শবে বরাত/লাইলাতুল বরাত’একটি প্রমাণিত বিষয়। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তা‘আলার যিনি মানবজাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর দুনিয়াতে কাজে কর্মেও যেন এই শ্রেষ্ঠত্ব বাকী থাকে, তাই আল্লাহ তা‘আলা হিাদায়াত স্বরূপ কুরআন অবতীর্ণ করেছেন এবং শিক্ষক হিসাবে যুগে যুগে নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও কুরআনের ভাষা অনুযায়ী মানুষের প্রকাশ্য শত্র“ শয়তান মানুষকে আল্লাহর হুকুম থেকে বিরত রাখে। ফলে মানবজাতি বিভিন্ন পাপাচারে লিপ্ত হয়। কিন্তু আল্লাহ আ‘আলা চান না যে, তার সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুক শয়তানের ধোকায় পড়ে জাহান্নামী হয়ে যাক। তাই বান্দাকে আপন করে নেওয়ার জন্য তাওবার পথ খুলে দিয়েছেন।

তওবার জন্য বিশেষ সময় যেমন, শেষ রাত, আযান-ইকামাতের মাঝের সময়, শুক্রবার আসরের পর। বিশেষ স্থান যেমন: বাইতুল্লাহ শরীফ, হজরে আসওয়াদ। বিশেষ রাত যেমন: দুই ঈদের রাত, শবে বরাত ও শবে কদর ইত্যাদি দান করেছেন। যেগুলো আমরা কুরআন ও বিভিন্ন হাদীস দ্বারা জানতে পেরেছি। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হচ্ছে, আমাদেরই কিছু ভাই শয়তানের ধোকায় পড়ে শবে বরাতের মত পূণ্যময় রাতকে অস্বীকার করে এবং বলে যে, এটা জাল তথা মনগড়া হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এর কোন অস্তিত্ব নেই। সাথে সাথে মানুষের মধ্যে এসব ভ্রান্ত কথা বলে ফিৎনা ছড়াচ্ছে। তাই আমি এখানে কুরআন-হাদীসের আলোকে শবে বরাতের অস্তিত্ব তার ফযীলত প্রমাণ করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।
শবে বরাত কী ?
শবে বরাতকে হাদীসের ভাষায় (ليلة النصف من شعبان)লাইলাতুন নিসফ্ মিন্ শা’বান বা শা’বানের মধ্যরাত বলা হয়। পরবর্তীতে এটাকে শবে বরাত কিংবা লাইলাতুল বরাত নামকরণ করা হয়েছে। কুরআন-হাদীসে ‘লাইলাতুল বরাত’ নামটি উল্লেখ নেই। এ রাতের গুরুত্ব মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ জনপদে অপরিসীম। কেননা, রাসুল স. ও তার সাহাবাগণের নিকট এবং পরবর্তীতে সাহাবাদের শিষ্য তাবেয়ীন ও তাদের শিষ্য তাবে-তাবেয়ীনসহ সর্বকালের ইতিহাসে রাতটি একটি তাৎপর্যমন্ডিত ও ফযীলতপূর্ণ রাত হিসেবেই স্বীকৃত। মুসলিম বিশ্বের মহা মনীষীগণ নির্ভরযোগ্য তাফসীর গ্রন্থ, হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ এবং বহু মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাদের লিখনীর মাধ্যমে শবে বরাতের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেছেন।
এর মধ্যে ইমাম গাযালী র. (احياء علوم الدين) -এর ‘ইহইয়াউ উলুমিদ্দীন’। আব্দুল কাদের জীলানী র. এর (غنية الطالبين) ‘গুনিয়াতুত তালিবীন’। ইমাম নববী র. এর (رياض الصالحين) ‘রিয়াযুস সালেহীন’। ইমাম দেহলভী র. এর (ما ثبت بالسنة) ‘মা সাবাতা বিস সুন্নাহ’। হযরত থানভী র.এর ( وعظ وتبليغ)‘ওয়ায ও তাবলীগ’। মুফতি শফী র.-এরحقيقت شب برات ‘হাকীকতে শবে বরাত’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কুরআনের আলোকে শবে বরাত
পবিত্র কুরআনে সূরায়ে দুখানের তিন নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন- إِنَّا أَنْزَلْناهُ فِي لَيْلَةٍ مُبارَكَةٍ অর্থাৎ “একটি মুবারক রাতে আমি কুরআন নাযিল করেছি” এরপর এ সুরার ৪নং আয়াতে ইরশাদ করেন: فِيها يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ
অর্থাৎ এই রাতেই প্রত্যেক জ্ঞানপূর্ণ বিষয় স্থীর হয় (মানুষের ভাগ্য তালিকা বণ্টন হয়)।
অন্য দিকে ভাগ্য তালিকা বণ্টনের রাতকে রাসুল স. এর হাদীসে শা’বানের মধ্য রাত তথা পনেরো তারিখের রাত বলা হয়েছে। এদুটি কথার মর্ম দাড়ায়, শা’বানের পনের তারিখের রাত যাকে শবে বরাত বলা হয়। এ রাতেই কুরআন নাযিল করা হয়েছে । অপর দিকে সূরা ক্বদরে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে যে, (إِنَّا أَنْزَلْناهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْر) “পবিত্র কুরআন লাইলাতুল ক্বদরেই নাযিল করা হয়েছে”। যে রাতটি পবিত্র রমযান মাসেরই অর্ন্তগত। যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে উল্লেখ আছে-
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ ..الخ.
সুতরাং এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। একটি হলো, কুরআন নাযিল হওয়ার রাত। আরেকটি হলো, মানুষের ভাগ্য লিপি চুড়ান্তের রাত। এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো, সূরা দুখানে (ليلة مباركة) “বরকতপূর্ণ রাত” বলা হয়েছে। কিন্তু শবে কদর বা শবে বরাত কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। তাই লাইলাতুল মুবারাকা/বরকতপূর্ণ রাত বলতে কোন রাতকে বুঝানো হয়েছে। এনিয়ে তাফসীর বিশারদদের মধ্যে বিভিন্ন মত দেখা দিয়েছে।
প্রথম মত: অধিকাংশ মুফাস্সিরদের মত হলো, লাইলাতুল মুবারাকা থেকে উদ্দেশ্য ‘শবে ক্বদর’ যা রমযান মাসের অর্ন্তগত। কেননা, সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতের প্রথমে বলা হয়েছে, “আমি পবিত্র কুরআন নাযিল করেছি মুবারক রাতে।” আর এটা সর্বস্বীকৃত যে, কুরআন তো শবে ক্বদরেই অবতীর্ণ হয়েছে।
দ্বিতীয় মত: হযরত ইকরামা ও কাতাদাহ র.-এর মতো শীর্ষ তাবেয়ীদের মত হচ্ছে-
লাইলাতুল মুবারকা থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে, শবে বরাত। কেননা, পরের আয়াতে (৪নং আয়াত) বলা হয়েছে, উক্ত রাতে মানুষের ভাগ্যলিপি চুড়ান্ত হয় এবং সবগুলো হাদীসে স্পষ্টভাবে এসেছে যে, ভাগ্য তালিকা বণ্টন শবে বরাত তথা শা’বানের মধ্য রাতেই হয়েছে। আর কুরআন নাযিল হওয়ার যে কথা ৩নং আয়াতে বলা হয়েছে, তার মর্ম হচ্ছে, সকল প্রজ্ঞাময় বিষয়ের মধ্যে কুরআন অবতীর্ণ সবার শীর্ষে। তাই ভাগ্য তালিকা বণ্টনের রাতে কুরআন অবতীর্ণ করার সিদ্ধান্তও আল্লাহ নিয়েছেন। সে অনুপাতে কুরআন লাইলাতুল ক্বদরে অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং এখানে নাযিলের সিদ্ধান্তকে নাযিল করেছি বলা হয়েছে।
আল্লামা ফখরুদ্দীন রাযী র. তার প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ ‘আত-তাফসীরুল কাবীরে’ লিখেন-
اختلفوا في هذه الليلة المباركة فقال الأكثرون إنها ليلة القدر وقال عكرمة وطائفة آخرون إنها ليلة البراءة وهي ليلة النصف من شعبان (التفسير الكبير: ১৪/৩৩৮، مفاتيح الغيب: ২৭/৩০৩)
অর্থ: এ বরকতময় রাতের ব্যাপারে সাহাবাদের মাঝে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশের মতে এটা লাইলাতুল কদর। আর হযরত ইকরিমা র.সহ অন্য একদল আলেমের মতে এ রাতটি হলো শবে বরাত। অর্থাৎ শা’বানের মধ্য রাত। (আত-তাফসীরুল কাবীর -১৪/৩৩৮)
অতপর ইমাম রাযী র. এ মতের পক্ষে দলীল পেশ করার পর বলেন-
ليلة النصف من شعبان ، ولها أربعة أسماء الليلة المباركة ، وليلة البراءة ، وليلة الصك ، وليلة القدر.
