ষেত্রে তা সর্বাধিক শক্তিশালী সহীহ হাদীস। যা সাধারণ মৌখিক সহীহ হাদীসের তুলনায় অনেক মর্যাদাবান।
একারণেই হানাফী ফকীহগণ হাদীসটিকে ২০ রাকাত তারাবীহর স্বপক্ষে দলিল স্বরূপ পেশ করেন।
লা-মাযহাবী বন্ধুগণ! আমাদের উপরোক্ত পর্যালোচনায় হয়তো নাক চিটকাতে শুরু করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, উপরোক্ত নীতিমালাটি আমরা আবিষ্কার করিনি; বরং এটি সকল হাদীস বিশারদ, ফকীহ ও উসুলীদের একটি সর্বস্বীকৃত নীতির উপর ভিত্তিশীল। আপনারা তা অমান্য করলে নিরেট অজ্ঞতার বহি:প্রকাশ ঘটবে। প্রমাণ স্বরূপ কয়েকটি উক্তি উসূলে হাদীসের কিতাব থেকে তুলে ধরছি।
১. লা-মাযহাবীদের মান্যবর ইমাম হাফেজ ইবনুল কায়্যিম র. ‘কিতাবুর রুহ’ গ্রন্থে এক যয়ীফ হাদীসের উপর মন্তব্য করেন:
فهذا الحديث وإن لم يثبت فاتصال العمل به فى سائر الامصار و الاعصار من غير نكير كاف فى العمل به-
এ হাদীসটি (সনদের দিক থেকে) সহীহ প্রমাণিত না হলে অর্থাৎ যয়ীফ হলেও বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শহরে কোনরূপ আপত্তি ছাড়াই এর উপর (সকলের ) আমল প্রতিষ্ঠিত থাকায় হাদীসটি আমলযোগ্য হওয়ার জন্য যথেষ্ট। (দ্র:পৃ:১৬)
২. মুহাদ্দিস ইমাম যারকাশী র. হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি বিষয়ক কিতাব ‘আন্নুকাত’-এ লিখেছেন-
إن الحديث الضعيف إذا تلقته الأمة بالقبول عمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر (৩৯০:১)
‘যয়ীফ’ হাদীস যখন ব্যাপকভাবে মুসলিম উম্মার নিকট সমাদৃত হয়, তখন হাদীসটি আমলযোগ্য হবে এটাই মুহাদ্দিসগণের বিশুদ্ধ মত। এমনকি তখন যয়ীফ হাদীসটি হাদীসে মুতাওয়াতির (বিপুল সংখ্যক সূত্রে বর্ণিত) এর পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয়ে যায়।
৩. হাফেজুদ্দুনিয়া আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী র. লিখেন-
ومن جملة صفات القبول أن يتفق العلماء على العمل بمدلول الحديث ، فإنه يقبل حتى يجب العمل به وقد صرح بذلك جماعة من أئمة الأصول- ( الإفصاح على نكت إبن الصلاح .( ৪৯৪:১)
হাদীস গ্রহণগোগ্য হওয়ার নিদর্শন সমূহের একটি নিদর্শন হলো, ফুকাহা বা ইমামগণ তার মর্মার্থের উপর আমল করার ক্ষেত্রে একমত পোষণ করা। এমতাবস্থায় হাদীসটি গ্রহণ যোগ্য হবে; বরং তার উপর আমল অপরিহার্য বলে গণ্য হবে। উসূলের অনেক ইমামগণের এবিষয়ে সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
৪. আল্লামা শামছুদ্দিন আস সাখাবী র. ‘ফাতহুল মুগীছ’ কিতাবে লিখেছেন-
وكذا إذا تلقت الأمة الضعيف بالقبول بعمل يعمل به على الصحيح حتى ينزل منزلة المتواتر فى أنة ينسخ المقطوع به، ولهذا قال الشافعى رح فى حديث “لا وصية لوارث” إنه لا يثبته أهل الحديث ولكن العامة تلقته بالقبول و عملوا به حتى جعلوه ناسخا لأية الوصية –( فتح المغيث ৩২৩:১)
উম্মাহ যখন ‘যয়ীফ’ হাদীসকে আমলীভাবে ব্যাপকহারে গ্রহণ করে নেয় তখন সঠিক মতানুসারে তা আমলযোগ্য হয়ে যায়। এমনকি এমন হাদীস অকাট্য বিধান রহিত হওয়ার ক্ষেত্রে মুতাওয়াতির দলিলের মানোত্তীর্ণ হয়। একারণেই ইমাম শাফেয়ী র. “لا وصية لوارث” হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন: হাদীস বিশারদগণ এটাকে (সনদের দিক দিয়ে সহীহ প্রমাণিত মনে না করলেও ব্যাপকহারে আলেমগণ এটাকে গ্রহণ করে নিয়েছেন ও তদানুযায়ী আমল করেছেন। এমনকি তারা এটিকে ওসিয়তের আয়াতের বিধান রহিতকারী আখ্যা দিয়েছেন। ( দ্র: খন্ড:১/পৃ:৩৩৩)
৫. হাফেজ জালালুদ্দিন সুয়ূতী র. তার ‘তাদবীর’ কিতাবে লিখেছেন-
يحكم للحديث بالصحة إذا تلقاه الناس بالقبول وان لم يكن له اسناد صحيح.
সনদের বিবেচনায় সহীহ না হলেও যে হাদীস মানুষ গ্রহণ করে নিয়েছে তাকে সহীহ বলা হবে।
৬. আল্লামা আনোয়ার শাহ্ কাশ্মীরী র. বলেছেন-
كان الاسناد لئلا يدخل فى الدين ما ليس منه ، لا ليخرج من الدين ما ثبت منه من عمل أهل الإسناد-
অর্থাৎ সনদের কাজ হচ্ছে যাতে দীনের বহির্ভূত কোন কাজ দীনের মধ্যে অনুপ্রবেশ না ঘটে। দীনের অধীন বিষয়কে বহির্ভূত করার জন্য নয়। (আল-আজবিবাতুল ফাযেলা পৃ : ২৩৮)
সারকথাা : আলোচ্য হাদীসটি যঈফের দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভূক্ত। যা সহীহ এর মানোত্তীর্ণ হয়েছে। কারণ, সাহাবাদের রা. যুগ থেকে আজ পর্যন্ত সকল উম্মাহর ধারাবাহিক ও অবিচ্ছিন্ন আমল অনুযায়ী চলে আসছে। তাই উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে এটি অবশ্যই শক্তিশালী সহীহ ও আমলযোগ্য হাদিস। এটাকে যারা ‘জাল’ আখ্যা দিয়ে আমল অযোগ্য বলে মন্তব্য করবে তারা বোকার স্বর্গে বাস করে।
তথাকথিত আহলে হাদীসদের হাদীসের ব্যাপারে অবিচার
আহলে হাদীসের বর্তমান শতাব্দীর বরেণ্য মনীষী আল্লামা নাসীরুদ্দিন আলবাণী সাহেব ২০ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণিত হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে ৮ রাকাতের পক্ষের উকালতী করেছেন। অথচ ১৩’শ বছর যাবত কোনো মুহাদ্দিস হাদীসটিকে ‘‘যয়ীফ তবে আমলযোগ্য” এর অতিরিক্ত কিছুই বলেন নি।
তিনি ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসটি মনগড়া ভাবে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়ে দাবির স্বপক্ষে কয়েকটি যুক্তি দিয়েছেন। যা নিম্নরূপ-
১. উক্ত হাদীসটি হযরত আয়েশা রা. ও হযরত জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসদ্বয়ের সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ হযরত আয়েশা রা. এর হাদীসটি সহীহ হলেও তা তাহাজ্জুদের বিবরণ সম্বলিত। যার সাথে তারাবীহর কোন সম্পর্ক নেই। বিস্তারিত আলোচনা আমরা পরে করবো। (ইনশাআল্লাহ)
সুতরাং উভয় হাদীসের সাথে আলোচ্য হাদীসের সংঘর্ষ কোথায়?
দ্বিতীয়ত: আয়েশা রা. এর বর্ণিত হাদীসে এগার রাকাতের কথা উল্লেখ থাকলেও আয়েশা রা. থেকে আরেকটি সহীহ হাদীসে তের রাকাত উল্লেখ আছে।
হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক এদুটি বর্ণনার মাঝে যে বৈপরীত্য আছে তার সমন্বয়ের ক্ষেত্রে যে ব্যাখ্যা ২০ রাকাতের হাদীসের ব্যাপারে একই ব্যাখ্যা দেয়া হলে সংঘর্ষ থাকলো কোথায় ? আসল কথা আয়েশা রা.এর হাদীসের মধ্যে তাহাজ্জুদের বিবরণ। ইবনে আব্বাস রা.এর হাদীসে তারাবীহর বিবরণ। অথবা বলুন, তারাবীহর নামায এগার, তের, বিশ রাকাত সবধরনের আমল রাসূলের ছিল। সাহাবগণ বিশ রাকাতের উপর (ইজমা) ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় উম্মাহ এর উপর আমল করেছেন। তাহলে এটা বিদআত বা মনগড়া হয় কী ভাবে ?
থেকে যায়, আলবানী সাহেবের উক্তি। হাদীসে জাবের রা. উক্ত হাদীসের বিপরীত হওয়া আলবানী সাহেব ভাল করেই জানেন বহুবিদ কারণে হাদীসে জাবের যয়ীফ বলে সর্ব স্বীকৃত (যার বিশ্লেষণ পরে আসবে)। এরপরও এমন যয়ীফ হাদীসকে ইবনে আব্বাসের হাদীসের বিপরীত দাড় করানো কমপক্ষে আলবানীর মত লোকের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। এটা একমাত্র অন্যায়ভাবে পক্ষপাতের মানষিকতায় তিনি তা বলেছেন বলে আমাদের ধারণা।
২. দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আলবাণী সাহেব বলেন যে, উক্ত হাদীসের সনদে (أبو شيبة إبراهيم بن عثمان) আবু শায়বা ইব্রাহীম বিন উসমান রয়েছেন। ইমাম শা’বী র. তাকে মিথ্যুক বলেছেন। কোন হাদীসের বর্ণনাকারী মিথ্যুক হলে হাদীসটি জাল হয়ে যায়।
অথচ আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি যে এবর্ণনাকারীর কারণেই মুহাদ্দিসগণ হাদীসটিকে ‘যয়ীফ’ বলেছেন ‘মউজু’ বা ‘জাল’ নয়। ‘যয়ীফ’ ও এমন যা হালকা ‘যয়ীফ’ (ضعيف خفيف) একারণে হাদীসটি আমলযোগ্য। ইজমায়ে সাহাবা ও খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত উম্মতের ধারাবাহিক আমলের কারণে হাদীসটি শক্তিশালী। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শু’বা কি তাকে মিথ্যুক বলেছেন ? জবাব হলো না, তিনি মিথ্যুক বলেননি। তিনি বা যারা বলেছেন এখানে তার অর্থ হচ্ছে ভুল করেন। কেননা, শু’বা ছাড়া বিজ্ঞ হাদীস বিশারদগণ তার ব্যাপারে কোন কঠিন মন্তব্য করেন নি; বরং অনেকে তার প্রশংসা করেছেন।
যেমন-
* ইমাম বুখারী র. তার ব্যাপারে বলেন- سكتوا عنه অর্থাৎ তার ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণ নীরবতা অবলম্বন করেছেন।
* আল্লামা ইবনে আদী র. তার ‘কামিল’ গ্রন্থে বলেন যে, له أحاديث صالحة وهو خير من إبراهيم بن عثمان أبو حية অর্থাৎ ইব্রাহীম বিন উসমানের কিছু গ্রহণযোগ্য হাদীস রয়েছে। তিনি ইব্রাহীম ইবনে আবু হাইয়্যার চেয়ে অধিক উত্তম। (তাহযীব দ্র:খ:১/পৃ:১৪৫)
* ইমাম বুখারী র. এর উস্তাদেরও উস্তাদ এবং স্বয়ং আবু শাইবা (ইব্রাহীম বিন উসমান) এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী, বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ ইয়াযীদ ইবনে হারুন র. বলেন-ما قضى على الناس رجل يعنى فى زمانه أعدل قضاء منه অর্থাৎ আমাদের যুগে তাঁর (ইব্রাহীম বিন উসমান আবু শাইবা) চেয়ে বড় ন্যায়পরায়ণ বিচারক কেউ ছিলেন না। (তাহযীব:খ:১/পৃ:১৪৫)
এসব বিজ্ঞজনের মন্তব্যের কারণেই ইমাম (শু’বা র. যে كذب বলেছেন তার অর্থ ‘মিথ্যুক’ বলেননি বরং ‘ভুল করেন’ এ অর্থই স্বর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। একারণেই হাদীস বিশারদদের শ্রেষ্ঠ ন্যায়পরায়ণ ইমাম আল্লামা যাহাবী র. ميزان الاعتدال গ্রন্থে শু’বার মন্তব্যকে অগ্রাহ্য বলেছেন। (খ:১/পৃ:৪৭)
সার কথাঃ ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসের সনদে আবু শাইবা নামক যে বর্ণনকারী আছেন তিনি মিথ্যুক বলে কেউ মন্তব্য করেননি। শু’বা করে থাকলেও তা ইমাম যাহাবী অগ্রাহ্য করেছেন অথবা তিনি ‘কাযাবা’ বলে ক্ষ্যান্ত করেছেন। যার অর্থ ভুল করা, মিথ্যা বলা নয়।
কিন্তু পরিতাপের বিষয়! জনাব আলবানী সাহেব হাদীসটি ‘জাল’ আখ্যা দেয়ার জন্য আবু শাইবার ব্যাপারে শু’বার মন্তব্যটি ‘মিথ্যুক’ অর্থে চালিয়ে দেন। যারা তার ব্যাপারে ভাল মন্তব্য করেছেন তাদের কথা যেমন: ইমাম ইবনে আদী ইয়াযীদ ইবনে হারুন ও আল্লামা যাহাবী। এদের কথাগুলো উল্লেখ করেননি। এতেই তার মনগড়া উক্তির রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে গেছে এবং এরকম উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মন্তব্য করে একটি গ্রহণযোগ্য মজবুত হাদীস কে জাল বানিয়ে দিলেন فأين المشتكى؟ অথচ এ যাবতকাল পর্যন্ত কেউ হাদীসটি ‘জাল’ বলেননি বরং ইমাম বায়হাকী ও তাবরানী স্ব স্ব গ্রন্থে বিশ রাকাত তারাবীহর অনুচ্ছেদে উক্ত হাদীস দ্বারা দলিল পেশ করেছেন।
৩. জনাব আলবানী সাহেব ইবনে আব্বাস রা. এর হাদীসটি কে ‘জাল’ প্রমাণ করার তৃতীয় কারণ হিসেবে বলেন যে, আবু শাইবা তথা ইবনে আব্বাসের রা. হাদীসে নাকি বিশ রাকাত তারাবীহ রাসূল সা. রমজান মাসে জামাত ছাড়া আদায় করার বিবরণ রয়েছে। যা হযরত আয়েশা ও জাবের রা. এর বর্ণিত হাদীসের বিরোধী। তাই উক্ত হাদীসটি ‘জাল’ নাউযুবিল্লাহ এমন কথা আমরা আলবানী সাহেব থেকে আশা করিনি।
প্রথম কারণ, উক্ত হাদীসটি আবু শাইবা থেকে তিনজন রাবী বর্ণনা করেছেন।
(ক) ইয়াযীদ বিন হারুন।
(খ) আলী ইবনুল জাদ।
(গ) মানসুর বিন আবু মুযাহীর।
এ তিনজনের মধ্যে প্রথম দুজন রাবী মানসুরের তুলনায় অত্যন্ত শক্তিশালী। মানসুর তাদের তুলনায় দুর্বল। বায়হাকী শরীফে মানসুরের বর্ণনায় ‘জামাত ছাড়া পড়তেন’ কথাটি উল্লেখ আছে। হাদীসটির ভাষ্য এ রকম-
عن إبن عباس قال :كان النبى ص فى شهر رمضان فى غير جماعة بعشرين ركعة والوتر( بيهقى : رقم ৪৬১৫)
তবে আবু শাইবার শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দুজন রাবী হাদীসটির বর্ণনা অনুসারে প্রাধান্য পাবে। তাহলে এবর্ণনাটি আয়েশা রা. ও জাবের রা. হাদীসের বিরোধী হলো কোথায়? বিষয়টি আলবানী সাহেবের অজানা নয় বরং শুধু পক্ষপাতিত্ব রক্ষা হচ্ছে এ সবের মূল কারণ।
দ্বিতীয়তঃ তাছাড়া ‘জামাত ছাড়া’ কথাটি ধরে নিলেও তা বিরোধী বলার প্রয়োজন কী ? রাসূল স. জামাতের সাথেও কয়েক রাকাত তারাবীহ পড়েছেন জামাত ছাড়াও পড়েছেন। আবার এক হাদীসের বর্ণনায় দেখা যায় কিছু নামায জামাতের সাথে পড়ার পর যখন দেখলেন মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, মাঝখানে জামাত ছেড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন অবশিষ্ট তারাবীহ ঘরেই পড়লেন। সুতরাং সব হাদীসে একই ঘটনার বিবরণ থাকতে হবে তা না আয়েশা ও জাবের এর বর্ণনায় (আলবানীর কথা মত) জামাতের তারাবীহর বিবরণ এসেছে। আর না ইবনে আব্বাসের বর্ণনায় জামাত ছাড়া যে তারাবীহ পড়েছেন সে তারাবীহ এর বিবরণ বিবৃত হয়েছে। এমতাবস্থায় পরষ্পর হাদীসগুলো বিরোধপূর্ণ হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
উপরোক্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ একথাটি মনগড়া নয়। হাফেজুল হাদীস আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী র. বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন: والظاهر إن هذا فى قصة أخرى (فتح البارى ৮:৩)
অর্থাৎ বাহ্যত এটা ভিন্ন কোন ঘটনা হয়ে থাকবে। হাদীসে আয়েশা ও হাদীসে ইবনে আব্বাসের ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন।
তৃতীয়তঃ অধিকন্তু জাবের রা.এর হাদীস যা আলবানী সাহেব বার বার ইবনে আব্বাসের হাদীসের সাথে বিরোধী বলে পেশ করেছেন, এটি ‘যয়ীফ’ হাদীস। যা ইবনে আব্বাসের হাদীসের সাথে বিরোধীতা করার শক্তি রাখেনা। আর হযরত আয়েশার হাদীসটি তাহাজ্জুদ সংক্রান্ত, তারাবীহর ব্যাপারে নয়।
চতুর্থঃ হাদীসটিতে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ার কথা বিষয়টি উল্লেখ নেই বরং হাদীসটির মধ্যে বহু প্রমাণ বিদ্যমান যে তা হযরত আয়েশার ঘরের নামায ছিল, মসজিদের নয়। (এব্যাপারে আমরা আলোচনা করেছি) তাহলে দুই হাদীসে বিরোধ কোথায় ? বিরোধ না হলে আলোচ্য ২০ রাকাতের হাদীসটি ‘জাল’ হলো কোথায় আর বিরোধ হলেও সামাঞ্জস্যপূর্ণ ব্যাখ্যা হাদীস বিশারদের থেকে পাওয়ার পরও আমলযোগ্য মজবুত হাদীসটি ‘জাল’ হবে কিভাবে ? আসলে আলবানী সহেব যা বললেন অন্তত তাঁর মুখে এটা কখনো শোভা পায়না।
দ্বিতীয় দলিল খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত
প্রথমত ঃ খুলাফায়ে রাশেদীন তথা চার খলীফা আবুবকর, ওমর, উসমান, ও আলী রা.এবং সাহাবায়ে কিরামের আমল ও কর্মধারা অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এরা হচ্ছেন নবী স. ও তার পরবর্তী উম্মতের মাঝে সেতুবন্ধন। আল্লাহ তাআলা কুরআনে এবং রাসূল স. তাঁর হাদীসের মাধ্যমে সাহাবায়ে কিরামকে সত্যের মাপকাঠি ঘোষণা করে তাদের মত ও পথের অনুসরণ অনুকরনের নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে- أمنو كما امن الناسতোমরা ঈমান আনয়ণ কর লোকেরা (সাহাবারা) যেভাবে ঈমান এনেছে। (সুরা বাকারা:১৩)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে- فان أمنو بمثل ما أمنتم به فقد اهتدوا তোমরা (সাহাবারা) যেভাবে ঈমান এনেছো তারা যদি সেরূপে ঈমান আনে নিশ্চিত তারা হেদায়াত পাবে।(সুরা বাকারা)
রাসূল স. ইরশাদ করেন-
تفرق أمتي علي ثلاث و ستون ملة كلهم في النار الا ملة واحدة قالوا من هي يا رسول الله قال ما انا عليه واصحابي ( ترمذي:২/৯৩)
অর্থাৎ আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। প্রতিটি দলই জাহান্নামে যাবে শুধু একটি দল নাজাত পাবে। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, কারা সেই নাজাত প্রাপ্ত দল ? রাসূল স. বললেন ‘আমি এবং আমার সাহাবাগণ যে পথ ও মতাদর্শের উপর ছিল ওই আদর্শের অনুসারীরাই নাজাতপ্রাপ্ত দল। (তিরমিযী খ:২/পৃ:৯৩)
বিশেষ করে সাহাবাদের মধ্যে রাসূলের চার খলীফার সুন্নাত আদর্শ ও আমল এবং আকীদাকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরার প্রতি রাসূল স. জোর তাকিদ দিয়ে বলেন-
فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلَافًا كَثِيرًا، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ، وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلَالَةٌগ্ধ(سنن ابي داود: ৪/২০০،رقم: ৪৬০৭)
অর্থাৎ আমারপরে তোমাদের মধ্যে যে জীবিত থাকবে সে অচিরেই বিভিন্ন মত বিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা অবশ্যই আমার ও আমার খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত এবং আদর্শের অনুসরণ করবে। তা কঠোর ভাবে আঁকড়ে ধরবে। (আবুদাউদ:৪/২০০(৪৬০৭) তিরমিযী,ইবনে মাজাহ)
দেখুন, উপরোক্ত পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সকল সাহাবা র. কে সত্যের মানদণ্ড এবং শরীয়তের বিধি নিষেধের ক্ষেত্রে তাদের অনুসরণকে অপরিহার্য এবং তাঁদের সুন্নাত বিশেষত খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে নবীজী নিজের সুন্নাতের সমপর্যায়ের ঘোষণা দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত ঃ আমরা ভূমিকায় বলেছি যে, খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূল সা. এটা জেনেছিলেন যে, তাদের জারীকৃত যেকোন আমল বা সুন্নাত নবীজী স. এর বাণী সুন্নাতেরই অনুগামী হবে। একারণে নবীজী স. খুলাফাদের সুন্নাতকে মজবুতভাবে আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়ে গেছেন। কাজেই উম্মতের সামনে যে কোন একজন খলীফায়ে রাশেদের সুন্নাত সঠিকভাবে প্রমাণিত হয়ে গেলে তা অনুসরণের ক্ষেত্রে ভিন্ন কোন দলীলের প্রয়োজন হবে না; বরং নবীজীর উপরোক্ত নির্দেশমূলক হাদীসই যথেষ্ট হবে। এ ব্যাপারে খলীফায়ে রাশেদের সুন্নাতটি নবী স. এর শিক্ষা বা সুন্নাতের কোন্ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাও দেখার প্রয়োজন নেই। অন্যদিকে রাসূল স. এর এক হাদীসে আছে-
قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الخِلاَفَةُ فِي أُمَّتِي ثَلاَثُونَ سَنَةً، ثُمَّ مُلْكٌ بَعْدَ ذَلِكَ. (ترمذي: ২২২৬)
অর্থাৎ খেলাফতের মেয়াদ আমার ইন্তেকালের পর ত্রিশ বৎসর চলবে। (তিরমিযী ২২২৬)
এ ভবিষ্যদ্বানী হিসেবে খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন তথা আবুবকর রা. ওমর রা. উসমান রা. এবং আলী রা.
উল্লেখ্য আলীর রা. শাহাদাত হয়েছে রাসূলের ত্রিশ বৎসর পর অর্থাৎ ৪০ হিজরীতে।
খলীফায়ে রাশেদ হযরত ওমর রা. এর মর্যাদা
এ চারজনের মধ্যে হযরত আবু বকর রা. এর পরেই হযরত ওমর রা. এর স্থান। নবীজী স. বিভিন্ন হাদীসে হযরত ওমর রা. এর মান ও মর্যাদা এভাবে বর্ণনা করেছেন-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: إِنَّ اللَّهَ جَعَلَ الحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ وَقَلْبِهِ.
অর্থাৎ রাসূল স. বলেছেন, আল্লাহ তাআলা হক ও সত্যকে ওমরের মুখ ও অন্তরে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। তিরমীযী-৩৬৮২
অপর হাদীসে রাসূল স. বলেন,
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: ্রإِنَّ اللَّهَ وَضَعَ الْحَقَّ عَلَى لِسَانِ عُمَرَ يَقُولُ بِهِ. (ابوداود: ২৯৬২) باب في تدوين العطاء.
অর্থ: আল্লাহ তাআলা সত্যকে ওমরের মুখে বদ্ধমূল করে দিয়েছেন। তিনি সর্বদা সত্যই বলে থাকেন। (আবু দাউদ-২৯৬২)
অন্য হাদীসে রয়েছে-
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْ كَانَ نَبِيٌّ بَعْدِي لَكَانَ عُمَرَ بْنَ الخَطَّابِ. (سنن الترمذي: ৩৬৮৬، باب في منافب ابي حفص عمر)
নবীজী স. বলেন, যদি আমার পরে কেউ নবী হতো তাহলে উমরই হতো। (তিরমিযী-নং ৩৬৮৬)
এসকল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ তাআলা সাহাবাদের রা. মধ্যে বিশেষভাবে হযরত উমর রা. কে হক ও সত্য বলার বিশেষ যোগ্যতা প্রদান করেছিলেন। তাই সভাবগতভাবেই তিনি সর্বদা সত্য বলতেন এবং তার সকল কাজ ও সিদ্ধান্ত সঠিক ও আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অনুপাতেই হতো। একারণে প্রায় সতেরটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হযরত উমর রা. এর মতকে স্বয়ং ওহীর মাধ্যমে সত্যতার সনদ দিয়েছেন। হযরত উমরের প্রশংসা এখানে সামান্য আলোচনা এজন্য করলাম যে, বিশ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহর নামাযে একই ইমামের ইক্তিদায় জামাতের সহিত মসজিদে নববীতে ধারাবাহিক হযরত উমরই রা. চালু করেছেলেন। সকল সাহাবা রা. তার এই পদ্ধতিকে সমর্থন দেয়ায় এর উপর সাহাবা রা. দের (ইজমা) ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর উসমান ও আলী রা. এ ধারাবাহিকতা বহাল রেখে বিশ্বের সকল উম্মতের মধ্যে অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক আমল(سنة متوارثة) প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সুতরাং উমর রা. থেকে আরম্ভ করে খুলাফায়ে রাশেদার ধারাবাহিক সুন্নাত ইজমায়ে সাহাবা দ্বারা প্রমাণিত সকল উম্মতের ধারাবাহিক অবিচ্ছিন্ন আমলের মাধ্যমে তারাবীহ বিশ রাকাত সুন্নাহ হিসেবে গৃহীত। আমাদের জন্যও বিশ রাকাতের উপর আমল করা অপরিহার্য। একে যারা বিদআত বা মনগড়া আমল বলবে এবং বিশ রাকাতের কম পড়বে তারাই পথভ্রষ্ট এবং তাদের এ আমল সুন্নাত পরিপন্থি বলেই সাব্যস্ত হবে।
রাসূল সা. এর যুগে এবং খলীফা হযরত আবু বকর রা. এর যুগে তারাবীহর নামাযের অবস্থা ও তার ইতিকথা
সহীহ বুখারী ও মুসলিম শরীফের হাদীস এবং অন্যান্য হাদীসের কিতাবে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল স. কখনো কখনো তারাবীহর নামায জামাতে পড়িয়েছেন, আবার কখনো কখনো এমন হয়েছে যে কয়েক রাকাত জামাতের সাথে পড়ে রুমে চলে গেছেন এবং একাকী নামায আদায় করেছেন।(দ্র:মুসলিম:১১০৪)
আবুদাউদ শরীফসহ বিভিন্ন কিতাবের হাদীস দ্বারা বুঝাযায় এক রমযানে রাসূল স. শুধু ২০,২৩,২৫ এবং ২৭ রমজান এ তিন রাত্র জামাতের সাথে তারাবীহ পড়িয়েছেন। প্রথম রাত্রে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত, দ্বিতীয় রাত্রে অর্ধরাত পর্যন্ত এবং তৃতীয় রাত্রে সাহরী পর্যন্ত তারাবীহ পড়িয়েছিলেন। অবশিষ্ট রাত্রগুলোতে একাকী-ই পড়েছেন এবং অধিকাংশ সময় জামাতে না পড়ার কারণটিও বলে দিয়েছেন خشية أن تفترض عليكم. অর্থাৎ জামাতের সাথে নিয়মিত তারাবীহ পড়লে এ নামাযটিও উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিল। এতে বুঝা যায় জামাতের সহীত পড়ার ইচ্ছা ছিল কিন্তু উপরোক্ত কারণে পড়েননি।
আল্লামা হাবীবুর রহমান আযমী র. বলেন- তারাবীহর নামায রাসূল স. এর কখনো জামাতের সাথে বা কখনো এককীভাবে গুরুত্ব সহকারে পড়া এবং রাসূলের মৌখিক হাদীস “سننت لكم قيامه” “আমি কিয়াম তথা তারাবীহকে সুন্নাত করেছি” দ্বারাই তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা হওয়ার প্রমাণবহন করে।
আর তারাবীহ জামাতের সাথে পড়া সুন্নাত কি না এ ব্যাপারে ফকীহদের দুটি মত রয়েছে-
ক) সুন্নাতে মুআক্কাদা। খ) সুন্নাতে যায়েদা।
যারা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা বলেন তাদের দলিল হচ্ছে- নবীজী স. যদিও প্রায় সময় একাকীই পড়েছেন, জামাতে পড়েননি। তবে জামাতে পড়ার অধিক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও ফরজ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তা পড়তে পারেননি। জামাতে পড়ার আগ্রহটি আমলীভাবে জামাতের গুরুত্ব বুঝায়। বিধায় তা আমলে দায়েমীর অন্তর্ভূক্ত। (حكمي عمل دائمي) তাই জামাতে তারাবীহ পড়াও সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। পক্ষান্তরে অনেক ফকীহ গবেষকগণ জামাতে পড়াকে সুন্নাতে মুআক্কাদা বলেন না; বরং সুন্নাতে যায়েদাহ বলেন। কেননা, নবীজী স. এর পক্ষ থেকে জামাতে পড়ার ধারাবাহিকতা পাওয়া যায় না। সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ হলে রাসূল স. কখনো জামাত ত্যাগ করতেন না।
এ কারণে দেখা যায় রাসূল স. এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম রা. এক ইমামের পিছনে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ার গুরুত্ব দিতেন না। তারাবীহ ব্যক্তিগত পর্যায়ের আমল ছিল। কখনো একাকী, কখনো জামাতে পড়লেও পুরা নামায জামাতে পড়তেন না। কখনো পুরা পড়লেও জামাতের গুরুত্ব বা বাধ্যবাধকতা ছিলনা। এসব কারণে তারাবীহ রাসূল স. এবং তাঁর যুগে সাহাবা রা. কত রাকাত পড়তেন এ ব্যাপারে আলোচনা গবেষণা করার প্রেক্ষাপট তৈরী হয়নি। একারণেই মূলত সরাসরি রাসূল স.এর পক্ষ থেকে মারফু হাদীস (মৌখিক বা আমলী) ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়নি। হযরত ইবনে আব্বাস রা. সহ মাত্র কয়েকজন সাহাবী থেকে যে কয়টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে তা আলোচনায় না আসায় প্রসিদ্ধি লাভ করেনি। এমতাবস্থায় হযরত আবু বকর রা. ও উমর রা. এর খেলাফতের প্রথম কয়টি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। সকলেই ব্যক্তিগত পর্যায়ে তারাবীহ আদায় করতেন। এক ইমামের ইক্তিদায় জামাতে পড়ার কোন পাবন্দী করতেন না। উমরের খেলাফতকালে যখন এক ইমামের পিছনে মসজিদে নববীতে জামাতের সাথে তারাবীহ গুরুত্বসহকারে আরম্ভ হলো তখনই রাকাতের বিষয়টি আলোচনায় আসলো এবং সাহাবীগণ ইবনে আব্বাসের হাদীসটির ভিত্তিতে বিশ (২০) রাকাতের উপর একমত হয়ে তারাবীহ পড়া আরম্ভ করলেন।
খলীফায়ে রাশেদ হযরত উমর রা. এর যুগে তারাবীহ
রাসূল সা. এর দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা. এর খেলাফতের প্রথম ছয় বছর ছিল ইসলামী বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ভভ সকল ফিতনা দমনের কাল। পুরা ইসলামী জগত রোম ও ইরানের আক্রমণ থেকে নিয়ন্ত্রণ ও সুশৃঙ্খল করে শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে মনযোগ দেন।
রমযানের একরাতে তিনি মসজিদে নববীতে গিয়ে দেখতে পান যে, মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ছোট বড় জামাতের সাথে তারাবীহ পড়া হচ্ছে। তিনি সকলকে একত্রিত করে এক ইমামের পিছনে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দিলেন এবং উবাই বিন কা’ব রা. কে ইমামতির দায়িত্ব দিলেন। ‘আদ্দুরুল মানছুর’ (الدر المنثور) কিতাবে সূরা কদর এর তাফসীরে উল্লেখ আছে যে, হযরত উমর রা.তারাবীহর এ নিয়ম চালু করার ক্ষেত্রে হযরত আলী রা. এর সাথে পরামর্শ করেছেন।
প্রথম দিকে হযরত ওমর রা. লম্বা কেরাত তিলাওয়াতের মাধ্যমে সাহরীর পূর্ব পর্যন্ত নামাজের জামাত চালাতে নির্দেশ দিয়েছেলেন এবং ইমামকে এগার (১১) রাকাত পড়ানোরও পরামর্শ দেন। যা ‘মুয়াত্তা মালেক’ গ্রন্থের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। (দ্র: পৃ:৪০) ধারণা এই ছিল যে, রাসূল স. রমযানের রাতে যে নামায জামাতের সাথে মাঝে মধ্যে পড়েছেন বা একাকী পড়েছেন তা তাহাজ্জুদই ছিল। এতএব, তাহাজ্জুদ ভিন্নভাবে পড়ার দরকার নেই। অতপর এহাদীসে পরিলক্ষিত হলো যে, নবীজী স. রমযানের রাতে ২/৩ দিন যে নামাযটি জামাতের সাথে পড়িয়েছিলেন তাতে তিনি বিশ রাকাত পড়িয়েছিলেন। যেমন ‘আল-তালখীসুল হাবীর’ ও ‘বায়হাকী শরীফে’র হাদীসে এসেছে। তাই হযরত উমর কেরাতকে সংক্ষিপ্ত করে রাকাতের সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিশ রাকাত পড়ানোর নির্দেশ দিলেন। এবং রাতের প্রথম অংশেই নামায শেষ করে ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদ ভিন্নভাবে পড়ার নির্দেশও প্রদান করলেন। সহীহ বুখারী হাদীস নং ২০১০ এ পাওয়া যায় যে, সর্বশেষ নামাযের নিয়ম চালুর নির্দেশ প্রদানের পর একদা হযরত উমর রা. মসজিদে নববীতে আসেন এবং দেখেন যে উবাই বিন কা’বের ইক্তিদায় সমস্ত মুসলমান জামাতের সাথে তারাবীহ পড়ছেন। তা দেখে তিনি অতি মূল্যবান অর্থবহ বাক্য উচ্চারণ করলেন-
قَالَ عُمَرُ: ্রنِعْمَ البِدْعَةُ هَذِهِ، وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِي يَقُومُونَগ্ধ يُرِيدُ آخِرَ اللَّيْلِ وَكَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ أَوَّلَهُ (صحيح البخاري: ২০১০) باب فضل من قام رمضان.
অর্থাৎ তারাবীহর এ নতুন নিয়মটি কতই না চমৎকার। মূলত হযরত উমর রা. এই বাক্য দ্বারা দুটি সংশয়ের জবাব দিয়েছেন।
১. হযরত উমর রা. এক ইমামের পিছনে জামাতের সাথে পুরা রমযান তারাবীহর নামায চালু করলেন। ইতোপূর্বে কেউ জামাতের প্রতি এমন গুরুত্ব প্রদান করেন নি। তাহলে এ নতুন নিয়মটি বিদআত হচ্ছে কি না?
২. এ নামাযটি রাতের প্রথম অংশেই শেষ হয়ে যায় এটা হয়তো তাহাজ্জুদের নামায।
আর তাহাজ্জুদই যদি হয় তাহলে তার সময় তো রাতের শেষাংশে অথচ প্রথমাংশে
পড়া হচ্ছে এ নিয়মটি বিদআত নয় তো ?
এসব নিয়ে কিছু গুঞ্জন সৃষ্টি হয়েছিল। হযরত উমর রা. উপরোক্ত বাক্য দ্বারা উভয় সংশয়ের জবাব এ ভাবে দিলেন যে, যদি কেউ মনে করে জামাতে এক ইমামের সাথে তারাবীহর নিয়ম চালু করা বিদআত। হ্যাঁ আমি এটি জেনে শুনেই করেছি কারণ, এটি নতুন নিয়ম হলেও রাসূল স. এর শিক্ষাই তার ভিত্তি বা আসল। আর তা হচ্ছে, ২/৩ দিন যাই হোক রাসূল স. সকলকে নিয়ে তারাবীহর জামাত করেছেন। যদিও ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তার ধারাবাহিকতা রাখেন নি। এখন ওহীর পথ খোলা নেই, আসবেনা নতুন কোনো শরীয়ত। তাই যে আশঙ্কা রাসূল স. এর জীবনে বিদ্ব্যমান ছিল তা এখন আর নেই। এ কারণে এটা আভিধানিক অর্থে বিদআত তথা নতুন কাজ হতে পারে; কিন্তু শরয়ী পারিভাষিক অর্থে বিদআত নয় বরং খুবই ভাল ও চমৎকার কাজ। (نِعْمَ البِدْعَةُ هَذِه) তেমনিভাবে যারা বলছেন তাহাজ্জুদকে সময়ের পূর্বে রাতের প্রথমাংশে পড়ার নতুন নিয়ম চালু হয়েছে যা রাসূলের যুগে ছিল না। তাদের সংশয়ের জবাবে উমর রা. বলেন- وَالَّتِي يَنَامُونَ عَنْهَا أَفْضَلُ مِنَ الَّتِي يَقُومُونَ অর্থাৎ তাহাজ্জুদকে প্রথমাংশে আনা হয়নি। কেননা, এটা তাহাজ্জুদ নয় এটা (قيام الليل) তারাবীহ। শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়তে হবে যা (صلوة الليل). সালাতুল লাইল। এদুটি ভিন্ন ভিন্ন নামায এক নয়। তাই আপনারা এখন জামাতের সাথে যে নামায পড়ছেন তার থেকে অধিক ফযীলতপূর্ণ ঐ নামায যা আদায় না করে শেষরাতে অনেকে সাহরী খেয়ে ঘুমিয়ে যান। বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় উমর রা. এর বক্তব্যে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে তারাবীহ আর তাহাজ্জুদ এক নয় স¤পূর্ণ ভিন্ন নামায। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আব্দিল বার র. মুয়াত্তা মালেকের সু-খ্যাত ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আল-তামহীদে’ উল্লেখ করেন যে, উমর রা. এখানে নতুন কিছুই করেন নি বরং তিনি তা-ই করেছেন যা স্বয়ং রাসূল স. পছন্দ করতেন। রাসূল স. উম্মতের উপর তারাবীহ ফরয হওয়ার আশঙ্কায় অধিক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও জামাতে ধারাবাহিকভাবে করতে পারেন নি। সে পছন্দের কাজটি উমর রা. করেছেন (কেননা রাসূল স. এর ওফাতের পর আর ঐ আশঙ্কা বিদ্যমান নেই) দ্র: খ:৮/পৃ:১০৮
হাফেজ ইবনে আব্দিল বার র. উপরোক্ত ঘটনা (উমর প্রথমে এগার (১১) রাকাত চালু করেছিলেন পরে বিশ রাকাত চালু করলেন এবং কেরাত সংক্ষিপ্ত করতে বললেন) এর সমর্থনে বলেন:
قال ابن عبد الله روي مالك في هذا الحديث احدي وعشرين وهو صحيح ولا اعلم احدا قال فيه احدي عشرة الا مالكا ويحتمل أن يكون ذلك اولا ثم خفف عنه طول القيام ونقلهم الي احدي وعشرين.
তারাবীহ একুশ (২১) রাকাতের কথাই সহীহ ও সঠিক। কারণ এগার রাকাতের কথা ইমাম মালেক ছাড়া অন্য কেউ বলেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে এ সম্ভাবনা রয়েছে যে, প্রথমে এগার (১১) রাকাত চালু করেছিলেন (খুব দীর্ঘ কেরাতের সাথে) পরে দীর্ঘ কেরাত সংক্ষেপ করে এগার (১১) রাকাতকে বিশ (২০) রাকাতে পরিণত করা হয়েছে। (ফাতহুল মূলহিম:২/৩০)
অবশেষে হযরত উমর রা. এর বিশ (২০) রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহর জামাত চালু করার নির্দেশের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা র. এর মন্তব্য-
وَرَوَى أَسَدُ بْنُ عَمْرٍو عَنْ أَبِي يُوسُفَ قَالَ: سَأَلْتُ أَبَا حَنِيفَةَ عَنِ التَّرَاوِيحِ وَمَا فَعَلَهُ عُمَرُ؟ فَقَالَ: التَّرَاوِيحُ سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ وَلَمْ يَتَخَرَّصْهُ عُمَرُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ مُبْتَدِعًا، وَلَمْ يَأْمُرْ بِهِ إِلَّا عَنْ أَصْلٍ لَدَيْهِ وَعَهْدٍ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، وَلَقَدْ سَنَّ عُمَرُ هَذَا وَجَمَعَ النَّاسَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّاهَا جَمَاعَةً وَالصَّحَابَةُ مُتَوَافِرُونَ (الاختيار للموصلي: ১/৭৪، باب صلاة التراويح)
ইমাম আবু ইউসুফ বলেন- আমি ইমাম আবু হানীফা র. কে তারাবীহ এবং উমর রা. এর নিয়ম চালুর নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং উমর রা. তা নিজের পক্ষ থেকে অনুমান করে নির্ধারণ করেন নি। নতুন কিছু আবিষ্কারও করেননি; বরং তার কাছে এর দলিল ছিল এবং রাসূল স. থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনার ভিত্তিতেই এ আদেশ দিয়েছেন। (আল ইখতিয়ার: খ:১ পৃ:৭৪)
সার কথা: হযরত উমর রা. যে নতুন কাজের সূচনা করছিলেন তথা জামাতের ইহতিমাম করা, বিশ রাকাত পড়তে বলা, রাতের প্রথমাংশে তারাবীহ শেষ করা, সবগুলো রাসূলের হাদীস ও তার নির্দেশনার ভিত্তিতেই করেছেন।
খলীফা উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত
প্রথম হাদীস :
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: ” كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً ” (السنن الكبري للبيهقي: ২/৮৯৬، رقم: ৪২৮৮)
অর্থাৎ: সায়েব বিন্ ইয়াযীদ রা. বলেন, হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এর আমলে সাহাবায়ে কেরাম রা. রমযান মাসে বিশ রাকাত (তারাবীহ) পড়তেন। (বায়হাকী, সুনানে কুবরা: খ:২ পৃ:৮৯৬)
পর্যালোচনা: এ হাদীসটিতে ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা নামে একজন রাবী রয়েছেন। ইমাম বায়হাকী থেকে রাবী ইয়াযীদ বিন খুসায়ফা পর্যন্ত দুটি সনদে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। এক সনদে হাদীসটি সুনানে কুবরায় উল্লেখ করেছেন যা আমরা উপরে উল্লেখ করেছি। অপর সনদটি তিনি আসসুনানুল কুবরাসহ আল-মা’রিফা গ্রন্থেও উল্লেখ করেছেন। যার ইবারত-
عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: ্রكُنَّا نَقُومُ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرِগ্ধ (معرفة السنن: ৫৪০৯)
সুনানে কুবরার উপরোক্ত সনদের হাদীসটিকে যারা সহীহ বলেছেন তারা হচ্ছেন ইমাম নববী র., আল্লামা ইরাকী র., হাফেজ আইনী র., হাফেজ জালাল সুয়ুতী র. এবং আল্লামা নিমাভী র. প্রমুখ। আর অপর সনদ তথা আল-মা’রিফা গ্রন্থের হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন- তাজুদ্দীন সুবকী র. এবং মোল্লা আলী আল-কারী র. প্রমুখ। সুতরাং হাদীসটি তার উভয় সনদের দিক দিয়ে বিশিষ্ট হাদীস বিশারদদের দৃষ্টিতে সহীহ এবং নির্ভরযোগ্য।
সহীহ হাদীস কে লা-মাযহাবীদের যয়ীফ বলার চক্রান্ত
লা-মাযহাবীরা মিযানুল ই’তেদাল ও তাহযিবুত তাহযীব গ্রন্থের বরাতে ভিত্তিহীন ভাবে মনগড়া মন্তব্য করে হাদীসটিকে যয়ীফ বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তারা বলেন যে, উক্ত হাদীসের সনদে ১নং রাবী (আবু উসমান বাসরী) ২নং রাবী (খালিদ বিন মাখলাদ) এবং ৩নং রাবী (ইয়াযীদ বিন খুসায়ফা) অস্বীকৃত, যয়ীফ ও প্রত্যাখ্যাত।
অথচ এদের মধ্যে খালেদ ও ইয়াযীদ দুজনই বুখারী ও মুসলিমের রাবী। তাদের বর্ণনা প্রত্যাখ্যাত হলে বুখারী মুসলিমে তাদের রেওয়ায়েতগুলো আসল কীভাবে ? তাহলে বুখারী ও মুসলিমের এ হাদীসগুলো কি প্রত্যাখ্যাত ? তদুপরী তারা যে দুটি কিতাবের বরাতে এদের সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন কিতাবগুলো খুলে দেখুন উক্ত রাবীর ব্যাপারে এধরণের কোনো সমালোচনা এসব কিতাবে পাওয়া যাবে না। এটাই লা-মাযহাবীদের আসল চেহারা। মনমতো না হলে বুখারীর হাদীসকেও যয়ীফ বা প্রত্যাখ্যাত বলতে দ্বিধা করেনা।
১. খালিদ বিন মাখলাদ র. সম্পর্কে বিশিষ্ট মুহাদ্দিস উসমান বিন আবী শাইবা র. সালেহ বিন মুহাম্মদ র. ইবনে হিব্বান র. ইবনে শাহীন র.সহ অনেকে বলেছেন তিনি বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য। ইবনে মঈন বলেছেন তার ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। আবু দাউদ এবং ইবনে হাজার বলেছেন তিনি সত্যবাদী। ইবনে আদী বলেছেন তার মধ্যে কোন রকম সমস্যা নেই, ইমাম বুখারী তার সরাসরি ছাত্র।
হ্যাঁ, শুধু ইমাম আহমদ একটি ব্যতিক্রম মন্তব্য করেছেন যে, (له مناكير) তার কিছু কিছু বর্ণনা আপত্তিকর।
উল্লেখ্য, ইমাম আহমদের মন্তব্যে তার বর্ণনা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়বেনা। কারণ তিনি ইমাম বুখারীর উস্তাদ। বুখারী মুসলিমে তার হাদীস রয়েছে। তা ছাড়া হাদীসের বিজ্ঞ মণিষীগণ তার প্রশংসা করেছেন এদের মোকাবেলায় ইমাম আহমদ র. এর মন্তব্য ধর্তব্য নয়।
উপরন্তু তার কিছু বর্ণনা ইমাম আহমদের কথা অনুসারে আপত্তিকর হলেও আমাদের আলোচ্য হাদীসটি তার আওতাভূক্ত নয়।
কারণ, এ হাদীসটি বিভিন্ন সনদে তিনি ছাড়া আরো অনেক বিশ্বস্ত রাবীদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।
২. ইয়াযীদ ইবনে খুসায়ফা র. এর ব্যাপারে হাদীস বিশারদদের মন্তব্য নিম্নরূপ:
ইমাম আবু হাতিম আবরাজী র. ইমাম নাসায়ী র. ও ইমাম ইবনে সা’দ র. তাকে ‘সিকাহ’ নির্ভরযোগ্য বলেছেন। ইমাম ইবনে মাঈন র. বলেছেন (ثقة حجة) অর্থাৎ তিনি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ও দলিলযোগ্য। ইমাম আহমদ র. থেকে তার সম্পর্কে দু ধরণের মন্তব্য পাওয়া যায়। এক, তিনি ‘সিকাহ’ নির্ভরযোগ্য। দুই. তিনি ‘মুনকারুল হাদীস’ অর্থাৎ তার কিছু হাদীস আপত্তিকর। এটা বাক্যটির অনুবাদ; কিন্তু ইমাম আহমদের পরিভাষায় এর অর্থ হচ্ছে তিনি কোন হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে একক ও নিঃসঙ্গ। (দ্র: মুকাদ্দামায়ে ফাতহুল বারী)
