নাস্তিক-মুক্তমনা লেখক ‘S.P.’ এর ইসলামবিদ্বেষী পোস্টের জবাব (প্রথম পর্ব)
.
বাংলাদেশের একজন নাস্তিক (নামের অদ্যাক্ষর S.P.) ইদানিং গল্প বলা স্টাইলে নাস্তিকতার প্রচার শুরু করেছে। ইসলামের বিভিন্ন অসঙ্গতি(!) প্রমাণের জন্য বিভিন্ন অপযুক্তি প্রদান করে সে নাস্তিকমহলে ব্যাপক বাহবা কুড়াচ্ছে। তার একটা ফেসবুক পোস্টের লিঙ্ক এক ভাই মেসেজ করে পাঠালেন। পোস্টটা পড়ে বরাবরের মতই এক গাদা অপব্যাখ্যা, মূর্খতা ও মিথ্যাচার দেখলাম। (S.P. অদ্যাক্ষরবিশিষ্ট সেই নাস্তিকের পূর্ণ নাম উল্লেখ করে তার আর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করলাম না। যারা আগেই তার পোস্ট পড়েছেন, তারা এমনিতেই চিনতে পারবেন।)
.
বরাবরের মতই সে সুরা তাওবার ৫নং আয়াত উল্লেখ করে ইসলামকে রক্তপিপাসু ধর্ম প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন।
সে লিখেছে –
// ‘মুশরিকদের যেখানে পাও সেখানেই হত্যা করবে’ –তাই তো? তাহলে এবার তুমিই বলো, এই আক্রমণের উশকানিটা কি আত্মরক্ষার্থে হয়েছিল? যে চারটি মাসে হত্যা রক্তপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেগুলো অতিবাহিত হয়ে গেলে মুসলমানদের বলা হচ্ছে মুশরিকদের জন্য গোপনে ওঁত পেতে থাকো আক্রমন করা জন্য। এবং বলা হচ্ছে, এই চারটি মাস মুশরিকরা স্বাধীনভাবে জমিনে ঘুরাঘুরি করুক, তারপরই তাদের ধরে ধরে জবাই করা হবে। তুমি কি এটাকে আত্মরক্ষা বলবে? কিংবা ‘যুদ্ধ’ তাও কি বলতে পারবে? তুমি কখনো শুনেছো যুদ্ধে আঁততায়ীর মত পিছন থেকে আঘাত করা হয়? এটা যুদ্ধের নিয়মের বিরুদ্ধে। //
.
আগের আর পরের আয়াতকে উপেক্ষা করে মনগড়া ‘তাফসির’(!) করে কুরআনকে বর্বর প্রমাণের পুরোনো নাস্তিকীয় প্রচেষ্টা। কুরআন খুলে সুরা তাওবার শুরুর আয়াতগুলো টানা পড়ে যান। আলোচ্য আয়াতের আগের আয়াত অর্থাৎ সুরা তাওবার ৪নং আয়াতেই উল্লেখ করা আছে যে, যেসব মুশরিক চুক্তি রক্ষা করেছে, এই নির্দেশ তাদের জন্য নয়।
.
এই আয়াতটি স্রেফ তাদের জন্য নাজিল হয়েছে যারা চুক্তি ভেঙেছিল। যে কোন একটি তাফসির গ্রন্থ থেকেই যদি এ আয়াতের আলোচনা দেখা হয় তাহলে উল্লেখ পাওয়া যাবে যে, ৬ষ্ঠ হিজরীতে যে হুদাইবিয়া সন্ধি হয়েছিল, তার ২ বছরের মধ্যে মুশরিকরা এ চুক্তি ভঙ্গ করে। হুদাইবিয়ার সন্ধিতে বলা ছিল যে কোন গোত্র চাইলে যে কোন পক্ষের (মুসলিম অথবা কুরাইশ) সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ হতে পারবে। এই ধারা অনুযায়ী বনু বকর গোত্র কুরাইশদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং বনু খুযাআ গোত্র মুসলিমদের সঙ্গে মৈত্রীতে আবদ্ধ হয়।
কিন্তু ২ বছর যেতে না যেতেই ৮ম হিজরী সালে শক্তিশালী বনু বকর গোত্র দুর্বল বনু খুযাআকে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে বনু খুযাআর অনেক মানুষ নিহত হয়। কুরাইশরা অস্ত্র দিয়ে এই কাজে সাহায্য করে এমনকি কুরাইশ যোদ্ধারাও এতে অংশ নেয়। এই ঘৃণ্য আক্রমণ ছিল রাতের বেলায় এবং তারা আশা করেছিল এই কারণে এর বিস্তারিত বিবরণ বাইরে ছড়াবে না।
এই প্রেক্ষিতে খুযাআ গোত্রের আমর বিন সালিম মদীনায় এসে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কাছে এসে এই জুলুমের বর্ণণা দেন এবং বলেন, “… কুরাইশগণ অবশ্যই আপনার প্রতিজ্ঞার বিরোধিতা করেছে এবং আপনার পরিপক্ক অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। তারা কোদা নামক স্থানে গোপন অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং মনে করেছে আমি সাহায্যের জন্য কাউকে আহ্বান করব না। …তারা রাত্রিবেলায় ওয়াতিরে আক্রমণ চালিয়েছে এবং আমাদেরকে রুকু ও সিজদাহরত অবস্থায় হত্যা করেছে। …” [১]
.
বনু খুযাআ যেহেতু হুদাইবিয়ার সন্ধি অনুযায়ী মুসলিমদের মিত্র গোত্র ছিল, কাজেই এর প্রতিকারের দায়িত্ব ছিল মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর, বনু খুযাআকে সাহায্য করা অপরিহার্য ছিল। মুসলিমরা সন্ধিচুক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ও শান্তির সাথে পালন করেছিল। অথচ তার জবাব কুরাইশরা দিয়েছিল রাতের বেলা অতর্কিতে আক্রমণ করে নামাজরত মানুষকে হত্যা করে।
নাস্তিক-মুক্তমনাগণের কাছে কিন্তু এগুলো মোটেও ‘অমানবিক’ বা ‘বর্বর’ কাজ বলে অভিহিত হয় না। বরং এই অমানবিক হত্যাকাণ্ডের কারণে যে পদক্ষেপের নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন, মুক্তমনাদের কাছে সেটাকে ‘বর্বর’ বলে মনে হয়। যেন চোর-ডাকাতদের কর্মকাণ্ড ‘মানবিক’ আর আর তাদের অপকর্মের প্রতিকারকারী পুলিশেরা ‘বর্বর’। সুবহানাল্লাহ, নাস্তিক-মুক্তমনাদের এ মানসিকতা দ্বারা বোঝা যাচ্ছে যে কারা আসলে ‘বর্বর’।
.
সুরা তাওবার ৫নং আয়াতে এমন কথা পাওয়া যাচ্ছে না যে ‘গোপন স্থান থেকে মুশরিকদের হামলা করতে হবে’। অথচ নাস্তিক মহোদয় এমন দাবিই করেছে। ঘাটি মানে কি গোপন স্থান?! এখানে কোথায় পেছন থেকে আক্রমণ করতে বলা হল?! আর কোথায়ই বা যুদ্ধের নিয়ম লঙ্ঘণ করা হল? যুদ্ধের নিয়ম আসলে কে লঙ্ঘণ করেছিল – কুরাইশরা, নাকি মুসলিমরা?? বাংলার নাস্তিক-মুক্তমনাকূলের অসামান্য যুক্তি অনুযায়ীঃ রাতের আঁধারে আক্রমণ করে মানুষ হত্যাকারী কুরাইশরা ‘মজলুম’, আর এই বর্বরতা প্রতিরোধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী মুসলিমরা ‘জালিম’। এই হচ্ছে নাস্তিকীয় ‘প্রজ্ঞা’। এমনকি ঐ আয়াতের পরের আয়াতে অর্থাৎ সুরা তাওবার ৬নং আয়াতেই এটাও বলা হয়েছে যেসব মুশরিক আশ্রয় চাইবে তাদেরকে নিরাপদ স্থানে পোঁছে দিতে হবে। ৭নং আয়াতে বলা হয়েছে যতক্ষণ তারা চুক্তি ভঙ্গ না করে, মুসলিমরাও যেন তাদের প্রতি সরল থাকে। এগুলো কিন্তু ভুলেও নাস্তিক মহাশয়ের চোখে পড়বে না। কিংবা চোখে পড়লেও তিনি এ নিয়ে টুঁ শব্দ করবেন না।
উপরন্তু ঘাড়ের রগ ফুলিয়ে তর্ক করে হয়তো বলে বসবে (অথবা পোস্ট দেবে): “মুমিনরা এখানে তাফসির আর সিরাহ থেকে রেফারেন্স দিছে! কুরআনে কোথায় চুক্তি আর চুক্তি ভঙ্গের কথা? এখানে সব অমুসলিমকে হত্যা করতে বলছে!!”
