নারী অধিকার: ইসলামের পূর্বে ও পরে-

বর্তমানে নারীদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি ও ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। নারী অধিকার, নারীনীতি, সমানাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে সমগ্র বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে অসংখ্য সংগঠন, সংস্থা। এরা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা নামে কাজ করলেও মূলত নারী অধিকার বলতে তারা কি বোঝাতে চাচ্ছে, তা আদৌ স্পষ্ট নয়। নারী অধিকার দ্বারা যদি এ কথা বুঝায় যে, নারী ও পুরুষের অবাধ মেলা-মেশা নিশ্চিত করা, নারী ও পুরুষের মধ্যে কোন প্রকার পার্থক্য না করা, উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো, পশ্চিমা নারীদের মত তাদেরও অধিকার নিশ্চিত করা, তাহলে আমরা বলব, আপনাদের সাথে আমাদের কোন বিতর্ক নয়। আপনারা আপনাদের মত করে কাজ চালিয়ে যান। যারা আপনাদের ষড়যন্ত্রের বেড়াজালে পা দেবে তারা তাদের পরিণতি সম্পর্কে অচিরেই বুঝতে পারবে। কারণ পশ্চিমা নারী আজ তাদের জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজেদের বেঁচে থাকার উপায় খুঁজছে। তাদের অশান্তি আত্ম-কলহ এতই চরমে যে, তাদের দেশে নারীদের আত্মহত্যা করার প্রবণতা বাড়ছে। তারা তাদের জীবনের প্রতি খুবই বিতৃষ্ণ। পশ্চিমা দেশের সচেতন নারীরা তাদের ভোগবাদী ও পশুত্বের জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে পশ্চিমা দেশগুলোতে পুরুষদের তুলনায় নারীদের ইসলাম গ্রহণের হার অধিক। কারণ, তাদের দেশে তথাকথিত নারী স্বাধীনতা থাকলেও কিন্তু তাদের দেশে নারীর আসল মর্যাদা যা আল্লাহ তা‘আলা তাদের জন্য নির্ধারণ করেছেন তা প্রতিষ্ঠিত হয় নি।

মূলত: আল্লাহ তা‘আলাই নারীদের জন্য তাদের প্রকৃত সম্মান, মর্যাদা ও অধিকার দিয়েছেন। আমরা পর্যালোচনা করে দেখতে পাই যে, নারী ও পুরুষ কখনোই সমান হতে পারে না। কোন ক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও মর্যাদা বেশি আবার কোন ক্ষেত্রে পুরুষের অধিকার ও মর্যাদা বেশি। কিছু কাজ আছে, যে গুলো নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা পুরুষরা করতে সক্ষম নয়, আবার কিছু আছে, যেগুলো পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যা নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। নারী ও পুরুষদের এ ধরনের ক্ষেত্র বিশেষ পার্থক্যকে অস্বীকার করার কোন ভিত্তি নাই। যারা এ বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করে, তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা কোন অবিবেচকের কাজ হবে না।

ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবরা নারীদের প্রতি বিষম বৈষম্য প্রদর্শন করত। তাদের তারা মানুষ হিসেবে গণ্য করতেও সংকোচ করত। তাদের উপর চলত অমানবিক নির্যাতন। কিন্তু ইসলাম এসে নারীদের প্রতি কি ধরনের সম্মান দেয়, তার একটি পর্যালোচনা এ নিবন্ধে তুলে ধরা হল।

জাহিলিয়্যাতের যুগে আরব সমাজে নারীদের অবস্থান ও তাদের প্রতি ইসলামের অনুগ্রহ:

আরবদের ইতিহাস হল, তারা নিজেদের আত্মমর্যাদা ও ইজ্জত সম্মানের দিকটি অধিক বিবেচনা করার কারণে, তাদের নারীদের প্রতি কোন প্রকার অশুভ ও অসম্মানজনক আচরণ হতে পারে এ আশঙ্কায় তারা তাদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করে ফেলত। বিশেষ করে, তাদের মধ্যে যারা সম্ভ্রান্ত পরিবার বলে পরিচিত ছিল, তারা তাদের সম্মান ও মর্যাদাহানিকে কোনক্রমেই মেনে নিতে পারত না। তাই তারা মনে করত, তাদের নিকট কন্যা সন্তানদের হত্যার কোন বিকল্প নাই। অন্যথায় তাদের পদে পদে অসম্মান হতে হবে। তাদেরই এক শ্রেণীর লোক এমন ছিল, যাদের নিকট তুলনামূলক কিছুটা হলেও নারীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করার প্রচলন ছিল; কিন্তু এ অবস্থাও বিভিন্নভাবে নারীদের অধিকারকে ঘোলাটে করে ফেলত এবং তাদেরকে তাদের মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত করা হত। ফলে এক কথায় বলা চলে তৎকালীন আরব সমাজে নারীর অধিকার বলতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। প্রতিনিয়তই তাদের ইজ্জত ও সম্মান লুণ্ঠিত হত এবং তাদের সাথে অমানবিক আচরণ করা হত। জাহিলিয়্যতের যুগে নারীদেরকে তাদের উত্তরাধিকারী সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা হত। তাদেরকে সাধারণত কোন সম্পদের মালিক করা হত না, যার কারণে জাহিলিয়্যাতের যুগে আরবের নারীদের মালিকানা বলতে কিছুই ছিল না।

আর ইসলামের আগমনের পর ইসলাম নারীদের জন্য উত্তরাধিকারী সম্পত্তিতে তাদের অধিকার নিশ্চিত করে এবং সম্পত্তিতে তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করে।

জাহেলিয়াতের যুগে স্বামীর তালাক অথবা মৃত্যুর পর তার পছন্দানুযায়ী অপর কোন পুরুষের নিকট বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া নারীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। ফলে একজন নারী তালাকপ্রাপ্তা বা স্বামীহারা হলে তাকে অসহনীয় যন্ত্রণা ও সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হত এবং তাকে বাধ্য হয়ে অতি কষ্টে কালাতিপাত ও জীবন—যাপন করতে হত।

কিন্তু ইসলাম নারীদের এ দুর্ভোগের প্রতিকার করে তাদের লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার হাত থেকে উদ্ধার করেছে। ইসলাম তাদের পুনরায় নতুন জীবন শুরু করার সুযোগ করে দেয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

{وَإِذَا طَلَّقْتُمُ النِّسَاء فَبَلَغْنَ أَجَلَهُنَّ فَلاَ تَعْضُلُوهُنَّ أَن يَنكِحْنَ أَزْوَاجَهُنَّ إِذَا تَرَاضَوْاْ بَيْنَهُم بِالْمَعْرُوفِ ذَلِكَ يُوعَظُ بِهِ مَن كَانَ مِنكُمْ يُؤْمِنُ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكُمْ أَزْكَى لَكُمْ وَأَطْهَرُ وَاللّهُ يَعْلَمُ وَأَنتُمْ لاَ تَعْلَمُونَ }

অর্থ: আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দেবে, অতঃপর তারা তাদের ইদ্দতে পৌঁছবে তখন তোমরা তাদেরকে বাধা দিয়ো না যে, তারা তাদের স্বামীদেরকে বিয়ে করবে যদি তারা পরস্পরে তাদের মধ্যে বিধি মোতাবেক সম্মত হয়। এটা উপদেশ তাকে দেয়া হচ্ছে, যে তোমাদের মধ্যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে। এটি তোমাদের জন্য অধিক শুদ্ধ ও অধিক পবিত্র। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না। [সূরা বাকারা: আয়াত ২৩২]

জাহিলিয়্যাতের যুগে নারীরা তাদের নিজদের ধন-সম্পদ নিজেরা ভোগ করতে পারত না। তাদের সম্পত্তিতে তাদের কোন অধিকার ছিল না। ফলে তারা ইচ্ছা করলেও তাতে কোন হস্তক্ষেপ করতে পারত না। মোহরানা হিসেবে তাদের যে টাকা-অর্থ কড়ি- দেয়া হত, তাও স্বামীরা তাদের থেকে আত্মসাৎ করে নিয়ে নিত। তারা নারীদের উপর অযাচিত হস্তক্ষেপ করত ও তাদের ক্ষতি সাধনের লক্ষ্যে তাদেরকে গৃহাভ্যন্তরে আটক করে রাখত। ফলে তারা অন্য কোন স্বামীর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারত না।

কিন্তু ইসলাম আসার পর নারীদের উপর এ ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ ও অনধিকার চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হয়, নারীরা তাদের সম্পত্তিতে তাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যয় করা এবং পছন্দমত বিবাহ করার অধিকার ফিরে পায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَرِثُوا النِّسَاءَ كَرْهًا وَلَا تَعْضُلُوهُنَّ لِتَذْهَبُوا بِبَعْضِ مَا آَتَيْتُمُوهُنَّ إِلَّا أَنْ يَأْتِينَ بِفَاحِشَةٍ مُبَيِّنَةٍ وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللَّهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا﴾

হে মুমিনগণ, তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা জোর করে নারীদের ওয়ারিশ হবে। আর তোমরা তাদেরকে আবদ্ধ করে রেখো না, তাদেরকে যা দিয়েছ তা থেকে তোমরা কিছু নিয়ে নেয়ার জন্য, তবে যদি তারা প্রকাশ্য অশ্লীলতায় লিপ্ত হয়। আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস কর। আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রাখবেন। [সূরা নিসা: ১৯]

জাহিলিয়্যাতের যুগে নারীরা তাদের স্বামীদের পক্ষ হতে নানাবিধ নির্যাতন, বৈষম্য ও অবহেলার স্বীকার হত। নারীরা তাদের স্বামীদের পক্ষ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অশুভ আচরণের মুখোমুখি হত। আবার কখনো কখনো তারা নারীদেরকে একটি অনিশ্চিত জীবনের দিকে ঠেলে দিত। তাদের তালাকও দিত না আবার স্ত্রীরূপে তাদের মেনেও নিত না। বরং তাদের ঝুলিয়ে রাখত। এটি ছিল তাদের জন্য একটি অবর্ণনীয় দুরবস্থা; যার প্রতিকার একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। ইসলাম স্ত্রীদের সাথে এ ধরনের অশালীন ও অন্যায় আচরণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে এবং এ ধরনের আচরণকে চিরতরে হারাম ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

{ وَلَن تَسْتَطِيعُواْ أَن تَعْدِلُواْ بَيْنَ النِّسَاء وَلَوْ حَرَصْتُمْ فَلاَ تَمِيلُواْ كُلَّ الْمَيْلِ فَتَذَرُوهَا كَالْمُعَلَّقَةِ وَإِن تُصْلِحُواْ وَتَتَّقُواْ فَإِنَّ اللّهَ كَانَ غَفُوراً رَّحِيماً } سورة النساء ، الآية ১২৯

অর্থ, আর তোমরা যতই কামনা কর না কেন তোমাদের স্ত্রীদের মধ্যে সমান আচরণ করতে কখনো পারবে না। সুতরাং তোমরা [একজনের প্রতি] সম্পূর্ণরূপে ঝুঁকে পড়ো না, যার ফলে তোমরা [অপরকে] ঝুলন্তের মত করে রাখবে। আর যদি তোমরা মীমাংসা করে নাও এবং তাকওয়া অবলম্বন কর, তবে নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সূরা নিসা: ১২৯]

আর জাহিলিয়্যাতের যুগে কিছু কিছু খাদ্য এমন ছিল, যা শুধু পুরুষরা খেতে পারত নারীরা খেতে পারত না। নারীদের জন্য তা ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। আল্লাহ তাদের এ ধরনের বৈষম্যের সমালোচনা করে বলেন—

{ وَقَالُواْ مَا فِي بُطُونِ هَـذِهِ الأَنْعَامِ خَالِصَةٌ لِّذُكُورِنَا وَمُحَرَّمٌ عَلَى أَزْوَاجِنَا وَإِن يَكُن مَّيْتَةً فَهُمْ فِيهِ شُرَكَاء سَيَجْزِيهِمْ وَصْفَهُمْ إِنَّهُ حِكِيمٌ عَلِيمٌ } سورة الأنعام ، الآية

অর্থ, আর তারা বলে, এই চতুষ্পদ জন্তুগুলোর পেটে যা আছে, তা আমাদের পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট এবং আমাদের স্ত্রীদের জন্য হারাম। আর যদি তা মৃত হয়, তবে তারা সবাই তাতে শরীক। অচিরেই তিনি তাদেরকে তাদের কথার প্রতিদান দেবেন। নিশ্চয় তিনি প্রজ্ঞাবান, জ্ঞানী। [সূরা আনআম: ১৩৯]

এ ছাড়াও তাদের বিবাহ করার কোন নির্ধারিত সংখ্যা ছিল না। তারা তাদের ইচ্ছামত একাধিক বিবাহ করত এবং দুই বোনকে একত্রে এক সাথে বিবাহ করা তাদের সমাজে নিষিদ্ধ ছিল না। ইসলামের আগমনের পর দু বোনকে একত্র করা এবং এক সাথে চারের অধিক বিবাহ করা নিষিদ্ধ হয়। যার ফলে পুরুষদের জন্য যা ইচ্ছা তা করার যে একটা প্রবণতা তাদের সমাজে অব্যাহত ছিল, তা একটি নিয়মনীতি আওতায় চলে আসে এবং তাতে নারীদের দুশ্চিন্তার পরিসমাপ্তি ঘটে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

﴿حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالَاتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمُ اللَّاتِي أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ مِنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَائِبُكُمُ اللَّاتِي فِي حُجُورِكُمْ مِنْ نِسَائِكُمُ اللَّاتِي دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَإِنْ لَمْ تَكُونُوا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ وَحَلَائِلُ أَبْنَائِكُمُ الَّذِينَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ وَأَنْ تَجْمَعُوا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ إِلَّا مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا﴾

অর্থ, তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে তোমাদের মাতাদেরকে, তোমাদের মেয়েদেরকে, তোমাদের বোনদেরকে, তোমাদের ফুফুদেরকে, তোমাদের খালাদেরকে, ভাতিজীদেরকে, ভাগ্নিদেরকে, তোমাদের সে সব মাতাকে যারা তোমাদেরকে দুধ-পান করিয়েছে, তোমাদের দুধ-বোনদেরকে, তোমাদের শাশুড়িদেরকে, তোমরা যেসব স্ত্রীর সাথে মিলিত হয়েছ সেসব স্ত্রীর অপর স্বামী থেকে যেসব কন্যা তোমাদের কোলে রয়েছে তাদেরকে, আর যদি তোমরা তাদের সাথে মিলিত না হয়ে থাক তবে তোমাদের উপর কোন পাপ নেই এবং তোমাদের ঔরসজাত পুত্রদের স্ত্রীদেরকে এবং দুই বোনকে একত্র করা [তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে]। তবে অতীতে যা হয়ে গেছে তা ভিন্ন কথা। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। [সূরা নিসা: ২৩]

তাদের মধ্যে আরেকটি বর্বরতা ও কুসংস্কার বিরাজ করছিল যে, পিতা তার স্ত্রীদের তালাক দিলে, অথবা মারা গেলে সন্তানরা পিতার স্ত্রীদের বিবাহ করতে পারত। এ ধরনের মানবতা বিরোধী ও ঘৃণিত কাজটি করতে তাদের সমাজে কোন অপরাধ ছিল না এবং তারা কোন প্রকার দ্বিধা-বোধও করত না। তবে ইসলামের আগমনের পর আল্লাহ তা‘আলা এ ধরনের নিন্দিত ও ঘৃণিত কাজটিকে চিরতরে রহিত করে দেন এবং হারাম ঘোষণা করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

﴿وَلاَ تَنكِحُواْ مَا نَكَحَ آبَاؤُكُم مِّنَ النِّسَاء إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَمَقْتاً وَسَاء سَبِيلاً﴾

অর্থ, আর তোমরা বিবাহ করো না নারীদের মধ্য থেকে যাদেরকে বিবাহ করেছে তোমাদের পিতৃপুরুষগণ। তবে পূর্বে যা সংঘটিত হয়েছে [তা ক্ষমা করা হল]। নিশ্চয় তা হল অশ্লীলতা ও ঘৃণিত বিষয় এবং নিকৃষ্ট পথ। [সূরা নিসা: ২২]

জাহেলিয়াতের যুগে জীবজন্তু ও ধন সম্পদ যেভাবে মিরাসের সম্পত্তি হওয়ার যোগ্য অনুরূপভাবে নারীরাও ধন সম্পদের মত মিরাসের সম্পত্তি রূপে পরিগণিত হত।

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন— আরবদের অবস্থা ছিল এই যে, তাদের কারো পিতা মারা গেলে অথবা তার সহযোগী কেউ মারা গেলে, তার স্ত্রীর উপর কর্তৃত্ব অন্যদের তুলনায় তাঁরই বেশী হত। সে ইচ্ছা করলে তাকে আটকে রাখতে পারত অথবা তার মোহরানা বা ধন— সম্পত্তি দ্বারা মুক্তিপণ না দেয়া পর্যন্ত তাকে করায়ত্ত করে রাখতে পারত অথবা তার মৃত্যু পর্যন্ত ধরে রাখতে পারত। আর যখন মারা যায় তখন সে তার ধন-সম্পদসহ যাবতীয় সবকিছুর মালিক হত।

আতা ইবন আবি রাবাহ বলেন— জাহিলিয়্যাতের যুগে যদি কোন মানুষ মারা যেত, তখন তাদের মধ্যে কোন ছোট বাচ্চা থাকলে, তার লালন-পালনের জন্য তার পরিবারের লোকেরা স্ত্রীটিকে আটক করে রাখত। অন্য কোথাও বিবাহ বসার অনুমতি দিত না।

আল্লামা সুদ্দী রহ. বলেন— জাহিলিয়্যাতের যুগে পিতা, ভাই বা ছেলে মারা যাওয়ার পর, মৃত ব্যক্তির ওয়ারিশদের থেকে যে সর্বাগ্রে তার উপর স্বীয় চাদর রাখতে পারত, সেই তার স্বামীর দেয়া মোহরের বিনিময়ে তাকে বিবাহ করা অথবা অপরের নিকট বিবাহ দিয়ে তার মোহরের মালিক হওয়ার সর্বাধিক বেশি হকদার। আর যদি মহিলাটি তার উপর কাপড় ফেলার পূর্বে সে তার পরিবারের নিকট চলে যায়, তাহলে সে নিজেই তার নিজের যাবতীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রাখত!

একটু ভেবে দেখুন কি এক অদ্ভুত ছিল তাদের জীবন ব্যবস্থা ও সামাজিক রীতিনীতি। বিশেষ করে তাদের নারীদের জীবন ব্যবস্থা ও তাদের জন্য আরোপিত আইন কানুন।

জাহিলিয়্যতের যুগে তালাকের কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিল না। যে যত পারত সে তার স্ত্রীদের ততই তালাক দিত পারত। কিন্তু ইসলাম তালাককে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তালাকের সংখ্যা নির্ধারণ করে দেয়। সুতরাং এখন আর নির্ধারিত পরিমাণের অতিরিক্ত তালাক দেয়া ও নারীদের নিয়ে তামাশা করার যাবতীয় পথ বন্ধ করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে ইরশাদ করেন—

﴿الطَّلَاقُ مَرَّتَانِ فَإِمْسَاكٌ بِمَعْرُوفٍ أَوْ تَسْرِيحٌ بِإِحْسَانٍ وَلَا يَحِلُّ لَكُمْ أَنْ تَأْخُذُوا مِمَّا آَتَيْتُمُوهُنَّ شَيْئًا إِلَّا أَنْ يَخَافَا أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَإِنْ خِفْتُمْ أَلَّا يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا فِيمَا افْتَدَتْ بِهِ تِلْكَ حُدُودُ اللَّهِ فَلَا تَعْتَدُوهَا وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُودَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الظَّالِمُونَ﴾

অর্থ, তালাক দুইবার। অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে। আর তোমাদের জন্য হালাল নয় যে, তোমরা তাদেরকে যা দিয়েছ, তা থেকে কিছু নিয়ে নেবে। তবে উভয়ে যদি আশঙ্কা করে যে, আল্লাহর সীমারেখায় তারা অবস্থান করতে পারবে না। সুতরাং তোমরা যদি আশঙ্কা কর যে, তারা আল্লাহর সীমারেখা কায়েম রাখতে পারবে না তাহলে স্ত্রী যা দিয়ে নিজকে মুক্ত করে নেবে তাতে কোন সমস্যা নেই। এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন করো না। আর যে আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্তুত তারাই যালিম। [সূরা বাকারাহ: ২২৯]

জাহিলিয়্যাতের যুগে আরবদের কন্যা সন্তানদের প্রতি এতই অনীহা ছিল যে, তারা তাদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করতেও কোন প্রকার কুণ্ঠাবোধ করত না। অনেক আরব পিতারা কন্যা সন্তানদের নিজ হাতে হত্যা করে নিজেদের কলঙ্কের হাত থেকে রক্ষা করত। এ ধরনের ঘটনা তাদের সমাজে ছিল অসংখ্য।

তাদের সামাজিক অবয়ের এহেন নাজুক মুহূর্তেই ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। ইসলাম তাদের সামাজিক অবক্ষয়ের মূলোৎপাটন করে এবং তাদের আলোর পথের সন্ধান দেয়। আরবরা বিভিন্ন কারণ তাদের সন্তানদের হত্যা করত। বিভিন্ন লোক বিভিন্ন কারণে তাদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করত।

অপমান ও আত্ম-মর্যাদাবোধ ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কায় তারা তাদের কন্যা সন্তানদের হত্যা করত।

আবার তাদের মধ্যে কতক এমন ছিল, যারা তাদের কন্যা সন্তানের কান-নাক কাটা, অত্যধিক কালো, অন্ধ, খোঁড়া, বোবা ও বধির হওয়ার কারণে হত্যা করত। কারণ, তারা মনে করত এ সব দোষ তাদের জন্য দুর্ভোগ ভয়ে আনবে।

কখনো কখনো কোন কারণ ছাড়াই তারা অত্যন্ত পাষাণ ও নির্দয় হয়ে নির্মমভাবে তাদের হত্যা করত অথবা জীবন্ত গোরস্থ করত। এতে তারা অত্যন্ত পাষণ্ড হৃদয়ের পরিচয় দিত তাদের মধ্যে কোন দয়া-মায়া বলতে কিছুই ছিল না। এহেন গর্হিত কাজটি করতে তাদের বিবেক তাদের কোন বাধা দিত না।

আবার কখনো তার পিতা দেশের বাইরে বা কোন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে হত্যা করতে পারত না। ফলে সে যখন বাড়িতে আসত, তখন তাকে হত্যা করত। এতে দেখা যেত সে বড় হয়ে গেছে এবং সব কিছু বুঝে; তারপরও তারা তাকে হত্যা করত। বড় হয়ে যাওয়া ও সব কিছু বুঝতে পারা ইত্যাদি কোন কিছুই এ সব পাষণ্ডদের এ অমানবিক কাজ হতে বিরত রাখতে পারত না।

এ বিষয়ে পরবর্তীতে তাদের অনেকেই নিজদের জীবনের একাধিক হৃদয়—বিদারক ঘটনার একাধিক বর্ণনা দিয়েছেন।

আবার তাদের অনেকে এমন আছে, যারা তাদের কন্যা সন্তানদের পাহাড়, ঘরের চাঁদ অথবা অন্য কোন উঁচু স্থান থেকে নিক্ষেপ করে হত্যা করত।

আল্লাহ তা‘আলা এ জঘন্যতম ঘৃণিত কাজটি সম্পর্কে কুরআনে করীমেও আলোচনা করেন। আল্লাহ বলেন—

﴿وَإِذَا الْمَوْؤُودَةُ سُئِلَتْ . بِأَيِّ ذَنبٍ قُتِلَت﴾

আর যখন জীবন্ত গোরস্থ কন্যাকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কি অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছে? [সূরা তাকওয়ীর:৮-৯]

·আরবের যারা খুব গরীব ও অসহায় গোত্র ছিল, তারা তাদের কন্যা সন্তানদের দরিদ্রতা, অভাব ও তাদের জন্য ব্যয় করার মত কিছু না থাকার কারণে হত্যা করত। আল্লাহ তাদের এসব কারণে হত্যা করতে সম্পূর্ণ নিষেধ করে বলেন—

﴿وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلادَكُمْ خَشْيَةَ إِمْلاقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُهُمْ وَإِيَّاكُم إنَّ قَتْلَهُمْ كَانَ خِطْئاً كَبِيراً ﴾

অভাব-অনটনের ভয়ে তোমরা তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করো না। আমিই তাদেরকে রিযক দেই এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ। [সূরা আল ইসরা: ৩১]

জাহিলিয়্যাতের যুগে আরবদের মধ্যে আরও একটি ব্যতিক্রম নিয়ম ছিল, আরবের কতক সরদার ও সম্ভ্রান্ত লোক কন্যা সন্তানদের ক্রয় করে নিত। এ বিষয়ে সা-সা ইবনে নাহিয়া নামে এক ভদ্র লোক বলেন— ইসলামের আগমনের পূর্বে তিনশত জীবন্ত-প্রোথিত [যাদের হত্যা করা হত] কন্যা সন্তানকে আমি মুক্ত করছি।

আরবদের মধ্যে আরেকটি প্রথা ছিল, তারা এ বলে মান্নত করত; যদি তাদের দশটি সন্তান হয় তাহলে তারা একটিকে জবেহ করবে। আব্দুল মুত্তালিব নিজেও এ ধরনের মান্নত করেছিল।

আবার তাদের কতক লোক করত, ফেরেশতারা হল আল্লাহর কন্যা— অথচ তারা যা বলে আল্লাহ তা হতে সম্পূর্ণ পবিত্র। তারা আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান সাব্যস্ত করে অথচ আল্লাহ তা‘আলা তাদের বিষয়ে অধিক হকদার।

আর যেনা-ব্যভিচার আরবদের মধ্যে কোন দূষণীয় বিষয় ছিল না। যেনা-ব্যভিচার করাকে আরবের স্বাধীন মহিলারা তাদের উন্নতি ও অহংকারের কারণ বলে বিবেচনা করত। তবে তারা তা প্রকাশ করা এবং এ গুণে তাদের সম্বোধন করাকে অপছন্দ করত! [একে তারা তাদের জন্য অপমান হিসেবে আখ্যায়িত করত] তাদের মধ্যে যেনা-ব্যভিচার ছিল অত্যন্ত সংগোপনে, কেউ তা জানতে পারত না।

ইসলাম আসার পর ইসলাম পবিত্রা নারীদের প্রশংসা করে এবং যাবতীয় অপকর্ম ও সব ধরনের যেনা-ব্যভিচার হতে নারীদের বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়। নারীদের পবিত্রতা সংরক্ষণ ও তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের যাবতীয় উপায় উপকরণ অবলম্বনের নির্দেশ দেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

﴿الْيَوْمَ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ وَطَعَامُ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ حِلٌّ لَّكُمْ وَطَعَامُكُمْ حِلُّ لَّهُمْ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُواْ الْكِتَابَ مِن قَبْلِكُمْ إِذَا آتَيْتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ مُحْصِنِينَ غَيْرَ مُسَافِحِينَ وَلاَ مُتَّخِذِي أَخْدَانٍ وَمَن يَكْفُرْ بِالإِيمَانِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ وَهُوَ فِي الآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ﴾

আজ তোমাদের জন্য বৈধ করা হল সব ভাল বস্তু এবং যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, তাদের খাবার তোমাদের জন্য বৈধ এবং তোমাদের খাবার তাদের জন্য বৈধ। আর মুমিন সচ্চরিত্রা নারী এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের সচ্চরিত্রা নারীদের সাথে তোমাদের বিবাহ বৈধ। যখন তোমরা তাদেরকে মোহর দেবে, বিবাহকারী হিসেবে, প্রকাশ্য ব্যভিচারকারী বা গোপন গ্রহণকারী হিসেবে নয়। আর যে ঈমানের সাথে কুফরি করবে, অবশ্যই তার আমল বরবাদ হবে এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত। [সূরা মায়েদা: ৫]

তাদের মধ্যে যারা সম্ভ্রান্ত ও উচ্চ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং মধ্যম শ্রেণীর লোক তাদের মধ্যে নারীদের সাথে বিভিন্ন রকমের সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, যার আলোচনা আয়েশা রা. করেছেন, তিনি বলেন—

أن النكاح في الجاهلية كان على أربع أنحاء : فنكاح منها نكاح الناس اليوم : يخطب الرجل إلى الرجل وليته أوابنته ، فيصدقها ثم ينكحها . ونكاح آخر : كان الرجل يقول لامرأته إذا طهرت من طمثها أرسلي إلى فلان فاستبضعي منه ، ويعتزلها زوجها ولا يمسها أبدا ، حتى يتبين حملها من ذلك الرجل الذي تستبضع منه ، فإذا تبين حملها أصابها زوجها إذا أحب ، وإنما يفعل ذلك رغبة في نجابة الولد ، فكان هذا النكاح نكاح الاستبضاع .

ونكاح أخر : يجتمع الرهط ما دون العشرة ، فيدخلون على المرأة ، كلهم يصيبها ، فأذا حملت ووضعت ، ومر عليها ليال بعد أن تضع حملها ، أرسلت إليهم ، فلم يستطع رجل أن يمتنع ، حتى يجتمعوا عندها ، تقول لهم : قد عرفتم الذي كان من أمركم وقد ولدت ، فهو ابنك يا فلان ، تسمي من أحبت باسمه فيلحق به ولدها ، لا يستطيع أن يمتنع منه الرجل .

ونكاح رابع : يجتمع الناس كثيرا ، فيدخلون على المرأة ، لا تمتنع ممن جاءها ، وهن البغايا ، كن ينصبن على أبوابهن رايات تكون علما ، فمن أراد دخل عليهن ، فإذا حملت إحداهن ووضعت حملها جمعوا لها ، ودعوا القافة ، ثم ألحقوا ولدها بالذي يرون ، فالتاط به ، ودعي ابنه ، لا يمتنع من ذلك فلما بعث النبي صلى الله عليه وسلم بالحق ، هدم نكاح الجاهلية كله إلا نكاح الناس اليوم .

জাহিলিয়্যাতের যুগে বিবাহ ছিল চার প্রকার। এক— বর্তমানে মানুষ যেভাবে বিবাহ করে— কোন ব্যক্তি কারো অভিভাবকের নিকট তার অভিভাকত্বের অধীন কোন মেয়েকে অথবা সে অভিভাবকের নিকট তার মেয়ের জন্য বিবাহের প্রস্তাব করত। তারপর সে রাজি হলে, তাকে মোহরানা দিয়ে বিবাহ করবে। দুই— স্বামী তার স্ত্রীকে বলত, তুমি তোমার অপবিত্রতা হতে পবিত্র হলে অমুকের নিকট গিয়ে, তার কাছ থেকে তুমি উপভোগ করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ কর। তারপর তার স্বামী তাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখত এবং যতদিন পর্যন্ত ঐ লোক যার সাথে সে যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছিল, তার থেকে গর্ভধারণ না করা পর্যন্ত সে তাকে স্পর্শ করত না। আর যখন সে গর্ভধারণ করত তখন চাইলে সে তার সাথে সংসার করত অথবা ইচ্ছা করলে সে নাও করতে পারত। আর তাদের এ ধরনের অনৈতিক কাজ করার উদ্দেশ্য হল, যাতে তাদের গর্ভে যে সন্তান আসবে তা মোটা তাজা ও সুঠাম দেহের অধিকারী হয়। এ বিবাহকে জাহিলিয়্যাতের যুগে নিকাহে ইস্তেবজা বলা হত।

তিন— দশজনের চেয়ে কম সংখ্যক লোক একত্র হত, তারা সকলেই পালাক্রমে একজন মহিলার সাথে সঙ্গম করত। সে তাদের থেকে গর্ভধারণ করার পর যখন সন্তান প্রসব করত এবং কয়েক দিন অতিবাহিত হত, তখন সে প্রতিটি লোকের নিকট তার নিকট উপস্থিত হওয়ার জন্য খবর পাঠাতো। নিয়ম হল, সে যাদের নিকট সংবাদ পাঠাতো কেউ তা অস্বীকার করতে পারতো না। ফলে তারা সকলে তার সামনে একত্র হত। তখন সে তাদের বলত তোমরা অবশ্যই তোমাদের বিষয়ে অবগত আছ। আমি এখন সন্তান প্রসব করেছি এর দায়িত্ব তোমাদের যে কোন একজনকে নিতে হবে। তারপর সে যাকে পছন্দ করত তার নাম ধরে তাকে বলত এটি তোমার সন্তান। এভাবেই সে তার সন্তানকে তাদের একজনের সাথে সম্পৃক্ত করে দিত। লোকটি তাকে কোনভাবেই নিষেধ করতে পারত না।

চার— অনেক মানুষ কোন একই মহিলার সাথে যৌন কর্মে মিলিত হত। তার অভ্যাস হল, যেইতার নিকট খারাব উদ্দেশ্য আসতো, সে কাউকে নিষেধ করত না এবং বাধা দিত না। এ ধরনের মহিলারা হল, ব্যভিচারী মহিলা। তারা বাড়ির দরজায় নিদর্শন স্থাপন করত, যাতে মানুষ বুঝতে পারত যে, এখানে কোন যৌনাচারী মহিলা আছে। যে কেউ ইচ্ছা করে সে এখানে প্রবেশ করতে পারে। তারপর যখন তারা গর্ভবতী হত এবং সন্তান প্রসব করত, তারা সবাই তার নিকট একত্র হত এবং একজন গণককে ডাকা হত। সে যাকে ভালো মনে করত, তার সাথে সন্তানটিকে সম্পৃক্ত করে দিত এবং তাকে তার ছেলে বলে আখ্যায়িত করা হত। নিয়ম হল গণক যাকে পছন্দ করবে সে তাকে অস্বীকার করতে পারত না।

এভাবেই চলতে ছিল আরবদের সামাজিক অবস্থা ও তাদের নারীদের করুণ পরিণতি। তারপর যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সত্যের বাণী নিয়ে দুনিয়াতে প্রেরণ করা হল, রাসূল জাহিলিয়্যাতের যুগের সব বিবাহ প্রথাকে বাদ দিয়ে দিলেন একমাত্র বর্তমানে প্রচলিত বিবাহ ছাড়া। [বুখারী: ৫১২৭]

জাহিলিয়্যাতের যুগে কোন কোন আরবরা দাসীদের মাঝে অর্থ উপার্জনের জন্য বা তাদের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যভিচারকে উৎসাহিত করত। ইসলামের আগমনের পর আল্লাহ তা‘আলা দাসীদের ব্যভিচারে বাধ্য করতে নিষেধ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন—

﴿وَلْيَسْتَعْفِفِ الَّذِينَ لَا يَجِدُونَ نِكَاحًا حَتَّى يُغْنِيَهُمُ اللَّهُ مِنْ فَضْلِهِ وَالَّذِينَ يَبْتَغُونَ الْكِتَابَ مِمَّا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ فَكَاتِبُوهُمْ إِنْ عَلِمْتُمْ فِيهِمْ خَيْرًا وَآَتُوهُمْ مِنْ مَالِ اللَّهِ الَّذِي آَتَاكُمْ وَلَا تُكْرِهُوا فَتَيَاتِكُمْ عَلَى الْبِغَاءِ إِنْ أَرَدْنَ تَحَصُّنًا لِتَبْتَغُوا عَرَضَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَمَنْ يُكْرِهُّنَّ فَإِنَّ اللَّهَ مِنْ بَعْدِ إِكْرَاهِهِنَّ غَفُورٌ رَحِيمٌ﴾

“আর যাদের বিবাহের সামর্থ্য নেই আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাব-মুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে। আর তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায় তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর, যদি তোমরা তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে বলে জানতে পার এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা থেকে তোমরা তাদেরকে দাও। তোমাদের দাসীরা সতীত্ব রা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের কামনায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য করো না। আর যারা তাদেরকে বাধ্য করবে, নিশ্চয় তাদেরকে বাধ্য করার পর আল্লাহ তাদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। [সূরা আন-নূর:৩৩]

এভাবেই জাহিলিয়্যাতের যুগে নারীদের প্রতি বৈষম্য ও তাদের ভোগের পণ্যে পরিণত করা হত। তাদের সমাজের বোঝা মনে করা হত। মানুষ হিসেবে সমাজে তাদের কোন মূল্যায়ন ছিল না। জুলুম নির্যাতন ছিল তাদের নিত্যদিনের সাথী। নারী বলে জন্ম গ্রহণ করাই ছিল তাদের একমাত্র অপরাধ। প্রতিনিয়তই তারা নির্যাতিত হত পুরুষদের মাধ্যমে।

তারপর যখন ইসলামের আগমন ঘটল, ইসলামই নারীদের মর্যাদার আসনে সমাসীন করলেন। তাদের সম্মান ও আত্ম-মর্যাদাবোধ তাদের ফিরিয়ে দিলেন। ইসলাম নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহ তাদের থেকে যাবতীয় জুলুম নির্যাতন প্রতিহত করল। তাদের প্রতি পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলো কি তা পালনে ইসলাম পুরুষদের বাধ্য করল।

ইসলাম ছোট বেলায় কন্যা সন্তান হিসেবে, কৈশোরেবোন হিসেবে, যুবতী হলে স্ত্রী হিসেবে এবং বার্ধক্যে পৌছলে মা হিসেবে নারীদের যথার্থ মূল্যায়ন করল এবং তাদের উচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করল। বর্তমানে অনেকগুলো প্রচার মাধ্যম, সাহিত্যিক ও লেখকগণ নারীদের ছোট বেলা থেকে নিয়ে বার্ধক্যে পৌঁছা পর্যন্ত ইসলাম যে অধিকার দিয়েছেন তা সম্পর্কে তাদের নূন্যতম কোন জ্ঞান না থাকার কারণে তারা ইসলাম বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করে থাকে। অথচ ইসলাম নারীদের যে সম্মান ও অধিকার দিয়েছে, ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত দুর্লভ। এ বিষয়ে কিয়দংশ নিম্নে আলোচনা করা হল।

১. ইসলাম নারীদের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং মানুষ হিসেবে তাদের সম্মান দিয়েছে। ইয়াহূদীরা মনে করে নারীরা অত্যন্ত খারাপ আত্মার অধিকারী ও নিকৃষ্ট প্রকৃতির। কারণ, নারীর কারণেই আদম আ. ধোঁকায় পড়ল এবং নারীই জান্নাত হতে বের ও বিতাড়িত হওয়ার কারণ হলো, ইসলাম এ ধারনার সমর্থন করে না।

জাহিলিয়্যাতেরযুগেরআরবরা গোমরাহিওঅজ্ঞতারউপরএতই মগ্ন ছিল যারকারণেতারানারীদেরঅস্তিত্বইমেনেনিতেরাজিহতোনাবরংনারীদেরকথাশুনলেইতাদেরচেহারাকালোহয়েযেত।রাগে, ক্ষোভেওলজ্জায়তাদেরমাটিতেমিশেযাওয়ারউপক্রমহত।আল্লাহতা‘আলাতাদেরঅবস্থারবর্ণনাদিয়েবলল—

﴿وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُمْ بِالأُنثَى ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدّاً وَهُوَ كَظِيمٌ . يَتَوَارَى مِنَ الْقَوْمِ مِن سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ أَيُمْسِكُهُ عَلَى هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ أَلاَ سَاء مَا يَحْكُمُونَ﴾

অর্থ, আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেয়া হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, সে দুঃখে সে কওমের থেকে আত্মগোপন করে। অপমান সত্ত্বেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুঁতে ফেলবে? জেনে রেখ, তারা যা ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ”!

অথচআল্লাহতা‘আলানারীওপুরুষদেরসম্মানেরদিকদিয়েতাদেরউভয়েরসমমর্যাদারঅধিকারীকরেন।আল্লাহরমাখলুকহিসেবেতাদেরউভয়েরযথাযথসম্মানওমর্যাদা আল্লাহ তা‘আলাতাদেরদিয়েছেন।আল্লাহতা‘আলাকুরআনেকরীমেইরশাদকরেন—

﴿وَلَقَدْ كَرَّمْنَا بَنِي آدَمَ وَحَمَلْنَاهُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَرَزَقْنَاهُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى كَثِيرٍ مِّمَّنْ خَلَقْنَا تَفْضِيلاً﴾

অর্থ, আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদেরকে স্থলে ও সমুদ্রে বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে দিয়েছি উত্তম রিয্‌ক। আর আমি যা সৃষ্টি করেছি তাদের থেকে অনেকের উপর আমি তাদেরকে অনেক মর্যাদা দিয়েছি। [সূরা আল ইসরা: ৭০]

অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলা নারী পুরুষ সবাই যে মানুষেরই অন্তর্ভুক্ত তা তিনি নিশ্চিত করেন। নারী পুরুষ সবই আল্লাহর সৃষ্টি এবং তাদের আল্লাহ তা‘আলা এক আত্মা থেকেই সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে ইরশাদ করেন—

﴿يَا أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُواْ رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفْسٍ وَاحِدَةٍ وَخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيراً وَنِسَاء وَاتَّقُواْ اللّهَ الَّذِي تَسَاءلُونَ بِهِ وَالأَرْحَامَ إِنَّ اللّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيباً﴾

অর্থ, হে মানুষ, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক নফস থেকে। আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক্ষক। [সূরা নিসা, আয়াত ১৬]

সুতরাং প্রতিটি মুসলিম নারী এ কথা বিশ্বাস রাখবে যে, সে একজন নারী সেও একজন মানুষ। নারী হওয়াতে সে কখনোই কোন প্রকার হীনমন্যতায় ভুগবে না। কখনোই ভাববে না যে, তার সৃষ্টি ছিল অনর্থক, তার দ্বারা জাতির কোন উপকার হয় না এবং সে জ্ঞান বুদ্ধিতে দুর্বল। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে তাদের জন্য যা করা উপযোগী সে বিষয় সম্পাদন করার জন্য তাদেরকে বিশেষ যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করার মাধ্যমে তাদের যথাযথ সম্মান দেয়া হয়েছে।

যেমনি-ভাবে যিনি একজন পুরুষ তাকে তার জন্য প্রযোজ্য ও উপযুক্ত বিষয়ে যোগ্য করে সৃষ্টি করার মাধ্যমে আল্লাহ�

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *