কাদিয়ানিদের বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের জবাব – (পর্ব পাচ)

সূরা আ’রাফ আয়াত নং ৩৫ এর সঠিক মর্মার্থ কী তা জনৈক কাদিয়ানী মতাবলম্বী জানতে চেয়ে প্রশ্ন করেছেন যে, মুসলিমরা বিশ্বাস করে মুহাম্মদ (সা) আখেরি নবী, তাঁর পরে আর কোনো নবী নেই। কিন্তু সূরা আ’রাফের ৩৫ নং আয়াত দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, প্রত্যেক যুগেই নবী রাসূল আগমন করার সম্ভাবনা আছে। এমতাবস্থায় মির্জা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী নিজেকে নবী দাবি করাতে সে এবং তার প্রতিষ্ঠিত ‘আহমদিয়া মুসলিম জামাত’ গোষ্ঠীটি ইসলাম থেকে খারিজ হবে কেন?
______
# উত্তর :
_____
আপনার প্রশ্নের জবাব দেয়ার আগে সূরা আ’রাফের ৩৫ নং আয়াতের অনুবাদ দেখুন!
______
يا بني آدم إما يأتينكم رسل منكم يقصون عليكم آياتي فمن اتقى وأصلح فلا خوف عليهم ولا هم يحزنون

__________
অর্থ :- ‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে কোনো রাসূল (বার্তাবাহক) আগমন করেন, তোমাদেরকে আমার আয়াত সমূহ শুনায়, তাহলে যে ব্যক্তি সংযত হয় এবং সৎকাজ করে; তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।’ ( ৭ : ৩৫)।
_______
এবার আপনার প্রশ্নের উত্তর নিন! তার আগে জেনে রাখি, সূরা নিসা’র ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহতালা বলেন : فإن تنازعتم في شيء فردوه إلى الله والرسول ان كنتم تؤمنون بالله واليوم الآخر زالك خير و احسن تاويلا.
অর্থ : ‘যদি তোমরা কোনো বিষয়ে পরস্পর মতানৈক্যে জড়িয়ে যাও, তাহলে (তার সমাধানের উদ্দেশ্যে) সেটিকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (তথা কুরআন সুন্নাহ)’র দিকে ফিরিয়ে নাও, যদি আল্লাহ এবং শেষদিবসের প্রতি তোমরা ঈমান রাখো। এটি সর্বোত্তম এবং ব্যাখ্যায় প্রকৃষ্টতর।’
______
সুতরাং একজন মুমিন হিসেবে প্রত্যেকের জন্য দায়িত্ব যে কোনো মতভেদপূর্ণ মাসয়ালা কুরআন এবং সুন্নাহ দ্বারা মীমাংসা করে নেয়া। তাই উপরের প্রশ্নটিও সেভাবে সমাধান করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ। আর তাই কুরআনের সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীনতম তাফসীরগ্রন্থ ‘তাফসীরে তাবারী’ খুলে দেখব, তাতে উক্ত আয়াতের প্রকৃত মর্মার্থ কিভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে এবং তার সমর্থনে সহীহ হাদিসে কী কী দলিল প্রমাণ রয়েছে?