(الجامع لاحكام القرآن: ১৬/১২৬)
অর্থ: (অতপর) যারা এ আয়াতে ليلة مباركة এর অর্থ ‘শবে বরাত’ করেছেন তাদের দৃষ্টিতে শা’বানের মধ্যরাত্রির চারটি প্রসিদ্ধ নাম রয়েছে। যথা: আল লাইলাতুল মুবারকাহ, লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুস্সক এবং লাইলাতুল কদর। (তাফসীরে কাবীর: ১৪/৩৩৯)

সারকথা- ‘শবে বরাত’ কুরআন দ্বারা প্রমাণিত কিনা ? এর জবাব উপরোক্ত আলোচনা থেকেই বুঝে আসে। তা হচ্ছে, অধিকাংশ মুফাসসিরদের মতে সূরা দুখানে শবে বরাতের আলোচনা নেই। কারণ, লাইলাতুল মুবারকার অর্থই শবে ক্বদর। অতএব, এ আয়াত দ্বারা তা প্রমাণিত নয়; বরং তারা বলেন যে, শবে বরাত বহু হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। বিধায় শবে বরাত অস্বীকারকারী পথভ্রষ্ট। তবে কুরআনের সূরা দুখানের ৩নং আয়াতে বরকতপূর্ণ রাত (ليلة مباركة) বলতে শবে বরাত উদ্দেশ্য নয়; বরং শবে ক্বদরই উদ্দেশ্য।
আর হযরত ইকরিমা, কাতাদাহ এবং তাদের অনুসারী কিছু সংখ্যক মুফাসসির বলেন যে, শবে বরাত স্বয়ং কুরআনের সূরা দুখানের ৩নং আয়াত দ্বারাই প্রমাণিত। এর অস্বীকার কুরআনের আয়াতের সরাসরি অস্বীকারের শামিল। (দ্র. তাফসীর খ.১৪ পৃ.৩৪১)
আমাদের দৃষ্টিতে এ দু’মতের মধ্যে প্রথম মতটিই অগ্রগণ্য। এ ব্যাপারে বিশদ ব্যাখ্যাসহ জানতে লিখকের বইটি পড়তে পারেন ‘কুরআান হাদীসের আলোকে শবে বরাত’।
এখানে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হচ্ছে, যারা প্রথমোক্ত মতটি গ্রহণ করেছেন যে, মুবারক রাত থেকে উদ্দেশ্য, শবে ক্বদর। তারা কেউই কিন্তু শবে বরাতকে অমান্য বা বিদআত বলেননি। বরং তারা সবাই শবে বরাত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত এবং বড়ই গুরুত্বপূর্ন রাত এ মত ব্যক্ত করেছেন। সকলেই শবে বরাতের ফযীলত অর্জনের লক্ষে তা পালনও করতেন।
কিন্তু আজ যারা এদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রথম তাফসীরকে গ্রহণ করে কুরআনের উক্ত আয়াতে শবে বরাতের আলোচনা নেই বলেছেন। তারা অনেকে শবে বরাত কে ভিত্তিহীন, জাল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত, অগ্রহণযোগ্য, বিদআত বলে বুলি উড়াচ্ছেন। অথচ তাদের তাফসীরের অনুকরণে কুরআনে শবে বরাত অবশ্য মান্য করার কথা ছিলো। কিন্তু তারা তা না করে কুরআনে না থাকার অজুহাত দেখিয়ে ১২টির মতো সহীহ, হাসান আমলযোগ্য হাদীস কে অস্বীকার করে বসলো। এটাই হচ্ছে এ সম্প্রদায়ের চরিত্র। এরাই আজ শবে বরাত নিয়ে মসজিদে মসজিদে জনসাধারণের মাঝে ফিৎনা ছড়াচ্ছে। আল্লাহ পাক সকলকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন ॥
হাদীসের আলোকে শবে বরাত
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকীদা বিশ্বাস হচ্ছে- কুরআন-সুন্নাহ দ্বারা যে বিষয়টি প্রমাণিত নয় এবং খুলাফায়ে রাশেদা ও সাহাবাগণের আমল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয় সেটাকে দীনের অংশ মনে করা যাবে না; বরং দীনের বিধান বা ইবাদত মনে করলেও তা বিদআত হবে।
বড়ই পরিতাপের বিষয়, বর্তমানে কিছু স্থুল দৃষ্টিসম্পন্ন লোক শবে বরাত সম্পর্কে দাবী তুলেছে যে, শবে বরাত কুরআন হাদীসে নেই। এ জাতীয় ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে শবে বরাতের ফযীলত সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে। এমনকি এ পবিত্র রজনীতে নফল নামায পড়া, যিকির করা, দরূদ শরীফ পড়া ও কুরআন তিলাওয়াতসহ সকল ইবাদত বন্দেগীকে অবৈধ ও বিদআত বলে অপপ্রচার করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে চলেছে।
মূলকথা: আমি পূবেই বলেছি যে, কুরআনের উক্ত আয়াত থেকে অনেক বিজ্ঞ ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণ শবে বরাত প্রমাণ করেছেন। যদিও দলীল প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের এমতটি অপর মতের তূলনায় জোরালো নয়। তথাপিও মুসলিম উম্মাহর একটি বিশেষ জামাতের দৃষ্টিতে শবে বরাত সূরা দুখানের ৩নং আয়াত দ্বারা যে প্রমাণিত, তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই।
যদি ধরে নেয়া হয় যে, কুরআনে এনিয়ে আলোচনাই নেই। তবুও হাদীসের দ্বারা তা প্রমাণিত হওয়ার ব্যাপারে খুলাফায়ে রাশেদীন, সাহাবা, তাবেয়ী, সালফে সালেহীন ও চার মাযহাবের ইমামগণসহ কোনো মুফাসসির, মুহাদ্দিস ও ফকীহর দ্বিমত নেই।
আর যে আমল বা বিধান হাদীস, সুন্নাতে খুলাফায়ে রাশেদীন, আসারে সাহাবা ও তাবেয়ীন এবং উম্মতের ব্যাপক অবিচ্ছিন্ন আমল দ্বারা প্রমাণিত, তা অস্বীকার করা এবং তাকে বিদআত বলা যে পুরো শরীয়তকে অমান্য করার শামীল তা সর্বস্বীকৃত।