.
তার এহেন কথায় হয়তো কোন কোন অন্ধ নাস্তিক-মুক্তমনা যুদ্ধজয়ের আনন্দ পাবে, লাইক-কমেন্টে হয়তো তার পোস্ট ভাসিয়ে দেবে। কিন্তু কোন যুক্তিবান মানুষ তার এ কথার কোন মানে খুঁজে পাবে না। কেননা সুরা তাওবার ৫নং আয়াতটির আগের-পরের অনেকগুলো আয়াতে সুস্পষ্টভাবে চুক্তি ও এর চুক্তি ভঙ্গকারী মুশরিকদের কথা বলা আছে, যারা চুক্তি রক্ষা করেছে, তাদের প্রতি সরল থাকতে বলা হয়েছে (সুরা তাওবার ৪ ও ৭-১১নং আয়াত)।
.
মুমিন কিংবা যুক্তিবানের কাজ হচ্ছে কোন অভিযোগ দেখলে উৎস থেকে ব্যাপারটা যাচাই করে দেখা। আর অন্ধ নাস্তিক-ধর্মবিদ্বেষীর কাজ হচ্ছে প্রসঙ্গহীন ১-২টি উদ্ধৃতি দেখেই সেটাকে নিয়ে মেতে থাকা, সেটাকে তুলে ধরে নিজের মত অপব্যাখ্যা করে বিষোদগারে অনলাইন গরম করে নিজের মূর্খতাকেই প্রকাশ করা। আল্লাহ যথার্থই বলেছেনঃ
“অন্ধ ও চক্ষুষ্মান সমান নয়, আর (সমান নয়) যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং যারা কুকর্ম করে। তোমরা তো অল্পই অনুধাবন করে থাক।” [সুরা মু’মিন(গাফির), ৪০:৫৮]
.
সুরা তাওবার এই আয়াত নাজিল হয়েছিল যেই মুহাম্মাদ ﷺ এর উপর, তিনি কীভাবে আমল করেছেন? মক্কা বিজয় করে তিনি কা’বার নিকট গিয়ে বললেন—
“ওগো কুরাইশ জনগণ! তোমাদের কী ধারণা, তোমাদের সঙ্গে আমি কীরূপ ব্যবহার করব বলে তোমরা মনে করছ?”
সকলে বললঃ “খুব ভালো। আপনি সদয় ভাই এবং সদয় ভাইয়ের পুত্র।”
নবী করিম ﷺ বললেন, “তাহলে তোমরা জেনে রেখ যে, আমি তোমাদের সঙ্গে ঠিক সেরূপ কথাই বলছি যেমনটি ইউসুফ (আলাইহিস সালাম) তাঁর ভাইদের সঙ্গে বলেছিলেন যে – আজ তোমাদের জন্য কোন নিন্দা নেই। যাও, আজ তোমাদের সকলকে মুক্তি দেয়া হল।” [২]
.
অথচ মুহাম্মাদ ﷺ এবং তাঁর সাথীদের উপর এমন অত্যাচার করেছিল কুরাইশরা – তাঁদেরকে পূর্ণাঙ্গ বয়কট করেছিল, তাঁদের সাথে ব্যাবসা-বাণিজ্য, খাওয়া দাওয়া, বৈবাহিক সম্পর্ক বন্ধ করে দিয়েছিল, এমন অবস্থা হয়েছিল যে মুসলিমরা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হয়েছিল, তাঁদেরকে না খাইয়ে মারার জন্য কুরাইশরা খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী করে দিয়ে উপহাস করত, রাসুলকে ﷺ নামাজরত অবস্থায় উটের নাড়িভুঁড়ি চাপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছে, সাহাবিদেরকে কষ্ট দিয়ে হত্যা করেছে, মদীনায় হিজরত করে যাবার পরেও যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এমনকি হুমকি দিয়ে পত্র পর্যন্ত লিখেছে, নবী ﷺ কে মদীনায় পর্যন্ত হত্যা করবার অপচেষ্টা চালিয়েছে। [৩]
.
সেই মহাপাপীদেরকে মুহাম্মাদ ﷺ এভাবেই সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা করে মুক্তি দিয়েছিলেন। গুরুতর অপরাধী অল্প কয়েকজন বাদে কাউকে সামান্যতমও শাস্তি দেয়া হয়নি।পৃথিবীর ইতিহাসে এর তুলনা কোথায়?
.
নাস্তিক সাহেব তার সেই সেই ‘দুর্ধর্ষ’ পোস্টটিতে আরো লিখেছে –
//মদিনার প্রথম মসজিদের জায়গা বিনামূল্যে দান করেছিল ইহুদিরাই। এবার আয়াতের ভাষাটা খেয়াল করো, এখানে কি হামলা আক্রমণের সরাসরি আহ্বান জানানো হচ্ছে না শুধুমাত্র ইসলামের ধর্মের সাথে একমত না হওয়ার কারণে। কেবল মাত্র হযরত মুহাম্মদকে নবী বলে স্বীকার না করার কারণে।//
.
কী অবলীলায় মিথ্যা কথা বলেছে সে। আর অবলীলায় তাতে লাইক দিয়ে উৎসাহ জুগিয়েছে বাংলার নাস্তিক-মুক্তমনাকূল। মদীনায় প্রথম মসজিদ ছিল কুবা মসজিদ। এই মসজিদ ছিল বনু আমর ইবন আওফের পল্লীতে। সেখানে ‘কুবা’ নামক স্থানে এ মসজিদ স্থাপিত হয়। এলাকাটি ছিল বনু আমর ইবন আওফের। কোথাও উল্লেখ নেই যে ইহুদিরা এই মসজিদের জন্য জায়গা দিয়েছিল। [৪]
.
মদীনায় এরপর প্রতিষ্ঠা করা হয় মসজিদুন নববী। মসজিদের স্থানের মালিক ছিল ২জন অনাথ বালক। নবী ﷺ ন্যায্য মূল্যে স্থানটি ক্রয় করেন এবং মসজিদুন নববী নির্মাণ করেন। [৫]
এই মসজিদে নববীরও কোনো জায়গার মালিক ইহুদিরা ছিল না।
.
সেই ‘মহাজ্ঞানী’(!) নাস্তিকের “দুর্ধর্ষ”(?) সেই পোস্টটির জবাব এখনো শেষ হয়নি; আরো আসছে আগামী পর্বে (ইন শা আল্লাহ)।ইসলামের বিরুদ্ধে তার ‘অসামান্য’ (!) যুক্তিগুলোর আরো পোস্টমর্টেম অপেক্ষা করছে আগামী পর্বে। আল্লাহু মুসতা’আন।
.
= = = = = =
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার
#সত্যকথন
= = = = = =
[১] দেখুন- তাফসির মাআরিফুল কুরআন(সংক্ষিপ্ত), মুফতি শফি(র), সুরা তাওবার প্রথম ৬ আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৫৫৩; ‘আর রাহিকুল মাখতুম’, শফিউর রহমান মুবারকপুরী(র), তাওহিদ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৪৫২-৪৫৩
[২] ‘আর রাহিকুল মাখতুম’, শফিউর রহমান মুবারকপুরী(র), তাওহিদ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ৪৬৫
[৩] ‘আর রাহিকুল মাখতুম’, শফিউর রহমান মুবারকপুরী(র), তাওহিদ প্রকাশনী, ১৫১-১৬৯ এবং ২৩৮-২৩৯ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য
[৪] দেখুনঃ সীরাতুন্নবী(স)- ইবন হিশাম, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৬
http://life-in-saudiarabia.blogspot.com/…/7-unknown-facts-a…
http://www.arabnews.com/news/600996
[৫] আর রাহিকুল মাখতুম’, শফিউর রহমান মুবারকপুরী(র), তাওহিদ প্রকাশনী, পৃষ্ঠা ২২৮
Leave Your Comments