৩. আবু উসমান র. তার নাম আমর ইবনে আব্দুল্লাহ। তিনি বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আবু তাহির ও হাসান ইবনে আলী র. এর উস্তাদ। তারা বহু হাদীস তার থেকে গ্রহণ করেছেন। তার ব্যাপারে (متروك) প্রত্যাখ্যাত বা যয়ীফ বলে কোন মুহাদ্দিস মন্তব্য করেনি। লা-মাযহাবী বন্ধুরা তার ব্যাপারে যা বলেছেন সবই মনগড়া। এধরণের বহু রাবীর হাদীস বুখারীতেও আনা হয়েছে তাছাড়া আমাদের আলোচ্য হাদীসটি আবু উসমান ব্যতিত অন্যান্য নির্ভরযোগ্য রাবীদের সনদেও বর্ণিত হয়েছে। এ ছিল লা-মাযহাবীদের চক্রান্তের উপর সামান্য পর্যালোচনা।
সারকাথা: হযরত উমর রা. যে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ার নিয়ম চালু করেছিলেন এবং সাহাবায়ে কিরাম যে ওই যুগে বিশ রাকাত তারবীহ পড়তেন এনিয়ে সায়েব বিন ইয়াযীদ র. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সকল মুহাদ্দিসের দৃষ্টিতে সহীহ এবং অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। তাই এ হাদীস ও তার সমর্থনে বর্ণিত অন্যান্য হাদীসের ভিত্তিতে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমানিত হলো যে উমর রা. এর যুগেই আনসার ও মুহাজির সকল সাহাবা মসজিদে নববীতে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এতে তাদের কেউ আপত্তি করেন নি। আম্মা আয়েশা রা. এর হুজরা মোবারকের সামনেই বিশ রাকাতের আমল যুগ যুগ ধরে চালু ছিল তিনি ও কোন আপত্তি করেন নি। কেননা তিনি জানতেন যে, বুখারীতে বর্ণিত “এগার (১১) রাকাতের বেশী পড়েন নি” মর্মে যে, হাদীস তিনি বর্ণনা করেছেন তা তাহাজ্জুদ সম্পকীয়। তারাবীহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। একেই সাহাবীগণের ইজমা বা সম্মিলিত কর্মধারা বলা হয়।
২নং হাদীস তাবেঈনদের বর্ণনা
ক. হযরত ইয়াযীদ ইবনে রূমান র. এর হাদীস-
عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ؛ أَنَّهُ قَالَ: كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَانِ (১) عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، فِي رَمَضَانَ، بِثَلاَثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً (موطأ لامام مالك: رقم: ৩৮০)
উমর রা. এর যুগে মানুষ (সাহাবা ও তাবেঈন) রমযানে তেইশ রাকাত (তারাবীহ ২০ রাকাতা বিতর ৩ রাকাত) পড়তেন। (মুয়াত্তা মালেক ৪০ নং ৩৮০, আসসুনানুল কুবরা বায়হাকী: ২/৪৯৬)
খ. তাবেয়ী হযরত ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-আনসারী র. এর হাদীস :
عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، ্রأَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّي بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَةًগ্ধ (مصنف ابن ابي شيبة:২/২৮৫،رقم: ৭৬৮২)
হযরত উমর রা. এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিলেন যে, তিনি যেন লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত (তারাবীহ) আদায় করেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা:খ:২/পৃ:২৮৫)
গ. তাবেয়ী হযরত আব্দুল আযীয ইবনে রুবাই র. এর হাদীস:
عَنْ عَبْدِ الْعَزِيزِ بْنِ رُفَيْعٍ قَالَ: ্রكَانَ أُبَيُّ بْنُ كَعْبٍ يُصَلِّي بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ بِالْمَدِينَةِ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَيُوتِرُ بِثَلَاثٍগ্ধ (مصنف ابن ابي شيبة: ২/২৮৫،رقم: ৭৭৬৬)
হযরত উমর রা. কর্তৃক নিয়োজিত ইমাম উবাই বিন কা’ব রা. সম্পর্কে ইবনে কা’ব র. বলেন যে, তিনি রমযানে মদীনা শরীফে লোকদেরকে(সাহাবা ও তাবেঈন) নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (দ্র: মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : খ:২/ পৃ:২৮৫/ হা:৭৭৬৬)
ঘ. তাবেয়ী মুহাম্মদ বিন কা‘ব আল কুরাযী র. এর হাদীস :
্রكَانَ النَّاسُ يُصَلُّونَ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً يُطِيلُونَ فِيهَا الْقِرَاءَةَ وَيُوتِرُونَ بِثَلَاثٍগ্ধ (قيام الليل للمروزي: ৯১)
মুহাম্মদ ইবনে কা‘ব আল কুরাযী র. বলেন, হযরত উমর এর যুগে রমযানে লোকেরা (সাহাবা ও তাবেয়ী) বিশ রাকাত পড়তেন। তাতে তারা দীর্ঘ কেরাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (কিয়ামূল লায়ল: পৃ:৯১)
এ হলো তাবেঈন কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের আলোকে হযরত উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহর প্রমাণ।
এ ধরণের আরো বহু হাদীস পাওয়া যায়। যেগুলোর সারমর্ম এক ও অভিন্ন। তাই এগুলোর মূল বক্তব্য সহীহ ও মুতাওয়াতিরের পর্যায়ের। সুতরাং হযরত উমর রা.-এর যুগ থেকে সাহাবা ও তাবেয়ীর ধারাবাহিক আমল যে বিশ রাকাত তারাবীহর উপর ছিলো তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। যাতে কোনো দ্বিধা দ্বন্দের অবকাশ নেই।
খলীফায়ে রাশেদ: হযরত উমর রা.-এর সুন্নাতের ব্যাপারে লা-মাযহাবীদের দ্বিমুখী বক্তব্য
লা-মাযহাবীরা এ ব্যাপারে স্ববিরোধী কথা বলে থাকেন। যেমন: এক সময় বলেন যে, বিশ রাকাত তারাবীহ হযরত উমর রা. থেকে প্রমাণিত নয়। এ ব্যাপারে যেসব হাদীস উপরে পেশ করা হলো এগুলো ‘যয়ীফ’ তথা আমল অযোগ্য। আবার কখনো বলেন, এটা হযরত উমরের কর্ম ও আমল যার পিছনে উমর রা.-এর অনুমোদন ছিলো না। আবার বলেন যে, হযরত উমর নিজেই উবাই ইবনে কা‘বকে এগার রাকাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন ইত্যাদি।
আমরা বলতে চাই, মেনে নিলাম তিনি এগার রাকাতের নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবার বলুনতো তার আদেশ লঙ্ঘন করে কারা বিশ রাকাত তারাবীহর নির্দেশ চালু করেছিলেন ? যার কারণে সাহাবা তাবেয়ী সকলেই যুগ যুগ ধরে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ে আসছেন। আর হযরত উমর রা.-এর আমলের ভিত্তি যদি রাসূলের কোনো সমর্থনই না থেকে থাকে তাহলে বলুনতো (عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين) অর্থাৎ তোমরা আমার সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত শক্ত হাতে আকঁড়ে ধরো। এ হাদীসের উদ্দেশ্য কী ? দেখুন, আল্লামা ইবনুল হুমাম কী চমৎকার কথা বলেছেন:
وَكَوْنُهَا عِشْرِينَ سُنَّةُ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ وَقَوْلُهُ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – ্রعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَগ্ধ نَدْبٌ إلَى سُنَّتِهِمْ. (فتح القدير: ১/৪৮৬)
বিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। আর রাসূলের বাণী “তোমরা আমার সুন্নাত ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরো” দ্বারা তাদের সুন্নাতের প্রতি গুরুত্বারোপ ও উৎসাহিত করা হয়েছে। (দ্র: ফাতহুল কাদীর ১/৪৮৬)
থেকে যায় তাবেয়ীন কর্তৃক উপরোল্লিখিত বর্ণনা বা হাদীসগুলো ‘যয়ীফ’ তথা মান্য করার অযোগ্য হওয়ার বিষয়টি।
তাবেয়ীনদের বর্ণনাগুলো ‘যয়ীফ’ বা অগ্রহণযোগ্য নয় কেন ?
উপরে ক. থেকে ঘ. পর্যন্ত যে কয়টি তাবেয়ীদের বর্ণনা পেশ করা হয়েছে এদের অনেকেই হযরত উমর রা.-এর যুগ পাননি। আবার কার থেকে বর্ণনা করলেন তাও তারা বলেননি। এসব কারণে হাদীসগুলো মুনকাতি (منقطع) বা মুরসাল (مرسل) তথা সূত্র বিচ্ছিন্ন বলা হয়। কিন্তু এ ধরণের তাবেয়ীর উস্তাদ পর্যায়ে যেহেতু কোনো দুর্বল বর্ণনাকারী ছিলো না বললেই চলে তাই তাদের মুরসাল হাদীসগুলো গ্রহণযোগ্য। তদুপরি হাদীসটি একাধিক তাবেয়ী থেকে বর্ণিত এবং একটি সহীহ হাদীসও এ বক্তব্যের সমর্থনে বিদ্যমান। তাই এগুলো অগ্রহণযোগ্য বলা হাদীস শাস্ত্রের বিধান লঙ্ঘন। তা ছাড়া মূল হাদীস তো সাহাবী ‘সায়েব ইবনে ইয়াযীদ’ কর্তৃক বর্ণিত। আর এগুলো ওই হাদীসের সমর্থক বা অতিরিক্ত সাক্ষী হিসেবে গণ্য। উপরন্তু তাবেয়ীদের এসব বর্ণনাগুলোর সমর্থনে (تعامل امت) তথা “উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন সম্মিলিত কর্মধারা” বিদ্যমান থাকায় এগুলো প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য। হাদীস শাস্ত্রের নীতিমালা অনুযায়ী এ ধরণের মুনকাতি বা মুরসাল হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপর কারো কোনো দ্বিমত নেই। এগুলোকে লা-মাযহাবীরা যয়ীফ বলে আখ্যা দেয়া তাদের মারাত্মক অজ্ঞতার বহি:প্রকাশ ও হাদীসের ব্যাপারে জালিয়াতি। তাছাড়া এসব হাদীসকে কোনো মুহাদ্দিস যয়ীফ বলেননি।
দেখুন- এব্যাপারে লা-মাযহাবীদেরই মান্যবর শীর্ষ আলেম শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. কী বলেছেন-
قال ابن التيمية: المرسل الذي ما يوافقه أو الذي عمل به السلف حجة باتفاق الفقهاء. (مجموع الفتاوي، منهاج السنة)
তিনি বলেন, যে মুরসালের (সূত্রবিচ্ছিন্ন) অনুকূলে অন্য কোনো প্রমাণ পাওযা যায় কিংবা পূর্বসূরীগণ যার অনুসরণ করে থাকেন। তাহলে তা ফকীহগণের সর্বসম্মতিক্রমে দলিল হিসেবে গৃহীত হবে। (মাজমূউল ফতোয়া খ.২৩ পৃ. ২৭১ মিনহাজুস সুন্নাহ খ.৪/১১৭)
‘মাজমুউল ফতোয়া’ গ্রন্থে তিনি উমর রা.-এর যুগে মসজিদে নববীতে যে বিশ রাকাত তারাবীহ হতো এ সম্পর্কে বলেন-
فَإِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنَّ أبي بْنَ كَعْبٍ كَانَ يَقُومُ بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً فِي قِيَامِ رَمَضَانَ وَيُوتِرُ بِثَلَاثِ. فَرَأَى كَثِيرٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ أَنَّ ذَلِكَ هُوَ السُّنَّةُ؛لِأَنَّهُ أَقَامَهُ بَيْن الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَلَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ.(مجموع الفتاوي: ২৩/১১২-১৩)
এ বিষয়টি প্রমাণিত যে, উবাই বিন কা‘ব রা. (যিনি উমরের নিযুক্ত ইমাম ছিলেন) রমযানে তারাবীহতে মুসল্লিদের নিয়ে বিশ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। তাই অসংখ্য আলেমের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এটাই সুন্নাত। কেননা, তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই তা আদায় করেছিলেন অথচ কেউ তাতে আপত্তি করেনি। (দ্র: মাজমাউল ফতোয়া Ñ ২৩/১১২-১১৩)
ইবনে তাইমিয়া আরো বলেন-
قال ابن التيمية: ثبت من سنة الخلفاء الراشدين وعمل المسلمين. (مجموع الفتاوي)
অর্থাৎ (বিশ রাকাত তারাবীহ ) খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং মুসলিম জাতির সম্মিলিত কর্মধারায় এটি প্রমাণিত। (দ্র. খ.২৩/১১৩)
হযরত আবুল আলিয়া র. থেকে বর্ণিত-
عَنْ أَبِي الْعَالِيَةِ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ أَنَّ عُمَرَ أَمَرَ أُبَيًّا أَنْ يُصَلِّيَ بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ فَقَالَ إِنَّ النَّاسَ يَصُومُونَ النَّهَار وَلَا يحسنون أَن (يقرؤا) فَلَوْ قَرَأْتَ الْقُرْآنَ عَلَيْهِمْ بِاللَّيْلِ فَقَالَ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ هَذَا (شَيْءٌ) لَمْ يَكُنْ فَقَالَ قَدْ عَلِمْتُ وَلَكِنَّهُ أَحْسَنُ فَصَلَّى بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَة (إِسْنَاده حسن) (مسند احمد بن منيع، المختارة لضياء المقدسي)
হযরত উমর রা. উবাই রা.কে রমযানে লোকদের নিয়ে নামায পড়তে আদেশ দিলেন এবং এ কথা বললেন যে, লোকরা দিনভর রোযা রাখে তারপর সুন্দরভাবে কুরআন পড়তে পারে না। তাই আপনি যদি রাতে তাদেরকে নিয়ে কুরআন পড়তেন। তিনি তখন বললেন, আমি জানি যে এটা অনেক ভালো কাজ। এরপর উবাই রা. লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়লেন। (দ্র. আল মুখতারা ১১৬১)
হাদিসটির মান: ‘হাসান’ এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে যে, জামাতে পড়ার ক্ষেত্রে তিনি আপত্তি করলেও কিন্তু বিশ রাকাতের ব্যাপারে কোনো আপত্তি উবাই রা. করেননি। অথচ বিশ রাকাতের বিষয়টি শরীয়তের বিষয়। যা কেউ নিজ থেকে নির্ধারণ করতে পারে না। বুঝা গেলো, হযরত উমর রা. কর্তৃক বিশ রাকাত তারাবীহ রাসূলের পরোক্ষ নির্দেশেই হয়েছে এবং বিশ রাকাত যে মসজিদে নববীর ইমাম উবাই পড়তেন তাও সর্বস্বীকৃত। এ হাদীস দ্বারা তাবেয়ীদের উপরোক্ত হাদীসগুলোর জোরালো সমর্থন পাওয়া গেলো। আর উমর রা.-এর যুগে যে বিশ রাকাত তারাবীহর নিয়ম চালু হয়েছিলো তাতে স্বয়ং উবাইও আপত্তি করেননি।
এসব দলিল প্রমাণ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেলো যে, বিশ রাকাত বিশিষ্ট তারাবীহ হযরত উমর রা-এর যুগে পড়া হতো। সাহাবাগণ ও তাবেয়ীগণ সকলেই পড়েছেন। একথা কিছু লা-মাযহাবি ছাড়া সারা পৃথিবীর সকল আলেম ও ফকীহ মুহাদ্দিস এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।
হযরত উসমান রা. এর যুগ
১৪ হিজরি থেকে উমর রা. এর শাহাদাত বরণ পর্যন্ত দশ বছর উসমানের রা. উপস্থিতিতেই তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া হয়েছে। তিনি তারাবীহর রাকাত সংখ্যা নিয়ে আপত্তি করেন নি। যা তার সম্মতির লক্ষণ। তাছাড়া তিনি যদি তার
খেলাফতকালে নতুন নির্দেশ জারি করতেন তাহলে তা অবশ্যই ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত থাকতো।
হযরত আলী রা. এর যুগ
হযরত আলী রা. বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং লোকদেরকেও বিশ রাকাত পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দুটি বর্ণনা দ্বারা তা প্রমাণিত হয়।
ক.
عن أبي عبد الرحمن السلمي عن على رضي الله عنه قال : دعا القراء في رمضان فأمر منهم رجلا يصلي بالناس عشرين ركعة قال وكان علي رضي الله عنه يوتر بهم
অর্থ: আবু আব্দুর রহমান সুলামী র. হযরত আলী রা. সম্পর্কে বলেন, তিনি রমযানে হাফেজদেরকে ডাকলেন এবং তাদের একজনকে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহর নামায পড়ার নির্দেশ দিলেন। আলী রা. নিজে তাদেরকে নিয়ে বিতর পড়তেন। (বায়হাকী: ২/৪৯৬)
খ.
عن أبي الحسناء : أن عليا أمر رجلا يصلي بهم في رمضان عشرين ركعة.
আবুল হাসনা বলেন, আলী রা. একজনকে নির্দেশ দিয়েছেন রমযানে তাদেরকে নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহর নামায পড়তে। (ইবনে আবী শাইবা: ৫/২২৩-নং৭৭৬৩)
এসমস্ত হাদীস দ্বারা খুলাফায়ে রাশেদীন থেকে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া প্রমাণিত হয়। আর তাদের আমল আমাদের জন্য অনুসরণীয়। কারণ রাসূল স. ইরশাদ করেছেন-
عليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين. عضوا عليها بالنواجذ. وإياكم والأمور المحدثات. فان كل بدعة ضلالة
অর্থাৎ, তোমাদের জন্য আমার সুন্নাত ও হেদায়াতপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ জরুরি। তোমরা তা পরিপূর্ণভাবে আঁকড়ে ধরো। (ইবনে মাজা: পৃ:৫, আবু দাউদ)
এ হাদীসে রাসূল স. ও সাহাবাদের আদর্শকে গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে যারা তা গ্রহণ করবেনা তাদেরকে বিদআতী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হযরত আলী রা. এর যুগে বিশ রাকাত তারাবীহর উপরোক্ত দুটি হাদীস যথাত্রমে আব্দুর রহমান আস সুলামী র. ও আবুল হাসনা র. এর বর্ণনাকে লা-মাযহাবী বন্ধুরা ‘যয়ীফ’ অগ্রহণযোগ্য বলেছেন।
মূলকথা: আবু আব্দুর রহমান সুলামীর হাদীসটি ইমাম বায়হাকী র. অন্য একটি হাদীসকে সমর্থন ও শক্তিশালী করার জন্য এনেছেন। এতে প্রমাণ বহণ করে যে, বায়হাকীর নিকট হাদীসটি সহীহ। নচেৎ অন্য হাদীসকে শক্তিশালী করবে কিভাবে? তাছাড়া আস সুলামীর হাদীসকে ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. মিনহাজুস সুন্নাহ গ্রন্থে এবং ইমাম যাহাবী র. আল মুনতাকাহ গ্রন্থে দলিলস্বরূপ পেশ করে প্রমাণ করেছেন যে, হযরত আলী রা. তারাবীহর জামাত এবং রাকাত সংখ্যার বিষয় হযরত উমর রা. এর নীতিই অনুকরণ করেছিলেন। এতে আবার প্রমাণিত হলো যে, হাদীসটি ইবনে তাইমিয়া ও আল্লামা হাফেজ যাহাবীর দৃষ্টিতেও সহীহ, আমলযোগ্য।
আর আবুল হাসনা র. এর হাদীসটি মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবায় উদ্ধৃত। এ হাদীস সম্পর্কে আলবানী ও মুবারকপুরী র. এর বরাতে লা-মাযহাবীরা বহু কটুক্তি করে থাকেন। তারা বলেন আবুল হাসনা মাজহুল ও মাতরুক (পরিত্যক্ত)। তাই এ হাদীসটি প্রত্যাখ্যাত। অনুসন্ধানে দেখা গেছে ‘আবুল হাসনা’ নামক দুই জন রাবী ছিলেন।
একজন হলেন, হযরত আলী রা. এর সরাসরি ছাত্র এবং আমর ইবনে কাইস ও আবু সা’দ আল বাক্কালের উস্তাদ। তিনি ইবনে হাজারের মত মুহাদ্দিসদের শ্রেণী নির্ণয় অনুপাতে তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীর মুহাদ্দিস। পক্ষান্তরে অপর ‘আবুল হাসনা’ হলেন, আলী রা. এর ছাত্রের ছাত্র। হাকিম বিন উতায়বার শাগরেদ এবং শরীফ নাখায়ী নামক ব্যক্তির উস্তাদ। সুতরাং এটা প্রমাণিত যে উভয় আবুল হাসনা এক ব্যক্তি নন;বরং ভিন্ন ব্যক্তি। আলোচ্য হাদীসে যে আবুল হাসনা রয়েছেন তিনি (সিকাহ রাবী) গ্রহণযোগ্য ও আলী রা. এর ছাত্র। তার ব্যাপারে ইবনে হাজারসহ কেউ মাজহুল (অজ্ঞাত) মাতরুক (পরিত্যক্ত) বলেননি এবং তার বর্ণনাকৃত হাদীসকেও কেউ প্রত্যাখ্যাত বলেননি। এগুলো সবই লা-মাযহাবীদের অজ্ঞতা বা জালিয়াতির বহি:প্রকাশ। হ্যাঁ, আবুল হাসনার হাদীসকে অধিকন্তু মাসতুর (مستور) বলা যেতে পারে। কারণ যদিও তার শিষ্যদের মধ্যে একাধিক বর্ণনাকারী রয়েছে কেউ কিন্তু তার ব্যাপারে সূ-খ্যাতি বর্ণনা করেনি। আর মাসতুর রাবীর বর্ণনা হাদীস শাস্ত্রের মূলনীতি অনুসারে অধিকাংশ মুহাদ্দিসদের নিকট নি:শর্তে গ্রহণযোগ্য। কেউ কেউ একটি শর্ত জুড়িয়ে দিয়েছেন যে, উক্ত হাদীসের সমর্থনে অন্য হাদীস বর্ণিত থাকা চাই। আলোচ্য আবুল হাসানা র. এর হাদীস উভয় মতানুসারে গ্রহণযোগ্য।
কারণ এ বর্ণনার সমর্থনে আবু আব্দুর রহমান আস সুলামীর হাদীস বিদ্যমান।
উপরন্তু হযরত আলী রা. যে বিশ রাকাত তারাবীহর শিক্ষা/নির্দেশ দিয়েছেন তার আরো প্রমাণ হচ্ছে, হযরত আলী রা. এর বিশিষ্ট শাগরেদ শুতাইর ইবনে শাকল র. আব্দুর রহমান বিন আবু বকর র. সাঈদ বিন আবুল হাসানা র. সুয়াইদ ইবনে গাফালাহ র. এবং আলী ইবনে রাবীয়া র. প্রমুখ সকলেই বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন এবং পড়াতেন।
সারকথা- বিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত। হযরত ওমর রা. ও হযরত আলী রা. এর যুগে তাদের আদেশক্রমে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া হতো। হযরত উসমান রা. হযরত উমর রা. এর যুগে বিশ রাকাত পড়েছেন ও সমর্থন দিয়েছেন। আর নিজের খেলাফতকালেও তার ব্যতিক্রম করেননি। হযরত আবু বকর রা. থেকে বিশ রাকাতের বিরুদ্ধে কোন বর্ণনা পাওয়া যায়নি। যদিও সঠিক কত রাকাত পড়া হতো তার স্পষ্ট বর্ণনাও মিলে না।
শরীয়তের যে কোন বিষয় কোন এক খলীফার সুন্নাত হিসেবে প্রমাণিত হলে তা সকল উম্মতের জন্য নবী সা. এর হাদীসের আলোকেই অনুসরণীয় ও অনুকরনীয় সাব্যস্ত হয় এবং এর বিরোধীতা করা গুনাহ। বিশ রাকাত তারাবীহ তিন খলীফার সুন্নাত প্রমাণিত হওয়ায় এটা কেমন গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত সাব্যস্ত হলো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। অতিরিক্ত বিশ রাকাতের বিষয়টি রাসূল সা. এর মারফু হাদীস দ্বারাও সমর্থিত। এর পরও যদি কেউ তা প্রত্যাখ্যান করে ভিত্তিহীন দলিল দ্বারা ৮ রাকাতকেই সুন্নাত বললে নি:সন্দেহে তা হবে নব আবি®কৃত বিদআত। যা সকল যুগের উম্মাহর জন্য গ্রহণ করা নিষিদ্ধ।
৩য় দলিল : ইজমায়ে সাহাবা
মুহাজির আনসারসহ সকল সাহাবায়ে কিরামের ইজমা
সাহাবায়ে কিরামকে কুরআনুল কারীম হেদায়েতপ্রাপ্ত এবং অনুসরণযোগ্য সাব্যস্ত করেছে এবং মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের অনুসরণের আদেশ দিয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা সাহাবাদের পথকে “সাবীলুল মু’মিনীন” আখ্যা দিয়ে তাদের অনুকরণকে জান্নাতি হওয়ার মানদণ্ড সাব্যস্ত করেছেন। এ ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অধ্যায় আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করেছি। এখানে মাত্র একটি আয়াত পেশ করছি-
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন –
وَمَنْ يُشَاقِقِ الرَّسُولَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ الْهُدَى وَيَتَّبِعْ غَيْرَ سَبِيلِ الْمُؤْمِنِينَ نُوَلِّهِ مَا تَوَلَّى وَنُصْلِهِ جَهَنَّمَ وَسَاءَتْ مَصِيرًا (১১৫)
যে কেউ রাসূল সা.-এর বিরুদ্ধাচরণ করে তার কাছে হেদায়েতের পথ প্রকাশিত হওয়ার পর এবং সকল মু’মিনের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে চলে, আমি তাকে ওই দিকেই ফিরিয়ে দেব। আর সে যে দিকটি অবলম্বন করবে তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থল। (সুরা নিসা ১১৫)
এ আয়াতে মু’মিনের অনুসৃত পথ বলতে সাহাবায়ে কিরামের পথ বুঝানো হয়েছে।
অন্যদিকে রাসুল সা. উম্মতকে জান্নাতী ও নাজাতপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য সাহাবাদেরকে মাপকাঠি এবং মানদণ্ড সাব্যস্ত করে বলেন,ماانا عليه واصحابى “আমার ও আমার সাহাবাদের আদর্শ অনুকরণকারী দলই হচ্ছে নাজাতপ্রাপ্ত দল। সুতরাং সাহাবাদের জামাত সত্যের মাপকাঠি, নাজাতপ্রাপ্ত জামাত। তাদের আদর্শ ও কর্মধারাই উম্মতের জন্য পালনীয় ও অনুসরণীয়।
অন্যদিকে ইসলামী শরীয়া যে চারটি মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত (কুরআন হাদীস ইজমা ও কিয়াস) তার তৃতীয়টি হচ্ছে ইজমা। শরীয়তে এ ইজমার যথেষ্ঠ গুরুত্ব রয়েছে। ইসলামের বেশ কিছু বিধান এই ইজমার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন, আবু বকর রা. নবীর প্রথম খলীফা সাব্যস্ত হওয়ার বিধান, তিন তালাক দিলে তিন তালাকই পতিত হওয়ার বিধান, জুমআর দুই আযানের বিধান ইত্যাদি। ইজমার অনেকগুলো প্রকার রয়েছে তার মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো মুহাজির, আনসার সাহাবাসহ অন্যান্য সাহাবাগণের ইজমা। সুতরাং ইজমা যদি ব্যাপকভাবে অবিচ্ছিন্ন ও সম্মিলিতরূপে উম্মাহর নিকট পৌঁছে তবে তা শরীয়তে অকাট্য দলিল হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এ দলিল বিদ্যমান থাকলে ঐ বিষয়ে অন্য কোনো দলীলের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ ইসলামী শরীয়া ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে। তাই ইজমা দ্বারা যে বিধান প্রমাণিত তা স্পষ্ট হাদীস না পাওয়া গেলেও বিধানটিকে অমান্য করার কোন সুযোগ বাকী থাকেনা। আমাদের আলোচ্য বিশ রাকাত তারাবীহর বিষয়টিও ইজমায়ে সাহাবা ও আনসার-মুহাজির দ্বারা প্রমানিত।
মসজিদে নববীতে প্রায় ১৪ হিজরী থেকে উমর রা. এর নির্দেশে উবাই বিন কা‘বের ইমামতিতে বিশ রাকাত তারাবীহ জামাতে পড়ার নিয়ম চালু হলো। ওই জামাতে শীর্ষস্থানীয় সাহাবায়ে কিরাম, আনসার ও মুহাজিরগণ রা. মুক্তাদী হয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন। এরা সকলেই নবী সা. এর অবর্তমানে পুরা উম্মতকে কুরআন, হাদীস, ও শরীয়া শিক্ষা দিতেন। যারা মদীনার বাহিরে মক্কা, কুফা, বসরা ইত্যাদিতে অবস্থান করছিলেন। সকলেই মদীনার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে খলীফায়ে রাশেদের কর্ম ও সিদ্ধান্ত অনুকরণ করেই চলতেন।
মদীনাসহ বিশ্বের যত শহরে ওই যুগে রাসূল স. এর সাহাবাদের পবিত্র জামাত ছিলো সকলেই তারাবীহ বিশ রাকাতই পড়েছেন। একজন সাহাবী সম্পর্কে কেউ দেখাতে পারবেনা যে বিশ রাকাত তারাবীহ নিয়ে কোন আপত্তি তুলেছিলেন। এটাই ইজমায়ে সাহাবা, ইজমায়ে আনসার ও মুহাজির। তার কিছু প্রমাণ এখানে তুলে ধরছি :
ক. বিখ্যাত তাবেয়ী ইমাম আতা ইবনে আবী রাবাহ মক্কী র. বলেন-
عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: ্রأَدْرَكْتُ النَّاسَ وَهُمْ يُصَلُّونَ ثَلَاثًا وَعِشْرِينَ رَكْعَةً بِالْوِتْرِগ্ধ(مصنف ابن ابي شيبة: ৭৬৮৮)
আমি লোকদেরকে (সাহাবী ও তাবেয়ী) দেখেছি তারা বিতরসহ তেইশ রাকাত (তারাবীহ) পড়তেন। ( মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা : খ:২, পৃ:২৮৫)
সুতরাং এটা ইজমায়ে সাহাবা।
খ. ইমাম আব্দুল বার র. ‘ইসতিযকার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-
وَهُوَ الصَّحِيحُ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ (مِنْ غَيْرِ خِلَافٍ مِنَ الصَّحَابَةِ (الاستذكار: ৫/১৫৭)
এটিই (বিশ রাকাত তারাবীহ) উবাই ইবনে কা‘ব রা. থেকে বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত এবং এতে সাহাবীগণের কোন ভিন্নমত নেই। (ইসতিযকার: ৫/১৫৭)
এখানে কারো কোন ভিন্ন মত নেই এর অর্থ হচ্ছে সবাই একমত ছিলেন। এটাই ইজমায়ে সাহাবা।
গ. ইমাম আবু বকর কাসানী র. বলেন-
وَالصَّحِيحُ قَوْلُ الْعَامَّةِ لِمَا رُوِيَ أَنَّ عُمَرَ – رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ – جَمَعَ أَصْحَابَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فِي شَهْرِ رَمَضَانَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّى بِهِمْ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَلَمْ يُنْكِرْ أَحَدٌ عَلَيْهِ فَيَكُونُ إجْمَاعًا مِنْهُمْ عَلَى ذَلِكَ.(بدائع الصنائع: ১/৬৪৪)
অধিকাংশ ওলামায়ে কিরাম যা বলেছেন তা-ই সঠিক। (অর্থাৎ তারাবীহ বিশ রাকাত) কারণ হযরত উমর রা. রমযান মাসে সাহাবায়ে কিরাম রা.কে উবাই বিন কা‘ব রা. এর ইমামতিতে একত্র করেন এবং উবাই বিন কা‘ব রা. তাদের নিয়ে প্রতি রাতে বিশ রাকাত (তারাবীহ) পড়তেন এবং তাদের একজনও এ ব্যাপারে কোন আপত্তি তুলেননি। সুতরাং এ ব্যাপারে (বিশ রাকাতের ব্যাপারে) তাদের (সাহাবাগণ) সকলের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয় (দ্র: বাদায়েউস সানায়ে খ:১,পৃ:৬৪৪)
ঘ. ইমাম ইবনে কুদামা মাকদেসী হাম্বলী র. বলেন-
لَوْ ثَبَتَ أَنَّ أَهْلَ الْمَدِينَةِ كُلَّهُمْ فَعَلُوهُ لَكَانَ مَا فَعَلَهُ عُمَرُ، وَأَجْمَعَ عَلَيْهِ الصَّحَابَةُ فِي عَصْرِهِ، أَوْلَى بِالِاتِّبَاع. (المغني لابن قدامة: ২/৬০৪)
উমর রা. যা করেছেন (জামাতের সাথে বিশ রাকাত তারাবীহ) এবং তার খেলাফত কালে অন্যান্য সাহাবীগণ যে ব্যাপারে একমত হয়েছেন তাই অনুসরণের সর্বাধিক উপযুক্ত। (আলমুগনী :২/৬০৪)
ঙ. লা-মাযহাবীদের মান্যবর শীর্ষ আলেম শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. ইজমার কথাটি ভিন্ন ভাষায় এভাবে বলেন-
إِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنَّ أبي بْنَ كَعْبٍ كَانَ يَقُومُ بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً فِي قِيَامِ رَمَضَانَ وَيُوتِرُ بِثَلَاثِ. فَرَأَى كَثِيرٌ مِنْ الْعُلَمَاءِ أَنَّ ذَلِكَ هُوَ السُّنَّةُ؛ لِأَنَّهُ أَقَامَهُ بَيْن الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَلَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ.(مجموع الفتاوي: ২৩/১১২-১৩)
অর্থাৎ এটা প্রমাণিত যে উবাই বিন কা‘ব রা. রমযানে তারাবীহতে লোকদের নিয়ে বিশ রাকাতই পড়তেন। তাই অধিকাংশ আলেম এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, এটাই (বিশ রাকাত) সুন্নাত। কেননা উবাই বিন কা‘ব রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই বিশ রাকাত পড়িয়েছেন এবং কেউ তাতে আপত্তি উত্থাপন করেননি। (দ্র: মাজমুউল ফাতাওয়া: খ: ২৩,পৃ:১১২-১১৩)
সারকথা : সাহাবায়ে কিরামের পবিত্র যুগে তারাবীহ বিশ রাকাতের বিষয়টি সকলের ঐক্যমতেই সুপ্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কোন সাহাবীর এ ব্যাপারে দ্বিমত ছিলনা। কেউ এর উপর আপত্তিও তোলেনি। তাহলে এটাই নাজাতপ্রাপ্ত জামাতের মত-পথ। কুরআনের ভাষায় এটাই সাবিলুল মু‘মিনীন (سبيل المؤمنين) তথা মুমিনগণের মত। এরা কেউ বিশ রাকাতকে নাজায়েযও বলতেন না বিদআতও আখ্যা দিতেন না। কুরআন-সুন্নাহ বিরোধীও বলতেন না। এগুলো নাজাতপ্রাপ্ত জামাতের পরিচয়। আজ যারা ২০ রাকাত তারাবীহকে বিদআত বলছে, সুন্নাতের খেলাফ বলে প্রচার করছে তারা মুমিনগণের পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে।
আর সূরা নিসার ১১৫ নং আয়াতের বরাতে পূর্বে উল্লেখ করেছি যে, মুমিনগণের অনুসৃত পথের বিরুদ্ধে যারা চলবে তারা জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে। আর তা নিকৃষ্টতর গন্তব্যস্থান। আল্লাহ সকলকে হেদায়াত দান ও হিফাজত করুন। আমীন।
৪র্থ দলিল : মারফুয়ে হুকমী
‘মারফুয়ে হুকমী’ বলা হয়- সাহাবাদের এমন কথা বা কাজকে, যাতে ইজতিহাদ ও কিয়াসের সুযোগ নেই। উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহের মূলনীতি অনুযায়ী ‘মারফুয়ে হুকমী’ মারফু হাদীস (নবীজীর কথা ও কাজ)-এরই একটি প্রকার। কারণ এটা তো স্পষ্ট যে, যেসব বিষয়ে যুক্তি ও ইজতিহাদ চলে না ঐ সব ক্ষেত্রে সাহাবারা রাসূল সা. থেকে না শুনে কোনো কাজ করতেন না। (মুকাদ্দামাতুশ শায়খ : পৃ: ১, মুকাদ্দামা ইবনে সালাহ : পৃ.৭৬-৭৭)
ইতোপূর্বে বিশ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত, মুহাজির-আনসারসহ অন্যান্য সাহবীদের ইজমা উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো তো স্বতন্ত্র দলিল। পাশাপাশি মারফুয়ে হুকমীও আরেক দলিল। কারণ নামাযের রাকাত সংখ্যা কিয়াস দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। সাহাবা ও তাবেঈনরা যুগ যুগ ধরে বিশ রাকাত পড়েছেন। তারা নিশ্চয়ই ২০ রাকাত তারাবীহকে রাসূলের সা. আদর্শ হিসাবে জানতেন। তাই তারা এর উপরই আমল করেছেন।
এ বিষয়টি ইমাম আবু হানীফা র.-এর কথায চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে-
روى أسد بن عمرو عن أبي يوسف قال سألت أبا حنيفة عن التراويح وما فعله عمر رضي الله عنه فقال : التراويح سنة مؤكدة ولم يتخرصه عمر من تلقاء نفسه ولم يكن فيه مبتدعا ولم يأمر به إلا عن أصل لديه وعهد من رسول الله صلى الله عليه و سلم ،ولقد سن عمر هذا وجمع الناس علي ابي بن كعب فصلاها جماعة والصحابة متوافرون منهم عثمان وعلي وابن مسعود والعباس وابنه وطلحة والزبير ومعاذ وابي وعيرهم من المهاجرين والانصار ومارد عليه واحد منهم بل ساعدوه ووافقوه وامروا بذلك.
“আবু ইউসুফ র. বলেন, আমি আবু হানীফা র.কে তারাবীহ ও এব্যাপারে উমরের রা. কর্ম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। উমর রা. অনুমান করে নিজের পক্ষ থেকে এটা নির্ধারণ করেননি। এক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছুও উদ্ভাবন করেননি। তিনি তাঁর নিকট বিদ্যমান ও রাসূল স. থেকে প্রাপ্ত কোনো নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই আদেশ দিয়েছেন। তাছাড়া উমর রা. যখন উবাই বিন কা‘বের রা. ইমামতিতে লোকদেরকে জমা করে এই প্রথা চালু করলেন, তখন বিপুল পরিমাণ সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন। তাদের মধ্যে হযরত উসমান, আলী, ইবনে মাসউদ, আব্বাস, ইবনে আব্বাস, তালহা, যুবাইর, মুআয ও উবাই রা. প্রমুখ মুহাজির ও আনসার সাহাবা ছিলেন। তাদের কেউই এর উপর আপত্তি করেননি। বরং সকলেই তাকে সমর্থন করেছেন, তার সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন এবং অন্যদেরও এই আদেশ দিয়েছেন।” (আল ইখতিয়ার লি তা‘লীলিল মুখতার : ১/৯৪)
৫ম দলিল : সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা
সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা তথা তাআমুলে উম্মত
শরীয়তের একটি মৌলিক দলিল হচ্ছে- (تعامل امت) তথা মুসলিম উম্মার ব্যাপক ও অবিচ্ছিন্ন সম্মিলিত কর্মধারা। এটাকে সুন্নাতে মুতাওয়ারাসাও বলে। এটি হাদীস ও সুন্নাহর একটি উন্নত প্রকার। যার গ্রহণযোগ্যতা মৌখিক বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত হাদীস থেকেও অনেক শক্তিশালী । এ প্রসঙ্গে খতীব বাগদাদী র. الفقيه والمتفقه কিতাবে باب القول فيما يرد به الخبر الواحد অনুচ্ছেদে মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত তাব্বা মালেকীর কথা উদ্ধৃত করেন। তিনি বলেন যে,
كل حديث جائت عن النبي (ص) لم يبلغك احدا من اصحابه فعله فدعه. ০ج১/১৩২)
অর্থাৎ- তোমার নিকট নবীজীর কোনো সহীহ হাদীস পৌঁছলেও যদি তার উপর সাহাবীদের কাউকে আমল করতে না দেখ তাহলে তা ছেড়ে দাও। (১/১৩২)
* ইমাম যাহাবী র. হাদীস সহীহ সূত্রে বর্ণিত হলেও তা আমলযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে এক নীতির পর্যালোচনায় বলেন-
لَكِنْ بِشَرْطِ أَنْ يَكُونَ قَدْ قَالَ بِذَلِكَ الحَدِيْثِ إِمَامٌ مِنْ نُظَرَاءِ الإِمَامَيْنِ مِثْلُ مَالِكٍ، أَوْ سُفْيَانَ، ……….و أَمَّا مَنْ أَخَذَ بِحَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَقَدْ تنكَّبَهُ سَائِرُ أَئِمَّةِ الاِجتهَادِ، فَلاَ. (سير اعلام النبلاء: ১৬/৪০৪)
মর্মার্থ : হাদীসকে সহীহ পেলেও আমল করার জন্য মালেক ও সুফিয়ান র. এর মতো মুজতাহিদ ইমামগণ তা গ্রহণ করেন কিনা তা দেখতে হবে। যে ব্যক্তি হাদীস সহীহ পাওয়া মাত্র গ্রহণ করেন অথচ ইমামে মুজতাহিদগণের কেউ তা গ্রহণ করলো না তা মানা সঠিক হলো না। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ১৬/৪০৪)
* ইমাম আওযায়ী র. বলেন-
كنا نسمع الحديث فنعرضه علي اصحابنا كما يعرض الدرهم الزائف فما عرفوا منه اخذناه وما انكروا تركناه. (المحدث الفاضل للمروزي: ৩১৮)
মর্মার্থ : আমরা হাদীস শুনতাম অত:পর তা মুজতাহিদ ইমামগণের নিকট পেশ করতাম। যেমনিভাবে খাইটযুক্ত দিরহাম যাচাই করা হয়। তারা যদি তা মানার যোগ্য বলতেন তাহলে তা মেনে নিতাম। অন্যথায় তার উপর আমল করা থেকে বিরত থাকতাম। (আল মুহাদ্দিসুল ফাযিল পৃ:৩১৮)
* ইমাম মালেক র. কাজী মুহাম্মাদ বিন হাযম কর্তৃক আদালতের ফয়সালা বাহ্যিকভাবে সহীহ হাদীস এর বিপরীত হলে তার ব্যাখ্যার ব্যাপারে মন্তব্য করেন:
ما اجمع عليه العلماء المدينة يريد بأن العمل بها اقوي من الحديث. (الاثر الحديث الشريف للعوام: ص৯২)
মর্মার্থ : মদীনার ওলামায়ে কিরাম যার উপর ঐক্যবদ্ধ তা সহীহ হাদীসের উপর আমল করা থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। (আছরুল হাদীস আশশরীফ পৃ৯২)
* ইমাম ইবনে আবী যাইদ কাইরাওয়ানী র. আহলে সুন্নাত ওয়াল হকের আলামতস্বরূপ বলেন-
والتسليم للسنن لاتعارض برأي ولا تدافع بقياس وما تأوله منها السلف الصالح تأولناه وما عملوا به عملناه وما تركوه تركناه. (كتاب الجامع: ص১১৭)
অর্থাৎ সুন্নাত হাদীসকে মানতে হবে। কোনো রায় বা কিয়াস দ্বারা হাদীস অমান্য করা যাবে না। সালাফে সালেহীন হাদীসের যে ব্যাখ্যা প্রদান করেন সে ব্যাখ্যা অনুপাতেই আমল করবো। তারা যেভাবে আমল করেছেন আমরাও তার উপর আমল করবো। আর তারা যেটাকে আমলের ব্যাপারে বিরত রয়েছেন তার উপর আমরা আমল করবো না। (আল জামে ১১৭)
উপরোক্ত কয়েকজন বিজ্ঞ মুহাদ্দিস ও ফকীহগণের মন্তব্য পেশ করলাম যার সারমর্ম হচ্ছে, সাহাবা, তাবেয়ী এবং আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের ধারাবাহিক আমল যা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারারূপে প্রমাণিত তা কোনো সহীহ হাদীসের বিপরীত মনে হলেও গ্রহণযোগ্য। কারণ হাদীসটির মর্ম উদ্ঘাটনে তারাই সর্বাধিক অভিজ্ঞ (وهو اعلم الناس بمعاني الحديث) কেননা এ সম্মিলিত নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রমাণিত ও বিদ্যমান কর্মধারা যাকে সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা বলে তা খবরে ওয়াহিদ (الخبر
الواحد) থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী।
আমাদের আলোচ্য বিষয় “বিশ রাকাত তারাবীহ”র ব্যাপারে ইতি মধ্যে উল্লেখ করেছি যে, এর ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরাম মুহাজির আনসারসহ সকলের আমলী ঐক্যমত রয়েছে। খুলাফায়ে রাশেদীনের (তিন খলীফা) ঐক্যবদ্ধ কর্মধারা বা আমল, বিভিন্ন শহরের ফকীহ ও আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা দ্বারা প্রমাণিত। তাই এটা যে সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা ও তাআমুলে উম্মত তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। মূলত বিশ রাকাত তারাবীহর ক্ষেত্রে এটাই মৌলিক দলিল যা সকল উম্মতের জন্য পালনীয়। এর বিপরীত কোনো সহীহ হাদীস নেই। যে কয়েকটি হাদীস পেশ করা হয় এগুলো অত্যন্ত দুর্বল (যা পরে আলোচনা করা হবে)। এমতাবস্থায় এমন শক্তিশালী দলিলকে উপেক্ষা করে আট রাকাত পড়াকে সুন্নাত আর ততোধিক পড়াকে নাজায়েয বা বিদআত বলার কোনো সুযোগ নেই। বরং এটা হবে নবীর সকল ঐক্যবদ্ধ উম্মাহর বিরুদ্ধাচরণ যা মারাত্মক গোমরাহী বৈ কী।
তারাবীর বিশ রাকাত যে, তাআমুলে উম্মত বা সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত তার যথেষ্ঠ প্রমাণ ইতোপূর্বে দেয়া হয়েছে।এখানে কয়েকটি প্রমাণ পেশ করছি:
* সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাকারক ইমাম নববী র. লিখেন-
الْأَفْضَلُ صَلَاتُهَا جَمَاعَةً كَمَا فَعَلَهُ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ وَالصَّحَابَةُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَاسْتَمَرَّ عَمَلُ الْمُسْلِمِينَ عَلَيْهِ لِأَنَّهُ مِنَ الشَّعَائِرِ الظَّاهِرَةِ. (شرح النووي علي مسلم: ৬/৩৯،رقم: ৭৫৯)
উত্তম হচ্ছে তারাবীহ জামাতের সাথেই আদায় করা। যেমনটি উমর রা. ও সাহাবায়ে কিরাম করেছিলেন (এবং তা বিশ রাকাতই ছিলো) আর মুসলিম উম্মার সর্ব যুগের আমল ও কর্মধারা এরূপই ছিলো। (শরহে মুসলিম- ৬/৩৯)
তিনি আরো লিখেন-
اعلم أن صلاة التراويح سُنّة باتفاق العلماء، وهي عشرون ركعة، يُسَلِّم من كل ركعتين. (الاذكار: ص৮৩)
তারাবীহর নামায সুন্নাত হওয়ার বিষয়ে সকল উলামা একমত। এ নামায বিশ রাকাত। যার প্রতি দু’রাকাতেই সালাম ফেরাতে হয়। (শরহুল মুসলিম, আল আযকার পৃ.৮৩)
ক. মক্কাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل مكة
* ইমাম শাফেয়ী র. মক্কাবাসীর আমল বা তাআমুল সম্পর্কে বলেন:
وَأَحَبُّ إلَيَّ عِشْرُونَ؛ لِأَنَّهُ رُوِيَ عَنْ عُمَرَ وَكَذَلِكَ يَقُومُونَ بِمَكَّةَ وَيُوتِرُونَ بِثَلَاثٍ.(الأم للشافعي: ص১৪২)
তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া আমার নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয়। কারণ উমর রা. থেকে এরূপই বর্ণিত হয়েছে। মক্কাবাসীও তারাবীর নামায এভাবেই (বিশ রাকাত) আদায় করতেন। আর তারা বিতর নামায তিন রাকাত পড়ে থাকেন। (কিতাবুল উম্ম লিশ শাফেয়ী)
ইমাম তিরমিযী র. সকল মুজতাহিদ ইমামগণের মতামত ব্যক্ত করার পর ইমাম শাফেয়ী কর্তৃক মক্কাবাসীর আমল এভাবে তুলে ধরেন-