_____
প্রাচীন তাফসীরগ্রন্থ তাফসীরে তাবারী’র আরবী ইবারত (Text) :-
_________
القول في تأويل قوله ( يا بني آدم إما يأتينكم رسل منكم يقصون عليكم آياتي فمن اتقى وأصلح فلا خوف عليهم ولا هم يحزنون ( 35 ) ) قال أبو جعفر : يقول تعالى ذكره معرفا خلقه ما أعد لحزبه وأهل طاعته والإيمان به وبرسوله ، وما أعد لحزب الشيطان وأوليائه والكافرين به وبرسله : ( يا بني آدم إما يأتينكم رسل منكم ) ، يقول : إن يجئكم رسلي الذين أرسلهم إليكم بدعائكم إلى طاعتي ، والانتهاء إلى أمري ونهيي ” منكم ” ، يعني : من أنفسكم ، ومن عشائركم وقبائلكم ( يقصون عليكم آياتي ) ، يقول : يتلون عليكم آيات كتابي ، ويعرفونكم أدلتي وأعلامي على صدق ما جاءوكم به من عندي ، وحقيقة [ ص: 406 ] ما دعوكم إليه من توحيدي ( فمن اتقى وأصلح ) ، يقول : فمن آمن منكم بما أتاه به رسلي مما قص عليه من آياتي ، وصدق ، واتقى الله فخافه بالعمل بما أمره به والانتهاء عما نهاه عنه على لسان رسوله ( وأصلح ) ، يقول : وأصلح أعماله التي كان لها مفسدا قبل ذلك من معاصي الله بالتحوب منها ( فلا خوف عليهم ) ، يقول : فلا خوف عليهم يوم القيامة من عقاب الله إذا وردوا عليه ( ولا هم يحزنون ) ، على ما فاتهم من دنياهم التي تركوها ، وشهواتهم التي تجنبوها ، اتباعا منهم لنهي الله عنها ، إذا عاينوا من كرامة الله ما عاينوا هنالك .
14554 – حدثني المثنى قال ، حدثنا إسحاق قال ، حدثنا هشام أبو عبد الله قال ، حدثنا هياج قال ، حدثنا عبد الرحمن بن زياد ، عن أبي سيار السلمي قال ، إن الله جعل آدم وذريته في كفه فقال : ( يا بني آدم إما يأتينكم رسل منكم يقصون عليكم آياتي فمن اتقى وأصلح فلا خوف عليهم ولا هم يحزنون ) ، ثم نظر إلى الرسل فقال : ( يا أيها الرسل كلوا من الطيبات واعملوا صالحا إني بما تعملون عليم وإن هذه أمتكم أمة واحدة وأنا ربكم فاتقون ) ، [ سورة المؤمنون : 51 – 52 ] ، ثم بثهم .

_______
অনুবাদ : আল্লাহ’র বাণী (হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে কোনো রাসূল আগমন করেন…)’র ব্যাখ্যায় বিশিষ্ট তাবেয়ী ইমাম হযরত আবু জা’ফর আল-মাখযূমী রহঃ (মৃত : ১৩০ হিজরী) বলেন – মহান আল্লাহ তিনি তাঁর দলের জন্য, তাঁর প্রতি এবং তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসী, আনুগত্যকারীদের জন্য আর যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে অবিশ্বাসী এবং শয়তানের দল ও তার বন্ধুদের জন্য (যথাক্রমে জান্নাত এবং জাহান্নামে) যা যা প্রস্তুত করলেন তদ্বিষয়ে আপনা সৃষ্টি (মানুষ)-কে [রূহের জগতে] জ্ঞানদান স্বরূপ বলেছেন : (হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে কোনো রাসূল আগমন করেন….) যদি তোমাদের নিকট আমার কোনো রাসূল আসেন যাঁদেরকে আমি তোমাদের নিকট পাঠাবো আমার আনুগত্যের প্রতি আহবান করার জন্য….।
___
মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত-তাবারী বলেন, মুছান্না আমাকে বর্ণনা করেছেন তিনি বলেন ইসহাক আমাকে বলেছেন, তিনি বলেন হিশাম আবু আব্দুল্লাহ বলেছেন আমাকে হিয়াজ বলেছেন তিনি বলেন আমাকে আব্দুর রহমান বিন যিয়াদ বর্ণনা করেছেন তিনি আবু ছাইয়ার আল-আসলামী থেকে, তিনি বলেছেন : ‘নিশ্চয় আল্লাহতালা আদম এবং তাঁর সন্তান-সন্ততিদেরকে আপনা কুদরতি তালুতে নিয়ে বললেন, ‘হে বনী আদম! যদি তোমাদের নিকট তোমাদের মধ্য থেকে কোনো রাসূল (বার্তাবাহক) আগমন করেন, তোমাদেরকে আমার আয়াত সমূহ শুনায়, তাহলে যে ব্যক্তি সংযত হয় এবং সৎকাজ করে; তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।’….। অত:পর রাসূলগণের প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বললেন : হে রাসূলগণ তোমরা পাক পবিত্র বস্তু আহার কর এবং নেক আমল কর; তোমরা যা কর সে সম্বন্ধে আমি পরিজ্ঞাত এবং তোমাদের এ যে জাতি এ তো একই জাতি এবং আমিই তোমাদের রব, তাই আমাকে ভয় কর।’ (মুমিনূন : ৫১-৫২)। [সংক্ষিপ্ত অনুবাদ শেষ হল]। [প্রাচীন তাফসির গ্রন্থ, তাফসীরে তাবারী, আল্লামা মুহাম্মদ ইবনে জারীর আত-তাবারী রহঃ দ্রষ্টব্য।]
______
পরিশিষ্ট : সূরা আ’রাফ আয়াত নং ৩৫-এর শানে নুযূল তথা আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট চোখবুজে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যাতে সত্য গোপন রেখে মানুষকে সহজে প্রতারিত করা যায়। তারা এরকম দুরভিসন্ধির মাধ্যমে বানোয়াট দলিল আর অপব্যাখ্যা দিয়ে বুঝাতে চায় যে, ‘মুহাম্মদ (সা) শেষনবী নন, তাঁর পরেও আরো অনেক নবী আগমন করবে।’ (নাউজুবিল্লাহ)। কুরআন থেকে আয়াতের ভুল ও বানোয়াট ব্যাখ্যা দিয়ে তারা মির্জার নবুওয়াত দাবির বদনাম ঘোচানো সহ অহর্নিশি বিভ্রান্তি সৃষ্টির আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে :- ما كان محمد أبا أحد من ر جالكم ولكن رسول الله و خاتم النبیین
________
অর্থাৎ মুহাম্মদ তোমাদের মধ্য থেকে কোনো (প্রাপ্তবয়স্ক) পুরুষের পিতা নন, তবে ‘তিনি (মুহাম্মদ) আল্লাহ’র রাসূল এবং নবীগণের খাতাম বা সমাপ্তি।’
_____
আর সূরা আ’রাফের ৩৫ নং আয়াতের শানে নুযূল (আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট) বা উদ্দিষ্ট বক্তব্যের অন্তর্নিহিত মর্মার্থ দ্বারা যাচাইবাছাই করলে পরিষ্কার হবে যে, আয়াতটিতে মহান আল্লাহ কর্তৃক নবীগণের আগমনী সংবাদদানের উল্লিখিত বক্তব্যটি শুধুমাত্র উম্মতে মুহাম্মদিকে উদ্দেশ্য করে ছিলনা, বরং মানব-আত্মার জগতে হযরত আদম সহ তাঁর সন্তানদের সকলের উদ্দেশ্যে ছিল, পরবর্তীকালে যেটি আদম থেকে শুরু করে আখেরি নবী মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত এসে পূর্ণতা পায়। (সুবহানআল্লাহ)।
______
কাজেই, উক্ত আয়াত দ্বারা আখেরি নবীর খতমে নবুওয়াত এর উপর যে কোনো ধরণের আপত্তি তোলা মারাত্মক জুলুম, অজ্ঞতা আর বে-ঈমানীর পরিচয় বৈ কিছুনা।
______
মজার ব্যাপার হল, স্ববিরোধী মির্জা কাদিয়ানী সাহেব নিজেও নবুওয়াত এবং রেসালাতের দাবিদারকে তারই লিখনীতে ‘কাজ্জাব’ এবং ‘কাফির’ বলে গেছেন। যদিও তিনি কোথাও কোথাও নিজেকে নবী রাসূল বলে দাবি করে প্রচার করেছেন। যার ফলে মির্যা নিজের ফতুয়াতেই কাজ্জাব এবং কাফির। (দেখুন মাজমু ইশতিহারাত ১/২৩০-৩১) ইতিপূর্বে এ বিষয়ে বহু প্রামাণ্য ডকুমেন্ট আপনাদের উদ্দেশ্যে পেশ করা হয়েছে।

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *