আমাদের সমাজে কিছু লোক আছে, যারা ইসলামী ফিকহের প্রতি মানুষের অনাস্থা তৈরির জন্য বিভিন্ন ওয়াসওয়াসা সৃষ্টি করে থাকে। এরা বলে, ফিকহ হলো বিদয়াত। এগুলো সব মানুষের তৈরি। এসব বিদয়াত পরিত্যাগ করা উচিৎ।
এখন তাদের কাছে আমাদের কিছু প্রশ্ন-
প্রথম প্রশ্ন: ফিকহ শব্দের অর্থ হলো বুঝ—। কুরআন ও হাদীসের সঠিক বুঝকে ফিকাহ বলে। আর আমরা জানি সাধারণত উৎস ও মুলের হুকুম একই হয় ।এখন কুরআন ও হাদীসের বুঝ যদি বিদয়াত হয়, তাহলে এই বিদয়াতের মূল উৎস (নাউযুবিল্লাহ) কুরআন ও হাদীস ও কি আপনাদের কাছে বিদয়াত?
দ্বিতীয় প্রশ্ন: আপনারা কুরআন ও হাদীস বুঝে আমল করেন না কি না বুঝে? যদি বলেন, বুঝে আমল করি। তাহলে বলবো, আপনারাই বলেন কুরআন ও হাদীসের বুঝ তথা ফিকহ হলো বিদয়াত, তাহলে আপনি নিজে কেন এই বিদয়াতের উপর আমল করেন? আর যদি বলেন, আমরা কুরআন ও হাদীস না বুঝে আমল করি। তাহলে বলবো, না বুঝে আবার কিভাবে আমল করেন।আপনারাই তো রাত দিন কুরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণা করার কথা বলেন। তাহলে এ তো দিন কি না বুঝে গবেষণা করেছেন?
তৃতীয় প্রশ্ন: বড় বড় ইমামদের ফিকাহ বা বুঝ যদি বিদয়াত হয়, তাহলে কার বুঝ সঠিক?আপনাদের নাকি আপনাদের অনুসরণীয় কোন আলেম যেমন, আলবানী, কাজী ইব্রাহীম, মতিউর রহমান মাদানী সাহেবদের? তাহলে প্রশ্ন সৃষ্টি হবে যে, ইসলামের সর্বজন স্বীকৃত ইমামদের বুঝ বিদয়াত বলছেন আর তাদের মোকাবেলায় এসব লোকদের কথা মানার যুক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা কতটুকু? আশা করি ভেবে দেখবেন?
চতুর্থ প্রশ্ন: আপনারা কি বড় বড় ইমামদের ফিকহ বা বুঝকে বিদয়াত বলেন, না কি সাহাবা ও অন্যান্য তাবেয়ীনদের বুঝকেও বিদয়াত বলেন? আপনাদের কাছে ফিকাহ যদি বিদয়াত হয়, তাহলে সাহাবীদের ফিকাহও কি বিদয়াত?
আপনারা তো সাহাবীদেরকেও বিদয়াতী বলতে দ্বিধা করে না। হযরত উমর ও হযরত উসমান রা. কে পর্যন্ত আপনাদের কথা অনুযায়ী বিদয়াতী । আপনাদের অনেক শাইখ তো সাহাবীদেরকে ফাসেক পর্যন্ত বলেছে। নাউযুবিল্লাহ। আপনাদের কাছে প্রশ্ন হলো, আপনারা কি শুধু ইমামদের ফিকহ কে বিদয়াত বলেন না কি সাহাবীদের ফিকাহ বা বুঝকেও বিদয়াত বলেন?
সাহাবীদের ফিকাহ সংকলন করে বাজারে প্রচুর বই বের হয়েছে। কিছু কিছু কিতাব মূলত: মাস্টার্স ও ডক্টরেট এর থিসিস পেপার । উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি বিখ্যাত কিতাব ও থিসিস পেপার এর নাম উল্লেখ করছি। এসব সাহাবীদের ফিকাহ সম্পর্কে আপনাদের মতামত জানতে চাই।
১. হযরত আবু বকর রা. এর ফিকাহ:
ক. উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটির মাস্টার্সের থিসিস পেপার, فقه ابي بكر الصديق في الطهارة والصلاة (পবিত্র ও নামায বিষয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর ফিকাহ)
খ.فقه ابي بكر الصديق في المعاملات والانكحة دراسة مقارنة (লেনদেন ও বিবাহের ক্ষেত্রে হযরত আবু বকর সিদ্দিক রা. এর ফিকাহ) এটিও মাস্টার্সের থিসিস পেপার।
গ. فقه ابي بكر الصديق في سياسة الحكم والجهاد والقضاء والايمان والنذور والاطعمة واداب اللباس والزينة وما يتصل بها (রাজনৈতিক বিধি-বিধান, বিচারকার্য, শপথ, মান্নত, খাদ্য.. ইত্যাদি বিষয়ে হযরত আবু বরক সিদ্দিক রা. এর ফিকাহ বা বুঝ)
২. হযরত উমর রা. এর ফিকাহ: ক. موسوعة فقه عمر بن الخطاب (মাউসুয়াতু ফিকহি উমর ইবনিল খাত্তাব, হযরত উমর রা. এর ফিকাহ সংকলন) । এটি রওয়াস কালআজী সংকলন করেছেন। এটি দারুন নাফাইস বয়রুত থেকে ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
৩.হযরত উসমান গনী রা. এর ফিকাহ বা বুঝ:
ক.হযরত উসমান গণি রা. এর ফিকাহ বা বুঝ সংকলন করে কি মাস্টার্সের থিসিস পত্র বের হয়েছে। فقه الخليفة الراشد عثمان بن عفان في العبادات ( ইবাদতের ক্ণেত্রে হযরত উসমান রা. এর ফিকাহ বা বুঝ)
খ. মুয়ামালাত বা লেন-দেনের ক্ষেত্রে হযরত উসমান রা. এর ফিকাহ বা বুঝ। فقه الخليفة الراشد عثمان بن عفان في المعاملات এটি মাস্টার্সের থিসিস পেপার।
গ. فقه عثمان بن عفان رضي الله عنه في الحدود ، والجنايات ، والديات ، والتعازير (দন্ডবিধি, অপরাধ, দিয়াত, তা’জীর ইত্যাদি বিষয়ে হযরত উসমান রা. এর ফিকাহ বা বুঝ।)
ঘ. পরিবীরনীতি বা পরিবারের বিধি-বিধান সংক্রান্ত হযরত উসমান রা. এর ফিকাহ বা বুঝ। فقه عثمان بن عفان رضي الله عنه في احكام الاسرة (এটিও মাস্টার্সের থিসিস পেপার।)
৪. হযরত আলী রা. এর ফিকাহ বুঝ সংকলন করে লিখিত কিতাবসমূহ: ক.فقه أمير المؤمنين علي بن أبي طالب في الحدود والجنايات وأثره في التشريع الجنائي
৫. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর ফিকাহ বা বুঝের সংকলন:
فقه عبد الله بن عباس رضي الله عنهما في أحكام النكاح ومايلحق بة والفرقة بين الزوجين والآثر المترتب عليها دراسة وتوثيقا ومقارنة
খ. فقه عبدالله بن عباس رضي الله عنهما في احكام الحج والعمرة دراسة وتوثيقا ومقارنة بآراء أشهر المجتهدين
গ. /فقه عبدالله بن عباس- رضي الله عنهما في العقوبات -الحدود والجنايات والديات والكفارات والتعزبرات جمعا ودراسة مقارنة
ঘ.فقه عبدالله بن عباس رضي الله عنهما في المعاملات المالية والمواريث دراسة وتوثيقاً ومقارنة ( এটি ডক্টরেট এর থিসিস পেপার)
হযরত আবু দারদা রা. এর পরিবারের ফিকাহ বা বুঝ: فقه آل الدرداء رضي الله عنهم جمعا ودراسة مقارنة
হযরত আয়েশা রা. এর ফিকাহ বা বুঝ:
ক.فقه أم المؤمنين عائشة رضي الله عنها في بابي الطهارة والصلاة
থ.موسوعة فقه عائشة أم المؤمنين
www.waqfeya.com/book.php?bid=2365
সাহাবায়ে কেরামের যুগেও ফিকহের মাযহাব ও ফিকহের মতপার্থক্য ছিল, অথচ তাঁরা খেয়ালখুশির মতভেদ কখনো সহ্য করতেন না। তাদের কাছে এ জাতীয় মতভেদকারীদের উপাধি ছিল ‘আহলুল আহওয়া’, ‘আহলুল বিদা ওয়াদ দ্বলালাহ’ এবং ‘আহলুল বিদআতি ওয়াল ফুরকা’।
সাহাবায়ে কেরামের যুগের ফিকহের মাযহাব সম্পর্কে ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর বিবরণ শুনুন :
১. ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. (১৬১ হি.-২৩৪ হি.) ইমাম বুখারী রাহ.-এর শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ছিলেন। তিনি সাহাবায়ে কেরামের সেসব ফকীহের কথা আলোচনা করেছেন, যাদের শাগরিদগণ তাঁদের মত ও সিদ্ধান্তগুলো সংরক্ষণ করেছেন, তা প্রচার প্রসার করেছেন এবং যাদের মাযহাব ও তরীকার উপর আমল ও ফতওয়া জারি ছিল। আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. এই প্রসঙ্গে বলেছেন, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে এমন ব্যক্তি ছিলেন
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (মৃত্যু : ৩২ হিজরী),
যাইদ ইবনে ছাবিত রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ১১ ও মৃত্যু : ৪৫ হিজরী) ও
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. (জন্ম : হিজরতপূর্ব ৩ ও মৃত্যু : ৬৮ হিজরী)।
তাঁর আরবী বাক্যটি নিম্নরূপ:- ولم يكن في أصحاب رسول الله صلى الله عليه وسلم من له صُحَيْبَةٌ، يذهبون مذهبه، ويفتون بفتواه ويسلكون طريقته، إلا ثلاثة عبد الله بن مسعود وزيد بن ثابت وعبد الله بن عباس رضي الله عنهم، فإن لكل منهم أصحابا يقومون بقوله ويفتون الناس.
এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. তাঁদের প্রত্যেকের মাযহাবের অনুসারী ও তাঁদের মাযহাব মোতাবেক ফতওয়া দানকারী ফকীহ তাবেয়ীগণের নাম উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন,
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর কিরাত অনুযায়ী মানুষকে কুরআন শেখাতেন, তাঁর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মানুষকে ফতওয়া দিতেন এবং তাঁর মাযহাব অনুসরণ করতেন তারা হলেন নিন্মোক্ত ছয়জন মনীষী।
আলকামাহ (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আসওয়াদ (মৃত্যু : ৭৫ হিজরী), মাসরূক (মৃত্যু : ৬২ হিজরী), আবীদাহ (মৃত্যু : ৭২ হিজরী), আমর ইবনে শারাহবীল (মৃত্যু : ৬৩ হিজরী) ও হারিস ইবনে কাইস (মৃত্যু : ৩৬ হিজরী)। ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. (৪৬-৯৬ হিজরী) এই ছয়জনের নাম উল্লেখ করেছেন।
ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর উপরোক্ত বিবরণের সংশ্লিষ্ট আরবী পাঠ নিম্নেরূপ الذين يقرؤن الناس بقراءته ويفتونهم بقوله وبذهبون مذهبه …
এরপর আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. লিখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর (ফকীহ) শাগরিদদের সম্পর্কে এবং তাঁদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবরাহীম (নাখায়ী) (৪৬-৯৬ হিজরী) ও আমের ইবনে শারাহীল শাবী (১৯-১০৩ হিজরী)। তবে শাবী মাসরূক রাহ.-এর মাযহাব অনুসরণ করতেন।
আরবী পাঠ নিম্নেরূপ وكان أعلم أهل الكوفة بأصحاب عبد الله ومذهبهم إبراهيم والشعبي إلا أن الشعبي كان يذهب مذهب مسروق.
এরপর লিখেছেন- وكان أصحاب زيد بن ثابت الذين يذهبون مذهبه في الفقه ويقومون بقوله هؤلاء الاثنى عشر …
অর্থাৎ যাইদ ইবনে ছাবিত রা.-এর যে শাগরিদগণ তাঁর মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং তাঁর মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচার প্রসারে মগ্ন ছিলেন তাঁরা বারো জন। তাদের নাম উল্লেখ করার পর ইবনুল মাদীনী রাহ. লেখেন,
এই বারো মনীষী ও তাদের মাযহাবের বিষয়ে সবচেয়ে বিজ্ঞ ছিলেন ইবনে শিহাব যুহরী (৫৮-১২৪ হিজরী), ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী (মৃত্যু : ১৪৩ হিজরী), আবুয যিনাদ (৬৫-১৩১ হিজরী),আবু বকর ইবনে হাযম (মৃত্যু ১২০ হিজরী)। এদের পরে ইমাম মালেক ইবনে আনাস রাহ. (৯৩-১৭৯ হিজরী)।
এরপর ইবনুল মাদীনী রাহ. বলেছেন- وكما أن أصحاب ابن عباس ستة الذين يقومون بقوله ويفتون به ويذهبون مذهبه.
তদ্রুপ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর যে শাগরিদগণ তার মত ও সিদ্ধান্তসমূহ সংরক্ষণ ও প্রচারে মগ্ন ছিলেন, সে অনুযায়ী ফতওয়া দিতেন এবং তার অনুসরণ করতেন, তাঁরা ছয়জন। এরপর তিনি তঁদের নাম উল্লেখ করেন।
ইমাম ইবনুল মাদীনী রাহ.-এর পূর্ণ আলোচনা তাঁর ‘কিতাবুল ইলালে’ (পৃষ্ঠা : ১০৭-১৩৫, প্রকাশ : দারুবনিল জাওযী রিয়ায, ১৪৩০ হিজরী।) বিদ্যমান আছে এবং ইমাম বাইহাকী রাহ.-এর ‘আলমাদখাল ইলাস সুনানিল কুবরা’তেও (পৃষ্ঠা : ১৬৪-১৬৫) সনদসহ উল্লেখিত হয়েছে। আমি উক্তিটি দুইটি কিতাব সামনে রেখেই উদ্ধৃত করছি। এই কথাগুলো আলোচ্য বিষয়ে এতই স্পষ্ট যে, এখানে আর কোনো টীকা-টিপ্পনীর প্রয়োজন নেই।
সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইমামগণের ফিকহী মাযহাবের যে মতপার্থক্য তাকে বিভেদ মনে করা অন্যায় ও বাস্তবতার বিকৃতি এবং সাহাবায়ে কেরামের নীতি ও ইজমার বিরোধিতা।
ফিকহের ব্যাপারে অনাস্থা সৃষ্টিকারী ভাইদের কাছে প্রশ্ন, আপনারা কি শুধু ইমামদের ফিকাহ (মাযহাব) বা বুঝকে বিদয়াত বলেন না কি সাহাবীদের ফিকাহ (মাযহাব) বা বুঝকেও বিদয়াত বলেন?
(সংগৃহীত ও সম্পাদিত)
Leave Your Comments