وَأَكْثَرُ أَهْلِ العِلْمِ عَلَى مَا رُوِيَ عَنْ عُمَرَ، وَعَلِيٍّ، وَغَيْرِهِمَا مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَهُوَ قَوْلُ الثَّوْرِيِّ، وَابْنِ المُبَارَكِ، وَالشَّافِعِيِّ ” وقَالَ الشَّافِعِيُّ: ্রوَهَكَذَا أَدْرَكْتُ بِبَلَدِنَا بِمَكَّةَ يُصَلُّونَ عِشْرِينَ رَكْعَةًগ্ধ (سنن الترمذي: ১/১৬৬)
অধিকাংশ আহলে ইলম ওই মতই পোষণ করেন যা উমর রা. আলী রা. এবং অন্যান্য সাহাবীদের থেকে বর্ণিত হয়েছে তথা তারাবীহ বিশ রাকাত ৩৬ রাকাত নয়। যেমন ইমাম মালেক পড়তেন। সুফিয়ান সাওরী, আব্দুল্লাহ বিন মুবারক ও ইমাম শাফেয়ীর মতও তাই। ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, আমি মক্কাবাসীকে মক্কা শরীফে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তে দেখেছি। (জামে তিরমিযী ১/১১৬)
মক্কার অধিবাসী বিশিষ্ট তাবেয়ী আতা বিন আবি রাবাহ র. বলেন-
– حَدَّثَنَا ابْنُ نُمَيْرٍ، عَنْ عَبْدِ الْمَلِكِ، عَنْ عَطَاءٍ، قَالَ: ্রأَدْرَكْتُ النَّاسَ وَهُمْ يُصَلُّونَ ثَلَاثًا وَعِشْرِينَ رَكْعَةً بِالْوِتْرِগ্ধ (مصنف ابن ابي شيبة: رقم: ৭৬৮৮)
আমি লোকদের (মক্কাবাসী) বিতরসহ তেইশ রাকাত পড়তে দেখেছি। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা : ৭৬৮৮)
মক্কার কাযী ও মুয়ায্যিন ইবনে আবী মুলাইকাহ র. সম্পর্কে হযরত নাফে বিন উমর র. বলেন-
كان ابن ابي مليكة يصلي بنا في رمضان عشرين ركعة. (اثار السنن : ص২৯২)
তিনি আমাদের নিয়ে রমযানে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। (আসারুস সুনান পৃ.২৯২)
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, মক্কাবাসীর তাআমুল تعامل اهل مكة বিশ রাকাত । আর এটাই সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা।
খ. মদীনাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل مدينة
চৌদ্দশ’ বছরের ইতিহাস অনুসন্ধানে দেখা যায়, মদীনাবাসীও সর্বদা তারাবীহর নামায বিশ রাকাতই পড়েছেন; বর্তমানেও তাই। তবে কিছু উদ্যমী মানুষ মক্কাবাসীকে বিশ রাকাতের পাশাপাশি চারটি তাওয়াফ ও তাওয়াফ পরবর্তী আট রাকাত নামায আদায় করতে দেখে চার তাওয়াফের পরিবর্তে আট রাকাত এবং তাওয়াফের আট রাকাত এর বিনিময় আরো আট রাকাত মোট ষোল রাকাত বৃদ্ধি করে সর্বমোট ৩৬ রাকাত তারাবীহ পড়া আরম্ভ করেন। অত:পর তিন রাকাত বিতর পড়তেন। এতে ৩৯ রাকাত হয়ে যেতো। তবে এদেরও মূল তারাবীহ হতো বিশ রাকাত। অতিরিক্ত ১৬ রাকাত মুস্তাহাব বা ফযীলত অর্জন তথা মক্কাবাসীর সমান সওয়াব পাওয়ার লক্ষেই পড়া হতো । এ ব্যাপারে ইমাম সুয়ূতী র.-এর বিশ্লেষণ নিম্নরূপ-
وَذَكَرَ السُّيُوطِيُّ فِي رِسَالَتِهِ أَنَّهُ يُسْتَحَبُّ لِأَهْلِ الْمَدِينَةِ سِتًّا وَثَلَاثِينَ رَكْعَةً تَشْبِيهًا بِأَهْلِ مَكَّةَ، حَيْثُ كَانُوا يَطُوفُونَ بَيْنَ كُلِّ تَرْوِيحَتَيْنِ طَوَافًا وَيُصَلُّونَ رَكْعَتَيْهِ، وَلَا يَطُوفُونَ بَعْدَ الْخَامِسَةِ، فَأَرَادَ أَهْلُ الْمَدِينَةِ مُسَاوَاتَهُمْ، فَجَعَلُوا مَكَانَ كُلِّ طَوَافٍ أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ، وَلَوْ ثَبَتَ عَدَدُهَا بِالنَّصِّ لَمْ تَجُزْ الزِّيَادَةُ عَلَيْهِ، وَلَأَهْلُ الْمَدِينَةِ وَالصَّدْرُ الْأَوَّلُ كَانُوا أَوْرَعَ مِنْ ذَلِكَ.(مرقاة المفاتيح: ৩/১৯৩، باب قيام شهر رمضان)
অর্থাৎ মক্কাবাসী তারাবীহর প্রতি চার রাকাত পর (বিশ্রামের সময়) তাওয়াফ করে নিতেন এবং দুই রাকাত নামাযও পড়তেন। তবে শেষ বৈঠকে এমনটি করতেন না। মদীনাবাসী এটা দেখে তাদের সামঞ্জস্যতার লক্ষে প্রতি তারবীহর পরিবর্তে (তাওয়াফ ও নামাযসহ) চার রাকাত নফল পড়তেন। এভাবে ৪দ্ধ৪=১৬ রাকাত বৃদ্ধি হয়ে যায়।
কিন্তু সৌদি আরবের প্রসিদ্ধ আলেম মসজিদে নববীর সুখ্যাত মুদাররিস ও শরীয়া আদালতের কাযী (আমার সরাসরি উস্তাদ) শায়খ আতিয়্যাহ সালিম ‘মসজিদে নববীর হাজার বছরের তারাবীহর ইতিহাস’ নামক আরবীতে তার লেখা একটি কিতাবে প্রমাণ করেছেন যে, বিশ রাকাত তারাবীহই ছিলো মসজিদে নববীর ধারাবহিক তাআমুল।
তিনি তার কিতাব (التراويح اكثرمن الف عام) এ স্ববিস্তারে তা পেশ করেছেন।
প্রথম শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
উপরোক্ত আলোচনায় সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন অনুচ্ছেদে দেখেছেন যে হযরত উমর রা. এর যুগ থেকে শুরু করে খিলাফতে রাশেদার পূর্ণ যুগ এবং তারপরও সাহাবাদের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত তারাবীহ বিশ রাকাতই পড়া হতো।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
শায়খ আতিয়্যাহ বলেন,
مضت المائة الثانية والتراويح ست وثلاثون وثلاث وتر ودخلت السنة الثالثة وكانت المظنون أن فظل علي ماهي عليه تسع وثلاثون بما فيه الوتر. (التراويح اكثر من الف عام: ص৪১)
দ্বিতীয় শতাব্দিতে তারাবীহ ছত্রিশ রাকাত পড়া হতো এবং বিতর পড়া হতো তিন রাকাত। তৃতীয় শতাব্দীতেও তদরূপ বিতরসহ উনচল্লিশ রাকাতই পড়া হতো।
চতুর্থ ,পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে মসজিদে তারাবীহ
তিনি লিখেন,
عادت التراويح في تلك الفطرة كلها الي عشرين ركعة فقط بدلا من ست وثلاثني في السابق. ص৪২
এই তিন শতাব্দীতে ছত্রিশ এর পরিবর্তে পূনরায় বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া আরম্ভ হয়।
অষ্টম, নবম, দশম, ও একাদশ শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
তিনি লিখেন,
فكان يصلي التراويح أول الليل بعشرين ركعة على المعتاد. ثم يقوم آخر الليل في المسجد بست عشرة ركعة. (ص৪৭)
প্রথম রাতে যথারীতি তারাবীহর নামায বিশ রাকাতই পড়া হতো। তবে শেষ রাতে ষোল রাকাত নামাজ মসজিদেই পড়া হতো।
দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও অনুরূপ ছিলো (আত তারাবীহ পৃ.৪৭)
চতুর্দশ শতাব্দীতে মসজিদে নববীর তারাবীহ
তিনি লিখেন:
دخل القرن الرابع عشر والتراويح في المسجد النبوي على ما هي عليه من قبل وظلت إلى قرابة منتصفه.(ص৫৮)
চৌদ্দতম শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত মসজিদে নববীতে তারাবীহর নামায পূর্বের মতোই অব্যাহত ছিলো। (বিশ রাকাত প্রথম রাতে শেষ রাতে ষোল রাকাত)
এ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের ব্যাপারে তিনি লিখেন :
ثم جاء العهد السعودي فتوحدت فيه الجماعة في المسجد النبوي وفي المسجد الحرام للصلوات الخمس وللتراويح. أما عدد الركعات وكيفية الصلاة فكانت عشرين ركعة بعد العشاء وثلاثا وترا، وذلك طيلة الشهر……… وعليه فتكون التراويح قد استقرت على عشرين ركعة على ما عليه العمل في جميع البلاد وعليه المذاهب الثلاثة. (التراويح اكثر من الف عام: ص৬৫)
অর্থাৎ এ সময় সৌদি শাসনামলের সূচনা হয় এবং মক্কা মদীনার পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও তারাবীহর ব্যবস্থাপনা অধিক সুসংহত করা হয়। এ সময় পুরো রমযানে এশার পর বিশ রাকাত তারাবীহ ও তিন রাকাত বিতর পড়া হতো। এতে প্রতীয়মান হয়, বিশ রাকাত তারাবীহ-ই ছিলো মসজিদে নববীর সর্বযুগের আমল। মদীনা ছাড়া অন্যান্য ভূখণ্ডেও এ নিয়ম জারী ছিলো। (আত তারাবীহ আকসার মিন আলফে আম পৃ.৬৫)
(অধম লিখক) বলছে, ১৯৮৩ সাল তথা চতুর্দশ হিজরীর শেষ দিকে আমি ইমাম মোহাম্মদ বিন সাউদ ভার্সিটিতে অধ্যায়নকালে বিতর সম্পর্কে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করি। বিশ রাকাত তারাবীহর পর বিতর পড়া হতো। আবার শেষ রাতে ১০রাকাত পড়া হতো এবং এরপর পুনরায় বিতর পড়া হতো তিন রাকাত। সর্বমোট তের রাকাত। বিতর একাধিকবার পড়ার ওপর কিছু আলেম আপত্তি করলে প্রথমে ইমাম পরিবর্তন করা হয়। যিনি প্রথম রাতে বিতর পড়াতেন তিনি শেষ রাতে পড়াতেন না। অবশেষে যা বর্তমান সময়েও জারি আছে তা হলো- এশার পর বিশ রাকাত তারাবীহ পড়িয়ে বিতর পড়া থেকে বিরত থাকতেন এবং শেষ রাতে ১০রাকাতের পর তিন রাকাত বিতির পড়াতেন। মক্কা ও মদীনাতে একই নিয়ম এখনো চালু রয়েছে।
গ. কুফাবাসীর তাআমুল- تعامل اهل كوفة
কুফাবাসীর আমলও মক্কা মদীনাবাসী সাহাবা ও তাবেয়ীগণের আমল থেকে ব্যতিক্রম ছিলো না। কুফা ছিলো হযরত আলী রা.-এর রাজধানী। তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ার নির্দেশ দিয়ে তারাবীহর নিয়ম চালু করার কথা পূর্বেই আলোচনা হয়েছে। আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা.ও কুফাতেই বসবাস করতেন,হাদীস ও ফিকহের দরস দিতেন। তিনিও বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতেন (দ্র. কিয়ামুল লাইল পৃ.৯১)
আরো যেসব প্রসিদ্ধ তাবেয়ী কুফাতে ছিলেন এবং বিশ রাকাত তারাবীহ পড়িয়েছেন তাদের মধ্যে আসওয়াদ ইবনে ইয়াযীদ র. সুয়াইদ ইবনে গাফালাহ র. আলী ইবনে রাবীআ র. সাঈদ ইবনে যুবাইর র. সুফিয়ান ছাওরী র. ইমাম আবু হানীফা র. প্রমুখ ছিলেন অন্যতম।
ঘ. বসরাবাসীর তাআমুল
সাহাবা ও তাবেয়ীর যুগে ইরাকের বসরা নগরী ইলম ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে খুবই অগ্রগামী ছিলো। বহু সাহাবা ও তাবেয়ী এ শহর আবাদ করেছিলেন। হাদীসের দরসের পাশাপাশি ফিকহের দরসও অবিরাম চালু ছিলো। মুহাদ্দিস ও ফুকাহায়ে তাবেয়ীর সকলেই বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এর কমে পড়ার কোনো প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় না। এ শহরের বিশিষ্ট তাবেয়ী যারা বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আব্দুর রহমান বিন আবু বকর র. সাঈদ বিন আবুল হাসান র. ইরান আবদী র. যুরারা ইবনে আবু আওফা র. প্রমুখ।
ঙ. বাগদাদবাসীর তাআমুল
বাগদাদ শহরে জন্ম নিয়েছেন ইসলামের যুগশ্রেষ্ঠ মনিষীগণ। তাদের ইমাম আহমদ বিন হাম্বল র. প্রথম সারির ফকীহ ছিলেন। যিনি হাম্বলী মাযহাবের ইমাম। তিনি বিশ রাকাত তারাবীহ আদায় করতেন, এটাই তার মাযহাব ছিলো। দেখুন এই মাযহাবের কিতাবসমূহ।
এরপর যাহেরী মাযহাবের ইমাম দাউদ যাহেরী র. ও বাগদাদের অধিবাসী। তিনিও তারাবীহ বিশ রাকাতের পক্ষে ছিলেন।
আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক র. তিনিও বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। ইসহাক বিন রাহ্ওয়াই র. তিনিতো ৪১রাকাত পর্যন্ত পড়তেন। (দ্র. কিয়ামুল লাইল পৃ.৯২)
পরিশিষ্ট
একটি প্রশ্ন ও তার খণ্ডন
সুন্নাতে মুতাওয়ারাসা বা তাআমুলে সাহাবা ও তাবেয়ীন এবং আয়িম্মায়ে মুজতাহিদীন সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনায় প্রমাণিত হলো যে, বিশ রাকাত তারাবীহ সারা বিশ্বে সাহাবাযুগ থেকে সর্বকালের উলামা ও উম্মতের এক অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক আমল। এটি সাধারণ সহীহ হাদীস থেকেও অনেক বেশী শক্তিশালী।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- হাদীস থেকেও বেশী শক্তিশালী হয় কীভাবে ?
এর সংক্ষিপ্ত জবাব-
এ ধরণের ব্যাপক সম্মিলিত কর্মধারার পেছনে মূলত রাসূল সা.-এর শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা অবশ্যই বিদ্যমান যা অনেকের হয়তো জানার বাইরে। কেননা নবী স.-এর সকল সাহাবা, তাবেয়ী নবীর স্পষ্ট সহীহ হাদীস ও শিক্ষার বিপরীতে তার অন্য কোনো নির্দেশনা ছাড়া মন মতো শরীয়তের বিষয়ে আমলী সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন তা কল্পনাতীত।
দেখুন, আমাদের আলোচ্য বিষয়টিতে যদি তারাবীহর নামায আট রাকাত এ ব্যাপারে রাসূল সা.-এর থেকে সুস্পষ্ট সহীহ হাদীস বিদ্যমান থাকতো, এর বিপরীতে বিশ রাকাতের ব্যাপারে নবীজীর কোনো দিকনির্দেশনা না থাকতো, তাহলে হযরত উমরের যুগ থেকে নিয়ে সর্বকালের সাহাবা তাবেয়ী ও আইম্মায়ে মুজতাহিদ এমনিতে বিশ রাকাত তারাবীহর উপর একমত হয়ে তা আমলীভাবে গ্রহণ করে শরীয়তের বিধানটি চালু করে নিয়েছেন এ কথা কোনো বিবেকহীন বিশ্বাস করতে পারে না।
বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করার জন্য হযরত উবাই বিন কা‘বের বর্ণনাটি পড়ে দেখুন- (যা পূর্বেও পেশ করা হয়েছে)
عن أبي بن كعب أن عمر بن الخطاب أمره أن يصلي بالليل في رمضان فقال: إن الناس يصومون النهار ولا يحسنون أن يقرأوا فلو قرأت عليهم بالليل، فقال: يا أمير المؤمنين هذا شيء لم يكن، فقال: قد علمت ولكنه حسن فصلى بهم عشرين ركعة.(كنز العمال: ৮/৪০৯،رقم: ২৩৪৭০)
অর্থাৎ হযরত উমর রা. উবাই বিন কা‘বকে রমযানে লোকদের নিয়ে নামায পড়ার আদেশ দিতে গিয়ে বলেন, তারা দিনে রোযা রাখে কিন্তু রাতের বেলায় সুন্দরভাবে কোরআন পড়তে পারে না। আপনি যদি তাদের নিয়ে কুরআন পড়েন (অর্থাৎ জামাতে নামায আদায় করতেন) উত্তরে উবাই বলেন, আমীরুল মুমিনীন এ বিষয়টি (জামাতে তারাবীহ) আগে করা হতো না। উত্তরে উমর রা. বলেন, তা আমি ভালো করে জানি;তবে এটা ভালো কাজ। এরপরই উবাই রা. তাদের নিয়ে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া আরম্ভ করেন। (হাদীসটির মান হাসান)
এ হাদিসে দেখার বিষয় হচ্ছে- কয়েকটি ছোট ছোট দলকে নিয়ে জামাতের সাথে একত্রিত করে এক ইমামের পিছনে নামাজ আদায় করার নিয়ম বানানো একটি ব্যবস্থাপনাগত বিষয় ছিল। আর তিন বার হলেও রাসূল স. তা নিজেই আমল করেছিলেন তথাপি উবাই রা. এ ব্যাপারে নিজের সংশয়ের কথা প্রকাশ করলেন (هذا شيئ لم يكن) কিন্তু তিনি তারাবীহ যে বিশ রাকাত পড়তে আরম্ভ করলেন এ ব্যাপারে তো কোনো সংশয় পেশ করলেন না ?
অথচ তারাবীহর রাকাত সংখ্যা তো কোনো ব্যবস্থাপনাগত বিষয় ছিলো না; বরং শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো। যা কিয়াস করে নিজে নিজেই নির্ধারণ করার বিষয় নয়। এরপরও কেন তিনি আপত্তি বা সংশয় প্রকাশ না করে বিশ রাকাত পড়ে দিলেন? আচ্ছা তার সাথে যারা নামাজ আদায় করেছেন- আশারায়ে মুবাশশারাহ (আবু বকর ছাড়া) ও অন্যান্য সাহাবায়ে কিরাম তারাও কি কোনো আপত্তি তুলেছিলেন ?
সবাই এমন একটি শরয়ী বিধানকে একবাক্যে মেনে নেয়া বিশেষ করে হযরত উবাইয়ের তাতে প্রশ্ন না তোলা প্রমাণ করে, বিশ রাকাতের উপর সকলের আমল ও তাআমুল এর পিছনে রাসূল সা.-এর অবশ্যই কোনো দিকনির্দেশনা ছিলো। যা হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত হাদীসে মারফু দ্বারা প্রমাণিত। তা না হলে প্রাণ যেতেও সাহাবারা শুধু হযরত উমরের কথায় বিশ রাকাতের উপর একমত হতেন না। কিংবা হযরত উমর রা. এর মত বিদআত বিরোধী শক্ত মেজাযের মানুষ আট রাকাতের শিক্ষা বিদ্যমান থাকতে বিশ রাকাত পড়ার কথা বলতেন না।
এ বিষয়টিই ইমাম আবু হানীফা র. এর ভাষায়-
فَقَالَ: التَّرَاوِيحُ سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ وَلَمْ يَتَخَرَّصْهُ عُمَرُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ مُبْتَدِعًا، وَلَمْ يَأْمُرْ بِهِ إِلَّا عَنْ أَصْلٍ لَدَيْهِ وَعَهْدٍ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ. (الاختيار لتعليل المختار للموصلي: ১/৭০)
“তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং উমর রা.তা নিজের পক্ষ থেকে অনুমান করে নির্ধারণ করেননি; বরং তিনি দলীলের ভিত্তিতে এবং নবীজী থেকে প্রাপ্ত কোনো নির্দেশনার ভিত্তিতেই এই আদেশ প্রদান করেছেন।”
ষষ্ট দলিল : ইজমায়ে উম্মত
বিশ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে সাহাবা, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ীসহ পুরো উম্মতের ইজমা সংগঠিত হয়েছে। এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য আলেম-ফকীহদের মত এবং গ্রহণযোগ্য কিতাবসমূহের ইবারত তুলে ধরা হলো-
(১) মোল্লা আলী আল-কারী র. বলেন- أجمع الصحابة علي أن التراويح عشرون ركعة.
অর্থাৎ ‘সাহাবারা ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, তারাবীহ ২০ রাকাত।’ (মিরকাত ৩/৩৪৬-মাকতাবা আশরাফিয়া)
(২) আল্লামা আইনী র. ইবনে আব্দুল বার র.-এর বক্তব্য উল্লেখ করেছেন-
وهو قول جمهور العلماء وبه قال الكوفيون و الشافعى وأكثر الفقهاء ، وهو الصحيح عن أبى بن كعب من غير خلاف من الصحابة –
“এ মত পোষণ করেন কুফাবাসী, ইমাম শাফেয়ী র. ও অধিকাংশ ফুকাহা। আর
সাহাবাদের থেকে মতানৈক্য ছাড়া ২০ রাকাত প্রমাণিত। (উমদাতুল কারী : ৮/২৪৬-মাকতাবা যাকারিয়া)
(৩) কাযীখান র. তার স্বীয় ফাতওয়া গ্রন্থে লিখেন-
وهو المشهور من الصحابة والتابعين-
“সাহাবা ও তাবেয়ী থেকে এটাই (২০ রাকাত পড়া) প্রসিদ্ধ।”(ফাতাওয়া কাযীখান : ১/২০৬)
(৪) ইবনে হাজার মাক্কী র. বলেন, ২০ রাকাতের উপর সাহাবাদের ইজমা রয়েছে। (ইনারাতুল মাসাবীহ : পৃ.১৮)
(৫) আব্দুল হাই লাখনবী র. লিখেন-
ثبت اهتمام الصحابة على عشرين فى عهد عمر و عثمان وعلى فمن بعدهم-
“হযরত উমর, উসমান, আলী রা.-এর যুগে এবং পরবর্তীতে সাহাবাদের ২০ রাকাতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রমাণিত।”(হাশিয়ায়ে শরহে বেকায়া : ১/১৭৫- আশরাফী বুক ডিপো)
(৬) ‘ইতহাফু সাদাতিল মুত্তাকীন’ নামক কিতাবে আছে-
وبالإجماع الذى وقع فى زمن عمر أخذ أبو حنيفة و الشافعى وأحمد و الجمهور.
‘উমর রা.-এর যুগে যে ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা-ই গ্রহণ করেছেন আবু হানীফা, শাফেয়ী, আহমাদ র. ও অধিকাংশ আলেম-ফকীহ।’ (৩/৪২২)
ইবনে কুদামা র. মুগনীতে (২/৩৬৪), শামসুদ্দীন র. শরহে মুকান্নাতে (১/৮৫২), আ. হাই লাখনবী র. আত তা‘লীকুল মুমাজ্জাদে (পৃ:৫৩), মোল্লা আলী আল-কারী র. শরহে নেকায়াতে (পৃ.১০৪) এবং নবাব সিদ্দীক হাসান খান (যিনি গায়রে মুকাল্লিদদের গুরু) আওনুল বারীতে (২/৩০৭)। ২০ রাকাত তারাবীহর উপর ইজমা উল্লেখ করেছেন।
উপরন্তু (১২-১৩) ইমাম নববী র. “باتفاق المسلمين” শব্দ দ্বারা (আল আযকার পৃ. ৮৩) আর ইবনে তাইমিয়া র. فلما “جمعهم” عمر علي ابي بن كعب. বাক্য দ্বারা (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ১১/৫২০) ইজমা নকল করেছেন।
(১৪-১৫) তাহতাবী র. হাশিয়ায়ে তাহতাবীতে (১/২৯৬-মাকতাবা রশীদিয়া,কোয়েটা) আর শারাম্বুলালী র. মারাকীউল ফালাহতে (পৃ.৮১) “متوارث” শব্দ দ্বারা ইজমা উল্লেখ করেছেন।
(১৬-২৪) ইবনে হুমাম র. ফাতহুল কাদীরে (১/৪৮৫), আন্ওয়ার শাহ্ কাশ্মীরী র. আল আরফুশ শাযীতে (হাশিয়ায়ে তিরমিযী : ১/১৬৬), ইবনে নুজাইম র. বাহরুর রায়েকে (২/১১৭-যাকারিয়া), আল্লামা শামী র. রদ্দুল মুহতারে (২/৪৫-সাঈদ), কাসানী র. বাদায়েতে (২/২৭২-দারুল হাদীস), আ. হক মুহাদ্দিসে দেহলবী র. ‘মা সাবাতা বিস সুন্নাহ’ গ্রন্থে (পৃ.২১৭), হালাবী র. শরহে মুন্য়াতে (পৃ.৪০৬), সুয়ূতী র. মাসাবীহ গ্রন্থে (পৃ.১৬) এবং সুবকী র. মাসাবীহতে (পৃ.১৬) “ثم استقر الامر علي هذا” ইত্যাদি বাক্য দ্বারা ইজমা উল্লেখ করেছেন। কোনো আলেম বা ফকীহ এগুলোর উপর আপত্তি করেননি। উপর্যুক্ত দলিল-প্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হলো, বিশ রাকাত তারাবীহর উপর পুরো উম্মতের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
আল্লামা ইবনে তাইমিয়া র.-এর অভিমত
২০ রাকাত তারাবীহর ব্যাপারে গায়রে মুকাল্লিদদের মান্যবর ইমাম আরববিশ্বের অন্যতম গবেষক ইবনে তাইমিয়া র.-এর মতামত তুলে ধরা হলো। তিনি লিখেন-
قد ثبت ان ابي بن كعب رضي الله عنه كان يقوم بالناس عشرين ركعة في قيام رمضان ويوتر بثلاث فرأي كثيرمن العلماء ان ذلك هو السنة لانه اقامه بين المهاجرين والانصار ولم ينكره منكر.
অর্থ : একথা প্রমাণিত যে, উবাই বিন কা‘ব রা. রমযানে তারাবীহতে লোকদের নিয়ে ২০ রাকাত পড়তেন এবং তিন রাকাত বিতর পড়তেন। তাই বহু আলেমের সিদ্ধান্ত এটাই সুন্নত। কেননা তিনি মুহাজির ও আনসার সাহাবীদের উপস্থিতিতেই তা আদায় করেছিলেন। কেউ তাতে আপত্তি করেননি। (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ১২/৬৮-মাকতাবা আবীকান; ২৩/৬৫-দারুল হাদীস)
তিনি আরো লিখেন-
ثبت (التراويح عشرون ركعة) من سنة الخلفاء الراشدين وعمل المسلمين.
অর্থাৎ, খুলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত ও মুসলিম জাতির আমল দ্বারা ২০ রাকাত তারাবীহ প্রমাণিত । (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ২৩/৬৬-দারুল হাদীস)
অন্যত্রে তিনি বলেন-
كما أن نفس قيام رمضان لم يوقت النبى صلى الله عليه وسلم فيه عددا معينا….. فلما جمعهم عمر علي ابي بن كعب ، كان يصلي بهم عشرين ركعة ويوتر بثلاث …. ثم كانت طائفة من السلف يقومون باربعين ركعة ويوترون بثلاث وآخرون قاموا بست وثلاثين واوتروا بثلاث، وهذا كله سائغ. فكيفما قام فى رمضان من هذه الوجوه فقد أحسن-
অর্থ: “তারাবীহর ব্যাপারে রাসূলের সা. পক্ষ থেকে কোনো সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি। হযরত উমর রা. যখন সাহাবাদেরকে উবাই বিন কা‘ব রা.-এর পিছনে তারাবীহর জন্য একত্রিত করেন তখন উবাই রা. তাদেরকে ২০ রাকাত তারাবীহ ও ৩ রাকাত বিতর পড়ান। পরবর্তীতে অনেকে ৩৯ রাকাত, অনেকে ৩৬ রাকাত তারাবীহ পড়তেন। এর প্রত্যেকটিই বৈধ। এর যে কোনো একটি পড়লেই তারাবীহ আদায় হবে। (মাজমুআতুল ফাতাওয়া : ২২/৪৯৫-দারুল হাদীস)
সুতরাং বুঝা যায় যে, ইবনে তাইমিয়া র.-এর মতে তারাবীহর নামায বিশ রাকাতের অধিক বৈধ হলেও বিশের কমে ৮ রাকাত তারাবীর কোনো নযীর নেই।
হারামাইনের চৌদ্দ শ’ বছরের তারাবীহর ইতিহাস
আরববিশ্বের প্রখ্যাত আলেম মদীনার শরয়ী আদালতের বিচারপতি, মসজিদে নববীর দীর্ঘকালের স্বনামধন্য উস্তাদ শাইখ আতিয়্যা সালেম র. এ বিষয়ে “التروايح من اكثر الف عام” নামে একটি তথ্যবহুল বই লিখেছেন। এতে তিনি মসজিদে নববীর তারাবীহর ইতিহাস তুলে ধরেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, সুদীর্ঘ (প্রায়) দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে মসজিদে নববীতে ২০ রাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়নি। সাহাবা ও তাবেয়ী ২০ রাকাত পড়েছেন। ২য় ও ৩য় শতাব্দীতে কিছু অতি উৎসাহী লোক ৩৬ রাকাত পড়েছেন। এরপর চতুর্থ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত মদীনাতে ২০ রাকাত তারাবীহর নামায পড়া হচ্ছে।
قال الشيخ عطية سالم رح: مضت المائة الثانية والتراويح ست وثلاثون وثلاث وتر ودخلت المائة الثالثة وكان المظنون أن تظل ما هي عليه تسع وثلاثون بما فيه الوتر.
উপসংহারে তিনি বলেন, যখন এ দীর্ঘকালে উল্লেখযোগ্য এমন একজনও পাওয়া যায় না যিনি বলেছেন তারাবীহর নামাজ আট রাকাতের বেশি পড়া জায়েয নেই বা রাসূল সা.-এর মসজিদে কোনো এক দিন জামাতের সাথে আট রাকাত পড়া হয়েছে। তারপরও যারা আট রাকাতের উপর অটল আছেন এবং অন্যদের সেদিকে দাওয়াত দিচ্ছেন তাদেরকে শুধু এটুকু বলার আছে যে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকে আজ পর্যন্ত পুরো মুসলিম উম্মাহর ধারাবাহিক আমলের বিরোধীতা করার চেয়ে অনুসরণ করাই অধিক শ্রেয়। (আত তারাবীহ আকসারু মিন আলফি আম :পৃ.৪১-৪২-৪৭-৪৮-৬৫-১০৮-১০৯)
দ্বিতীয় অধ্যায়
তারাবীহ ৮ রাকাতের পক্ষের দলিল ও তার খণ্ডন
আমরা এ পর্যন্ত বিশ রাকাত তারাবীহর পক্ষে সবধরণের অত্যন্ত শক্তিশালী দলিল পেশ করলাম। অথচ লা-মাযহাবী বন্ধুরা এসব দলীলের বিরোধীতা করে বর্তমানে পুরো মুসলিম উম্মাহকে এক কঠিন পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত করে রেখেছেন। আর তাদের মত মুমিনগণের অনুসৃত পথ থেকে যে সম্পূর্ণ বিচ্যুত তা পূর্বের আলোচনাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
আমরা এ অধ্যায়ে তাদের দাবীর পক্ষে দলিলগুলো যাচাই করে দেখবো। তবে তারপূর্বে ভূমিকা স্বরূপ একটি বিষয় জেনে রাখা প্রয়োজন, তা হলো-
নবীজী স. কত রাকাত তারাবীহ পড়েছেন ?
রাসূল স. রমযানের রাতসমূহে কী পরিমাণ নামায আদায় করতেন এ নিয়ে হযরত আয়েশা রা. হতে দু’ধরণের বিবরণ পাওয়া যায়।
ক. রাসূল স. সারা বৎসরের তুলনায় রমযান মাসে খুব বেশী ইবাদত করতেন এবং অধিক পরিমাণে রাতে নামায পড়তেন। যেমন:
* মুসলিম শরীফের বর্ণনা-
قَالَتْ عَائِشَةُ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا: ্রكَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَجْتَهِدُ فِي الْعَشْرِ الْأَوَاخِرِ، مَا لَا يَجْتَهِدُ فِي غَيْرِهِ. (صحيح مسلم: رقم: ১১৭৫، باب الاجتهاد في العشر)
“নবী স. রমযানের শেষ দশকে ইবাদত বন্দেগীতে এত অধিক সময় মনোনিবেশ করতেন, যা বছরের অন্য কোনো সময়ে করতেন না।” (মুসলিম শরীফ: ১/৩৭২)
* বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে-
عن عائشة رضي الله تعالي عنها قالت كان رسول الله صلي الله عليه وسلم اذا دخل رمضان احي الليل وايقظ اهله وشد المئزر. (صحيح البخاري)
“আয়েশা রা. বলেন, রমযানের শেষ দশকে রাসূল স. নিজেও রাত জাগতেন আপন পরিবারকেও জাগাতেন এবং ইবাদত বন্দেগীর জন্য কোমর বেঁধে নিতেন।”
* হযরত আয়েশা বর্ণনা করেন-
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: ” كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ رَمَضَانُ تَغَيَّرَ لَوْنُهُ، وَكَثُرَتْ صَلَاتُهُ، وَابْتَهَلَ فِي الدُّعَاءِ، وَأَشْفَقَ مِنْهُ. (شعب الايمان: رقم ৩৩৫৩، فضائل شهر رمضان)
“রমযান মাস আসলে নবী স. এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো, তিনি অধিক পরিমাণে নামায আদায় করতেন এবং কাকুতি-মিনতি ও অনুনয়-বিনয়ের সাথে খুব বেশী দোয়া করতেন এবং তাঁর তরে খোদাভীতিও বেড়ে যেতো” (শুয়াবুল ঈমান-নং৩৩৫৩)
এসব হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, রমযানের রাত্রীকালিন নামায বছরের অন্যান্য রাত্রের তূলনায় অনেক বেশী ছিল। যদিও কত রাকাত তার কোন সংখ্যা এতে উল্লেখ নেই।
খ. পক্ষান্তরে হযরত আয়েশা রা. থেকেই অপর এক বর্ণনায় এর বিপরীত বক্তব্য পাওয়া যায়। যেমন-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، كَيْفَ كَانَتْ صَلاَةُ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ؟ فَقَالَتْ: ্রمَا كَانَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ وَلاَ فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلاَثًاগ্ধ (صحيح البخاري: ১/১৫৪،২০১৩)
অর্থাৎ হযরত আবু সালামা র. আম্মাজান হযরত আয়েশা রা. কে জিজ্ঞেস করলেন রমজান মাসে নবী স. এর নামাজ কী রূপ ছিল ? উত্তরে হযরত আয়েশা বলেন নবী স. রমযানে এবং রমযানের বাইরে কখনো ১১ রাকাতের বেশী পড়তেন না। প্রথমে চার রাকাত (এক নিয়তে) পড়তেন এতো দীর্ঘ ও সুন্দর নামায পড়তেন যার বিবরণ দেয়া প্রায় অসম্ভব। পূনরায় একইভাবে অতি দীর্ঘ ও সুন্দর করে চার রাকাত পড়তেন। অতপর তিন রাকাত বিতর পড়তেন। (সহীহুল বুখারী:১/১৫৪)
এ হাদীস থেকে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, রমযানের রাতেও বছরের অন্যান্য রাতের মত ১১ এগার রাকাতই পড়তেন, এর বেশী পড়তেন না।
গ: মুসলিম শরীফে রয়েছে, আবু সালামা র. আয়েশা রা. কে রাসূল সা. এর নামায সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ، قَالَ: سَأَلْتُ عَائِشَةَ، عَنْ صَلَاةِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَقَالَتْ: ্রكَانَ يُصَلِّي ثَلَاثَ عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي ثَمَانَ رَكَعَاتٍ، ثُمَّ يُوتِرُ، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ وَهُوَ جَالِسٌ، فَإِذَا أَرَادَ أَنْ يَرْكَعَ قَامَ فَرَكَعَ، ثُمَّ يُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ بَيْنَ النِّدَاءِ وَالْإِقَامَةِ مِنْ صَلَاةِ الصُّبْحِগ্ধ.(صحيح مسلم: ১/২৫৪، رقم: ১২৬)
অর্থাৎ তিনি তের রাকাত নামাজ পড়তেন। (প্রথমে) আট রাকাত পড়তেন এরপর (তিন রাকাত) বিতর পড়তেন। এরপর দুই রাকাত নামায বসে পড়তেন। (মুসলিম:১/২৫৪)
এই হাদীসগুলো দ্বারা বুঝা গেল:
ক. নবী স. রমযানে অনেক বেশী নামাজ পড়তেন।
খ. সারা বছরও একই রকম নামায পড়তেন এবং তা এগার রাকাতই ছিল এর বেশী কখনো পড়তেন না।
গ. তের রাকাত পর্যন্ত পড়তেন।
এসব হাদীসকে বাহ্যিকভাবে পরষ্পরবিরোধী মনে হয়। অন্যদিকে উক্ত নামায তারাবীহ ছিল নাকি তাহাজ্জুদ ছিলো তার স্পষ্ট বিবরণ নেই। লা-মাযহাবীদের উক্তিমত যদি (খ) এর হাদীসটিকে তারাবীহই গণ্য করা হয় যদিও আসলে তা তাহাজ্জুদের নামায) তাহলে তারবীহর রাকাত সংখ্যা সহীহ হাদীসে আট রাকাতই প্রমাণ হবে। অথচ (ক) এর হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাকাতের কোন সংখ্যাই রাসূল স. থেকে নির্ধারিত ছিল না।
মোট কথা : হযরত আয়েশা রা. থেকে বিভিন্ন প্রকারের বর্ণনা পাওয়া যায়। এক বর্ণনানুযায়ী রাকাতের সংখ্যা অনির্ধারিত। অপর বর্ণনা মতে রাকাত সংখ্যা আট বা দশ (এগার বা তিন)। এসব কারণে রাসূল স. এর তারাবীহ সম্পর্কে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের উলামা থেকেও দু’ধরণের বক্তব্য পাওয়া যাচ্ছে। এক শ্রেণীর আলেম মনে করেন, নবী স. কত রাকাত তারাবীহ পড়েছেন এটা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। এদের মধ্যে রায়েছেন- ১. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া, ২. আল্লামা তাজুদ্দিন সুবকী, ৩. জালালুদ্দীন সূয়ুতী, ৪. ইমাম শাফেয়ী, ৫. আল্লামা শাওকানী, ৬. নবাব সিদ্দিক হাসান খান প্রমুখ।
অপর শ্রেণীর উলামায়ে কিরামের মন্তব্য হচ্ছে নবী স. বিশ রাকাতই তারাবীহ পড়েছেন যা ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণিত হাদীসে বিধিত রয়েছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে রয়েছেন ১) আল্লামা রাফেয়ী আশশাফেয়ী। ২) ইমাম তাহাবী আলহানাফী। ৩) আল্লামা কাযী খান। ৪) ইমাম শাহ আব্দুল আযীয র. প্রমুখ
যারা বিশ রাকাত তারাবীহ রাসূল স. থেকে নির্ধারিত এবং তিনি পড়িয়েছেন বলে মনে করেন তাদের দলিল আমরা ইতোপূর্বে প্রথম দলিল হাদীসে মারফু অধ্যায়ে স্ব-বিস্তারে পেশ করেছি।
যারা রাকাতের সংখ্যা রাসূল স. থেকে নির্ধারিত নেই বলে মন্তব্য করেন তাদের কয়েকটি বিবরণ এখানে পেশ করছি :
১. আহলে হাদীসের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব ও আদর্শ পুরুষ নবাব সিদ্দিক হাসান খান বলেন-
{إن صلاة التراويح سنة بأصلها لما ثبت أنه (ص) صلاها في ليالي ثم ترك شفقة علي الامة أن لاتجب علي العامة أو يحسبوها واجبة ولم يأت تعين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة ولكن يعلم من حديث كان رسول الله (ص) يجتهد في رمضان مالا يجتهد في غيره أن عددها كان كثيرا.} رواه مسلم.
অর্থাৎ তারাবীহর নামায মৌলিকভাবে সুন্নাত। কেননা হাদীসে প্রমাণ আছে যে নবী স. কয়েক রাত তারাবীহ পড়েছেন। অতপর এ আশঙ্কায় ছেড়ে দেন যে, উম্মতের উপর হয়তো ফরয হয়ে যাবে। কিংবা উম্মত সেটাকে ফরয ধারণা করে বসবে। তবে কোনো মারফু সহীহ হাদীসে তারাবীহর নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা বর্ণিত নেই। হ্যাঁ, মুসলিম শরীফের এক হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, রাকাত সংখ্যা অনেক বেশি ছিল।
উল্লেখ্য, বুখারীতে হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত এগার রাকাতের হাদীস যদি তারাবীহর সাথে সম্পৃক্ত হতো সেটা কি সহীহ মারফু নয় ? তাহলে কীভাবে এ মন্তব্য করা হবে ? হ্যাঁ, তিনিও জানেন আয়েশা রা. এর হাদীসটি তাহাজ্জুদের; তারাবীর নয়।
২. শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. বলেন-
{من ظن ان قيام رمضان فيه عدد معين موقط عن النبي (ص) لا يزيد ولا ينقص فقد اخطأ. (الانتقاض الرجيح: ৬৩)
অর্থাৎ যে ব্যক্তি এই ধারণা করে যে, নবী স. রমযানে নির্দিষ্ট সংখ্যায় তারাবীহ পড়েছেন। কখনো কম বেশি করেননি, তাদের ধারণা ভুল।
৩. আল্লামা শাওকানী র. বলেন-
وَالْحَاصِلُ أَنَّ الَّذِي دَلَّتْ عَلَيْهِ أَحَادِيثُ الْبَابِ وَمَا يُشَابِهُهَا هُوَ مَشْرُوعِيَّةُ الْقِيَامِ فِي رَمَضَانَ، وَالصَّلَاةُ فِيهِ جَمَاعَةً وَفُرَادَى، فَقَصْرُ الصَّلَاةِ الْمُسَمَّاةِ بِالتَّرَاوِيحِ عَلَى عَدَدٍ مُعَيَّنٍ، وَتَخْصِيصُهَا بِقِرَاءَةٍ مَخْصُوصَةٍ لَمْ يَرِدْ بِهِ سُنَّةٌ.(نيل الاوطار: ৩/৬৬)
অর্থাৎ এ সম্পর্কীয় সবগুলো হাদীস মিলিয়ে দেখলে বুঝা যায় যে, রমযানের রাত্রি জাগরণ এবং নামায পড়া প্রমাণিত। এই নামায জামাতেও পড়া যায়, একাকীও পড়া যায়। সুতরাং নামাযকে নির্দিষ্ট সংখ্যা এবং নির্দিষ্ট সূরা কেরাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ করার ব্যাপারে কোনো (সহীহ) হাদীস পাওয়া যায়না। (নাইলুল আওতার- ৩/৬৬)
এখানে লা-মাযহাবীদের তিনজন আদর্শ পুরুষের মন্তব্য তুলে ধরলাম। এরা সবাই দ্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন, তারাবীহ সম্পর্কে রাসূল স. থেকে সুনির্দিষ্ট কোন সংখ্যাই সহীহ হাদীসে বর্ণিত নেই। অন্যদিকে উপরোল্লিখিত মুসলিম শরীফের হাদীস দ্বারা বুঝাযায় যে, রাকাত সংখ্যা অনেক বেশী ছিলো। আবার বেশ কিছু ফকীহ ও মুহাদ্দিসের মন্তব্য হচ্ছে, তারাবীহর সংখ্যা বিশ রাকাত ছিলো। কিন্তু তারাবীহর সংখ্যা আট রাকাত ছিলো’ এ মন্তব্য কোথাও কেউ করতে দেখা যায়নি। হাজার বছর পর এসে আলবানী ও তার অনুসারী লা-মাযহাবীরা তাদের আদর্শ পুরুষ ইবনে তাইমিয়া, নবাব সিদ্দিক হাসান ও ইমাম শাওকানীর স্পষ্ট ঘোষণার বিরুদ্ধে রাকাতের সংখ্যা আট বলে দাবী করে বসলেন। প্রমাণস্বরূপ বুখারীতে বর্ণিত হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক তাহাজ্জুদের হাদীসটি পেশ করলেন। বিচারের ভার পাঠকদের কাছে ছেড়ে দিলাম। বলুন! এতে প্রতীয়মান হয়না যে, তারবীহ আট রাকাত বলার মতামতটি নব আবি®কৃত ফিতনা। হাজার বছর যাবত কেউ একথা বলেননি, বুখারীতে বর্ণিত আয়েশা রা. এর হাদীসকে কেউ তারাবীহর হাদীসও বুঝেন নি। আল্লাহ তাদের সহীহ বুঝ দান করুন। আমীন॥
লা-মাযহাবীদের আট রাকাতের দলিল
বিশ রাকাত তারাবীহর সবগুলো দলিলকে উপেক্ষা করে লা-মাযহাবীরা আহলে সুন্নাতের অনুসৃত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে আট রাকাতকেই সুন্নাত এবং এর বেশী পড়াকে বিদআত আখ্যা দিয়ে ফিৎনার সৃষ্টি করছেন। তাঁরা আট রাকাতে তারাবীহ সীমাবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে নিম্নোক্ত দলিল গুলো পেশ করে থাকেন-
১ নং দলিল :
উ¤মূল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা. এর বর্ণনা-
عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ، كَيْفَ كَانَتْ صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ؟ قَالَتْ: مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلَا فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً، يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلَا تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي أَرْبَعًا، فَلَا تَسْأَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّي ثَلَاثًا، فَقَالَتْ عَائِشَةُ: فَقُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ أَتَنَامُ قَبْلَ أَنْ تُوتِرَ، فَقَالَ: ্রيَا عَائِشَةُ إِنَّ عَيْنَيَّ تَنَامَانِ، وَلَا يَنَامُ قَلْبِيগ্ধ (صحيح مسلم: ১/২৫৪،رقم: ১২৫، باب صلاة الليل والوتر)
অর্থাৎ আবু সালামা হযরত আয়েশা রা.কে জিজ্ঞেস করলেন, রমযানে রাসূল স. এর নামায কীরূপ হতো ? তিনি বললেন- রমযান ও অন্য সময়ে তিনি এগার রাকাতের বেশী আদায় করতেন না। তিনি প্রথমে চার রাকাত আদায় করতেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসা করোনা। অতপর চার রাকাত আদায় করতেন। আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে বিতির পড়ার পূর্বেই ঘুমিয়ে পড়েন ? তিনি বললেন- আয়েশা! আমার চোখ ঘুমায় তবে আমার হৃদয় জাগ্রত থাকে। (সহীহ মুসলিম:২৫৪)
এ হাদীসটি তাদের সবচেয়ে শক্তিশালী দলিল। অথচ এ হাদীস তাহাজ্জুদ নামাযের ব্যাপারে এসেছে। তারা এর অপব্যাখ্যা করে তারাবীহর ব্যাপারে প্রয়োগ করেছে। আর এ প্রয়োগকে বৈধতা দেয়ার জন্য তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম বলে প্রচার চালিয়েছে এবং বলে, যে নামাযটি এগার মাস যাবত তাহাজ্জুদ থাকে তা-ই রমযানে এসে তারাবীহ হয়ে যায়। বাহ্ কী চমৎকার কথা ! কিন্তু এ পর্যন্ত তারা তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ যে এক নামাযের দুই নাম এবং তাহাজ্জুদ আট রাকাতের বেশী পড়া যায়না তা সহীহ তো দূরের কথা কোনো যয়ীফ হাদীস দ্বারাও প্রমাণ করতে পারেনি। বাংলাদেশে উত্তর বঙ্গের এক বিশাল সমাবেশে তারা দুই লক্ষ টাকার পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন। আমি তাদেরকে দশ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। আজ পর্যন্ত এর জবাব মিলেনি।
দলিলটি খণ্ডন
মূলত অনেকগুলো দলিল দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত যে, আলোচ্য হাদীসটি তারাবীহ বিষয়ক নয়; বরং তাহাজ্জুদের সাথে সম্পৃক্ত। এর মমার্থ হচ্ছে, বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এসেছে যা আমরা পূর্বে বর্ণনা করেছি যে, রাসূল স. রমযান মাসে ইবাদত ও নামাযে বেশি নিমগ্ন থাকতেন তাই সম্ভাবনা ছিলো রমযানে তাহাজ্জুদ নামাযের রাকাত সংখ্যা অন্যান্য মাসের চেয়ে বেশি হবে। এ কারণেই আবু সালামা শুধু রমযানের তাহাজ্জুদের অবস্থা সম্পর্কে হযরত আয়েশা রা. থেকে জানতে চাইলেন। তাই হযরত আয়েশা রা. জানিয়ে দিলেন যে, তাহাজ্জুদের রাকাত সংখ্যা রমযান মাসেও অন্যান্য মাসের মতো অপরিবর্তিত থাকতো। প্রশ্ন শুধু রমযানের ব্যাপারে থাকলেও উপরোক্ত কারণেই জবাবে (لا في رمضان ولافي غيره) রমযান ও গাইরে রমযানের বাক্যটি উল্লেখ করেছেন। সুতরাং হাদীসটি যে তাহাজ্জুদ সম্পর্কে তা সুস্পষ্ট।
এর প্রমাণ স্বয়ং হাদীসটি বর্ণনার ধরণেই বিদ্যমান। যেমন-
১Ñ এ হাদীসে ওই নামাযের কথাই বলা হয়েছে, যা রমযান ও অন্যান্য মাসে পড়া হতো। সর্বস্বীকৃত কথা হচ্ছে তারাবীহ একমাত্র রমযান মাসেই পড়া হয়ে থাকে; সব মাসে নয়। বুঝা গেলো এ নামাযটি তারাবীহ নয়; বরং তাহাজ্জুদ।
২Ñ এ নামাযের বিবরণে স্পষ্ট আছে أربعا)) চার রাকাত চার রাকাত করে পড়েছেন। মাও. মুবারকপুরী আহলে হাদীসের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও তিরমিযীর ব্যাখ্যা গ্রন্থে বলেন, এর অর্থ হচ্ছে এক সালামে চার রাকাত পড়া হয়েছিলো। বিতরের তিন রাকাতও এক সালামে পড়া হয়েছে। সবারই জানা কথা, তাহাজ্জুদ চার রাকাত করে যেমন পড়া যায়, দুই রাকাত করেও পড়া যায়। কিন্তু তারাবীহর নামায এক সালামে চার রাকাত পড়ার পক্ষে স্বয়ং আলবানী সাহেবও নন। কেউ এটাকে জায়েযও মনে করেন না। তাহলে প্রতীয়মান হলো, এ হাদীস তাহাজ্জুদের ব্যাপারে বর্ণিত।
৩. এ হাদীসে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তাতে রাসূল স. নামায শেষে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন এবং পরে ঘুম থেকে উঠে বিতর পড়তেন। অথচ তারাবীহর ক্ষেত্রে নামায শেষে ঘুমের পূর্বেই বিতর পড়া হয়ে থাকে অথবা বিতর না পড়ে ঘুমিয়ে গেলে ঘুম থেকে উঠে প্রথমে তাহাজ্জুদ তারপর বিতর পড়ার নিয়ম ছিলো, এখনো আছে। সুতরাং যে নামাযের পর ঘুমিয়ে অত:পর উঠে শুধু বিতর পড়া হয় তা একমাত্র তাহাজ্জুদ নামায হওয়া সম্ভব; তারাবীহ হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। একথা বলারও সুযোগ নেই যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামায। একটু পরেই আমরা আলোচনা করবো যে, এ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন নামায।
৪. এ হাদীসে যে নামাযের কথা বলা হয়েছে তা হযরত আয়েশা রা.এর ঘরে একাকী নামায ছিলো। যা হাদীসের শেষাংশে হযরত আয়েশা রা.এর প্রশ্ন ও রাসূল স. এর উত্তর থেকে স্পষ্ট। আর বলা বাহুল্য, তাহাজ্জুদই নির্জনে একাকী পড়া হয়ে থাকে পক্ষান্তরে তারাবীহ তো জামাতের সাথে পড়া হয়।
৫. এ স্পষ্ট সহীহ হাদীসে আট রাকাতের নামাযটি যদি তারাবীহ হতো, তাহলে সাহাবায়ে কিরামের পক্ষে তারাবীহ বিশ রাকাত পড়া আদৌ সম্ভব ছিলো না। কেননা, সাহাবারা ছিলেন রাসূলের সুন্নাত ও আদর্শের প্রতি সবচেয়ে বেশী আসক্ত। এক একটি সুন্নাতের জন্য যারা প্রাণ উৎসর্গ করতে সর্বদা প্রস্তুত, তাদের পক্ষে এমন অকাট্য সুস্পষ্ট আট রাকাতের হাদীস থাকতে বিশ রাকাত পড়ার মতো দুঃসাহস কল্পনাও করা যায় না।
৬. স্বয়ং হযরত আয়েশা রা. যিনি এ হাদীসের বর্ণনাকারী, তিনিও হাদীসটিকে তারাবীহ বিষয়ক মনে করতেন না। অন্যথায় তার চোখের সামনে তারই হুজরার পাশে মসজিদে নববীতে চল্লিশ বছর যাবত বিশ রাকাত তারাবীহ পড়ে স্পষ্ট রাসূলের আদর্শবহির্ভূত কাজ সাহাবারা করবেন, আর তিনি চুপ করে তা মেনে নিবেন- কল্পনাও করা যায় না। এমন ধারণা স্বয়ং হযরত আয়েশা রা.এর সম্মানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার নামান্তর।
৭. মুহাদ্দিসগণও এই হাদীসকে তারাবীহ নয় বরং তাহাজ্জুদের ক্ষেত্রেই মনে করতেন। এ কারণে ইমাম মুসলিম র., আবু দাউদ র., তিরমিযী র., নাসায়ী র., ইমাম মালেক র., দারমী র., আবু আওয়ামা র. ও ইবনে খুযায়মা র. প্রমুখ এদের কেউই এ হাদীসটিকে তাহাজ্জুদের অধ্যায়ে উল্লেখ করেননি। শুধু ইমাম বুখারী র. ও ইমাম মুহাম্মদ র. এ হাদীসকে তারাবীহর নামায বিষয়ক মনে করতেন বরং যথা সম্ভব তারা উভয় অধ্যায়ে হাদীসটি এনেছেন তাহাজ্জুদের নামায হিসেবে। তাহাজ্জুদ এবং তারাবীহর অধ্যায় এনেছেন একথা বুঝানোর জন্য যে রাতের নামায যেনো তারাবীহর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে; বরং তাহাজ্জুদও যেনো পড়া হয়।
এতে প্রমাণ হলো মুহাদ্দিসগণও এ হাদীসকে তারাবীহ সংক্রান্ত বলে মেনে নেননি।
৮. বিশ্বের কোনো ফকীহও এ হাদীস থেকে তারাবীর নামায বুঝেনি। নচেৎ কোনো না কোনো ফকীহ এমন সুস্পষ্ট হাদীস দ্বারা তারাবী আট রাকাত বলে মত ব্যক্ত করতেন। অথচ তাদের কেউ তারাবীহ আট রাকাতের মত পোষণ করেননি। ইমাম তিরমিযী র. তার হাদীস গ্রন্থে প্রত্যেক মাসআলাতে ফকীহগণের মত উল্লেখ করে থাকেন। এটা সুনানে তিরমিযীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। তিনি একইভাবে তারাবীহর অধ্যায়ে রাকাতের সংখ্যার বিষয়ে বহু মত পেশ করেছেন। বিশ রাকাত থেকে সর্বোচ্চ ৪১রাকাতের মতও পেশ করেছেন। কিন্তু কোনো ফকীহ তারাবীহর নামায আট রাকাত বলে মনে করেন- এমন কোনো মতামত তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি অন্যত্রে বলেছেন, (كذلك قال الفقهاء وهم أعلم بمعاني الحديث) “এব্যাপারে ফকীহগণ অনুরূপ বলেছেন, আর হাদীসের মর্ম সম্পর্কে তারাই সর্বাধিক অবগত ছিলেন।”
প্রমাণ হলো, হাদীস সম্পর্কে সব চেয়ে অভিজ্ঞ উলামায়ে কিরামও আলোচ্য হাদীসকে তারাবীহ সংক্রান্ত বলে মেনে নেননি।
৯. আলবানী সাহেবদের কথামতো আলোচ্য হাদীসটি তারাবীহ সম্পর্কে হলে তাদেরই মান্যবর উলামা ইবনে তায়মিয়া র. আল্লামা শাওকানী র. এবং নওয়াব সিদ্দিক হাসান খান র. তারাবীহর রাকাতের সংখ্যা সম্পর্কে কেন বললেন যে,
لم يأت تعيين العدد في الروايات الصحيحة المرفوعة، ولم تردبه سنة، فقد أخطأ.
“এ ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই, এমন ধারণা যে করবে সে ভুল করবে।” বলুন ! এ হাদীসটি বুখারীতে এসেছে এটা কি সহীহ না ? আসলে এরাও হাদীসটিকে তারাবীহ সংক্রান্ত মনে করতেন না।
মোটকথা, এসব দ্বারা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হযরত আয়েশা রা.-এর হাদীসটি তাহাজ্জুদ সম্পর্কে , তারাবীহ সম্পর্কে নয়। যদি তারাবীহ সম্পর্কে হতো তাহলে সাহাবায়ে কিরামের পক্ষে বিশ রাকাত পড়ার উপর ঐক্যমত হওয়া কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। অনুরূপভাবে রাসুল স. থেকে বিশ রাকাতের ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা না থাকলে তাও তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না।
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ সম্পূর্ণ ভিন্ন নামায
তারা এমনও বলে থাকেন- তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম। গাইরে রমযানে যাকে তাহাজ্জুদ বলে, রমযানে তা তারাবীহ হয়ে যায়। (قيام الليل)কিয়ামুল লাইল ও (قيام رمضان) কিয়ামে রমযান এর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সুতরাং আয়েশা রা.-এর হাদীস তাহাজ্জুদের সাথে সম্পৃক্ত। আর তাহাজ্জুদই তারাবীহ।
অতএব, এ হাদীসকে তারাবীহরও বলা চলে, পড়তে হবে আট রাকাত। এর বেশী পড়া হবে বিদআত। এ সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য সুস্পষ্ট। তা হচ্ছে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামায হলে তা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করুন? কষ্মিনকালেও সক্ষম হবেন না। আর তাহাজ্জুদ আট রাকাতের বেশী পড়লে বিদআত হবে এ কথাও হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে তাহাজ্জুদের জন্য কোনো নির্ধারিত রাকাত সংখ্যা নেই। দুই দুই রাকাত চার চার রাকাত করে যতো ইচ্ছা পড়া যাবে।
আর রাসূল স. ইরশাদ করেন-
اوتروا بخمس أو بسبع أو بتسع أو باحدي عشرة أوباكثر من ذلك .
তোমরা রাতের নামায (তাহাজ্জুদবিতর সহকারে) পাঁচ রাকাত পড়, সাত রাকাত পড়, নয় রাকাত পড়, এগারো রাকাত পড় কিংবা তার চেয়ে বেশী পড় (সবই সঠিক)। (বি. দ্র. সহীহ ইবনে হিব্বান, ২৪২৯, মুস্তাদরাক ১১৭৮)
হাদীসটি মুহাদ্দিসগণের নিকট সহীহ। (দেখুন আততালযীম ২-১৪ নাইলুন আওতার ৩/৪৩)
উপরন্তু আলোচ্য হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল স. রাতের নামায এগারো রাকাত থেকে বেশী পড়তেন না। অন্যদিকে স্বয়ং হযরত আয়েশা রা.-এর বর্ণনাতেই পাওয়া যায়, রাসূল স. তাহাজ্জুদের নামায (ফজরের সুন্নাত ছাড়া ) বিতরসহ তেরো রাকাতও পড়েছেন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং১১৬৪)
পূর্বে আমরা হাদীসটি উল্লেখ করেছি। অন্যান্য সহীহ হাদীসে তাহাজ্জুদের নামাযের সংখ্যা বিতরসহ সতেরো রাকাত এবং তদাধিকও পাওয়া যায়। (নাইলুল আওতার, শাওকানী)
এখন লা-মাযহাবীদের প্রতি জিজ্ঞাসা হলো, একদিকে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদকে এক নামায সাব্যস্ত করবেন, অপরদিকে তারাবীহ আট রাকাতের চেয়ে বেশী পড়াকে বিদআতও বলবেন, অথচ উপরোক্ত আলোচনায় দেখলেন যে, সহীহ হাদীসেই তাহাজ্জুদ বেশী পড়ারও প্রমাণ রয়েছে। তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়ালো। আপনারা হাদীসকে অমান্য করেও আহলে হাদীস, স্ববিরোধী কথা বলেও বড় পণ্ডিত? আসলে حفظت شيأ وغابت عنك الاشياء অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্কর। বড়দের মানার মেজায থাকলে এমনটি হয়না। অজ্ঞ হয়েও মুজতাহিদ সাজলে এমনই হয়।
তাহাজ্জুদ ও তারাবীহর মাঝে পার্থক্য
তথাকথিত আহলে হাদীসগণ দাবি করেন যে, তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ একই নামায। তাদের এদাবি ভুল। তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ আলাদা নামায। কারণ:-
১. তাহাজ্জুদের মাঝে ডাকাডাকি জায়েয নেই,কিন্তু তারাবীহতে জায়েয আছে।
২. তারাবীহর সময় হলো ঘুমানোর পূর্বে আর তাহাজ্জুদের নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। তবে উত্তম সময় হলো ঘুম থেকে উঠার পর।
৩. মুহাদ্দিসগণ তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ কে পৃথক পৃথক অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন।
৪. তাহাজ্জুদের নামায প্রথমে ফরয ছিলো তারপর ফরযের বিধান রহিত হয়ে গেছে। ফলে দ্বিতীয়বার ফরয হওয়ার সম্ভাবনা ছিলোনা। অথচ রাসুল সা. কিয়ামে রমযানের জামা‘আত নিয়মিত করেননি তা ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। এর দ্বারা বুঝা গেলো,তাহাজ্জুদ ও তারাবীহ এক নয়।
৫. তাহাজ্জুদের বিধান কুরআনে আছে-
(ক) ومن الليل فتهجد به نافلة لك. (সূরা বনী ইসরাঈল:৭৯)
(খ)ياايها المزمل قم الليل الا قليلا …الخ (সূরা মুয্যাম্মিল : ১-৪)। আর তারাবীহর বিধান আছে হাদীসে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন-
(গ) وسننت لكم قيامه (নাসায়ী:১/৩০৮;৪/১৫৮)
৬. তাহাজ্জুদের হুকুম মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে, আর তারাবীহর বিধান মদীনায়।
৭. হাদীসে তারাবীহর আলোচনা ‘কিয়ামে রমাযান’ আর তাহাজ্জুদের আলোচনা ‘কিয়ামূল লাইল’ নামে এসেছে। এটাও একটা দলিল যে, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ এক নয়। কারণ তাহাজ্জুদ রমযানের সাথে খাস নয়।
৮. তাহাজ্জুদের নির্দিষ্ট রাকাত রাসূল স. থেকে বর্ণিত আছে অর্থাৎ বিতরসহ সর্বোচ্চ ১৩ রকাত আর সর্বনিম্ন ৭ রাকাত। অপরদিকে তারাবীহর ব্যাপারে গাইরে মুকাল্লিদরাও বলে থাকেন যে, এব্যাপারে রাসূল স. থেকে নির্দিষ্ট কোনো রাকাত প্রমাণিত নেই। (আহসানুল ফাতাওয়া:৩/৫৩১-৩২)
দ্বিতীয় দলিল:
حدثنا عبد الأعلى حدثنا يعقوب عن عيسى بن جارية حدثنا جابر بن عبد الله قال : جاء أبي بن كعب إلى رسول الله صلى الله عليه و سلم فقال : يا رسول الله إن كان مني الليلة شيء ـ يعني في رمضان ـ قال : وما ذاك يا أبي ؟ قال : نسوة في داري قلن : إنا لا نقرأ القرآن فنصلي بصلاتك قال : فصليت بهن ثمان ركعات ثم أوترت قال…. (قيام الليل: رقم: ১৮০১)
অর্থাৎ উবাই বিন কা‘ব রা. রমযানে রাসূল স.এর কাছে এসে বললেন, “গত রাতে আমাকে ঘরের নারীরা বললো, আমরা তো কুরআন পড়তে পারিনা । তাই আমরা তোমার পেছনে নামায পড়বো। আমি তাদের নিয়ে আট রাকাত ও বিতর নামায পড়লাম।” রাসূল স. কিছু বললেন না। (কিয়ামূল লাইল: হা: নং ১৮০১)
আট রাকাত তারাবীহর
দ্বিতীয় হাদীসের পর্যালোচনা
এ হাদীসটি নিম্নে বর্ণিত কিতাব সমূহে এসেছে-
১. মুসনাদে আবী ইয়া’লা। ২. কিয়ামূল লাইল লিল মারওয়াযী পৃ:৯০, মুজামুল আওসাত লিত তাবারানী (৩৭৩১), যাওয়ায়েদে মুসনাদে আহমদ (৫/১১৫ হাদীস নং ২১৪১৫), মাজমাউয যাওয়ায়িদ লিল হায়ছামী ২/১৭৯। এরা সকলেই একই সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
১ নং জবাব:
হাদীস বিশারদদের বিবেচনায় এ হাদীসটি এতই দুর্বল যা কোনো শরয়ী মাসআলার ক্ষেত্রে প্রমাণ স্বরূপ পেশ করার অবকাশ নেই।
এর কারণ নিম্নরূপ-
* এহাদীসের সনদে “عيسي بن جارية”ঈসা বিন জারিয়া আছেন, তিনি মুহাদ্দিসদের দৃষ্টিতে ‘যয়ীফ’। তার সূত্রে বর্ণিত হাদীস প্রমাণযোগ্য নয়।
* তার সম্পর্কে ইমাম ইবনে মাঈন র. বলেন “ليس حديثه بذات” তার হাদীস মজবুত নয়। অন্য বর্ণনায় বলেছেন “ليس شيئ” তিনি কোন বস্তুই নন। অপর বর্ণনায় আছে “عنده مناكير” তার নিকট অনেক আপত্তিকর হাদীস আছে।
* ইমাম নাসায়ী র. বলেন “منكر الحديث” তিনি আপত্তিকর হাদীস বর্ণনাকারী। অপর বর্ণনায় আছে “متروك الحديث” তার বর্ণিত হাদীস বর্জনীয়।
* ইমাম আবু দাউদ র. বলেছেন তিনি “منكر الحديث” তার বর্ণনা অগ্রহণযোগ্য।
* ইমাম আদী র. বলেছেন- “احاديثه غير محفوظة” তার হাদীস সঠিক ভাবে সংরক্ষিত নয়।
* ইমাম উকাইল র. তাকে যয়ীফ রাবীদের দলভূত করেছেন।
* ইমাম ইবনুল জাওযী র. তাকে ‘যয়ীফ’ আখ্যা দিয়েছেন (তাহযীবুল কামাল ১৪/৫৩৩,মিযানুল ইতিদাল;১/৩১১)
মোট কথা: ঈসা ইবনে জারিয়া একজন ‘যয়ীফ’ রাবী। যার বর্ণনা দলিল বা সমর্থক দলিল কোন ক্ষেত্রেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুহাদ্দিসদের নিকট তিনি অনেক সময় ভুল ও আপত্তিকর কথাকে হাদীস স্বরূপ ভুলবশত: বা ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ণনা করেন একারণে অনেকে তাকে “منكر الحديث” বলেছেন।
২ নং জবাব –
এহাদীসের মূলভাষ্য ভাল করে পড়ে দেখুন, কোথাও তারাবীহ শব্দ উল্লেখ নেই। হাদীসের ভাষা তারাবীর জন্য “কিয়ামূল লাইল” বা “কিয়ামে রমযান” ব্যবহৃত হয়েছে, এখানে এ জাতীয় কোন শব্দ নেই।
সুতরাং এহাদীস দ্বারা আট রাকাত তারাবীহর প্রমাণ দেয়ার কোনো সুযোগ নেই; বরং এ বর্ণনায় বলা হয়েছে যে এটি রমযানের এক রাতের ঘটনা। তাহাজ্জুদের নামায জামাতের সাথে হতোনা, এক রাতে তিনি ঘরের মহিলাদের অনুরোধে আট রাকাত পড়িয়ে দিয়েছেন। তাই রাসূল স. এর নিকট তা প্রকাশ করেছেন। সব আলামত দ্বারা বুঝা যায় হযরত উবাই রা. মহিলাদের নিয়ে যে আট রাকাত পড়িয়েছেন তা তাহাজ্জুদ হওয়াটাই অধিক যুক্তিযুক্ত।
৩ নং জবাব-
অনুসন্ধানে দেখা যায় উপরোক্ত হাদীসটি তারাবীহ সংক্রান্ত হওয়াতো দূরের কথা রমযানের ঘটনা সম্পর্কেও পরিস্কার নয়। কারণ হাদীসটি যাওয়ায়েদ, মুসনাদে আহমদ এবং আওসাতে তাবারানীতে বর্ণিত হাদীসে রমযান শব্দ থাকলেও মূল হাদীসে রমযান শব্দ নেই; বরং রাবীর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা স্বরূপ “يعني في رمضان” এসেছে। এটা মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় (مدرج) মুদ্রাজ। যা সম্ভবত ঈসা বিন জারিয়া যিনি অনেক সময় বর্ণনায় ভুল করেন তার বা অন্য কোন রাবীর পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা স্বরূপ সংযোগ হয়েছে। কিয়ামূল লাইল কিতাবে সরাসরি রমযান থাকলেও উপরোক্ত কেউ তা মূল হাদীসের অংশ মনে করে বর্ণনা করেননি। সুতরাং যদি ঘটনাটা রমযানেরই না হয় (যা পূর্বে আলোচনায় অনুমান হলো) তাহলে তারাবীহর নামায আট রাকাতের দলিল স্বরূপ পেশ করা ব্যর্থ অপচেষ্টা বৈ কী।
৪. নং জবাব-
যদি ধরে নেয়া হয় যে, উক্ত হাদীসটি সহীহ। তাহলে বিরাট প্রশ্ন জাগে যে, উবাই রা. তারাবীহ আট রাকাত পড়ে রাসূল স. থেকে স্বীকৃতি নিলেন অথচ তিনি হযরত উমর রা. এর যুগে বিনা কথায় জামাতের সাথে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াতে গেলেন কেন ? তিনি তো তখন এ হাদীস দ্বারা হযরত উমর রা.সহ সকল সাহাবীর সামনে আট রাকাত তারাবীহর পক্ষেই প্রমাণ পেশ করার কথা ছিল। হাদীসের ভাণ্ডার খুলে দেখুন, এমন কোনো ঘটনা কি কেউ দেখাতে পারবে ? তাছাড়া হাদীসটির বর্ণনা হযরত জাবের রা.ও করেছেন। তিনি হযরত উমর রা. যুগে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়তেন কেন ? তিনিও তো এহাদীস দিয়ে আট রাকাতের স্বপক্ষে প্রমাণ দিতে পারতেন; কিন্তু তিনি তা করলেন না কেন ?
আসল কথা : এহাদীসের রাবী ‘ঈসা বিন জারিয়া’ তিনি স্বরণশক্তি দুর্বলতার কারণেই বিকৃত বিবরণ বর্ণনা করে হযরত উবাই বিন কা‘ব এর দিকে সম্বোধন করে দিয়েছেন।
আলোচ্য হাদীসটি ‘কিয়ামূল লাইল’ কিতাবের সনদে আরেকজন রাবী আছেন (محمد بن حميد) মুহাম্মদ বিন হুমায়দ রাযী র.।
* ইমাম বুখারী র. তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, فيه نظر তার ব্যাপারে আপত্তি আছে।
* হাফেজ ইবনে হাজার র. বলেছেন- তিনি حافظ ضعيف দুর্বল হাফেজে হাদীস।
* ইমাম যাহাবী র. তার কাশেফ গ্রন্থে বলেছেন- اولي تركه তাকে বর্জন করাই শ্রেয়। সম্ভবত এ দুর্বল রাবীর কারণেই কিয়ামূল লাইল গ্রন্থে হাদীসটি মূল ভাষ্যে رمضان রমযান শব্দটিও যোগ হয়েছে। নচেৎ অন্যান্য বর্ণনায় রমযান শব্দটি হাদীসে নেই। থাকলেও ব্যাখ্যা স্বরূপ এসেছে।
এসব কারণে এধরণের একটি মুনকার এবং অতি দুর্বল হাদীস দ্বারা উপরোক্ত অকাট্য বহু দলিল দ্বারা প্রমাণিত বিশ রাকাত তারাবীহর বিরোধীতা করা এক মাত্র শরীয়ত সম্পর্কে অজ্ঞ লোকদের পক্ষেই সম্ভব।
আট রাকাত তারাবী হওয়ার
তৃতীয় দলিল
হযরত জাবের রা.এর বর্ণনা-
عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ لَيْلَةً ثَمَانِ رَكَعَاتٍ وَالْوِتْرَ فَلَمَّا كَانَ مِنَ الْقَابِلَةِ اجْتَمَعْنَا فِي الْمَسْجِدِ وَرَجَوْنَا أَنْ يَخْرُجَ إِلَيْنَا فَلَمْ نَزَلْ فِيهِ حَتَّى أَصْبَحْنَا قَالَ: ্রإِنِّي كَرِهْتُ وَخَشِيتُ أَنْ يُكْتَبَ عَلَيْكُمُ الْوِتْرُগ্ধ (مختصر قيام الليل: ص৯০)
রাসূল স. আমাদেরকে নিয়ে রমযানে আট রাকাত ও বিতর পড়েছেন। পরে রাতে আমরা মসজিদে সমবেত হলাম এবং আশা করলাম তিনি (স.) বের হয়ে আমাদের নিকট আসবেন; কিন্তু সকাল পর্যন্ত আমরা মসজিদে (অপেক্ষমান) থাকলাম (তিনি আর বের হলেন না)। (কিয়ামূল লাইল পৃ:৯০)
হাদীসটির জবাব-
এ হাদীসটিও পূর্বের হাদীসের ন্যায় নিতান্ত ‘যয়ীফ’ অপ্রমাণযোগ্য। কারণ:
১. এ হাদীসের সনদেও ওই পূর্বোক্ত সমালোচিত রাবী ‘ঈসা ইবনে জারিয়া’ আছেন। যার ব্যাপারে পূর্বের হাদীসে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। তিনি ‘মুনকারুল হাদীস’ ‘মাতরুক’ তার অধিক বর্ণনাই ‘যয়ীফ’।
২. হাদীসটি সহীহ বলে মেনে নেয়া হলেও এ সম্ভাবনা প্রবল যে, রাসূল স. আট রাকাত সকলকে নিয়ে পড়েছেন। মানুষের ভিড় লক্ষ করে ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় ঘরে প্রবেশ করেন এবং অবশিষ্ট নামায ঘরেই একাকী আদায় করেন। এর স্বপক্ষে দলিল মুসলিম শরীফের সহীহ হাদীস।
মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে- একরাতে রাসূল স. সকলকে নিয়ে নামায পড়েছিলেন। মানুষের আগমনের অবস্থা দেখে জামাত ছেড়ে ঘরে চলে যান। অত:পর রাবী বলেন- ثم صلي صلاة لم يصلها عندنا. অর্থাৎ রাসূল স. এরপর হুজরায় গিয়ে একাকী নামায পড়েছেন। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং : ১১০৪)
সুতরাং এ রাতে সকলকে নিয়ে আট রাকাত পড়া এবং অবশিষ্ট নামায হুজরাতে গিয়ে একাকী আদায় করা প্রমাণ করেনা যে, তারাবীহ শুধু আট রাকাত।
৩. ঈসা বিন জারিয়া সূত্রে বর্ণিত হযরত জাবের রা. এর হাদীসটি রাসূল স. যে কয়েক রাতে জামাতের সাথে তারাবীহ পড়িয়েছেন তারই বিবরণ। আর একাধিক সহীহ হাদীসে বিভিন্ন সাহাবী থেকে ওই রাতগুলোর তারাবীহর বিবরণ সংকলন হয়েছে। কোন একটি রেওয়ায়েতে নামাযের সংখ্যার উল্লেখ নেই। আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি, ইমাম ইবনে তাইমিয়াসহ অনেকে একারণেই বলেছেন, যারা মনে করবে রাসূল স. থেকে নির্দিষ্ট কোন তারাবীহর সংখ্যা বর্ণিত হয়েছে তারা ভুল করবে।
সুতরাং কোন সহীহ হাদীসে রাকাত সংখ্যার উল্লেখ নেই। অথচ জাবের রা. এর এ হাদীসে আট রাকাতের কথা উল্লেখ আছে। আর হাদীসটি ঈসা বিন জারিয়ার কারণে মুনকার ও অধিক দুর্বল। এমন দুর্বল হাদীস সহীহ একাধিক হাদীসের বিপরীত হওয়ায় অগ্রহণযোগ্য ও প্রমাণযোগ্য নয়।
* এমর্মে যেসব সহীহ হাদীস একাধিক সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নে দেয়া হলো-
ক. হযরত আয়েশা রা.এর হাদীস (দ্র: বুখারী:৯২৪ ও মুসলিম:৭৬১) খ. হযরত আনাস রা.এর হাদীস (মুসলিম:১১০৪) গ. হযরত যায়েদ বিন সাবিত রা.এর হাদীস (দ্র: বুখারী: ৭৩১ও মুসলিম:৭৮১) ঘ. হযরত আবু যর রা. এর হাদীস (দ্র: আবু দাউদ ১৩৭৫ ও তিরমিযী:৮০৬) ঙ. নুমান বিন বাশীর রা.এর হাদীস (দ্র: নাসায়ী:১৬০৬)।
চতুর্থ দলিল
حَدَّثَنِي عَنْ مَالِك عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ يُوسُفَ عَنْ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ أَنَّهُ قَالَ أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُومَا لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً
অর্থ: সায়েব বিন ইয়াযীদ র. বলেন, উমর রা. উবাই ও তামিম দারী রা.কে লোকদেরকে নিয়ে এগার রাকাত নামায পড়তে আদেশ দিলেন । (মুওয়াত্তা মালেক: ৯৮ হা: নং ৩৭৯)
জবাব-১
এই হাদীসটি একটি ভুল বিবরণ। একজন রাবী হযরত উমর রা. এর যুগের তারাবীহর বিবরণ দিতে গিয়ে ভুলক্রমে বিশ রাকাতের স্থলে এগার রাকাত উল্লেখ করেছেন। অথচ হযরত উমরের যুগে যে তারাবীহ বিশ রাকাত হতো এতে সংশয়ের কোনো অবকাশ নেই। পূর্বে আমরা বহু সহীহ হাদীস, ইজমা ও ব্যাপক কর্মধারার মাধ্যমে তা প্রমাণ করেছি। ইমাম ইবনে আব্দিল বার র.সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ বলেছেন, এটা বর্ণনাকারীর ভুল। ইবনে আব্দিল বারের মন্তব্য নিম্নরূপ-
قال ابن عبد البر: روي مالك في هذا الحديث احد وعشرون وهو صحيح ولا اعلم احدا قال فيه احدي عشرة الي مالكا ويحتمل ان يكون ذلك اولا ثم خفف عنه طول القيام ونقلهم الي احدي وعشرين الا ان الاغلب عندي ان قوله احدي عشرة وهم. (اعلاء السنن: ৭/৪৮)
অর্থাৎ- ইমাম মালেক র. এই হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে কখনো ১১ রাকাত কখনো ২১ রাকাতের কথা বলেছেন এবং ২১ রাকাতের কথাটিই সহীহ ও সঠিক। কারণ, এগার রাকাতের কথা ইমাম মালেক র. ছাড়া আমার জানামতে অন্য কেউ বলেন নি। তবে এসম্ভাবনা আছে যে, হযরত উমর রা. এর যুগে প্রথমে এগার রাকাত ছিলো, পরে দীর্ঘ কেরাত সংক্ষেপ করে রাকাত বৃদ্ধি করে একুশ রাকাত করা হয়েছে। তবে আমার প্রবল ধারণা এগার রাকাতের কথাটি বর্ণনাগত ভুল।
সুতরাং এ হাদীসের মতনে اضطرابরয়েছে। এর অন্য সনদে তের ও একুশ রাকাত বর্ণিত আছে। তাই এটি গ্রহণযোগ্য নয়। (ইলাউস সুনান: ৭/৪৮)
জবাব-২
ইতোপূর্বে হযরত উমর রা.এর নির্দেশ সম্পর্কে অনেক সহীহ হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। যাতে বিশ রাকাতের কথা আছে। তাই এটি আমলযোগ্য নয়।
জবাব-৩
ইমাম মালেক র. নিজেও এর উপর আমল করেননি।
জবাব-৪
মুয়াত্তা মালেকেই বিশ রাকাতের রেওয়ায়েত আছে। (পৃ: ৪০)
জবাব-৫
রাবী সায়েব বিন ইয়াযিদ থেকেই বিশ রাকাতের বর্ণনা রয়েছে। (বায়হাকী: ১/২৬৭ও ২/৪৯৬)
সুতরাং প্রমাণিত হলো যে, লা-মাযহাবীদের পেশ করা দলিলগুলো অগ্রহণযোগ্য। তাই বিশ রাকাত তারাবীহই আদায় করতে হবে।
সর্বশেষ কথা
লা-মাযহাবীদের দলিলের সংখ্যা উপরোক্ত চারটি। তন্মধ্যে একটি হাদীস সহীহ যা মূলত তাহাজ্জুদের বর্ণনা সম্বলিত। আর এটাকে তারা তারাবীহর ক্ষেত্রে প্রমাণ করা ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। আর দু‘টি মুনকার ও অতি দুর্বল হাদীস, যা প্রমাণযোগ্যই নয়। মূল বিষয়েও অনেক অস্পষ্টতা রয়েছে। আর সর্বশেষ হাদীসটি একজন রাবীর ভুল বিবরণ। এধরণের ভিত্তিহীন দুর্বল হাদীস এবং একটি সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা দ্বারা অকাট্য বহু সহীহ হাদীস এবং সাহাবাদের ইজমা, সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদাসহ তাওয়াতুরে আমলীর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিশ রাকাতের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছে তাদের এ কর্মকাণ্ড গোটা মুসলিম মিল্লাতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শামিল।
ক্স মাহে রমযানে আল্লাহ তা‘আলার অসীম রহমত ও বরকত বান্দার জন্য অবধারিত। এমাসে এক রাকাত সুন্নাতের গুরুত্ব ফরযের সমতুল্য। এক রাকাত ফরযের সাওয়াব কমপক্ষে সত্তর গুন হয়ে থাকে। অত:পর প্রত্যেকের ইখলাস ও খুশু-খুযু অনুযায়ী তার সাওয়াব সাত’শ গুন পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। একারণে হাদীসে এসেছে, রমযান এলে রাসূল স.এর চেহারা বিবর্ণ হয়ে যেতো। তিনি অধিক পরিমাণে নামায আদায় করতেন। (বায়হাকী) রমযানের শেষ দশকে নিজেও রাত জাগতেন, আপন পরিবারকেও জাগাতেন। অধিক পরিমাণে ইবাদত বন্দেগী করতেন। (বুখারী,মুসলিম) কোন মুসলমানের পক্ষে এ অমূল্য সময়ে দলগত বিভ্রান্তিতে লিপ্ত হয়ে এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া মোটেই সমীচীন হবেনা।
ক্স পবিত্র মক্কা মদীনায় হারামাইন শরীফের হাজার বছরের ইতিহাসে কখনো কি বিশ রাকাতের কম তারাবীহ পড়া হয়েছিল? কোন সাহাবী, খলীফায়ে রাশেদ কি কখনো বিশ রাকাতের কম পড়েছিলেন ? তারা কি কেউ হযরত আয়েশা রা.কর্তৃক বর্ণিত তাহাজ্জুদের হাদীসটিকে তারাবীহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বলে ধারণা করেছিলেন ?
তাহলে ভিত্তিহীন কিংবা অপ্রাসঙ্গিক কয়েকটি বর্ণনা দ্বারা যারা মনগড়াভাবে উম্মতের অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিক কর্মধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে, আট রাকাতের নামে এ পবিত্র মাসের সাওয়াব থেকে বঞ্চিত করার জন্য মসজিদে মসজিদে ফিৎনা সৃষ্টি করছে, তাদের পাতানো ষড়যন্ত্রের জালে পড়া কি মুসলমানের জন্য সঠিক হবে ?
তারাবীহতে কুরআন খতম করার হুকুম
তারাবীহর নামাযে একবার কুরআন খতম করা সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা। তাই মানুষের অলসতার কারণে কুরআন খতম করা থেকে বিরত থাকা যাবে না মর্মেই অধিকাংশ ফুকাহার মত। (দুররে মুখতার ও শামী : ২/৪৯৭)
অনেক ফকীহর মতে (আমাদের যুগে) মুসল্লিদের অবস্থা বিবেচনা করে কেরাত পড়া উত্তম। তাই ইমাম ওই পরিমাণ কেরাত পড়বে, যাতে মুসল্লিরা বিরক্ত না হয়, এবং তাদের জন্য কষ্টকর না হয়। কারণ দীর্ঘ কেরাত থেকে জামাআতের লোকসংখ্যা বাড়ানো উত্তম। (বাদায়ে: ১/৬৪৬)
আল্লামা তাকী উসমানী দা.বা. লিখেছেন, এটা একদম অপারগ অবস্থার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমাদের যুগে এমন অপারগতা নেই, যার ফলে এই সুন্নাত বর্জন করতে হবে। বরং বর্তমানে হাফেজের সংখ্যাও অনেক আর সব মসজিদেই কুরআন খতম করা হয়। মুসল্লীরাও আগ্রহ-উদ্দীপনার সাথে খতমে তারাবীহতে অংশগ্রহণ করে কুরআন শুনে থাকে। (ফাতাওয়ায়ে উসমানী: ১/৪৬৭)
অনেকে বলেন, ২৭তম রাতে খতম করা মুস্তাহাব । কারণ এতে শবে কদর পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। (শামী: ২/৪৯৭) এমনিভাবে অন্য বেজোড় রাতেও খতম করা যাবে। আবু হানীফা র. থেকে বর্ণিত- প্রতি রাকাতে দশ আয়াত করে পড়বে। এতে কুরআনও খতম হবে যা সুন্নাত, আবার লোকদের জন্য কষ্টকরও হবে না। (শামী: ২/৪৯৭) খতম শেষ হওয়ার পর বাকি রাতগুলোতেও তারাবীহ পড়তে হবে। এতে যে কোনো কেরাত পড়া যাবে। (ফাতহুল কদীর : ১/৬৪৬, বাদায়ে: ১/৬৪৬)
তারাবীহর নামাযের সময়
অধিকাংশ ফকীহর মতে তারাবীহর সময় হলো ইশার পরে বিতরের আগে ফজর পর্যন্ত। এটা সাহাবাদের আমল দ্বারা প্রমাণিত। ইশা ও বিতরের পরে যদি তারাবীহ পড়া হয় তাহলে সহীহ মতানুসারে তারাবীহ হয়ে যাবে। যদি মাগরিবের পরে ইশার আগে তারাবীহ আদায় করা হয় তাহলে অধিকাংশ ফকীহর মতে তা যথেষ্ট হবে না। অবশ্য কিছু হানাফী আলেমের মতে তা যথেষ্ট হবে। হানাফীদের মতে তারাবীহ রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বা অর্ধেক পর্যন্ত বিলম্ব করা মুস্তাহাব। (শামী: ২/৪৯৩-৯৪ যাকারিয়া, মওসুআতুল ফিকহিয়্যা: ২৭/১৪৭-৪৮)
তারাবীহর কাযা
যদি কারো তারাবীহ ছুটে যায় তাহলে সহীহ মতানুসারে তা কাযা করতে হবে না। তবে কেউ যদি কাযা আদায় করে, তাহলে তা নফল হবে তারাবীহ হবে না। অনেকের মতে, কেউ যদি সময়ের মধ্যে তারাবীহ পড়তে না পারে তাহলে সে একাকী তা কাযা করবে, আরেক তারাবীহর সময় হওয়ার আগে। কেউ কেউ বলেন, রমযান মাস অতিবাহিত হওয়ার আগ পর্যন্ত কাযা করতে পারবে। (রদ্দুল মুহতার: ২/৪৯৫, মওসুআ: ২৭/১৪৯)
তারবীহা (চার রাকাত পরপর বিশ্রাম)
তারবীহা তথা চার রাকাত পরপর বিশ্রাম করা মুস্তাহাব। অনেকে এটাকে সুন্নাতও বলেছেন। চার রাকাত পড়তে যতটুকু সময় লাগে ততক্ষণ বিশ্রাম করা উত্তম। চুপ থাকা, তেলাওয়াত করা, তাসবীহ পাঠ বা একাকী নামাযও পড়া যাবে। উচ্চস্বরে কিছু পড়া যাবে না। সম্মিলিতভাবে দুআ করা যাবে না। এ সময়ের জন্য কোনো দুআকে নির্দিষ্ট করা যাবে না। কোনো দুআর উপর বারংবার পড়তে বলা বা পীড়াপীড়ি করাও উচিত নয়। সবাই নিজের ইচ্ছামতো আমল বা দুআ করবে। (দুররে মুখতার ও শামী : ২/৪৯৬-৯৭, বাদায়ে: ১/৬৪৮, মওসুআ: ২৭/১৪৪)
নফল নামাযের জামাআত
তারাবীহ, ইস্তিসকা ও কুসুফের নামাযের জন্য জামাআত বৈধ। অন্যান্য নফল নামাযের জামাআত যদি تداعي ডাকাডাকির সাথে হয় তাহলে তা মাকরুহে তাহরীমী। চাই এনামায রমযানে পড়া হোক বা অন্য সময়ে হোক। এটাই ফুকাহাদের অভিমত। বাদায়েতে আছে-
اذا صلوا التراويح ثم ارادواأن يصلوها ثانيا يصلون فرادي لا بجماعة لان الثانية تطوع مطلق، والتطوع المطلق بجماعة مكروه.
অর্থাৎ তারাবীহর নামায পড়ার পর আবার পড়তে চাইলে একাকী পড়তে হবে। জামাআতের সাথে নয়। কারণ দ্বিতীয়টি নফল আর নফল নামায জামাআতের সাথে পড়া মাকরুহ। (খ.১ পৃ.২৪০) বাহরুর রায়েকে আছে-
ولوصلوا التراويح ثم ارادوا أن يصلوها ثانيا يصلون فرادي.
তারাবীহর নামায কেউ দ্বিতীয়বার পড়তে চাইলে সে যেন একাকী পড়ে।
‘কিয়ামে রমযান’-এর মিসদাক
অনেকের মতে, হাদীসে উল্লিখিত কিয়ামে রমযান দ্বারা তারাবীহ উদ্দেশ্য নয়; বরং যে কোনো নফল নামাযই কিয়ামে রমযান। সুতরাং রমযানে নফল নামাযের জামাআত করা যাবে। এই মতটি সঠিক নয়। ফুকাহা ও মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় কিয়ামে রমযান দ্বারা তারাবীহই উদ্দেশ্য।
খতম তারাবীহ পড়িয়ে বিনিময় গ্রহণ করা
বর্তমান যুগে তারাবীহতে কুরআন খতম করে বিনিময় নেওয়ার গর্হিত প্রথা চালু হয়েছে। হাফেজ সাহেবরা কুরআনকে উপার্জনের মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। নিজেদের এলাকা ছেড়ে যেখানে টাকা বেশি পাওয়া যায় সেখানে চলে যায়। যা অত্যন্ত দু:খজনক।
যারা কুরআনকে উপার্জনের মাধ্যম বানায় তাদের ব্যাপারে কুরআন-হাদীসে কঠোর নিন্দা ও কঠিন হুঁশিয়ারি এসেছে। এক্ষেত্রে হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত হলো- আল্লাহর আনুগত্য বা ইবাদতমূলক কোনো কাজের পারিশ্রমিক গ্রহণ করা যাবে না। তবে দীনী স্বার্থে পরবর্তী ফকীহগণ যে গুলোর উপর দীন টিকে থাকা নির্ভর করে এমন কয়েকটি বিষয়কে এর ব্যতিক্রম সাব্যস্ত করেছেন। যেমন-তা‘লীম তথা দীনী শিক্ষা প্রদান, ইমামতি,আযান দেওয়া প্রভৃতি। কারণ পারিশ্রমিক ছাড়া কারো পক্ষে বেশিদিন এসব কাজে লেগে থাকা সম্ভব নয়। ফলে সব সময় এসব কাজের জন্য লোক পাওয়া যাবে না। এতে দীনের অনেক বড় ক্ষতি হবে। তাই প্রয়োজনের ভিত্তিতে এসব ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক গ্রহণকে বৈধ বলা হয়েছে। (দুররে মুখতার:৯/৮৬)
কিন্তু যেখানে এমন শরয়ী প্রয়োজন নেই সেখানে পারিশ্রমিক নেওয়া বৈধ হবে না। যেমন কুরআন তেলাওয়াত করে এবং ঈসালে সওয়াব করে টাকা নেওয়াকে ফুকাহারা নাজায়েয বলেছেন। (শামী:৯/৭৭-৭৮)
তেমনি তারাবীহতে কুরআন খতম করা দীনী কোনো প্রয়োজন নয়। এটি সুন্নত মাত্র, তাই কোথাও যদি হাফেয পাওয়া না যায়, সেখানে সূরা তারাবীহ পড়ে নিলেই যথেষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং শুধু কুরআন খতমের জন্য কুরআন বিক্রি করার অনুমতি ও বৈধতা কীভাবে হতে পারে ?
أجرة علي الطاعة (ইবাদতের বিনিময় গ্রহণ)-এ মাসআলার উপর ভিত্তি করে বর্তমান সময়ের মুফতীগণ খতম তারাবীহ পড়িয়ে বিনিময় গ্রহণ ও বিনিময় প্রদানকে নাজায়েয বলেছেন। চাই এটা চুক্তিভিত্তিক হোক বা প্রচলন হিসাবে হোক। উভয় অবস্থায় হারাম। তাই কোথাও ফী-সাবিলিল্লাহ পড়ানোর মতো হাফেজ পাওয়া না গেলে সূরা তারাবীহ পড়ে নিবে।
কোনো হাফেজ যদি স্বেচ্ছায় ফী-সাবিলিল্লাহ পড়ায় আর তার টাকা নেওয়ার ইচ্ছা না থাকে, তারপরও কোনো মুসল্লি হাদিয়াস্বরূপ তাকে কিছু দেয় তাহলে তা গ্রহণ করার অবকাশ আছে। তবে শর্ত হলো- সেখানে এধরণের কিছু দেওয়ার প্রথা না থাকতে হবে।
খতম তারাবীহর বিনিময় নাজায়েয হওয়ার দলিল
১. কুরআন:- ولاتشتروا بآياتي ثمنا قليلا.
‘তোমরা আমার আয়াতকে (পার্থিব) সামান্য বস্তুর বিনিময়ে বিক্রি করো না। (সূরা বাকারা:৪১)
২. হাদীস:- اقرءوا القرآن ولا تأكلوابه
‘তোমরা কুরআন পড়ো; কিন্তু এর মাধ্যমে উপার্জন করো না’। (নাসবুর রায়া:৪/৩২৬)
ফিকহের বহু কিতাবে এ বিষয়টি উদ্বৃত হয়েছে। কয়েকটি সূত্র উল্লেখ করছি।
৩. রদ্দুল মুহতার:৯/৭৬-৭৭ যাকারিয়া।
৪. আলমগীরী:৪/৪৪৮-যাকারিয়া।
৫. আল ফিকহ আলাল মাযাহিবিল আরবা‘আ : ৩/১৮
৬. তাবয়ীনুল হাকায়েক: ৬/১১৭
৭. হাশিয়ায়ে তাহতবী: ৪/৩০
৮. ফাতহুল কাদীর: ৯/৯৮-৯৯
৯. ফাতওয়া উসমানী : ১/৫০৪-৫-৬
১০. ইমদাদুল ফাতাওয়া:১/৪৭৪
১১. ইমদাদুল আহকাম : ১/৬৫৪-৬৬৪
১২. ফাতাওয়া রহীমিয়্যা:৬/২৪৫
১৩. ফাতাওয়া মাহমুদিয়া:১১/৪০৪
১৪. কিফায়াতুল মুফতী:২/৪১-৩/৪০৯
১৫. আহসানুল ফাতাওয়অ: ৩/৫১৪
১৬. নেযামুল ফাতাওয়া : ৬/৮৩-৮৫
১৭. ফাতাওয়া রশীদিয়া: ৩৯১।
যাতায়াত ভাড়া ও খাওয়ার খরচ
কোনো হাফেজ সাহেব যদি আসা-যাওয়া করে পড়ায় তাহলে তার যাতায়াত খরচ দেওয়া যাবে। এমনিভাবে খাওয়া-দাওয়ার জন্যও কিছু দেয়া যাবে। তবে উভয় ক্ষেত্রেই খরচটা যুক্তিসঙ্গত ও প্রয়োজনমাফিক হতে হবে। অন্যথায় (অতিরিক্ত দিলে) এটাও নাজায়েয হয়ে যাবে।
একটি হীলা বা কৌশল: নাজায়েয বিনিময় গ্রহণ থেকে বাঁচতে অনেক জায়গায় একটি হীলা অবলম্বন করা হয়। তা হলো, হাফেজ সাহেবকে নায়েবে ইমাম বানিয়ে তাকে ইমামতির বেতন দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে হাফেজ সাহেব ২/৩ ওয়াক্ত নামায পড়ান। এমন হীলা অবলম্বন বৈধ। তবে শর্ত হলো, শুরুতেই তার ইমামতির বেতন নির্ধারণ করতে হবে, আর তা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত হতে হবে। অন্যথায় এটাও খতমের বিনিময় হয়ে যাবে। (রহীমিয়া: ৬/২৩৫, মাহমুদিয়া: ২৫/২০৯, নেযামূল ফাতাওয়া: ৬/৮২-৮৩, কিফায়াতুল মুফতী: ৩/৪১০-দারুল এশা‘আত,করাচী)
শেষ কথা- রমযান মাসের গুরুত্বপূর্ণ আমল তারাবীহর নামায। ছাওয়াব লাভ ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের সুযোগ হয় তারাবীহর নামায আদায়ের মাধ্যমে। তাই সবার উচিত যথাযথভাবে তারাবীহ আদায় করে এই সুযোগ কাজে লাগানো। তারাবীহ হতে হবে রাসূল স. ও সাহাবায়ে কিরামের অনুসরণে এবং ফকীহদের নির্দেশিত পদ্ধতিতে। বিশেষ করে পুরো উম্মতের ঐক্যমতপূর্ণ আমল বিশ রাকাত তারাবীহকে আট রাকাত বলে অপপ্রচার করে নিজের ও অন্যদের আমল নষ্ট করা সম্পূর্ণ অনুচিত। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সীরাতে মুস্তাকীম তথা সরল-সঠিক পথের উপর থাকার তাওফীক দান করুন। আমীন ॥
Leave Your Comments