.
মুসা(আ) এর সময়কালে ফিরআউনের সহচর হামান(Haman): কুরআনের ঐতিহাসিক বর্ণনায় কি ভুল আছে?
=========================================================
.
আল কুরআনে মুসা(আ) এর ঘটনায় মিসরের ফিরআউনের(Pharaoh) সাথে সাথে আরো একজন মন্দ ব্যক্তির কথা উল্লেখ আছে। আর সে হচ্ছে হামান(Haman)।সে ছিল ফিরআউনের সহযোগী। কুরআনের ৩টি সুরায়{কাসাস ২৮:৬-৮, আনকাবুত ২৯:৩৯, মু’মিন(গাফির) ৪০:২৪,৩৬} হামানের কথা উল্লেখ আছে। সুরা মু’মিনের ৩৬ ও ৩৭ নং আয়াতে উল্লেখ আছে যে ফিরআউন তামাশাচ্ছলে হামানকে এক সুউচ্চ ইমারত(tower) নির্মাণের নির্দেশ দেয় যাতে করে সে আকাশে উঁকি দিয়ে মুসা(আ) এর উপাস্য প্রভুকে দেখতে পায় [আয়াতের লিঙ্কঃ www.quran.com/40/36-37]।
.
খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক মুক্তমনাদের দাবি—কুরআনের এই বিবরণে ভুল আছে।
কেন?
কারণ বাইবেলে মুসা(আ) এর ঘটনায় হামান নামে ফিরআউনের কোন সহচরের বিবরণ নেই।তা ছাড়া বাইবেলেও একজন হামানের কথা উল্লেখ আছে, সেও একটি tower নির্মাণ করে [বাইবেলের সংশ্লিষ্ট অংশের লিঙ্কঃ https://goo.gl/noM3q7 ]। কিন্তু বাইবেলের এই হামান মুসা(আ) ও ফিরআউনের সময়ে বাস করত না বরং এর থেকে প্রায় হাজার বছর পরে পারস্যের রাজা অহশ্বেরশ(Xerxes) এর সময়ে বাস করত। এ কারণে তাদের দাবি হচ্ছে কুরআন হামান বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে, মুসা(আ) ও ফিরআউনের সময়ে কোন হামান মিসরে ছিল না এবং হামান মুসা(আ) এর হাজার বছর পরের মানুষ।
.
প্রথম কথাঃ খ্রিষ্টান মিশনারীদের দাবির না হয় একটা হেতু পাওয়া গেল, তাদের ধর্মগ্রন্থের ঘটনার সাথে সাংঘর্ষিক তথ্য কুরআনে আছে।
কিন্তু নাস্তিক মুক্তমনারা কি কোন ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাস করে? তারা কেন সব সময়ে বাইবেলের ঘটনাকেই সঠিক ধরে নিয়ে কুরআনকে বিবেচনা করে? সাধারণ যুক্তি তো এটাই বলে যে—দু’টি গ্রন্থে যদি বিপরীত তথ্য থাকে, তাহলে এর যে কোন একটি সঠিক ও অন্যটি ভুল হতে পারে। যে কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তির এভাবেই বিষয়টা দেখা উচিত। কিন্তু নাস্তিক-মুক্তমনারা কেন ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থকে প্রথমে সঠিক ধরে নেয় আর কুরআনের তথ্যে বৈপরিত্য থাকলে সেটাকে ভুল বলে ধরে নেয়? এর উল্টোটা হবারও তো সম্ভাবনা থাকে। নাস্তিক-মুক্তমনাদের এই একচোখা দৃষ্টিভঙ্গী প্রমাণ করে যে তারা আসলে ধর্ম নিরপেক্ষ না, তারা আসলে ইসলামবিদ্বেষী।
.
দ্বিতীয় কথাঃ কুরআন আর বাইবেলের কোন তথ্যে মিল থাকলেই খ্রিষ্টান মিশনারী আর নাস্তিক-মুক্তমনারা হৈচৈ করে বলতে থাকে যেঃ কুরআন বাইবেল থেকে কপি করা।হামান বিষয়ক এই ঘটনায় যেহেতু বাইবেলের তথ্যের সাথে কুরআনের ঘটনার কোন মিল নেই, কাজেই এখানে তাদের এই অভিযোগ আনবার কোন সুযোগ নেই।
কাজেই এখানে হয় বাইবেল সত্য, নাহলে কুরআন সত্য। অথবা উভয় গ্রন্থই ভুল।
.
চলুন এবার আমরা ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণাদির আলোকে নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণ করে দেখি এখানে কোন গ্রন্থ সঠিক তথ্য দিয়েছে—বাইবেল নাকি কুরআন।
.
বাইবেলের Esther(বাংলা বাইবেলে ‘ইষ্টেরের বিবরণ’) নামক গ্রন্থে হামানের কথা উল্লেখ আছে। এটি বাইবেলের পুরাতন নিয়ম(Old testament) অংশের একটি গ্রন্থ।ইহুদিদের যে সকল কিতাবকে খ্রিষ্টানরা ঈশ্বরের বাণী হিসাবে বিশ্বাস করে, সেগুলোকে তারা বাইবেলের Old testament অংশে রেখেছে।এই অংশের গ্রন্থগুলো মূলত প্রাচীন ইহুদিদের লেখা। ইহুদিরা তাদের নিজেদের এ কিতাবকে কতটুকু বিশুদ্ধ বলে মনে করে? Jewish Encyclopediaতে Esther গ্রন্থবিষয়ক আলোচনায় Critical View অংশে বলা হয়েছেঃ “The vast majority of modern expositors have reached the conclusion that the book is a piece of pure fiction, although some writers qualify their criticism by an attempt to treat it as a historical romance. The following are the chief arguments showing the impossibility of the story of Esther”
অর্থাৎ:– বেশীরভাগ আধুনিক ব্যাখ্যাকার এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, এই বইটি নিখাদভাবে একটি কল্পিত গল্প(fiction)। …
শুধু তাই না, এ আর্টিকেলের Improbabilities of the Story অংশে দেখানো হয়েছে বাইবেলের অন্য বইগুলোর তথ্যের সাথে Esther গ্রন্থের তথ্য কতটা সাংঘর্ষিক।
আর্টিকেলের Probable Date অংশে বলা হয়েছেঃ In view of all the evidence the authority of the Book of Esther as a historical record must be definitely rejected. Its position in the canon among the Hagiographa or “Ketubim” is the only thing which has induced Orthodox scholars to defend its historical character at all. Even the Jews of the first and second centuries of the common era questioned its right to be included among the canonical books of the Bible (compare Meg. 7a).
অর্থাৎ:– সকল প্রমাণের আলোকে আমরা বলতে পারি যে, ঐতিহাসিক রেকর্ড হিসাবে Esther এর গ্রহণযোগ্যতা বাতিল হিসাবে গণ্য হবে।…এমনকি ১ম ও ২য় শতাব্দীর ইহুদিরাও বাইবেলের অনুমোদিত বই হিসাবে Esther এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলতো।
[১]
.
খোদ Jewish Encyclopediaতে বাইবেলের গ্রন্থ Esther এর ঐতিহাসিক গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে এইসব মন্তব্য করা হয়েছে। যে ইহুদিরা এই গ্রন্থের লেখক, ধারক ও বাহক, তারাই এর নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে এ রকম প্রশ্ন তুলেছে। এ তো গেল ইহুদি গবেষকদের কথা। সেকুলার গবেষকগণও এই গ্রন্থ নিয়ে অনেক যৌক্তিক অভিযোগ এনেছেন যেগুলো আর এখানে উল্লেখ করলাম না। এমনই একটি “নির্ভরযোগ্য”(!!!) ঐতিহাসিক ডকুমেন্টের সহায়তা নিয়ে ইসলামবিরোধিরা কুরআনের ঐতিহাসিক তথ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। সুবহানাল্লাহ!
.
এবারে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখি কুরআনে উল্লেখিত তথ্য কতটা সঠিক বা নির্ভরযোগ্য।
১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের মিসর অভিযানের সময়ে তার একজন সৈন্য Rosetta Stone আবিষ্কার করে। Rosetta Stoneএ প্রাচীন মিসরীয় লিপি( hieroglyphics) এবং তার তুলনামূলক গ্রীক বর্ণমালার বিবরণ ছিল যার সাহায্যে গবেষকগণ প্রাচীন মিসরীয় লিপির পাঠোদ্ধার করতে সক্ষম হন। [২] প্রাচীন মিসরীয় লিপি( hieroglyphics) পাঠোদ্ধারের পর জানা গেছে যেঃ প্রাচীন মিসরে যারা পাথর দ্বারা নির্মাণকাজ করত তাদের নেতাকে বলা হত ‘হামান’। অর্থাৎ ফিরআউন(pharaoh) এর মত ‘হামান’ও একটা টাইটেল। [৩]
.
এই ব্যাপারটি অনুসন্ধান করার জন্য ড. মরিস বুকাইলি ফ্রান্সের একজন মিসরবিদদের দ্বারস্ত হয়েছিলেন। তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেন যে, হামান বলে কোন নাম তিনি তার প্রাচীন মিসরবিষয়ক রেকর্ডে দেখেছেন কিনা। তিনি তাঁর কাছে জানতে চান তিনি কোথায় এই নাম পেলেন। তিনি তাকে রাসুল(ﷺ) এর কথা বলেন। মিসরবিদ তাঁকে বলেন যে এমন নামের সন্ধান পাওয়া তো তাঁর পক্ষে অসম্ভব কেননা রাসুল(ﷺ) এর যুগের অনেক কাল আগে প্রাচীন মিসরীয় ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তিনি তাঁকে আরো বলেন যে এইসব নামের রেকর্ডের জন্য তাঁকে জার্মানী যেতে হবে। তিনি সে অনুযায়ী জার্মানী যান এবং সেখানে গিয়ে প্রাচীন মিসরে মুসা(আ) এর সময়কালে ফিরআউনদের অধীনে নির্মাতা এবং স্থপতিদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে থাকেন। এবং সুবহানাল্লাহ, তিনি ‘হামান’ নামটি পেয়ে যান! যারা পাথর দ্বারা নির্মাণকাজ করত তাদের নেতার উপাধী এটা। তিনি ফ্রান্সে ফিরে সেই মিসরবিদকে ডিকশনারীটির ফটোকপি দেখান যাতে তিনি ‘হামান’ এর সন্ধান পেয়েছেন। এরপর তিনি তাকে কুরআন থেকে হামানের আয়াত দেখান। এটা দেখে সেই ফরাসী মিসরবিদ বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে যান। ১৯৮৯ সালে প্যারিস থেকে প্রকশিত ‘Réflexions sur le Coran’ বইতে মরিস বুকাইলি তাঁর এ ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। [৪]
.
পবিত্র কুরআনের বিবরণে আমরা দেখছি যেঃ মিসরের ফিরআউন ‘হামান’ বলে একজনকে ডেকে সুউচ্চ ইমারত বানাবার আদেশ দিচ্ছে; আর প্রাচীন মিসরীয় ভাষায় পাথরের নির্মান শ্রমিকদের নেতাকে ডাকা হত হামান বলে। সুরা কাসাসের ৩৮নং আয়াতে [লিঙ্ক: www.quran.com/28/38] এটাও বলা আছে ফিরআউন হামানকে ইট পুড়িয়ে ইমারত বানাতে বলেছিল। একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে মিসরবিদগণ(Egyptologists) জানতে পেরেছেন যে, প্রাচীন মিসরে কাদা পুড়িয়ে ইট বানানোর প্রচলন ছিল। কাদা পুড়িয়ে মজবুত ইট বানানোর জ্ঞান—প্রাচীন একটি সভ্যতার জন্য এটা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য একটা ব্যাপার। [৫] আর এই তথ্যটি আল কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
.
যে কুরআনকে খ্রিষ্টান মিশনারী আর নাস্তিকরা অভিযুক্ত করে “বাইবেল থেকে কপি” করা বলে, সেই কুরআনেই আমরা দেখছি এমন ঐতিহাসিক তথ্য আছে যা কোন ইহুদি বা খ্রিষ্টান পণ্ডিতের সেই যুগে জানা ছিল না। ঐতিহাসিক তথ্যে ভুল থাকা তো দূরের কথা, নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কুরআনে বিস্ময়করভাবে সঠিক ঐতিহাসিক তথ্য আছে। ইসলামবিদ্বেষীদের অভিযোগ আর সত্যের মাঝে সবসময়েই বিশাল ব্যবধান লক্ষ্য করা যায়।
.
প্রাচীন মিসরীয় ভাষা তো মুহাম্মাদ(ﷺ) এর শত শত বছর আগে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল।মুহাম্মাদ(ﷺ) এর যুগ ৭ম শতাব্দীতে পৃথিবীতে কেউ প্রাচীন মিসরীয় ভাষা জানতো না, কোন মিসরবিদও(Egyptologist) সে যুগে ছিল না। প্রাচীন মিসরীয় ভাষার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সময় থেকে এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় পরে, ১৮ শতকে। আজ থেকে ১৪শ বছর আগে এমন কে ছিল যে জানতো যে প্রাচীন মিসরে পাথরের নির্মাণশ্রমিকদের নেতার টাইটেল ছিল ‘হামান’ কিংবা প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতার মানুষেরা পোড়ানো ইট দিয়ে ইমারত নির্মাণ করত? ৭ম শতাব্দীতে কে মুহাম্মাদ(ﷺ)কে বলে দিল প্রাচীন মিসরীয় লিপির মর্ম? কে তাঁকে নিখুঁতভাবে ঐতিহাসিক তথ্য বলে দিল? একমাত্র মহান স্রষ্টা আল্লাহ ছাড়া?
.
“ তুমি[মুহাম্মাদ(ﷺ)] তো এর পূর্বে কোন কিতাব পাঠ করোনি এবং স্বহস্তে কোনদিন কিতাব লিখনি। এরূপ হলে মিথ্যাবাদীরা অবশ্যই সন্দেহ পোষণ করত।
বরং যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে, তাদের অন্তরে এটা (কুরআন) তো স্পষ্ট নিদর্শন। একমাত্র জালিম ছাড়া আমার নিদর্শন কেউ অস্বীকার করে না।“
(কুরআন, আনকাবুত ২৯:৪৮-৪৯)
.
“ তারা কেন কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি ওটা আল্লাহ ব্যতিত অন্য কারো নিকট হতে হতো তবে তারা ওতে বহু গরমিল পেতো। ”
(কুরআন, নিসা ৪:৮২)
.
====
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার [ফেসবুক id: Muhammad Mushfiqur Rahman Minar]
#সত্যকথন
.
===
তথ্যসূত্রঃ
.
[১] Jewish Encyclopedia; Article: Esther
http://www.jewishencyclopedia.com/articles/5872-esther
[২] 1799: Rosetta Stone found
http://www.history.com/this-day-in-hist…/rosetta-stone-found
[৩] ▪“Biblical Haman » Qur’ānic Hāmān: A Case Of Straightforward Literary Transition?” – Islamic Awareness
http://www.islamic-awareness.org/…/Cont…/External/haman.html
▪ “10 – Historical Miracles in the Quran – Proof of Islam ” (Abdur Rahim Green)
▪“Hāmān – The Qur’an stands up to History ”
https://www.youtube.com/watch?v=iLMFRkzPa94
[৪] ▪Egyptology In The Qur’an – Exhibition Islam
https://goo.gl/SPbHiL
▪ “The Miracle of Quran | Haman The Architect of Pharaoh | Nouman Ali Khan ”
https://www.youtube.com/watch?v=5QY0AfV1iAs
▪ Réflexions sur le Coran
http://www.iqrashop.com/Reflexions-sur-le-Coran-Professeur-…
[৫] ▪ “Were Burnt Bricks Used In Ancient Egypt In The Time of Moses? ” – Islamic Awareness
http://www.islamic-awareness.org/…/Contrad/…/burntbrick.html
▪ Ancient Egyptian Mud Brick Construction: Materials, Technology, and Implications for Modern Man -Data Plasmid
https://dataplasmid.wordpress.com/…/ancient-egyptian-mud-b…/
Leave Your Comments