.
প্রসঙ্গ নবী(স) এর ইসরা ও মিরাজঃ ইসরার ঘটনার সত্যতা কতটুকু? মসজিদুল আকসা কি আসলেই সে সময়ে ছিল? [বাকি অংশ]
(লেখাটির পূর্বের অংশ দেখুন #সত্যকথন_১০২ এ। লিঙ্কঃ https://goo.gl/FCR4zq )
.
মুহাম্মাদ(স) যখন ইসরা ও মিরাজে গিয়েছেন, তখন সেখানে কেউ না থাকলেও এর কয়েক বছর পর খলিফা উমার(রা) যখন জেরুজালেমে যান, তখন কিন্তু সেখানে অনেক লোক ছিল। খলিফা উমার(রা) কর্তৃক বাইতুল মুকাদ্দাসে ঢোকার বিবরণের মধ্যেও এটা উল্লেখ আছে যে — তিনি একটি দরজা দিয়ে সেখানে প্রবেশ করেছিলেন। এবং এটা ছিল সেই দ্বার যে দ্বার দিয়ে মুহাম্মাদ ﷺ ইসরার রাতে সেখানে প্রবেশ করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। উমার(রা) এর বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময় সেখানে অনেক মানূষ ছিল, অনেক সাক্ষী ছিল। কাজেই সেখানে যে দ্বার বা দরজা ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ঐতিহাসিক ঘটনা অনেকেই লিপিবদ্ধ করেছেন। ইবন কাসির (র) এর বর্ণণা থেকেঃ
.
“…খলিফা উমার (রা) সম্মুখে অগ্রসর হয়ে বায়তুল মুকাদ্দাসের খ্রিষ্টানদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করলেন এবং শর্ত করলেন যে, তিন দিনের মধ্যে সকল রোমান নাগরিক বায়তুল মুকাদ্দাস ছেড়ে চলে যাবে। এরপর তিনি বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করলেন সেই দরজা দিয়ে, মি’রাজের রাতে রাসুলুল্লাহ ﷺ যে দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেছেন যে, বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের সময়ে তিনি তালবিয়া পাঠ করেছিলেন,ভেতরে গিয়ে দাউদ (আ)-এর মিহরাবের পার্শ্বে তাহিয়্যাতুল মসজিদ নামায আদায় করলেন।পরের দিন ফজরের নামায মুসলমানদেরকে সাথে নিয়ে জামাআতের সাথে আদায় করলেন। …এরপর তিনি ‘সাখরা’ বা বিশেষ পাথরের নিকট এলেন।কা’ব আল আহবার (র) থেকে তিনি ঐ স্থান সম্পর্কে জেনে নিয়েছিলেন। কা’ব (র) এই ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন যেন তিনি মসজিদটি ওই পাথরের পেছনে তৈরি করেন। হযরত উমার(রা) বললেন, ইয়াহূদী ধর্ম তো শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর বায়তুল মুকাদ্দাসের সম্মুখে মসজিদ নির্মাণ করলেন।এখন সেটি উমরী মসজিদ নামে পরিচিত। … ”
[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবন কাসির(র), ৭ম খণ্ড(ইসলামিক ফাউন্ডেশন), পৃষ্ঠা ১০৭-১০৮]
.
ইমাম আহমাদ(র) আরো বর্ণণা করেন যে উমার(রা) বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশের পর ঠিক সেখানেই নামায পড়েন, যেখানে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) নামায পড়েছিলেন।
[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবন কাসির(র), ৭ম খণ্ড(ইসলামিক ফাউন্ডেশন), পৃষ্ঠা ১১২]
.
উমার (রা) দ্বার দিয়ে প্রবেশ করেন, নামায আদায় করেন, এবং পরে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে—মসজিদ তৈরির আগেই সেখানে দ্বার ছিল। বিবরণ থেকে এটাও বোঝা যাচ্ছে যে, এই দ্বার হচ্ছে বাইতুল মুকাদ্দাস এলাকার প্রবেশদ্বার। বাইতুল মুকাদ্দাসের একটি মানচিত্রের ছবি দেখলে বিষয়টি আরো পরিষ্কার বোঝা যাবে। উমার(রা) এর প্রবেশদ্বার অন্য স্থানগুলো এতে চিহ্নিত করে দেখানো আছে।
[[মানচিত্র ও এর বিবরণ ১ম, ২য় ও ৩য় কমেন্টে উল্লেখ করা হল।]]
.
আসলে ঐ এলাকাটি সম্পর্কে স্থানীয়দের পরিষ্কার ধারনা রয়েছে।এই দ্বার ও মসজিদের খুঁটিনাটি তাদের জানা।এমনকি এখানে “বুরাক দ্বার” নামে একটি প্রবেশদ্বারও আছে[চিত্রে ৮ নং দ্বার] । এটি Western wall ও Wailing Wall নামেই পর্যটকদের কাছে বেশি পরিচিত।দ্বারটি বর্তমানে বন্ধ এবং স্থানীয়রা একে বুরাক দেয়াল নামে চেনেন। এই দ্বার ও এলাকাটির ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তারা মোটেও নাস্তিক ও খ্রিষ্টান মিশনারীদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হন না। এ ব্যাপারে ঐ সব সরলমনা মুসলিম বিভ্রান্ত হন যারা ফিলিস্তিন থেকে অনেক দূরে বাস করেন, যাদের এলাকাটি সম্পর্কে ধারনা নেই এবং ইসরার ইতিহাস সম্পর্কেও বিস্তারিত জ্ঞান নেই।
.
আমরা আরো একটি বিবরণ দেখতে পারিঃ
.
“…এরপর তিনি [আবু বকর (রা)] সেখান থেকে সোজা রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নিকট চলে আসলেন এবং বললেনঃ হে আল্লাহর নবী! আপনি কি এদের কাছে বলেছেন যে এই রাতে আপনি বায়তুল মুকাদ্দাস গিয়েছিলেন?
তিনি ﷺ বললেনঃ হ্যাঁ।
আবু বকর (রা) বললেনঃ হে আল্লাহর নবী! সে মসজিদটির বর্ণণা দিন তো; আমি সেখানে গিয়েছিলাম।
তখন নবী ﷺ বললেনঃ তখন বায়তুল মুকাদ্দাসকে আমার সামনে তুলে ধরা হল। আমি তার দিকে তাঁকিয়ে দেখতে লাগলাম।
এরপর রাসুলুল্লাহ ﷺ আবু বকর (রা) এর কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের বর্ণণা দিতে লাগলেন। আর আবু বকর (রা) প্রতিবারই বলতে লাগলেনঃ আপনি সত্যই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আপনি আল্লাহর রাসুল। …”
[সীরাতুন নবী(সা.), ইবন হিশাম(র), ২য় খণ্ড(ইসলামিক ফাউন্ডেশন) পৃষ্ঠা ৭৪]
.
এখানে দেখা যাচ্ছে যে আবু বকর (রা) পুর্বে বাইতুল মুকাদ্দাসে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার বর্ণণা তাঁর জানা ছিল। রাসুল ﷺ যে বর্ণণা দিয়েছিলেন, তার সঙ্গে আবু বকর(রা) এর দেখা বাইতুল মুকাদ্দাস হুবহু মিলে গিয়েছিল।যদি বর্ণণা না মিলত, তাহলে তো আবু বকর (রা) বুঝতেন যে মুহাম্মাদ ﷺ সত্য বলেননি। অথচ আদৌ এমন কিছু হয়নি, মুহাম্মাদ ﷺ এর সত্যবাদিতাই আবু বকর(রা) এর কাছে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।
.
যেসমস্ত নাস্তিক ও খ্রিষ্টান মিশনারী ইসরা ও মিরাজের ব্যাপারে মুহাম্মাদ(ﷺ)কে অপবাদ দেন, তাদের কি উচিত না এই বিবরণটি দেখা?
.
আরো একটি বিবরণ উল্লেখ করছিঃ
.
“…আমি (উম্মু হানি) বললামঃ হে আল্লাহর নবী! আপনি এ (ইসরা ও মিরাজ এর) কথা লোকদের কাছে প্রকাশ করবেন না। অন্যথায় তারা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলবে ও আপনাকে কষ্ট দেবে।
.
কিন্তু তিনি বললেনঃ আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই তাদের কাছে এ ঘটনা ব্যক্ত করব।
তখন আমি আমার এক হাবশী দাসীকে বললামঃ বসে আছো কেন, জলদি রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সঙ্গে যাও, তিনি লোকদের কী বলেন তা শোন, আর দেখ তারা কী মন্তব্য করে।
.
রাসুলুল্লাহ ﷺ বের হয়ে গিয়ে লোকদের এ ঘটনা জানালেন।তারা বিস্মিত হয়ে বললঃ হে মুহাম্মাদ! এ যে সত্য তার প্রমাণ? এমন ঘটনা তো আমরা কোনদিন শুনিনি।
তিনি বললেনঃ প্রমাণ এই যে, আমি অমুক উপত্যকায় অমুক গোত্রের একটি কাফেলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।সহসা আমার বাহন জন্তুটির গর্জনে তারা ত্রস্ত হয়ে পড়ে।ফলে তাদের একটি উট হারিয়ে যায়।আমি তাদের উটটির সন্ধান দেই।
আমি তখন শামের দিকে যাচ্ছিলাম।এরপর সেখান থেকে ফিরে আসার পথে যখন দাজনান পর্বতের কাছে পৌঁছি, তখন সেখানেও একটি কাফেলা দেখতে পাই, তারা সকলে নিদ্রিত ছিল।তাদের কাছে একটি পানিভরা পাত্র ছিল।যা কোন কিছু দিয়ে ঢাকা ছিল।আমি সে ঢাকনা সরিয়ে তা থেকে পানি পান করি।এরপর তা আগের মত করে ঢেকে রেখে দেই।
আর এর প্রমাণ এই যে — সে কাফেলাটি এখন বায়যা গিরিপথ থেকে সানিয়াতুত তানঈমে নেমে আসছে।তাদের সামনে একটি ধুসর বর্ণের উট আছে।যার দেহে একটি কালো ও আরেকটি বিচিত্র বর্ণের ছাপ আছে।
.
উম্মু হানী (রা) বলেনঃ এ কথা শোনামাত্র উপস্থিত লোকেরা সানিয়ার দিকে ছুটে গেল।তারা ঠিকই সম্মুখভাগের উটটিকে রাসুলুল্লাহ ﷺ এর বর্ণণামত পেল। তারা কাফেলার কাছে তাদের পানির পাত্র সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল। তারা বলল, আমরা পানির একটি ভরা পাত্রে ঢাকনা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। জাগ্রত হওয়ার পর পাত্রটিকে যেমন রেখেছিলাম তেমনি ঢাকা পাই, কিন্তু ভিতর পানিশূন্য ছিল।
তারা অপর কাফেলাকেও জিজ্ঞেস করল। সে কাফেলাটি তখন মক্কাতেই ছিল।তারা বললঃ আল্লাহর কসম! তিনি সত্যই বলেছেন। তিনি যে উপত্যকার কথা বলেছেন, সেখানে ঠিকই আমরা ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমাদের একটি উট হারিয়ে যায়।আমরা অদৃশ্য এক ব্যক্তির আওয়াজ শুনতে পাই, যে আমাদের উটটির সন্ধান দিচ্ছিল। সেমতে আমরা উটটি ধরে ফেলি। ”
[সীরাতুন নবী ﷺ, ইবন হিশাম(র), ২য় খণ্ড(ইসলামিক ফাউন্ডেশন) পৃষ্ঠা ৭৬-৭৭]
.
এই ঘটনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ইসরা ও মিরাজের ব্যাপারে সে যুগেও লোকজন সন্দেহ পোষণ করেছিল। আর মুহাম্মাদ ﷺ সন্দেহবাদীদেরকে যথাযথ প্রমাণ দেখান। সুস্পষ্টভাবে তাদের সামনে মুহাম্মাদ ﷺ এর কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল।
যেসমস্ত নাস্তিক ও খ্রিষ্টান মিশনারীরা মুহাম্মাদ ﷺ এর ইসরা ও মিরাজ মিথ্যা প্রমাণের জন্য কলম ধরেন, তারা কেন এই বর্ণণাটি উল্লেখ করেন না? সংশয়বাদীদের কি উচিত না, এই বর্ণণাটি ভালো মত লক্ষ্য করা, যাতে মুহাম্মাদ ﷺ সেই যুগের সংশয়বাদীদেরকে সুস্পষ্টভাবে তাঁর কথার স্বপক্ষে প্রমাণ দেখিয়েছিলেন?
.
সব শেষে বলব যে – ইসরা ও মিরাজ নবী মুহাম্মাদ ﷺ এর জন্য বিরাট এক মর্যাদা ও সাধারণ মানুষের জন্য পরীক্ষা। যুক্তি ও বিবেকের কষ্টিপাথরে কেউ যদি যাচাই করে, তাহলে সে এটা নিশ্চিত বুঝতে পারবে যে সারাজীবনের আল আমিন(বিশ্বস্ত) মুহাম্মাদ ﷺ ইসরা ও মিরাজের ব্যাপারেও সত্য কথা থেকে এক চুল বিচ্যুত হননি। এবং তাহলেই এ পরীক্ষায় সফল হওয়া সম্ভব হবে।
{ وَمَا جَعَلْنَا الرُّؤْيَا الَّتِي أَرَيْنَاكَ إِلاَّ فِتْنَةً لِلنَّاسِ }
“আর আমি যে দৃশ্য আপনাকে দেখিয়েছি তা কেবল মানুষের পরীক্ষার জন্য”
[ সূরা বনী ইস্রাঈল(ইসরা) ১৭ : ৬০]
.
[লেখাটির প্রথম অংশ পড়তে ক্লিক করুন এখানে https://goo.gl/FCR4zq ]
.
======
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার
Leave Your Comments