পক্ষান্তরে শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসগুলোকে জাল বলা রাসূল স.এর সম্মানের বিরুদ্ধে মারাত্মক বিদ্রোহ এবং হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে চরম দৃষ্টতা প্রদর্শন।
কারণ, শবে বরাত সম্পর্কে প্রায় দশজনের অধিক সাহাবী রাসূল স. থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তার মধ্যে মাত্র তিনটি হাদীসকে সূত্রের দিক বিবেচনায় (ضعيف) দুর্বল বলা হয়েছে। এছাড়া একটি হাদীস সনদের বিচারে সহীহ। আর দুই হাদীস (حسن لذاته) হাসান লি-জাতিহী যা সহীর অন্তর্ভুক্ত। দুটি হাদীস সহীহ লি-গায়রিহী তথা সহীহ বলেই গণ্য।
যার বিস্তারিত বিবরণ আমার লেখা বই “কুরআন হাদীসের আলোকে শবে বরাত”-এ দেখুন। এ ক্ষুদ্র পরিসরে এগুলো উল্লেখ করার সুযোগ নেই। মাত্র কয়েকটি হাদীস সামনে তুলে ধরা হবে। (ইনশাআল্লাহ)
এ হাদীসগুলো সম্পর্কে প্রসিদ্ধ হাদীস বিশারদদের মন্তব্য শুনুন:
ক. আল্লামা আব্দুর রহমান মুবারকপুরীর অভিমত :
তিনি বলেন-
اعْلَمْ أَنَّهُ قَدْ وَرَدَ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ عِدَّةُ أَحَادِيثَ مَجْمُوعُهَا يَدُلُّ عَلَى أَنَّ لَهَا أَصْلًا فَمِنْهَا حَدِيثُ الْبَابِ وَهُوَ مُنْقَطِعٌ وَمِنْهَا حَدِيثُ عَائِشَةَ،ومنها حديث معاذ،ومنها حديث عبد الله بن عمرو، ومنها حديث علي (رض). فَهَذِهِ الْأَحَادِيثُ بِمَجْمُوعِهَا حُجَّةٌ عَلَى مَنْ زَعَمَ أَنَّهُ لَمْ يَثْبُتْ فِي فَضِيلَةِ لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ شَيْءٌ. (تحفة الاحوذي: ৩/৪৪২- دار الفكر)
অর্থাৎ জেনে রাখো যে, শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীস বর্ণিত হয়েছে। যার সমষ্টি প্রমাণ করে যে, শরীয়তে শবে বরাতের ভিত্তি রয়েছে। এসব হাদীসের মধ্যে আলোচ্য হাদীসটি ছাড়াও রয়েছে হযরত আয়েশা রা. হযরত মু‘আয রা. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. এবং হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ। এসব হাদীসের সমষ্টি ওদের বিরুদ্ধে অকাট্য দলীল হয়, যাদের ধারণা হচ্ছে শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত কোন হাদীস প্রমাণ যোগ্য নয়। (তুহফাতুল আহওয়াযী:১/৪৪২)
উল্লেখ্য, আল্লামা মুবারকপুরী আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ ইমাম ও মহামান্য ব্যক্তি, যিনি তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি ওই ব্যাখ্যাগ্রন্থেই এ মত উল্লেখ করেছেন। অথচ বর্তমান তথাকথিত আহলে হাদীসরা দাবী করছেন যে, এসব হাদীস নাকি ‘জাল’। এদেরই বিপক্ষে তাদের ইমামের উক্ত মন্তব্যটিই প্রমাণ করে যে, বর্তমান আহলে হাদীসগণ তাদের মান্যবরগণ কি বলছেন তাও খবর রাখেনা। মূলত এরা হাদীস সম্পর্কে অজ্ঞ ও মূর্খ।
খ. আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী সাহেবের অভিমত-
বর্তমান যুগের লা-মাযহাবীদের সবচে বড় ইমাম ও মুহাদ্দিস হচ্ছেন, আল্লামা নাসিরুদ্দিন আলবানী। আহলে হাদীসের মহামান্য সে ইমামের মন্তব্য শুনুন। আর শবে বরাত নিয়ে ফিৎনাকারী আহলে হাদীস বন্ধুদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন এ মন্তব্যটি শুনে মানুষের মাঝে ইবাদত নিয়ে বিভ্রান্তির অপপ্রয়াস না চালান।
আল্লামা আলবানী বলেন-
وجملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب والصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث، فما نقله الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في ” إصلاح المساجد ” (ص ১০৭) عن أهل التعديل والتجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح، فليس مما ينبغي الاعتماد عليه. (سلسلة الاحاديث الصحيحة للالباني: ৩/১৩৮)
অর্থাৎ সারকথা হচ্ছে, (শবে বরাতের ফযীলত সম্পর্কিত) হাদীসটি বহু সূত্রের সমষ্টির কারণে নিঃসন্দেহে সহীহ। কোন হাদীস অত্যাধিক দুর্বলতা থেকে নিরাপদ হলে এর চেয়ে কম সূত্রে বর্ণিত হলেও তা সহীহ বলে প্রমাণিত হয়। আর আলোচ্য হাদীসটি অত্যাধিক দুর্বলতা থেকে মুক্ত। সুতরাং কাসেমী যে তার কিতাব ‘ইসলাহুল মাসাজিদ’এ উল্লেখ করেছেন, “শবে বরাতের ফযীলতের হাদীস সহীহ নয়” তার এ কথাটি নির্ভরযোগ্য নয়। (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহ: ৩/১৮৩)
গ. আলবানী সাহেবের আরেকটি মন্তব্য
শবে বরাত সম্পর্কিত হাদীসের উপর আলবানী সাহেবের মন্তব্য নিম্নরূপ-
” يطلع الله تبارك وتعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن “.
قال الالباني: حديث صحيح، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا وهم معاذ ابن جبل وأبو ثعلبة الخشني وعبد الله بن عمرو وأبي موسى الأشعري وأبي هريرة وأبي بكر الصديق وعوف ابن مالك وعائشة. (سلسلة الاحاديث الصحيحة للالباني: ৩/১৩৫)
অর্থাৎ শবে বরাতের হাদীসটি (মূল বক্তব্যের দিক থেকে) ‘সহীহ’। সাহাবায়ে কিরামের একটি বড় জামাত থেকে হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত আছে।
তারা হচ্ছেন- হযরত মু‘আয রা., আবু ছা‘লাবা আল খোশানী রা., আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা., আবু মুসা আল-আশআরী রা., আবু হুরায়রা রা., আবু বকর রা., আউফ ইবনে মালিক রা. এবং হযরত আয়েশা রা.। (দ্র: সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহ: ৩/১৩৫)
উপরোক্ত মন্তব্যগুলো ভাল করে পড়ুন, এখানে মাত্র তিনটি মন্তব্য উল্লেখ করলাম। এগুলো লা-মাযহাবী বন্ধুদের পুঁজি ও অথরিটি। তাদের অনুকরণ বর্তমানের লা-মাযহাবীদের পাথেয়। আরো বহু মুহাদ্দিসের মন্তব্য রয়েছে যারা শবে বরাতের বেশ কিছু হাদীসকে সহীহ বলেছেন। একজন মুহাদ্দিসও এমন পাওয়া যাবে না, যিনি শবে বরাতের কোন একটি হাদীসকে ‘জাল’ বা ‘মওযু’ বলেছেন। কিন্তু বড় পরিতাপের বিষয়, হাদীস শাস্ত্রের সকল আলেমদের বিপরীতে বর্তমান লা-মাযহাবী বন্ধুরা শবে বরাতের হাদীসগুলো ‘জাল’ বা ‘প্রত্যাখ্যাত’ বলে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। আর মুসলিম উম্মাহকে এ মহিমান্বিত রজনীর ফযীলত থেকে বঞ্চিত করছেন। এতে প্রমাণ হয়, তারা আহলে হাদীস নন; বরং ‘আহলে ফিৎনা’ ও ‘মুনকিরে হাদীস’ অর্থাৎ হাদীস অস্বীকারকারী।
শবে বরাত সম্পর্কীয় বহু বর্ণনা হাদীসের কিতাবে বিদ্যমান। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হাদীস নিম্নে পেশ করছি-
প্রথম হাদীস
حدثنا احمد بن النضر العسكري ثنا هشام بن خالد ثنا عتبة بن حماد عن الاوزاعي و ابن ثوبان عن أبيه عن مكحول عن مالك بن يخامر عن معاذ بن جبل : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال : يطلع الله عز و جل على خلقه ليلة النصف من شعبان فيغفر لجميع خلقه الا لمشرك أو مشاحن (المعجم الكبير: ২০/১০৮-رقم الحديث: ২১৫) (البيهقي في شعب الايمان: ৫/২৭২)
অর্থ: হযরত মু‘আয ইবনে জাবাল রা. রাসূল স. থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের পনের তারিখ রাতে সমস্ত সৃষ্টি কুলের প্রতি রহমতের দৃষ্টি দান করে সকলকে ক্ষমা করে দেন। তবে মুশরিক এবং হিংসুক ছাড়া। (দেখুন: শুয়াবুল ঈমান-৫/২২৭ , আল-মু‘জামূল কাবীর-২০/১০৮)
হাদীসটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসদের অভিমত
ক. হাফেজ ইবনে রজব হাম্বলী র. মু‘আয রা. এর হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন: ইবনে হিব্বান হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। আর নির্ভরযোগ্যতার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।
খ. হাদীস পর্যালোচক আদনান আব্দুর রহমান বলেন, উক্ত হাদীসটি ইমাম বায়হাকী র. “ফাযাইলুল আওকাত” অধ্যায়ে বর্ণনা করেন। আর তার সনদ ‘হাসান’।
গ. (المعجم الكبير) গ্রন্থের মুহাক্কিক এবং বিশিষ্ট হাদীস পর্যালোচক বলেন: শবে বরাতের হাদীসটি বহু সূত্রে বর্ণিত আছে। যারা সূত্রগুলো সম্পর্কে অবগত তাদের নিকট হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ বলে পরিগণিত। (আল-মুজামূল কাবীর: ২০/১০৮)
দ্বিতীয় হাদীস
حدثنا عبدة بن عبد الله الخزاعي ومحمد بن عبد الملك أبو بكر . قالا حدثنا يزيد بن هارون . أنبأنا حجاج عن يحيى بن أبي كثير عن عروة عن عائشة قالت : – فقدت النبي صلى الله عليه و سلم ذات ليلة . فخرجت أطلبه . فإذا هو بالبقيع رافع رأسه إلى السماء . فقال ( يا عائشة أكنت تخافين أن يحيف الله عليك ورسوله ؟ ) قالت قد قلت وما بي ذلك . ولكني ظننت أنك أتيت بعض نسائك . فقال ( إن الله تعالى ينزل ليلة النصف من شعبان إلى السماء الدنيا فيغفر لأكثر من عدد شعر غنم كلب( سنن ابن ماجه: ص৯৯، رقم الحديث: ১৩৮৯. شعب الايمان للبيهقي: ৩/৩৮২৫)
অর্থ: হযরত আয়েশা রা. বলেন, একরাতে আমি রাসূল স.কে বিছানায় পেলাম না। তাই (খোজার উদ্দেশ্যে) বের হলাম। তখন দেখতে পেলাম তিনি জান্নাতুল বাকীতে আছেন। আমাকে দেখে তিনি বলে উঠলেন, তুমি কি এ আশঙ্কা করছো যে, আল্লাহ এবং তার রাসূল তোমার প্রতি অবিচার করবেন ? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল ! আমি ধারণা করছিলাম, আপনি আপনার অন্য স্ত্রীর ঘরে তাশরীফ নিয়েছেন। রাসূল স. বলেন শা’বানের পনের তারিখ রাতে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং ‘বনু কালব’ গোত্রের ভেড়ার পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক লোককে মাফ করে দেন। (তিরমিযী শরীফ: ১/১৫৬)
হাদীসটির ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের অভিমত
ইবনে হিব্বান র. আয়েশা রা. এর হাদীসটিকে হাসান বলেছেন। (শরহুল মাওয়াহিবিল লাদুনিয়্যাহ: ৭/৪৪১)
এছাড়া ইমাম ইবনে মাজা র. তার সুনানে ইবনে মাজাতে, ইবনে আবী শাইবা তার মুছান্নাফে, ইমাম আহমদ তার মুসনাদে এছাড়া আরো অনেকেই হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু কেউ হাদীসটিকে জাল বা অত্যাধিক দুর্বল বলেন নি। হাদীসটির বর্ণনাকারী ছিকাহ (বিশ্বস্ত) আর অন্য হাদীসের সহযোগিতায় হাদীসটি শক্তিশালী। এছাড়া আবু বকর রা., মু‘আজ বিন জাবাল রা. প্রমূখ প্রসিদ্ধ সাহাবী থেকে এরূপ বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং নিঃসন্দেহে হাদীসটি হাসান এবং সহীহ লি-গাইরিহী।
তৃতীয় হাদীস
أخبرنا أبو طاهر الفقيه أنا أبو حامد بن بلال نا محمد بن إسماعيل الأحمس نا المحاربي عن الأحوص بن حكيم عن المهاجر بن حبيب عن المكحول عن أبي ثعلبة الخشني : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال :
إذا كان ليلة النصف من شعبان اطلع الله إلى خلقه فيغفر للمؤمن و يملي للكافرين و يدع أهل الحقد بحقدهم حتى يدعوه (شعب الايمان للبيهقي: ৩/৩৮১-رقم الحديث: ৩৮৩২)
وكذا في العجم الكبير: ২২/২২৪-رقم الحديث: ৫৯৩)
অর্থ: হযরত আবী সা‘লাবা আল খুশানী রা. থেকে বর্ণিত হুজুর স. ইরশাদ করেন, আল্লাহ তা‘আলা শা’বান মাসের পনের তারিখ রাতে স্বীয় বান্দাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন। অতঃপর মুমিনদেরকে ক্ষমা করেন এবং কাফেরদেকে সুযোগ দেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদেরকে বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা পযর্ন্ত অবকাশ দেন। (শুয়াবুল ঈমান: ৩/৩৮১ , মু‘জামূল কাবীর: ২২/২২৩)
হাদীসের আলোকে শবে বরাতের ফযীলত
(ক) এ রাতে জীবন-মৃত্যু ও বার্ষিক বাজেট চুড়ান্ত হয়-
قوله : (هل تدرين ما) أي ما يقع. (في هذه الليلة) قال ابن حجر : نبه عليه السلام بهذا
يعني ليلة النصف من شعبان- قالت : ما فيها يا رسول الله ؟ فقال : فيها أن يكتب كل مولود بني آدم في هذه السنة ، وفيها أن يكتب كل هالك من بني آدم في هذه السنة ، وفيها ترفع أعمالهم ، وفيها تنزل أرزاقهم ، (مشكاة المصابيح مع شرحه: ৪/৬৭১-رقم الحديث: ১৩১৩) المطبعة الهندية: ১/৪০৮)
অর্থ: আয়শা রা. রাসূল স. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- তুমি কি জান এ রাতে কি কাজ করা হয় ? অর্থাৎ শা’বানের মধ্য রাতে। (আয়েশা রা. বলেন আমি বললাম) কি কাজ করা হয় হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, এ রাতে পুরো বছর যতগুলো সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। আর এ রাতে পুরো বছর কত লোক ইন্তেকাল করবে তা লেখা হয়। আর এ রাতেই বান্দাদের (পুরো বছরের) কার্যাবলী (আসমানে) উঠানো হয়। আর এ রাতেই নির্ধারিত রিযিক অবতীর্ণ হয়। তারপর আয়েশা রা. জানতে চাইলেন যে, আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ কি জান্নাতে যেতে পারবে ? হুজুর স. তিনবার বললেন কখনো না। আয়েশা রা. জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল ! আপনিও না ? তখন রাসূল স. নিজের মাথায় হাত রেখে বললেন, আমিও না। তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত আমাকে ঢেকে রেখেছে। একথাটি তিনি তিনবার বললেন। (মিশকাত :১/৪০৮)
(খ) সূর্যাস্ত থেকে সকাল পর্যন্ত পুরষ্কার বিতরণের ঘোষণা-
حدثنا الحسن بن علي الخلال . حدثنا عبد الرزاق . أنبأنا ابن أبي سبرة عن إبراهيم بن محمد عن معاوية بن عبد الله بن جعفر عن أبيه عن علي بن أبي طالب قال : – قال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها . فإن الله ينزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا . فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر (سنن ابن ماجه: ১/১৪৪- رقم الحديث: ১৩৮৮، وكذا في شعب الايمان: ৩/৩৭৮)
অর্থ: হযরত আলী রা. থেকে বর্ণিত হুজুর স. বলেন, যখন শা’বানের পঞ্চদশ রাতের আগমন হয় তখন তোমরা সারা রাত নামাজ পড় এবং দিনে রোজা রাখ। কেননা, এ রাতে সূর্যাস্তের সময় আল্লাহ তা‘আলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং সুবহে সাদিক পর্যন্ত এই আহবান করতে থাকেন। আছে কি কোন ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দিব। আছে কি কোন রিযিক যাচনাকারী, আমি তাকে রিযিক দিব। আছে কি কোন বিপদগ্রস্থ, আমি তাকে বিপদ হতে পরিত্রাণ দিব। আছে কি এমন কেউ ? আছে কি এমন কেউ ?

(গ) শবে বরাতে জাগরণ করলে জান্নাতের সু-সংবাদ
وروي عن معاذ بن جبل رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من أحيا الليالي الخمس وجبت له الجنة ليلة التروية وليلة عرفة وليلة النحر وليلة الفطر وليلة النصف من شعبان (الترغيب والترهيب: ২/১৫২-رقم الحديث: ১৬৫৯)
“হযরত মু‘আয রা. বর্ণনা করেন রাসূল স. ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি পাঁচ রাত ইবাদত বন্দেগীতে কাটাবে তার জন্য জান্নাত অবধারিত। ১. জিল হজ্জের আট তারিখের রাত। ২. আরাফার রাত। ৩. ঈদুল আযহার রাত। ৪. ঈদুল ফিতরের রাত। ৫. শা’বানের মধ্য রাত অর্থাৎ শবে বরাত। (আত-তারগীব ওয়াত তারহীব: ২/১৫২)
শবে বরাতে করণীয়
‘শবে বরাত’ তথা শা’বানের মধ্য রাতটি বান্দার প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ রহমতস্বরূপ। এ রাতে অগণিত মানুষের গুনাহ মাফ হয়। তাই এ রাতকে গনীমত মনে করে স্বীয় প্রভুর দরবারে বেশী বেশী তাওবা ইসতিগফার করা জরুরী। সকল প্রকার নব-আবিস্কৃত কুসংস্কার থেকে নিজকে মুক্ত রাখা ফযীলত অর্জনের পূর্বশর্ত।
এ রাতে যা করণীয়-
ক. রাত জেগে নফল ইবাদাত করা । এ রাতে ইবাদাতের বিশেষ কোনো নিয়ম পদ্ধতি শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত নেই। কত রাকাত নামায পড়বে, কোন সূরা দিয়ে পড়বে তারও কোনো বাধ্যবাদকতা নেই। সমাজে এ ব্যাপারে প্রচলিত নিয়মনীতি ভিত্তিহীন। তাই সাধ্যমত নফল নামায পড়বে। দরুদ শরীফ, তাওবা, ইস্তিগফার, যিকির করবে, তাসবীহ পড়বে, কুরআন তিলাওয়াত করবে। বিশেষকরে শেষ রাতে তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করবে, সালাতুস তাসবীহ পড়বে। আর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ইশা ও ফজর নামায অবশ্যই জামাতের সাথে পড়বে।
খ. দিনে রোযা রাখবে। এ রোযার ব্যাপারে হযরত আলী রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি সূত্রের দিক থেকে যয়ীফ হলেও যেহেতু শা’বান মাসে রোযা রাখার ব্যাপারে সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে, বিশেষ করে মাসের ১৩,১৪,১৫ তারিখ তিনটি রোযা রাখার উপর গুরুত্ববহ হাদীস বর্ণিত আছে। যাকে ‘আইয়ামে বীযে’র রোযা বলে। আর ১৫ তারিখের রোযা আইয়ামে বীযের রোযারই অন্তর্ভুক্ত। তাই ১৫ তারিখের রোযা মুস্তাহাব। তাই রোযা না রেখে নফল রোযার সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হওয়ার কোনো যুক্তিকতা নেই। তবে যারা মনে করেন, রোযা দুইটি রাখা আবশ্যক। এ কথার ভিত্তি শরীয়তে নেই। হ্যাঁ, এটা একমাত্র আশুরার রোযার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
গ. শবে বরাতে কবর যিয়ারত করা। হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল স. শবে বরাতে জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে কবরবাসীদের জন্য দোয়া করেছেন। তাই এ রাতে কবরস্থানে গমন ও যিয়ারত ভালো কাজ। তবে মনে রাখতে হবে রাসূল স. জীবনে মাত্র একবার শবে বরাতে কবরস্থানে গিয়েছিলেন। একাধিকবার যাওয়ার কোনো প্রমাণ মিলে না। তাই প্রত্যেক শবে বরাতে যাওয়া বৈধ হলেও সুন্নাত বলা যাবে না। এ কারণে প্রতি শবে বরাতে কবর যিয়ারতের নিয়ম বানানোর প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে বর্তমান আমাদের দেশে ওই রাত কবর যিয়ারতে নারী-পুরুষের সমাগম ঘটে। এতে সাওয়াবের তূলনায় গুনাহের সম্ভাবনা থাকে। বিধায় মাঝে মধ্যে গুনাহমুক্ত পরিবেশে কবর যিয়ারত করাই শ্রেয়।
শবে বরাতে যা বর্জনীয়
ক. ফরয নামায, রমযানে বিতর ও তারাবীহ এবং ইস্তেসকাহ-এর নামায ছাড়া অন্য নামাযের জামাত করা বৈধ নয়।
সুতরাং শবে বরাতে ও শবে ক্বদরে নফল নামায জামাতে পড়া যাবে না। ইমাম আবু হানীফা র. বলেন, নফল ইবাদতের সঠিক মূল্য দাও, আর তা হচ্ছে- “তুমি থাকবে আর তোমার আল্লাহ থাকবেন তৃতীয় কেউ থাকবে না”অর্থাৎ একাকী। হাদীসের বর্ণনায় এ রাতে আল্লাহর আহ্বান উল্লেখ আছে-
فيقول ألا من مستغفر لي فأغفر له ألا من مسترزق فأرزقه ألا مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر
এখানে একবচন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থাৎ তুমি একা আল্লাহর নিকট আসো। দলবদ্ধভাবে জামাতের সাথে প্রভুর দরবারে উপস্থিত হওয়া এ আহ্বান পরিপন্থী। তাই জামাতের সাথে নফল নামায আদায় করা মাকরূহ। বড় পরিতাপের বিষয়, আমাদের সমাজে ইদানিং মহিলারাও জামাতের সাথে সালাতুস তাসবীহ, তাহাজ্জুদ পড়া শুরু করেছে। এটা নিতান্তই শরীয়া গর্হিত ও বিবর্জিত।

খ. শবে বরাতে যেহেতু আল্লাহর রহমতের বারিধারা নেমে আসে, অগণিত বান্দার গুনাহ মাফ হয়। তাই শয়তান থেমে নেই; বরং বান্দাকে রহমত ও মাগফিরাতের নির্ঝরণী থেকে বঞ্চিত করার জন্য পরিকল্পনা করেই কিছু কুসংস্কারে লিপ্ত রাখতে আবিষ্কার করে, আতশ বাজি ও আলোক সজ্জার মতো বিজাতীয় কু-প্রথা। আর কিছু লোককে ব্যস্ত রাখে হালুয়া-রুটি, মিষ্টি ও শিরনী বণ্টনের কুসংস্কারে। কিছু লোকের ধারণা, হালুয়া-রুটি ও মিষ্টির আয়োজন ছাড়া শবে বরাতই পালন হয় না। এগুলো সব শয়তানের সুক্ষ্ম কারসাজী। এগুলো গুনাহের কাজ বিধায় বর্জনীয়।
এ ব্যাপারে আল্লামা মুহাদ্দিসে দেহলভী বলেছেন-
ومن البدع الشنيعة ما تعارف الناس في اكثر بلاد الهند، من ايقاد السرج ووضعها علي البيوت والجدران والاجتماع للهوواللعب بالنارواحراق الكبريت، فإنه مما لا اصل له في الكتب الصحيحة المعتبرة،ولم يرو فيها حديث ضعيف ولاموضوع. (ماثتب بالسنة : ২১৪)
আল্লাহ পাক সকলকে এসব কুসংস্কার থেকে মুক্ত রাখুন। আমীন॥

দ্বিতীয় অধ্যায়
শবে কদর
শবে কদর তথাليلة القدر এর অর্থ-
القدر শব্দের অর্থ সম্মান ও মর্যাদা। এ রাতের সম্মান ও মর্যাদার কারণেই এরাতকে ليلة القدر বলা হয়।
হযরত আবু বকর ওয়াররাক র. বলেন, এ রাতকে এজন্য ليلة القدر বলা হয় যে, ইতোপূর্বে যারা আমলহীনতার দরুণ আল্লাহ তা‘আলার নিকট মর্যাদাবান ছিলো না, তারা যেন এ রাতে তাওবা, ইস্তিগফার ও ইবাদতের মাধ্যমে صاحب قدرতথা মর্যাদাবান ও সম্মানিত হয়ে যায়।
القدر এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে, তাকদীর ও হুকুম। এ অর্থের দৃষ্টিতে ليلة القدر নামকরণের কারণ হচ্ছে যে, এ রাতে সকল সৃষ্টির এ রমযান হতে পরবর্তী রমযান পর্যন্ত সকল কাজের ভাগ্যলিপি নির্ধারণ হয় এবং তা ওইসব ফেরেশতাদের নিকট সোপর্দ করা হয়। যারা জাগতিক বিষয়াদি সম্পাদন ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন।
শবে কদর কী ?
শবে কদর হচ্ছে, রমযানুল মুবারকের পবিত্র রাতসমূহের অন্যতম একটি রাত। এ রাতের ব্যাপারে কুরআনুল কারীমে নিম্নোক্ত সূরাটি অবতীর্ণ হয়েছে।
بسم الله الرحمن الرحيم
إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ (১) وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ (২) لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (৩) تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ (৪) سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ (৫)
অর্থ: নিশ্চয় আমি কুরআন শরীফ কদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি। আপনি কি জানেন, কদরের রাত কি ? কদরের রাত এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ অর্থাৎ জিবরাইল আ. তাদের প্রতিপালকের নির্দেশে প্রত্যেক কল্যাণকর বিষয়সহ অবতরণ করেন। এ রাত সালাম তথা নিরাপত্তার রাত। যা ফজর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
আয়াতে ليلة القدر কে এক হাজার মাসের চেয়ে উত্তম বলা হয়েছে। সুতরাং ওই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে, এ রাত ইবাদতে কাটাতে পারল।
শবে কদর কি এই উম্মতের বৈশিষ্ট ?
অধিকাংশ আলেমদের মতে শবে কদর এ উম্মত অর্থাৎ উম্মতে মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট। যদিও কেউ কেউ বলেন যে, শবে কদর পূর্ববর্তী যুগেও ছিল। কিন্তু বিশুদ্ধ মত প্রথমটিই।
রাসূল স. এর ভাষ্য দ্বারাই তা প্রমাণিত-
و حَدَّثَنِي زِيَاد عَنْ مَالِك أَنَّهُ سَمِعَ مَنْ يَثِقُ بِهِ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ يَقُولُ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أُرِيَ أَعْمَارَ النَّاسِ قَبْلَهُ أَوْ مَا شَاءَ اللَّهُ مِنْ ذَلِكَ فَكَأَنَّهُ تَقَاصَرَ أَعْمَارَ أُمَّتِهِ أَنْ لَا يَبْلُغُوا مِنْ الْعَمَلِ مِثْلَ الَّذِي بَلَغَ غَيْرُهُمْ فِي طُولِ الْعُمْرِ فَأَعْطَاهُ اللَّهُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ (موطا مالك : ১/৩২১-رقم الحديث: ১১৪৫)
অর্থ: হযরত মালেক ইবনে আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বিশ্বস্ত এক আলেম থেকে শুনেছেন যে, রাসূল স.কে পূর্বের যুগের লোকদের বয়স (বা আল্লাহর যা ইচ্ছা) দেখানো হল। তখন তিনি দেখলেন যে, সে তূলনায় তার উম্মতের হায়াত অনেক কম। ফলে তার উম্মত আমলের মাধ্যমে ওই পর্যন্ত পৌছতে পারবে না। যেখানে দীর্ঘ হায়াতের কারণে পূর্ববর্তী উম্মত পৌঁছেছে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে অর্থাৎ রাসূল স.কে শবে কদর দান করলেন। যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। (মুয়াত্ত মালেক: ১/৩২১)
শবে কদরের নির্ধারিত তারিখ গোপন রাখার রহস্য
যে বস্তু যত মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ, তা ততো অধিক পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। সুতরাং শবে কদরের মত অতি মূল্যবান সম্পদ পরিশ্রম ছাড়া কিভাবে হাসিল হবে? এজন্য এর নির্দিষ্ট তারিখ গোপন রাখা হয়েছে।
রাসূল সা. ইরশাদ করেন- عسي أن يكون خيرا لكم
অর্থাৎ আশা করা যায়, এরই মধ্যে তোমাদের কল্যাণ নিহিত আছে। এর মর্মার্থ অত্যন্ত পরিষ্কার যে, যদি এর নির্দিষ্ট তারিখ জানিয়ে দেয়া হতো তাহলে এতটুকু মূল্য হতোনা। পক্ষান্তরে অবগতির পর মূল্যায়ণ না করা চূড়ান্ত দূর্ভাগ্য ও বঞ্চনার বিষয়।
আল্লামা ইবনে কাছীর র. বলেন, এটা গোপন রাখার মধ্যে হিকমত হচ্ছে,তার অনুসন্ধানকারী ও আগ্রহীগণ পুরো রমযান মাস ইবাদতের প্রতি গুরত্ব দিবে। (ইবনে কাছীর : ৪/৫৩৪)
শবে কদর কি এখনও বিদ্যমান ?
অধিকাংশ আলেমদের মতে শবে কদর এখনও বিদ্যমান এবং এটিই সঠিক মত। যদিও কেউ কেউ এর বিপরীত বলে থাকেন। কেননা, যদি শবে কদর উঠিয়ে নেয়া হতো তাহলে রাসূল স. কেন শবে কদর তালাশের প্রতি এবং তাতে ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন ? যেমনটি বুখারী শরীফের হাদীসে আছে-
حدثنا مسلم بن إبراهيم حدثنا هشام حدثنا يحيى عن أبي سلمة عن أبي هريرة رضي الله عنه : عن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( من قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن صام رمضان إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه (صحيح البخاري: ১/২৭০-رقم الحديث: ১৮০২)
অর্থ: যে ব্যক্তি শবে কদরে পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে সাওয়াবের আশায় ইবাদত করে, তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (বুখারী শরীফ: ১/২৭০)
অন্যত্র ইরশাদ হচ্ছে-
حدثنا قتيبة بن سعيد حدثنا إسماعيل بن جعفر حدثنا أبو سهيل عن أبيه عن عائشة رضي الله عنها : أن رسول الله صلى الله عليه و سلم قال ( تحروا ليلة القدر في الوتر من العشر الأواخر من رمضان (صحيح البخاري: رقم الحديث:১৯১৩)
অর্থ: তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে শবে কদর তালাশ করো।
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী র. বলেন, হাদীসে فرفعت অর্থাৎ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল, শবে কদরের তারিখ উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। শবে কদর উঠিয়ে নেয়া উদ্দেশ্য নয়। (মাওসুআতুল ফিকহিয়য়াহ: ৩৫/৩৬৩)
শবে কদর সম্পর্কিত কিছু হাদীস
বুখারী ও আবু দাউদ শরীফে বর্ণিত আছে-
حدثنا موسى بن إسماعيل حدثنا وهيب حدثنا أيوب عن عكرمة عن ابن عباس رضي الله عنهما : أن النبي صلى الله عليه و سلم قال ( التمسوها في العشر الأواخر من رمضان ليلة القدر في تاسعة تبقى في سابعة تبقى في خامسة تبقى (صحيح البخاري: ২/৭১১-رقم الحديث: ১৯১৭) (ابو داود : ১/৫২৫-رقم الحديث: ১৩৮৩)
অর্থ: হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত রাসূল স. বলেন- তোমরা শবে কদরকে প্রতি রমযানের শেষ দশদিনের মধ্যে তথা ২৯, ২৭, ২৫ তারিখ রাতে অনুসন্ধান করো। (বুখারী শরীফ: পৃ: ২০১১)
ইবনে মাজা শরীফে আছে-
حدثنا محمد بن عبد الملك بن أبي الشوارب وأبو إسحاق الهروي إبراهيم بن عبد الله ابن حاتم . قالا حدثنا عبد الواحد بن زياد . حدثنا الحسن بن عبيد الله عن إبراهيم النخعي عن الأسود عن عائشة : – قالت كان النبي صلى الله عليه و سلم يجتهد في العشر الأواخر مالا يجتهد في غيره (سنن ابن ماجه : ১/৫৬২-رقم الحديث : ১৭৬৭)
অর্থ: হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল স. রমযানের শেষ দশ দিন এত অধিক পরিমাণে ইবাদত করতেন, যা তিনি অন্য কোন সময় করতেন না। (ইবনে মাজা-১/৫৬২)
মুসনাদে আহমদ গ্রন্থে আছে-
حدثنا عبد الله حدثني أبي ثنا يزيد بن هارون أنا شعبة عن عبد الله بن دينار عن بن عمر قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : من كان متحريها فليتحرها ليلة سبع وعشرين وقال تحروها ليلة سبع وعشرين يعني ليلة القدر تعليق شعيب الأرنؤوط : إسناده صحيح على شرط الشيخين (مسند أحمد بن حنبل:২/২৭-رقم الحديث : ৪৮০৮)
অর্থ: হযরত ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত রাসূল স. বলেন- যে ব্যক্তি শবে কদর তালাশ করে, সে যেন ২৭এ রমযানে তা তালাশ করে। (মুসনাদে আহমদ-২/২৭)
أن النبي صلي الله عليه وسلم قال: ليلة القدر التاسعة والعشرون أوالسابعة والعشرون، وأن الملائكة بعدد الحصي. (مسند أحمد : ২/৫১৯)
অর্থ: রাসূল স. বলেছেন- শবে কদর হচ্ছে, রমযানের ২৯ অথবা ২৭ এ রজনী। এরাতে গুঁড়ি পাথরের সংখ্যা পরিমাণ ফেরেশতা অবর্তীণ হয়।
শবে কদর নিয়ে মতভেদ ও তার নিরসন
হযরত আবু যর গিফারী রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল স. এর নিকট আরয করলাম, “শবে কদর” নবী যুগের সাথে নির্দিষ্ট ? না পরেও হবে ? উত্তরে রাসূল স. বললেন, এটি কিয়ামত পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকবে। আমি আরয করলাম, এটি রমযানের কোন অংশে ? তিনি বললেন, প্রথম দশ দিন ও শেষ দশদিনে অনুসন্ধান কর। অতপর রাসুল স. অন্য কথায় লিপ্ত হলে আবার সুযোগ পেয়ে আরয করলাম, বলে দিন যে, শেষ দশদিনের কোন অংশে হয়ে থাকে ? একথা শুনে রাসূল স. এত অসুন্তুষ্ট হলেন যে, তিনি ইতোপূর্বে ও পরে আমার উপর এত রাগান্বিত হননি। এমতাবস্থায় বললেন, এরূপ উদ্দেশ্য হলে আল্লাহ তা‘আলা কি বলে দিতে পারতেন না ? শেষ সাত রাতে তা অনুসন্ধান কর। এটিই যথেষ্ট এরপর আর কোন কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।
* ইমাম আবু হানিফা র. এর বক্তব্য হচ্ছে যে, শবে কদর পুরো রমযান মাসে চক্কর দিয়ে থাকে।
* ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদ র. বলেন, শবে কদর রমযানের নির্দিষ্ট কোন এক রাতে হয়ে থাকে। তবে আমরা তা জানিনা।
* শাফেয়ীদের প্রাধান্যতম মত হলো ২১ এর রাতে শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।
* ইমাম মালিক ও আহমদ বিন হাম্বল র. বলেন, রমযানের শেষ দশ দিনের বেজোড় রাতসমূহে এটি চক্কর দিতে থাকে।
অধিকাংশ আলেমদের মত হচ্ছে, এটি ২৭শে রাতে হওয়ার প্রবল আশাবাদী। সুতরাং প্রত্যেকেরই নিজের সাহস ও সুযোগ অনুযায়ী সারা বছর তা অনুসন্ধান করা উচিত। তা সম্ভব না হলে, পুরা রমযান মাস তালাশ করা কর্তব্য। আর যদি এটাও সম্ভব না হয়, তাহলে রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতসমূহকে হাত ছাড়া করা যাবেনা। আল্লাহ না করুন, যদি এতটুকু ও সম্ভব না হয়, তাহলে সাতাশ তারিখের রাতকে শীতল গনীমত মনে করতে হবে। কেননা, আল্লাহর অনুগ্রহে যদি কারো এটা নসীব হয়ে যায়, তাহলে দুনিয়ার সমস্ত নিয়ামতরাজি এর তূলনায় তুচ্ছ। পক্ষান্তরে ভাগ্যে না জুটলেও এর প্রতিফল শূন্য হবে না, যদি সে ইশা এবং ফজরের জামাতের প্রতি সারা বছর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কেননা, সৌভাগ্যক্রমে যদি শবে কদরের রাতে এই দুই নামায জামাতের সাথে আদায় হয়ে যায়, তাহলে এক হাদীস অনুযায়ী সে শবে কদরের পূর্ণ ফযীলত লাভ করবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সবাইকে প্রতিবছর শবে কদরের বরকত অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন ॥
শবে কদরের আলামত
শবে কদরের আলামত সম্পর্কে উবাইদা ইবনে সামেত রা. এর এক হাদীসের একাংশ উল্লেখ করছি-
ومن اماراتها : أنها ليلة بلجة صافية ساجية لاحارة ولاباردة كأن فيها قمرا ساطعا ولايتحل أن يرمي به تلك اليلة حتي الصباح،ومن امارتها : أن الشمس تطلع علي صبيحتها لا شعاع لها مستوية كأنها القمر ليلةالبدروحرم الله علي الشيطان أن يخرج معها يومئذ. (ابن ابي شيبة: ২/২৫১)
অনুবাদ- শবে কদরের অন্যতম একটি আলামত হচ্ছে, এ রাত স্পষ্ট আলোকোজ্জল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, গরম ও নয় ঠান্ডা ও নয়, চন্দ্রালোকুজ্জল রাত। সকাল পর্যন্ত এরাতে শয়তানের প্রতি তারকা নিক্ষেপ করা হয় না। তদুপরি এ রাতের অন্যতম আলামত হচ্ছে, এ রাতের পরবর্তী ভোরে সূর্য কিরনহীন অবস্থায় উদিত হবে। যা প্রসারিত পিন্ডের মত, যেন একটা চতুর্দশীর পূর্ণচন্দ্র। এই দিন শুরু হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহ তা‘আলা শয়তানের বিচরন হারাম করে দেন। (মুছান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/২৫১)
শবে কদরের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীস
বাইহাকী শরীফে আছে-
أخبرنا أبو سعد عبد الملك بن أبي عثمان الزاهد نا أبو إسحاق إبراهيم بن محمد بن رجاء أنا عبد الله بن سليمان بن الأشعث نا محمد بن عبد العزيز الأزدي نا أصرم بن حوشب نا محمد بن يونس الحارثي عن قتادة عن أنس بن مالك قال : قال رسول الله صلى الله عليه و سلم : إذا كان ليلة القدر نزل جبريل عليه السلام في كبكبة من الملائكة يصلون على كل عبد قائم أو قاعد يذكر الله عز و جل (البيهقي: رقم الحديث ৩৭১৭)
অর্থ: হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসূল স. ইরশাদ করেন, যখন শবে কদরের আগমন হয় তখন জিবরাইল আ. একদল ফেরেশতাসহ অবতরণ করেন এবং বসা বা দাড়ানো অবস্থায় যে ব্যক্তিই আল্লাহর যিকির করে তাঁকে সালাম দেন এবং তার জন্য রহমতের দুআ করেন। (তাফসীরে কুরতুবী: ২০/১০৩, বাইহাকী: ৩৭১৭)
ইবনে মাজা শরীফে আছে-
حدثنا أبو بدر عباد بن الوليد . حدثنا محمد بن بلال . حدثنا عمران القطان عن قتادة عن أنس بن مالك قال دخل رمضان : – فقال رسول الله صلى الله عليه و سلم ( إن هذا الشهر قد حضركم . وفيه ليلة خير من ألف شهر . من حرمها فقد حرم الخير كله (ابن ماجه : ১/১২০-رقم الحديث : ১৬৪৪)
অর্থ: হযরত আনাস রা. বলেন, একবার পবিত্র রমযান এলে রাসূল স. ইরশাদ করলেন, এমাস তোমাদের নিকট আগমন করেছে। এতে এমন একটি রাত আছে যা এক হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত থাকলো, সে সমস্ত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত থাকলো। আর এ রাতের কল্যাণ থেকে ওই ব্যক্তিই বঞ্চিত হয় যে, প্রকৃত পক্ষেই বঞ্চিত। (ইবনে মাজাহ: ১/১২০)
তাফসীরে কুরতুবীতে আছে-
عن عبيد الله بن عامر بن ربيعة أن رسول الله صلي الله عليه وسلم قال: من صلي صلوة المغرب والعشاء الآخرة من ليلة القدر في جماعة فقد أخذ بحظه من ليلة القدر.(تفسير القرطبي: ২/১০৭)
অর্থ:হুজুর স. ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি শবে কদরে জামাতের সাথে মাগরীব ও ইশার নামায আদায় করলো, সে যেন শবে কদরের পূর্ণ ফযীলত লাভ করলো। (তাফসীরে কুরতুবী: ২০/১০৭)
শবে কদরের আমল
সুনানে কুবরা গ্রন্থে আছে-
(১০৭০৮) أخبرنا قتيبة بن سعيد قال حدثنا جعفر وهوبن سليمان عن كهمس عن عبد الله بن بريدة عن عائشة قالت قلت يارسول الله إن علمت أي ليلة ليلة القدر ما أقول فيها قال قولي اللهم إنك عفو تحب العفو فاعف عني (السنن الكبري : رقم الحجيث: ১০৭০৮)
অর্থ: আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল ! আমি যদি জানতে পারি কোনটি কদরের রাত, তাহলে আমি কী দোআ করবো ? তিনি বললেন তুমি বল, হে আল্লাহ! নিশ্চয় তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমাকরাকে পছন্দ কর। সুতরাং তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযী শরীফ:হাদীস নং ৩৫১৩)
এছাড়াও এরাত্রে জাগ্রত থেকে নামায, তিলাওয়াত, দরুদ শরীফ, তাসবীহ, তাহলীল, দুআসহ অন্যন্য নফল ইবাদাতের গুরুত্ব দেয়ার প্রতি বিভিন্ন হাদীসে উল্লেখ রয়েছে।

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *