কোরআনে কেনো ‘নির্দিষ্ট’ সময় উল্লেখ নাই?
কলাবিজ্ঞানী হুজুরকে দেখেই অনেকদিন ধরে মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা ঠেলে দিলো, ”আচ্ছা কোরআনে কোনো ঘটনার ‘সময়’ উল্লেখ করা নাই কেন? অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে যেমন বছরের সংখ্যা উল্লেখ আছে। কোরআন কি তাহলে সুকৌশলে বিজ্ঞানের ইন্টারোগেশন থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে?”
কলাবিজ্ঞানী কনফিডেন্ট। হুজুরদের কুরআন নিয়ে গর্ব করার পালা এবার শেষ। হুজুর স্বভাবভঙ্গিতে কিছুটা সময় নিয়ে বলা শুরু করলো।
‘দেখুন ”সময়” নিয়ে আমি, আপনি যত সহজভাবে ভাবি, ”সময়” কিন্তু সহজ কোনো বিষয়না।”
”টাইম’ আবার কঠিন কিভাবে? ‘টাইম’ তো ‘টাইম’ই, এখানে এতো প্যাঁচের কি আছে?”কলাবিজ্ঞানী বলে উঠলো।
”আপনার প্রশ্নের উত্তর অনেক ব্যাখ্যার দাবি রাখে, জানি এর অনেক ব্যাখ্যাই আপনার মনো:পুত হবে না, তবে বিজ্ঞান চর্চা না করেও যেহেতু নিজেকে বিজ্ঞানমনস্ক মনে করেন তাই বিজ্ঞানভিত্তিক একটা ব্যাখ্যাও দেয়ার চেষ্টা করবো।”
কলাবিজ্ঞানী বিরক্ত হয়ে বললো, ”বলুন আপনার সব ব্যাখ্যাই শুনবো।”
হুজুর তার কথা আরম্ভ করলো..
”দেখুন, কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা মূলত আমাদের জন্য শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় ঘটনা ও নির্দেশনায় পরিপূর্ণ একটি গ্রন্থ।। এর কোনো কথা, ঘটনা, উপলক্ষই আমাদের জন্য অনর্থক নয়। পূর্বে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা বর্ণনা করার ব্যতিক্রমধর্মী একটা কুরআনিক স্টাইল আছে, যা আমি আপনি কখনোই এর আগে কল্পনা করতে পারি নাই। কোরআন কোনো ঘটনা এমনভাবে বর্ণনা করে নাই যা শুনলে আমাদের কাছে স্রেফ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা বলে মনে হবে। যেমন ধরুন, কোরআন যদি বলতো, মুসাকে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বে কিতাব ও আদেশ নিষেদের বিধান দিলাম বা ৫০০০ বছর পূর্বে ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবা মেরামত করলো, তাহলে আমাদের কাছে এগুলো নিছক ঐতিহাসিক ঘটনা মনে হতো। কুরআন খুব ছোট একটা কিতাব, এখানে অপ্রয়োজনীয় তথ্য কেনো থাকবে? তাই কুরআন একই ঘটনা এমনভাবে বর্ণনা করেছে যেখানে ইতিহাস জানা ও এর থেকে শিক্ষা নেয়া দুটোই ফুটে উঠেছে। যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, ”স্বরণ করুন যখন আমি মুসাকে কিতাব দিলাম….” বা ”স্বরণ করুন যখন ইব্রাহিম ও ইসমাইল কাবার ভিত্তি গড়ে তুললো …” এখানে আল্লাহ আমাদের এবং ওই ঘটনার মধ্যকার হিস্টোরিক্যাল ডিসটেন্স তুলে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে যেনো আমরাও ঐ সময়টাতে উপস্থিতি ছিলাম। ফলে মনস্তাত্ত্বিকভাবেই ওই ঘটনাগুলো আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। পূর্বের ঘটনা নিছক কোনো গালগল্প নয়, যেমনটা নবি রাসূলদেরকে তাদের উম্মতেরা বলে থাকতো। আগের সব উম্মতের বলতো, এসব ঘটনাতে আমাদের জন্য শিক্ষা নাই, এটা রহিত হয়ে গেছে। কিন্তু সত্য হলো,পূর্বে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা স্থান কালের উর্দ্ধে। বর্তমানের জন্যেও সমানভাবে শিক্ষণীয়, তাই কোরআনে এসব ঘটনার কোনো ক্রনোলজি নাই, পাছে মানুষেরা এটাকে নিছক ইতিহাস মনে করে ছুড়ে ফেলে দেয়। ”
কলাবিজ্ঞানী চুপ থেকে বলে উঠলো, ”বুঝলাম এবার আপনার নেক্সট এক্সপ্লানেশন দেন।”
”আচ্ছা আপনি কি জানেন, আমরা যে ‘সময়’টা পার করি এটা একটা রিলেটিভ (আপেক্ষিক) ব্যাপার, মানে হলো, আমরা সময় বলে যা জানি তা ধ্রুব কোনো বিষয় না, এটা স্থান কাল আর পাত্র ভেদে পরিবর্তিত হয়?”
”কিছুটা ধারণা আছে কিন্তু এর সাথে এই প্রশ্নের সম্পর্ক কি?”
কলাবিজ্ঞানীর প্রশ্নের জবাবে হুজুর স্মিত হেসে বলে উঠলো,’অবশ্যই আছে”।
” আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো বস্তু যতো দ্রুত ধাবমান হয় তার সময় (ঘড়ি) ততো ধীর গতির হয়ে যায়। যদি বস্তুটি চলতে চলতে আলোর গতি অর্জন করে ফেলে তখন সময় শূন্য হয়ে যায় বা ঘড়ির কাটা আর সামনে চলেনা!! তার মানে কেউ যদি আলোর গতি বা এর কাছাকাছি গতির কোনো যানে বসে মহাশূন্যে পাড়ি জমায় তাহলে তার একদিন আপনার (পৃথিবীর) ৫০০০০ বছরের সমান!!!! তাহলে বুঝতেই পারছেন, সময় কতটা আপেক্ষিক। এখন সৃষ্টিকর্তা যিনি নিজেই জ্ঞান সৃষ্টি করেছেন, তিনি সময়ের এই ভিন্নতার কথা জানবেন না এটাতো হতে পারে না, তাইনা ? এই কারণেই কোরআনে পৃথিবীর হিসাবের কোনো বছরের হিসাব নির্দিষ্ট করে বলে দেয়া হয় নাই বা বিশেষ গুরুত্ব পায়নি, কারণ পৃথিবীর সময়টা আমাদের কাছে কনস্ট্যান্ট কিন্তু আমাদের দৃষ্টির বাইরের মহাজগতের বাসিন্দাদের কাছে ভ্যারিয়েবল। সুবহানাল্লাহ, আল্লাহ কোরআনে সময়ের এই অসামঞ্জস্যতা উল্লেখও করেছেন, ””……তোমার রবের (জান্নাত /জাহান্নাম) একদিন, তোমাদের (পৃথিবীর) এক হাজার বছরের সমান (২২:৪৭)”।
কলাবিজ্ঞানী ঢোক গিলতে লাগলো, কিন্তু হুজুর বলেই চললো…..
‘কোরআনে ‘আপেক্ষিক সময়’ নিয়ে আরো ক্লিয়ার-কাট ইনফরমেশন দেয়া আছে। কোরানে উল্লেখ আছে,’তার (আল্লাহ) কাছে ফেরেস্তা ও রূহ পৌঁছায় একদিনের মধ্যেই যা পঞ্চাশ হাজার বছরের (পৃথিবীর) সমান (৭০:৪)”। আইনস্টাইনের স্পেশাল রিলেটিভিটির ফর্মুলাতে, ফেরেস্তাদের সময় (একদিন), মানুষের সময় (৫০০০০ চন্দ্র বছর) আর আলোর স্বাভাবিক গতি, এই ভ্যালুগুলো বসালেই এঞ্জেলদের গতি বের হয়ে যায় এবং সুবহানাল্লাহ, এটা ৯৯.৯৯৯৯% আলোর গতির সমান। তারমানে ফেরেস্তা ও রূহদের একদিনের চলার সময় আমাদের ৫০০০০ বছর সময়ের সমান!!! যা আইনস্টাইনের স্পেশাল রিলেটিভিটি ফর্মুলা দ্বারা প্রুভেন।
আপনি হয়তো কুরআনের এই আয়াতটি শুনে থাকবেন,’ ”……তোমার রবের (জান্নাত /জাহান্নাম) একদিন, তোমাদের (পৃথিবীর) এক হাজার বছরের সমান (২২:৪৭)” এবং প্রশ্ন জেগে থাকবে মনে, আগে যেখানে বলা হলো একদিন মানে ৫০০০০ বছর আর এখানে আবার বলে হচ্ছে ১ দিন ১০০০ বছরের সমান, বিষয়টা কনফিউজিং না? জ্বি- ঠিক ধরেছেন, দুটো আলাদা বিষয়, আগেরটা সাথে ‘গতি বেগের’ সম্পর্ক আর পরেরটার সাথে ‘মহাকর্ষীয় সময় সম্প্রসারণ’ বা ‘গ্রাভিটেশনাল টাইম ডিলেশন’ সম্পর্কিত। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, যেখানে উচ্চমাত্রার গ্রাভিটেশনাল পোটেনশিয়াল বিদ্যমান সেখানকার টাইম ধীরগতির হয়ে যায়। যে বস্তুর আকার যত বড় তার মহাকর্ষীয় ক্ষমতা ততবেশি ফলে সেখানকার সময় স্বাভাবিকভাবে ধীরগতির হবে। আমরা জানি, কোরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী জান্নাত ও জাহান্নাম দেখতে এতটাই বিশাল যা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়। এতো বিশাল সৃষ্টির মহাকর্ষীয় ক্ষমতাও চরম পর্যায়ের হওয়ার কথা এবং ”সময়” প্রায় স্থির হয়ে যাওয়ার কথা। সুতরাং সেখানকার ১ দিন আমাদের হিসাবের ১ হাজার বছর হাওয়া মোটেই কাল্পনিক বা অবৈজ্ঞানিক না বরং বৈজ্ঞানিকভাবে যৌক্তিক। অতএব, দেখা গেলো ”সময়” নিয়ে কোরআন এমন সব ইনফরমেশন আগেই দিয়ে রেখেছে যা আধুনিককালে এসেও আমাদের বিস্মিত করে। তাই পৃথিবীর মানুষের দেয়া বছরের হিসাব না থাকাটা কোনো অর্থই বহন করে না, যেখানে ‘সময়’ নিয়ে ফান্ডামেন্টাল ইনফরমেশন কোরআন আগেই দিয়ে রেখেছে।
এতক্ষন একটানা বলতে থাকা হুজুর যখন কলাবিজ্ঞানীর আরো জিজ্ঞাসা আছে কিনা জানতে চাইবেন, চারপাশে কোথাও খুঁজে কলাবিজ্ঞানীর দেখা পাওয়া গেলোনা, ইতিমধ্যে তিনি লাপাত্তা!!!
#”কলাবিজ্ঞানীর জিজ্ঞাসা” থেকে…
Saifur Rahman
Leave Your Comments