সাফিয়া(রাঃ)- নিপীড়িত যুদ্ধবন্দীনি নাকি সম্মানিত উম্মুল মুমিনীন ? – ৩ [শিহাব আহমেদ তুহিন]

মুহাম্মদ ﷺ যদি সত্যিই নারীলোভী না হয়ে থাকেন তবে ইদ্দত পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি কেন?
———————————————————————————————-
.
এটা খুব জনপ্রিয় একটা মিথ্যা অভিযোগ। যুদ্ধবন্দীনির ক্ষেত্রে ইদ্দত পালনের বিধানটুকু নবী(সাঃ) অবশ্যই পালন করেছিলেন। আবু সাঈদ খুদরী(রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল ﷺ আওতাস গোত্রের যুদ্ধবন্দীনির ব্যাপারে বলেন, “গর্ভবতী নারীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না সন্তান প্রসব করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে মিলিত হওয়া যাবে না আর যারা গর্ভবতী নয় তাদের একটি মাসিক না হওয়া পর্যন্ত মিলিত হওয়া যাবে না।”[১] অর্থাৎ যুদ্ধবন্দীনিদের ক্ষেত্রে তাদের একটি মাসিক পর্যন্ত সময়টুকুই হচ্ছে ইদ্দত।
.
সাফিয়া(রাঃ) কিন্তু প্রথমে যুদ্ধবন্দিনীই ছিলেন অতঃপর রাসূল ﷺ তাঁকে মুক্ত করে বিয়ে করেন। বুখারী শরীফের হাদিসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি রাসূল ﷺ ইদ্দতের সময়টুকু অপেক্ষা করেছিলেনঃ আনাস ইবনে মালিক(রাঃ) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল ﷺ সাফিয়া(রাঃ)কে নিজের জন্য পছন্দ করলেন এবং তাঁকে নিয়ে রওনা দিলেন। একসময় আমরা সাদ-আস-সাহবা নামক স্থানে পৌঁছালাম। এসময় সাফিয়া(রাঃ) তাঁর মাসিক অবস্থা থেকে পবিত্র হলেন। অতঃপর রাসূল(সাঃ) তাঁকে বিয়ে করলেন।’[২]
.
কেমন ছিল সাফিয়া(রাঃ) ও রাসূল ﷺ এর দাম্পত্যজীবন?
.
সাফিয়া(রাঃ) যদি সত্যিই মন থেকে ইসলাম কবুল করে থাকেন তবে তা তাঁর পরবর্তী আচরণেই প্রকাশ পাবার কথা। দেখা যাক, এ ব্যাপারে হাদীস ও সীরাতগ্রন্থগুলো কি বলছেঃ
– ‘রাসূল ﷺ যখন প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে মৃত্যু শয্যায় ছিলেন, তাঁর স্ত্রীরা তাঁর চারপাশে জড় হলেন। তখন সাফিয়া(রাঃ)বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর শপথ! আপনার জায়গায় যদি আমি থাকতে পারতাম ।’ তাঁর কথা শুনে অন্য নবী পত্নীরা মুখটিপে হাসলেন। রাসূল ﷺ তাঁদের দেখে ফেললেন এবং বললেন, ‘তোমাদের মুখ ধুয়ে ফেল।’ তাঁরা বলল, ‘হে আল্লাহর রাসূল! কেন?’ তিনি জবাবে বললেন,‘কারণ তোমরা তাঁকে বিদ্রুপ করেছ। আল্লাহর শপথ সে সত্য বলছে।’[৩]
,
– ভ্রমণে যাবার সময় রাসূল ﷺ তাঁর হাঁটু সাফিয়া(রাঃ) এর জন্য বিছিয়ে দিতেন যাতে তিনি তাতে পা দিয়ে(উটের পিঠে) চড়তে পারেন।[৪]
.
-সাফিয়া(রাঃ) বলেন, ‘একবার ভ্রমণের সময় নবী ﷺ আমার প্রতি সীমাহীন মায়া মমতা দেখিয়েছিলেন। সে সময় আমার বয়স কম ছিল তাই প্রায় সময়ই হাওদাতে বসে থাকতে থাকতে আমার তন্দ্রা এসে যেত আর আমার মাথা কাঠের হাওদাতে বাড়ি খেত। নবী ﷺ অনেক ভালবাসা আর মমতার সাথে আমার মাথা ধরে রাখতেন আর বলতেন, ‘ওহে হুয়ায়ের কন্যা! নিজের দিকে খেয়াল রাখ, না হয় ঘুমিয়ে কিংবা ঝিমিয়ে পড়ে ব্যাথা পাবে।’[৫]
.
-একবার ভ্রমণের সময় সাফিয়া(রাঃ) আর রাসূল ﷺ উট থেকে পড়ে যান। আবু তালহা(রাঃ) দৌড়ে রাসূল ﷺ এর কাছে গেলে তিনি তাঁকে প্রথমে সাফিয়া(রাঃ) এর খোঁজ নিতে বলেন।[৬]
.
-সাফিয়া(রাঃ) বলেন, “একবার রাসূল ﷺ ঘরে এসে দেখতে পান আমি কাঁদছি। রাসূল ﷺ জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে তোমার?’ আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার কিছু স্ত্রী আপনার পরিবার আর কুরাইশদের সাথে সম্পর্কযুক্ত। তাঁরা বলে যে,তাঁরা কুরাইশদের সাথে সম্পর্কযুক্ত আর আমি একজন ইহুদির কন্যা। রাসূল ﷺ বললেন, ‘ওহে হুয়ায়ের কন্যা! এতে কান্নার কি আছে? তোমার তাদেরকে জবাব দেয়া উচিৎ ছিল, ‘কিভাবে তোমরা আমার থেকে উত্তম হতে পারো? যখন হারুন আমার পিতা, মুসা আমার চাচা আর মুহাম্মদ আমার স্বামী!’ [৭]
.
-সাফিয়া(রাঃ) বলেন, ‘একবার রাসূল ﷺ তাঁর স্ত্রীদের সাথে হজ্বে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আমার উট বসে পড়ল কারণ ওটা ছিল সবচেয়ে দুর্বল উট, আর তাই আমি কেঁদে ফেললাম। নবী ﷺ আমার কাছে আসলেন আর আমার চোখের জল নিজের জামা ও হাত দিয়ে মুছে দিলেন। তিনি আমাকে যতই আমাকে কাঁদতে নিষেধ করলেন, আমি ততই কাঁদতে থাকলাম।’[৮]
.
– একবার আয়েশা(রাঃ) , সাফিয়া(রাঃ) এর খাটো অবয়ব সম্পর্কে ইংগিত করলে রাসূল ﷺ বললেন, ‘তুমি এমন একটা কথা বলেছ যেটা সমুদ্রে নিক্ষেপ করলে তা পুরো সমুদ্রের পানি দুর্গন্ধময় করার জন্য যথেষ্ট।’ [৯]
.
– মুহাম্মদ ﷺ আজীবন সাফিয়া(রাঃ) এর প্রতি ভালোবাসা ও মমতা দেখিয়েছেন। তাইতো সাফিয়া(রাঃ) বলতেন, ‘আমি রাসূল ﷺ থেকে উত্তম ব্যক্তি কখনো দেখিনি।’[১০]
.
কারো অবস্থা বর্ণনার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে এটা দেখা যার সম্পর্কে বলা হচ্ছে সে নিজে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বলে। সাফিয়া(রাঃ) কে নিপীড়িত প্রমাণ করতে ইসলাম বিদ্বেষীরা যে বিশাল বিশাল লেখা লিখে, তাঁর নিজের কথায় কিন্তু একেবারে বিপরীত চিত্র ফুটে উঠে।
.
রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর কেমন ছিল সাফিয়া(রাঃ) এর জীবন ?
.
অনেকে বলতে পারে, যে মুহাম্মদ ﷺ এর ভয়েই সাফিয়া(রাঃ) অনুগত থেকেছেন। তাদের হতাশ করে বলতে হয় মহানবী ﷺ এর মৃত্যুর পর সাফিয়া(রাঃ) একই আনুগত্য দেখিয়ে গিয়েছেন। কারণ, তাঁর আনুগত্য ছিল ইসলামের প্রতি। আল্লাহর প্রতি।
,
– “একবার কিছু লোক রাসূল ﷺ এর স্ত্রী সাফিয়া(রা:) এর ঘরে জড় হয়েছিল। তারা আল্লাহকে স্মরণ করে কুরআন তিলওয়াত করছিল এবং সিজদা করছিল। সাফিয়া(রাঃ) তাদের ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমরা সিজদা করলে আর কুরআন তিলওয়াত করলে। কিন্তু (আল্লাহর ভয়ে) তোমাদের (চোখে) অশ্রু কোথায়?”[১১] –
.
“ সাফিয়া(রাঃ) নবী পরিবারের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি ফাতেমা(রাঃ) কে তাঁর প্রতি স্নেহের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গয়না উপহার দেন। এছাড়া তিনি খায়বার থেকে যে গয়না এনেছিলেন তা নবীপত্নীদের উপহার দেন।”[১২]
.
-“সাফিয়া(রাঃ) খুবই দানশীল ও উদার রমণী ছিলেন। তিনি আল্লাহর জন্য তাঁর যা আছে তাঁর সবই দান করতেন, অবস্থা এমন হয়েছিল যে তিনি জীবিত থাকা অবস্থাতেই তাঁর বাড়ি দান করে যান।”[১৩]
.
– প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ইবনে কাসির(রহ:) তাঁর সম্পর্কে বলেন, “ইবাদত, ধার্মিকতা, দুনিয়াবিমুখীতা এবং দানশীলতায় তিনি ছিলেন অন্যতম সেরা নারী।”[১৪]
.
প্রায় সব ইসলাম-বিদ্বেষীরাই সাফিয়া(রাঃ) এর সাথে রাসূল এর বিয়ে নিয়ে নিজেদের কল্পনার রং ছড়িয়ে গল্প বলার চেষ্টা করে। তাদের গল্পটা এমন- ‘যুদ্ধবাজ মুহাম্মদ ﷺ বিনা কারণে খায়বার দখল করেন আর সাফিয়া(রাঃ) এর নিরাপরাধ পিতা ও স্বামীকে হত্যা করেন। অতঃপর সাফিয়া(রাঃ) কে নিজের পিতার লাশ মাড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। নারীলোভী হবার কারণে ইদ্দতের সময়টুকু অপেক্ষা না করেই সাফিয়া(রাঃ)কে ধর্ষণ করেন।’[নাউজুবিল্লাহ]
.
তাদের বলা গল্প অনেকটা-‘আনিস সাহেব রাতের বেলায় এক যুবতী নারীর বাসায় গেলেন। নারীটি তখন বাসায় একা ছিল।’ এই টাইপের হয়ে যায়। অধিকাংশ সময়েই নিজেদের কথা ঢুকিয়ে তারা গল্পটিকে বিকৃত করে ফেলে। এ কারণে প্রসঙ্গসহ দুই পক্ষের বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাস জানাটা জরুরী। সকল প্রশংসা আল্লাহতায়ালার যিনি মুসলিমদের এমন কিছু স্কলার দান করেছেন যারা বিশুদ্ধতার ক্ষেত্রে খুবই খুঁতখুঁতে ছিলেন। যার কারণে ইসলামের ইতিহাসের ক্ষেত্রে জালিয়াতির সুযোগ খুব কম, বড়জোর সম্ভব ইতিহাসটিকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা।
.
অধিকাংশ নাস্তিক ও ইসলাম-বিদ্বেষীরা নিজেদের ট্রুথ-সিকার হিসেবে উপস্থাপন করে। তাদের দাবী হচ্ছে, তারা সত্য খুঁজে খুঁজে আজকের অবস্থানে এসেছে, যেখানে আস্তিকরা কেবল অন্ধ-অনুসরণ করে। ট্রুথ-সিকার তো সে যে নিরেপক্ষ থেকে সকল উৎস থেকে সত্য জানার চেষ্টা করে। একপেশে তথ্য তো কেবল প্রবঞ্চনাই নিয়ে আসে যদি না তাতে সত্য থাকে।
.
অবশ্য আলোর জানালা বন্ধ করে যারা সত্য খোঁজে তাদের প্রবঞ্চনা ছাড়া কিছু পাওয়াও উচিৎ না।
=====================================
তথ্যসূত্রঃ
[১] আবু দাউদ, হাদীস নং-২১৫৭ [১৩] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৮৮৯
[২] ইবনে সা’আদ, তাবাকাত। খন্ড ৮, পৃষ্ঠা ১০১
[৩] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৪২১১
[৪] মাজমা আল জাওয়া’ইদ-আলী ইবনে আবু বকর, খন্ড ৮
[৫] সহীহ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ
[৬] Muhammad ibn’ Isa at Tirmidhi, “Kitabul Manaaqib Bab Fadhlu Azwaajin Nabi,” in Al-Jami’ As-Sahih
[৭] আহমাদ, খন্ড-৬,পৃষ্ঠা-৩৩৭
[৮] সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৮৭৫
[৯] মুসনাদ, খন্ড-১৩, পৃষ্ঠা-৩৮
[১০] Abu Nu’aym al Asbahani, Hilyat al-Awliya, Vol-2, page-55
[১১] ইবনে সা’আদ-তাবাকাত, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১০০
[১২] ইবনে সা’আদ-তাবাকাত, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-১০২
[১৩] ইবনে কাসির-আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খন্ড-৮, পৃষ্ঠা-৪৭
=====================================
লেখকঃ শিহাব আহমেদ তুহিন

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *