মুখোশের অন্তরালে নাস্তিকতা ২ (জাফর ইকবাল)
বিজ্ঞান যেন তার রব
.
একজন মুসলিম যদি আল্লাহর নামে, ইসলামের নামে উল্টোপাল্টা কিছু রটাতে শোনে তার খারাপ লাগবে, রাগ লাগবে সেটাই স্বাভাবিক। আবার একজন হিন্দুও তার দেবতাদের নামে এমন রটাতে শুনলে তার খারাপ লাগবে। মোদ্দাকথা হল, যে যার যার ধর্মকে স্বাভাবিকভাবেই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। আর এ থেকেই সে নিজের ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু শুনলে নিজ জ্ঞান থেকে যথাসাধ্য ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করে। এটা ওই ধর্মের উপর তার ঈমান আনার একটা লক্ষণ।
.
এবার এক মুহুর্ত চিন্তা করুন তো – যে মানুষ বিজ্ঞানকে নিজের রব করে নিয়েছে সে যদি বিজ্ঞান সম্পর্কে খারাপ কিছু শোনে? উত্তরটা সহজ। সে বিজ্ঞানকে ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করবে, যেভাবে হোক বিজ্ঞানকে তার কলঙ্কমুক্ত করা চাই ই।
.
জাফর ইকবাল তার লিখায় ক্ষণে ক্ষণে বিজ্ঞানকে ডিফেন্ড করে থাকে। ‘বিজ্ঞানের কোনো দোষ নেই… বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি এক করে ফেলবেন না… প্রযুক্তি বাজে হতে পারে, বিজ্ঞান না…’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার কখনও আসে বিজ্ঞানীদের পক্ষে সাফাই – ‘বিজ্ঞানীরা রাজনীতির স্বীকার হয়, ব্যবসায়ীদের লোভের স্বীকার হয়’ ইত্যাদির মাধ্যমে সে স্বউদ্যোগে বিজ্ঞানীদের ডিফেন্ড করে যায়। বিজ্ঞানকে জাফর ইকবাল যেন রব করে নিয়েছে – কিন্তু এত সুন্দর করে ডিফেন্ড করার চেষ্টা সত্যিই অবাক করা। ‘একটুখানি বিজ্ঞান’ বইটির কিছু অংশ –
.
“মা এবং সন্তানের মাঝে তুলনা করতে গিয়ে একটা খুব সুন্দর কথা বলা হয়, কথাটা হচ্ছে ‘কুপুত্র যদি বা হয়, কুমাতা কখনো নয়।’ সন্তানের জন্য মায়ের ভালবাসা দিয়েই একটা জীবন শুরু হয় তাই মায়ের উপর এত বড় একটা বিশ্বাস থাকবে বিচিত্র কী? কুপুত্র এবং কুমাতা নিয়ে এই কথাটা একটু পরিবর্তন করে আমরা বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির জন্যে ব্যবহার করতে পারি, কথাটি হবে এরকম, “কুপ্রযুক্তি যদি বা হয়, কুবিজ্ঞান কখনো নয়।” যার অর্থ বিজ্ঞানটা হচ্ছে জ্ঞান আর প্রযুক্তিটা হচ্ছে তার ব্যবহার, জ্ঞানটা কখনোই খারাপ হতে পারে না, কিন্তু প্রযুক্তিটা খুব সহজেই ভয়ংকর হতে পারে। আইনস্টাইন যখন তার আপেক্ষিক তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে করতে লিখলেন E = mc2 তখন তার বুক একবারও আতঙ্কে কেঁপে উঠে নি। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে যখন হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহরে নিউক্লিয়ার বোমা এক মুহুর্তে কয়েক লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলল তখন তহন সারা পৃথিবীর মানুষের বুক আতঙ্কে কেঁপে উঠেছিল। এখানে E = mc2 হচ্ছে বিজ্ঞান আর নিউক্লিয়ার বোমাটা হচ্ছে প্রযুক্তি – দু’টোর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব।
.
প্রযুক্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই একটা কুৎসিত উদাহরণ দিয়ে সবার মন বিষিয়ে দেয়ার আমার কোনো ইচ্ছা নেই। মানুষ ক্রমাগত বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে গুলিয়ে ফেলে কাজেই দুটো বিষয়কে জোর করে হলেও আলাদা করে রাখা ভালো।”
(পৃষ্ঠা ১৬-১৭, একটুখানি বিজ্ঞান)
.
এতটুকু পড়ে হয়ত ভাববেন ভদ্রলোক তো ঠিকই বলছে। এখানে এত বাড়াবাড়ির কী আছে… আমিও তো বললাম সমস্যা নেই – সে তার দ্বীনকে ডিফেন্ড করছে। এটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু দেখুন এর পর পরই সে কী লিখেছে।
.
“… আলাদা করে রাখা ভালো। বিজ্ঞানের একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে, আজকালকার ধর্মের বইগুলো দেখলেই সেটা বোঝা যায়। ধর্মীয় কোনো একটা মতকে সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে ফুটনোটে লেখা হয় “ইহা বিজ্ঞান মতে প্রমাণিত।” বিজ্ঞানের এই ঢালাও গ্রহণযোগ্যতাকে ব্যবহার করে প্রযুক্তি যদি ছদ্মবেশে আমাদের মাঝে জোর করে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করে তার থেকে আমাদের একটু সতর্ক থাকা উচিত।” (পৃষ্ঠা ১৭, একটুখানি বিজ্ঞান)
.
কী বুঝলেন? প্রযুক্তিকে আলাদা বোঝাতে গিয়েও কৌশলে ‘ধর্ম বিজ্ঞানের অধীন’ এমন একটা মেসেজ দিয়ে দিলেন এই লোক। এটা নিয়ে এখনই অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু এখনই নয়, এই বিষয়ে সামনে আলোচনা হবে ইন-শা-আল্লাহ। এখন আপাতত ‘বিজ্ঞানকে যে এই লোক মোটামোটি নিজের রব বানিয়ে নিয়েছে তার আরও কিছু দৃষ্টান্ত দেখে নিই –
.
“… এটি এখন আর অস্বীকার করার উপায় নেই প্রযুক্তির মোহ আমাদের অনেক সময় অন্ধ করে ফেলছে, আমরা অনেক সময় কোনটা বিজ্ঞান আর কোনটা প্রযুক্তি সেটা আলাদা করতে পারছি না। বিজ্ঞানের কৃতিত্বটা প্রযুক্তিকে দিচ্ছি, কিংবা প্রযুক্তির অপকীর্তির দায়ভার বহন করতে হচ্ছে বিজ্ঞানকে।
.
ভোগবাদী পৃথিবীতে এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিজ্ঞান এবং প্রয্যক্তিকে আলাদা করে দেখা – তা না হলে আমরা কিন্তু খুব বড় বিপদে পড়ে যেতে পারি।” (একটুখানি বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ১৫)
.
“বিজ্ঞান নিয়ে কোনও সমস্যা হয় না কিন্তু প্রযুক্তি নিয়ে বড় বড় সমস্যা হতে পারে তার একটা বড় কারণ হচ্ছে বিজ্ঞানকে বিক্রি করা যায় না কিন্তু প্রযুক্তিকে বিক্রি করা যায়।” (একটুখানি বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২১)
.
বিজ্ঞান যাদের রব তাদের কাছে আম্বিয়া কারা বলুন তো? সহজ উত্তর – বিজ্ঞান ধর্মের চর্চাকারী অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা! জাফর ইকবাল সাহেব লিখেছেন –
.
“পৃথিবীটাকে জঞ্জালমুক্ত করার জন্যে আবার তখন আমাদের বিজ্ঞানী আর প্রযুক্তিবিদদের মুখের দিকেই তাকাতে হবে। কারণ শুধু তারাই পারবেন আমাদের সতিকারের পৃথিবী উপহার দিতে।” (একটুখানি বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২৩)
.
এমন উদাহরণ আরও বহু রয়েছে। সিরিজ শেষে একটা নোটে সবগুলো রেফারেন্স কাভার করব ইন-শা-আল্লাহ।
.
.
[৩] ধর্ম বিজ্ঞানের অধীন – এমন মেসেজ দেওয়া
“…ধর্মীয় কোনো একটা মতকে সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্যে ফুটনোটে লেখা হয় “ইহা বিজ্ঞান মতে প্রমাণিত।” (পৃষ্ঠা ১৭, একটুখানি বিজ্ঞান)
.
এই লাইনটিতে এত কৌশল প্রয়োগ হয়েছে যে এটা নিয়ে আলাদা একটা প্যারাগ্রাফ লিখা লাগলো।
.
বিজ্ঞানের স্কেলে ধর্মের কোনো তথ্য মেপে দেখালে বিজ্ঞান ধর্মের চেয়ে উপরের স্তরে চলে যায় না। আর ইসলামের ব্যাপারটা তো অন্যান্য ধর্মাবলি থেকে আলাদা। কারণ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও কুরআনের বিশুদ্ধতা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই – তা অবিকল ১৪০০ বছর আগে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপর নাযিলকৃত কুরআনের অনুরূপেই রয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান ক্রমপরিবর্তনশীল – আজ এক কথা, কাল আরেক কথা বলে থাকে।
.
কুরআন যখন নাযিল হয়েছিল তখন ‘আরবি সাহিত্য’ এর স্কেলে একে মেপে দেখা হয়েছিল। বর্তমানে বিজ্ঞানের স্কেলে মেপে দেখা হয়। ভবিষ্যতে হয়তো অন্য কোনও স্কেলে মেপে দেখা হবে। কিন্তু স্কেল যেমন একটা tool ছাড়া কিছুই নয়, বিজ্ঞানও তেমনি আল্লাহর সৃষ্টিজগতকে বোঝার একটা tool ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই বুদ্ধিমান দায়ীরা স্কেল দিয়ে মাপার পর স্কেলের অবস্থানটাও পরিষ্কার করে দেন। সত্যকে যেকোনও স্কেল দিয়ে মেপে দেখাই যেতে পারে, স্কেল যদি ঠিক থাকে তো সত্যকে জয়ীই দেখা যাবে।
.
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ… তাঁর চেয়ে সত্যবাদী কেউ হতে পারে না। আর একারণেই আল্লাহর পক্ষ থেকে কুরআন ও ইসলাম হল সর্বোচ্চ ও অপরিবর্তনীয়। কিন্তু আরবি সাহিত্যের তো তাও একটা নির্দিষ্ট ব্যকরণ ছিল, বিজ্ঞানের তো সেইরকম নির্দিষ্টতা বলতেও কিছু নেই – আজ এককথা তো কাল আরেক কথা। আর একই জিনিস নিয়ে হাজারটা থিউরি তো আছেই।
.
এছাড়াও আমরা ‘থিউরি’ বা তত্ত্বকে অনেক সময়ই ‘ফ্যাক্ট’ বা সত্যের সাথে গুলিয়ে ফেলি। মাল্টিভার্স থিউরি বা ইভল্যুশন থিউরি যতই চটকদার হোক না কেন, থিউরি কেবলই থিউরি – সত্য নয়।
.
মোদ্দাকথা হল, বিজ্ঞান মনুষ্যলব্ধ জ্ঞান আর ওহী হল স্বয়ং স্রষ্টা প্রদত্ত জ্ঞান। মনুষ্যলব্ধ জ্ঞান কখনও প্রমাণিত সত্য হলে স্রষ্টাপ্রদত্ত ওহীর সাথে মিলে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই মিলে যাওয়াকে ব্যবহার করে সত্যের দিকে আহ্বান করলেই মনুষ্যলব্ধ জ্ঞান স্রষ্টাপ্রদত্ত জ্ঞান থেকে উপরের স্তরে চলে যায় না। মানুষের সেই জ্ঞানও আসলে স্রষ্টার রহমতস্বরূপ – তা তো খুব অল্পই বুঝতে পারে।
.
(চলবে ইন-শা-আল্লাহ)
.
শেয়ার করে বা অন্ধভক্তদের ট্যাগ দিয়ে তাদের অন্ধত্ব দূরীকরণের একটা ছোট চেষ্টা করে দেখুন। তবে…
.
“It is not the eyes that are blind, but the hearts” (Surah Al-Haj, 22: 46)
.
#মুখোশের_অন্তরালে_নাস্তিকতা ২
#জাফর_ইকবাল
=======================
লেখকঃ তানভীর আহমেদ
Leave Your Comments