নাস্তিকদের অপ-বিজ্ঞানযাত্রা

নাস্তিকদের অপ-বিজ্ঞানযাত্রা
.
‘বিবর্তন নিয়ে আরিফ আজাদের মিথ্যাচার’- শিরোনামে লেখা দেখলাম বিজ্ঞান যাত্রা নামক ফেইসবুক পেজে। ভাবলাম দেখি আরিফ আজাদ কি এমন মিথ্যাচার করেছে যার জন্য এমন শিরোনামে নোট প্রকাশ করে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।
.
পোস্টার শুরুতেই কোরান এবং হাদিস নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে যার সাথে শিরোনামের কোনো মিল নেই। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, বিজ্ঞানের আবরণে ইসলামকে কটাক্ষ করা। যাই হোক এইগুলা যেহেতু ওদের রুটি রুজির উপকরণ তাই এই প্রসঙ্গ না তোলাই ভালো।
.
লেখক দাবি করেছেন, আরিফ আজাদের ৪০০০০ ফলোয়ারের সবাই ধর্মান্ধ ও বিজ্ঞান বিষয়ে অজ্ঞ। প্রথমেই লেখক ভুল করে বসেছে, আমি নিজেও তার একজন ফলোয়ার যে লেখকের চেয়ে শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিজ্ঞান গবেষণা ও অধ্যায়নে বিন্দুমাত্র পিছিয়ে আছে বলে মনে করে না!!!!
.
লেখক বলেছে, বিজ্ঞানের কোনো আলোচনায় ধর্মকে টানা উচিত না। খুবই ভালো প্রস্তাব, কিন্তু সমস্যা করেছে তো আপনাদের মতো ধূর্ত বিজ্ঞান ব্যবসায়ীরা যারা বিজ্ঞান দিয়ে ধর্মকে ভুল প্রমানে ব্যস্ত, তাই বাধ্য হয়ে আরিফ আজাদরা ধর্মের মধ্যে বিজ্ঞান টেনে নিয়ে আসে।
.
এর ঠিক পরেই লেখক বিশাল এক অলঙ্ঘনীয় শপথ করে বিজ্ঞান দিয়ে সব কিছু চুরমার করার ঘোষণা দিলেন।
.
প্রথমেই শিরোনাম, ‘রেফারেন্স নিয়ে ভাঁওতাবাজি’
.
খুবই অন্যায় কথা, রেফারেন্স নিয়ে ভাওতাবাজি ? এটা মানা যায় না। আমি নিজেও বিজ্ঞান গবেষণা করি, তাই রেফারেন্সে গরমিল হলে মাথা গরম হয়ে যায়। লেখক বলেছে আরিফ আজাদের দেয়া রেফারেন্স একটাও পিয়ার রিভিউইড সায়েন্টিফিক জার্নাল নয়!!! দেখে এমন হাসি পেলো ভাবলাম, এরা দেখি অনেক বিজ্ঞান করে। আরিফ আজাদ কি তার লেখা কোনো বিজ্ঞান সাময়িকীতে ছাপানোর জন্য লিখেছে যে সে সরাসরি সাইন্টিফিক জার্নাল থেকে রেফারেন্স দিবে? এইটা হলো লেখকের একটা ধূর্তামি। সাধারন জনতাকে এই সমস্ত হেভি হেভি টার্ম ইউজ করে ভড়কিয়ে দেয়া আর দেখিয়ে দেয়া এই দেখো আমরা অনেক বিজ্ঞান করি।
.
যাইহোক, তারপরেও লেখকের দেয়া স্ক্রিনশট থেকে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার লিংকে ঢুকলাম, ‘Breakthrough study overturns theory of ‘junk DNA’ in genome’ এই শিরোনামে লেখা রিপোর্টে বিস্তারিত আছে, কোথাকার বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে কাজ করেছে, কোন জার্নালে ছাপিয়েছে সব বিস্তারিত। কারো দরকার হলে ‘গার্ডিয়ান’ পত্রিকার লিংক থেকে সব তথ্য জেনে নিতে পারবে। এতো স্বচ্ছ আর নিখুঁত একটা রেফারেন্স দেয়ার পরেও লেখক কেনো এতো বিজ্ঞান করলেন সেটা বুঝতে পেরেছেন আপনারা? রেফারেন্স নিয়ে অভিযোগের একটা খণ্ডন করলাম বাকি গুলা একই পদ্ধতিতে আপনারা যাচাই করে নিতে পারেন।
.
এরপরে আরিফ আজাদের জাঙ্ক ডিএনএ সম্পর্কিত স্ক্রিন শট দিলেন, যেখানে আরিফ আজাদ লিখেছে প্রথমে বিজ্ঞানীরা মনে করতো ডিএনএ’র ৯৮% কোনো কাজে আসেনা কিন্তু এখন এর কিছু কিছু ফাঙ্কশন জানা যাচ্ছে। কথাটা পুরাই সঠিক।
.
লেখক সাহেব হটাৎ রেগে গিয়ে জাঙ্ক ডিএনএ কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি ইত্যাদি অপ্রাসঙ্গিক বয়ান দিতে শুরু করলেন, এক পর্যায়ে নেচার ম্যাগাজিনের এক লিংক দিয়ে, বলে দিলেন, জাঙ্ক ডিএনএ-এর অন্যতম কাজ হলো, এটি প্রাণীদের বিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখে।
.
ভাইরে, লিংকে গিয়ে পেপারটা পড়তেই লেখকের জালিয়াতি প্রকাশ পেয়ে গেলো। প্রথমত যদিও এটা একটা নেচার পেপার, কিন্তু এটা রিভিউ পেপার, যার মানে হলো এখানে সব প্রপোজিশন, অনুমান, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সম্পর্কে তাত্ত্বিক কথা বার্তায় ভরপুর, এক্সপেরিমেন্টাল এভিডেন্স পাওয়ার আগে যার কোনো মূল্য নাই। যাইহোক, এই পেপারে বলা হয়েছে জাঙ্ক ডিএনএ দ্বারা কিভাবে স্ট্রেসফুল কন্ডিশনে এনিম্যাল-প্লান্ট খাপ খাইয়ে চলতে পারে, এপি জেনেটিক্স কিভাবে এইসব আপাত দৃষ্টিতে অকর্মন্য ডিএনএ কে কাজে লাগিয়ে মিউটেশন, ডাইভারসিটি ইত্যাদি তৈরী করে।
.
লেখক সন্তপর্নে এড়িয়ে গেছেন এই পেপারের লেখকদ্বয় এভোলুশনে এই জাঙ্ক ডিএনএ’র ভূমিকা বলতে ‘মাইক্রো ইভোল্যুশন’ বুঝিয়েছে, কোথাও ডারউইনজমের ‘ম্যাক্রো এভোল্যুশন’ বুঝান নি। লেখক মনে হয় অতিরিক্ত বিজ্ঞান করতে গিয়ে বেমালুম ভুলে গেছেন যে ডারউইনের ইভোল্যুশন থিওরির সাথে ফান্ডামেন্টালী দ্বিমত পোষণ করতো যেই জাঙ্ক ডিএনএ নিয়ে লাফাইতেছেন তার উদ্ভাবক নোবেল জয়ী বারবারা ম্যাক ক্লিনটক!! অন্যের নাম মিথ্যাচার খুঁজতে গিয়ে আপনার নিজের চূড়ান্ত জালিয়াতি প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে!!!
.
‘পূর্বপুরুষ নিয়ে তথ্যগত ভুল’
.
এই অংশে লেখক বলেছে, মানুষ, শিম্পাঞ্জি, বোনোবো, ওরাং ওটান, আর গরিলা প্রজাতিগুলো একই পূর্বপুরুষ-প্রজাতি থেকে এসেছে। রেফারেন্স হিসাবে এই বার অবশ্য উনি নেচার বা সাইন্স ম্যাগাজিন দেন নি। এতো বড় আবিষ্কারের খবর তো নেচার, সাইন্স, সেল ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়ার কথা!!! শিম্পাঞ্জি আর মানুষের পূর্বপুরুষ এক আদি পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে বলে যে দাবি লেখক করেছে তা কিন্তু ওই পেপারে নেই। ওখানে আছে মানুষের সাথে শিম্পাঞ্জির জিনোমে ২৩% অমিল!!! কিছু দিন আগের গবেষণায় যে পার্থক্য ৪০% ছিলো আর ৫-৬ বছরের ব্যবধানে সেটা কমে গিয়ে ২৩% এ নামলো!!! লেখক আপনি সমজদার হলে ঠিকই বুঝবেন এই ধরণের গবেষণা কতটা ‘ফ্যাক্টর’ ডিপেন্ডেন্ট আর হাইপোথেটিক। এইগুলা দিয়ে সাধারণ মানুষদের ধোঁকা দেয়া খুব সহজ।
.
সাধারণ একটা কথা মনে রাখেন, ডিএনএ’র মিল থাকলেই সবকিছু হয়ে যায় না। ডিএনএ’ই শেষ কথা নয়, ডিএনএ থেকে আর.এন.এ হয়, তার পরে প্রোটিন তৈরী হয়। প্রোটিন হলো সব কিছুর মুলে। অনেকেই জানে না, একই জিন (পার্ট অফ ডিএনএ) থেকে বিভিন্ন ধরণের আর.এন.এ. তৈরী হতে পারে, একই আর.এন.এ. বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন তৈরী করতে পারে, একই প্রোটিনের বিভিন্ন আইসোফর্ম (দেখতে একই কিন্তু কাজ আলাদা) থাকতে পারে। তার মানে ডিএনএ’র মিল হলেই সবকিছু হয়ে যায় না। ব্যাক্টেরিয়ার ডিএনএ আর আমাদের ডিএনএ একই জিনিস দিয়ে তৈরী, তাই বলে ব্যাক্টেরিয়ার ডিএনএ যে কাজ আমাদের ডিএনএ কি একই কাজ করে? অবশ্যই নয়। প্রাণীদের ডিএনএ র সাদৃশ্য থাকতে পারে এবং থাকাটা স্বাভাবিক, মূল পার্থক্য হলো তাদের কাজে এবং এখানেই সবাই স্বাতন্ত্র ও আলাদা।
.
শেষের কথা দিয়ে শেষ করছি, উনি শেষে বলেছেন ‘আপনার যদি বিবর্তন তত্ত্বকে ভুল মনে হয়, আপনি ধুরন্ধর ধর্মব্যবসায়ীর মতো অযাচিতভাবে ধর্মকে না টেনে আপনার মতের পক্ষে যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করে একটি গবেষণাপত্র লিখে ফেলুন, তারপর সেটি পাঠিয়ে দিন কোনো বৈজ্ঞানিক জার্নালে। আপনার যুক্তি-প্রমাণ যদি নিখাদ হয়ে থাকে, যে কোনো ভালো জার্নাল অবশ্যই প্রকাশ করবে আপনার গবেষণাপত্র।’
.
লেখক সাপ, এতক্ষন ধরে আরিফ আজাদের নামে ‘মিথ্যাচার’ শিরোনামে প্রবন্ধ ঝাড়লেন এইটা কোন বৈজ্ঞানিক জার্নালে ছাপাইছেন ? আমরা যে ডারউইনিজম মানতেছিনা, এইটা নিয়ে একখান যুক্তি, প্রমানসহ প্রবন্ধ নেচার সায়েন্স ছাপায় দেন , আপনারে নিষেধ করছে কে? বায়োলজি যে তাত্ত্বিক যুক্তি প্রমানের বিষয় না এইটা বুঝার ক্ষমতাও এই মাত্রাতিরিক্ত ‘বিজ্ঞান করা’ লেখকের মাথায় নাই।
.
পাদটীকা:
.
সত্যিকার অর্থে জানার ইচ্ছা থাকলে এই সংক্রান্ত যেকোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে, বিস্তারিত জানতে চাইলে ইনবক্সে।
.
বৈজ্ঞানিকভাবে তর্ক করতে চাইলে কন্ডিশন: বায়োলজি বিষয়ে বিশেষ করে মলিকুলার বায়োলজি বিষয়ে ন্যূনতম অনার্স/মাস্টার্স।
.
কলাভবনে পড়ুয়া বা ইন্টারমিডিয়েট সাইন্স ছিলো, এই ধরণের পাব্লিকেরা সাইন্টিফিক আর্গুমেন্ট করার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত।
==========================
লেখকঃ সাইফুর রাহমান

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *