রাসূল ﷺ ও আয়েশা (রাঃ) কে নিয়ে যত মিথ্যাচার – ২ লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

রাসূল ﷺ ও আয়েশা (রাঃ) কে নিয়ে যত মিথ্যাচার – ২
[আগের পর্বের জন্য দেখুন – #সত্যকথন_৪৪]
.
“তারপরেও ছয় বছর বয়স স্বামী সংসারের জন্য উপযুক্ত না”
.
যারা ৬ বছর বয়সে আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ে নিয়ে আপত্তি তুলেন তারা অবশ্য ইতিহাসের একটা সত্য এড়িয়ে যান। সেটা হচ্ছে রাসূল ﷺ এর পূর্বেই আয়েশা(রাঃ) জুবাইর ইবনে মুতিম এর সাথে engaged ছিলেন। পরবর্তীতে, আবুবকর(রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করলে এ বিয়ে ভেংগে যায়। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি, সে সময় এই বয়সেই বিয়ে করা আরবে একেবারেই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পরবর্তীতে আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ ﷺ তাঁকে বিয়ে করেন। ৬ বছর স্বামী সংসারের জন্য উপযুক্ত নয় বলেই তিনি ৯ বছর বয়সে স্বামীগৃহে উঠেন।
.
Pedophile রা যেমন শিশুদের পাবার জন্য আকুল হয়ে উঠে, মুহাম্মদ ﷺ কখনোই এমন কিছু প্রদর্শন করেননি। তাই ৯ বছর বয়সে আয়েশা(রাঃ) উপযুক্ত হলে আয়েশা(রাঃ) এর পরিবারই তাকে স্বপ্রণোদিত স্বামীগৃহে উঠিয়ে দেন[১]। আজ থেকে ২০০ বছর আগে মেয়েরা ১০ বছর বয়সে বিয়ের জন্য উপযুক্ত হলে তা মেনে নিতে যদি আমাদের আপত্তি না থাকে তাহলে ১৪০০ বছর আগে একজন নারীর নয় বছর বয়সে সংসার করা নিয়ে অভিযোগ তোলা কি ডাবল- স্ট্যাণ্ডার্ড এর মাঝে পড়েনা?
.
কমনসেন্স,পরিসংখ্যান আর বিজ্ঞান এই তিনটাই সাক্ষ্য দেয় যে, স্বামীগৃহে উঠার সময় আয়েশা(রাঃ) “Pre-pubescent” স্টেজে ছিলেন না। যারা এমনটা বলেন তারা অবশ্যই মিথ্যাচার করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯০৫ সালের আগ পর্যন্ত মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ে কোন ইশ্যুই ছিল না। ১৯০৫ সালে জোনাথন ব্রাউন সর্বপ্রথম এটা নিয়ে জল ঘোলা করেন। কারণ, এর আগে এটা সবার কাছে একদম স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল।
.
যাদের এরপরেও ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হয় তাদের ছোট্ট একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে বলব। আপনার দাদী কিংবা নানী বেঁচে থাকলে তাদের জিজ্ঞেস করুন তাদের কত বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল, সম্ভব হলে তাদের কাছ থেকে জেনে নিন আপনার বড়-দাদী এবং বড়-নানীর বিয়ে কত বছর বয়সে হয়েছিল। দেখবেন বয়সটা ৯-১৫ এর বেশী না। এখন পারবেন কি নিজেদের পূর্বপুরুষদের শিশুকামী বলতে? আল্লাহ-তায়ালা এভাবেই মানুষের মিথ্যাগুলোকে মানুষের দিকেই ফিরিয়ে দেন।
.
এবার সভ্য দেশগুলোর দিকে তাকাই। মেক্সিকোতে ছেলে মেয়ের দৈহিক সম্পর্কের জন্য এই আধুনিক সময়ে নূন্যতম বয়স মাত্র ১৩। খোদ ইউ.এস স্টেটে মেয়েদের বিয়ের বয়সের ভিন্নতা আছে। যেমনঃNew Hampshire এ বয়স ১৩, New York এ ১৪, South Carlonia তে বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫। আপনি কোন বয়সটাকে সঠিক বলবেন?
.
তবে এটা ঠিক যে, অপরিপক্ক বয়সে বিয়ে হলে, মেয়েরা আত্নগ্লানিতে ভোগেন এবং স্বামীর প্রতি এতোটা অনুরক্ত হন না। আয়েশা(রাঃ) এর সাথে কি এমনটা হয়েছিল?
.
.
“কেমন ছিল আয়েশা(রাঃ) ও রাসূল ﷺ এর দাম্পত্য জীবন?”
.
মহানবী রাসূলুল্লাহ ﷺ অন্তরে আয়েশা রাদিআল্লাহ আনহার যে মহত্ব ও মর্যাদা ছিল, তা অন্য কোন স্ত্রীর জন্য ছিল না। তার প্রতি এ ভালবাসা তিনি কারো থেকে গোপন পর্যন্ত করতে পারেননি, তিনি তাকে এমন ভালবাসতেন যে, আয়েশা (রাঃ) যেখান থেকে পানি পান করতেন, তিনিও সেখান থেকে পানি পান করতেন, আয়েশা (রাঃ) যেখান থেকে খেতেন, তিনিও সেখান থেকে খেতেন।
.
অষ্টম হিজরিতে ইসলাম গ্রহণকারী আমর ইবনুল আস (রাঃ) তাকে জিজ্ঞাসা করেন : “হে আল্লাহর রাসূল, আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয় কে ?” তিনি বললেন : “আয়েশা”। আমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন : পুরুষদের থেকে ? তিনি বললেন : “তার পিতা”। {বুখারি ও মুসলিম}
.
রাসূলুল্লাহ ﷺ তার সাথে খেলা-ধুলা, হাসি-ঠাট্টা ইত্যাদিতে অংশ গ্রহণ করতেন। কোন এক সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায়ও অংশ নেন।
.
আয়েশা (রাঃ) আরো বর্ণনা করেন, যার দ্বারা তার সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্নেহ, মমতার প্রকাশ পায়।তিনি বলেন : “আল্লাহর শপথ, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ দেখেছি, তিনি আমার ঘরের দরজায় দাঁড়াতেন, হাবশিরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে খেলা-ধুলা করত, আর রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে তার চাদর দিয়ে ঢেকে নিতেন, যেন আমি তাদের খেলা উপভোগ করি তার কাঁধ ও কানের মধ্য দিয়ে। অতঃপর তিনি আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতেন, যতক্ষণ না আমিই প্রস্থান করতাম”। {আহমদ}
.
তার প্রতি রাসূলুল্লাহ ﷺ ভালোবাসার আরেকটি আলামত হচ্ছে, মৃত্যু শয্যায় তিনি আয়েশার নিকট থাকার জন্য অন্যান্য স্ত্রীদের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছেন, যেন আয়েশা (রাঃ) তাকে সেবা শুশ্রূষা প্রদান করেন।
.
“আয়েশা(রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ﷺ আমাকে বলেন : তুমি কখন আমার উপর সন্তুষ্ট থাক আর কখন রাগ কর আমি তা বুঝতে পারি। তিনি বলেন, আমি বললাম : কিভাবে আপনি তা বুঝেন ? তিনি বললেন : তুমি যখন আমার উপর সন্তুষ্ট থাক, তখন বল, এমন নয়- মুহাম্মদের রবের কসম, আর যখন আমার উপর রাগ কর, তখন বল, এমন নয়- ইবরাহিমের রবের কসম। তিনি বলেন, আমি বললাম : অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল, তবে আমি শুধু আপনার নামটাই ত্যাগ করি”। {মুসলিম}
.
আয়েশা(রাঃ) রাসূল ﷺএর প্রতি এতোটা আত্নসম্মান বোধ করতেন যে তিনি মুহাম্মদ ﷺ কে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “কেন আমার মত একজন নারী, আপনার মত একজন পুরুষকে নিয়ে আত্মসম্মান বোধ করবে না ?” {মুসলিম}
.
এরপরেও যারা এই বিয়ে নিয়ে জলঘোলা করে তাদের বলব, “If Ayesha (R) was happy and satisfied with her marriage, who are you to point your finger at her marriage?”
.
.
“বিয়ের পেছনে হিকমাহ”
.
মুহাম্মদ ﷺ ও আয়েশা(রাঃ) এর বিয়ের কারণে মুসলিম উম্মাহ নানাদিক থেকে লাভবান হয়েছিল। আয়েশা(রাঃ) মুহাম্মদ ﷺ এর স্ত্রীদের মধ্যে থেকে সবচেয়ে বেশী হাদীস বর্ণনা করেছিলেন।[২] [চিত্র ১]
.
সবচেয়ে বেশী হাদীস বর্ণনাকারীদের মাঝে তিনি ছিলেন চতুর্থ। আবু হুরাইরা,আবদুল্লাহ ইবনে উমার এবং আনাস ইবনে মালিকের পরেই তার অবস্থান। তিনি যেসব বিষয়ে হাদীস বর্ণনা করেছিলেন তা যদি তিনি বর্ণনা না করতেন তাহলে ইসলামী শরীয়তের একটা বড় অংশ অপূর্ণ থেকে যেত।
.
হাদীস এবং তাফসীরের এমন কোন বই নেই যাতে, আয়েশা(রাঃ) নামটি জ্বলজ্বল করে না।
.
রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর লম্বা একটা সময় তাঁর জ্ঞান আয়েশা(রাঃ) সাহাবী ও তাবেয়ীদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। ইবনে হাজার আসকালানী(রহঃ) এজন্য বলেছিলেন, “ মহিলাদের মধ্যে আয়েশা(রাঃ) ছিলেন ইসলামের সবচেয়ে বড় আলেম।” [৩]
.
উরওয়া বিন জুবায়ের বলেছেন-“ আমি কখনও কাউকে পাই নাই যিনি কুরআন ও হালাল এবং হারামের আদেশ নিষেধ, ইলমুল আনসাব বা নসব-শাস্ত্র এবং আরবি কবিতায় আয়েশা (রাঃ) এর চেয়ে বেশি জানতেন। সেই কারণে অনেক বয়োজৈষ্ঠ সাহাবিয়ে কেরামগণ জটিল কোন বিষয় নিরসনে আয়েশা(রাঃ) এর সাহায্য গ্রহণ করতেন। [৪]
.
আবার মক্কার মুশরিক কুরাইশদের কাছে ফিরে যাই। নানাভাবে মুহাম্মদ ﷺ কে প্রলোভন দেখিয়েও তারা মুহাম্মদ ﷺ এর সাথে কোন সমঝোতা করতে পারেনি। মুহাম্মদ ﷺ যদি নারীলোভী হতেন তবে তখনকার পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আরবের সবচেয়ে সুন্দরী নারীদের বিয়ে করতে পারতেন, শিশুকামী হলে পারতেন বেছে বেছে শিশুদের ভোগ করতে। তিনি তার কিছুই করেননি। কারণ, তাঁর মিশন ছিল সত্যের পথে আজন্ম সংগ্রামের। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ‘সৃষ্টির দাসত্ব থেকে স্রষ্টার দাসত্ব’ এর দিকে নিয়ে যাওয়া। তাই তো সত্য প্রচারের জন্য অনমনীয় থেকে তিনি বলেছিলেন-
.
“আমার এক হাতে সূর্য আরেক হাতে চন্দ্র এনে দিলেও আমার ধর্ম থেকে আমি বিরত হব না। হয় আল্লাহ আমাকে জয়ী করবেন, নতুবা আমি শেষ হয়ে যাব। কিন্তু এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হব না।” [৫]
=======================
তথ্যসূত্রঃ
[১] সহীহ মুসলিম, কিতাবুল নিকাহ
[২] সিরাতুর রাসূল-মুহাম্মদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা- ৭৬৮
[৩] Young Ayesha-Anwar Al Awlaki
[৪] ইবনে কাইয়্যুম ও ইবনে সা’দ কর্তৃক জালা-উল- আফহাম খন্ড ২, পৃষ্ঠা-২৬
[৫] সীরাতে ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩১৪ =======================
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *