কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী প্রত্যেক সামর্থ্যবান নর-নারীর ওপর কুরবানী ওয়াজিব। এটি মৌলিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আদম আলাইহিস সালাম থেকে সকল যুগে কুরবানী ছিলো। তবে তা আদায়ের পন্থা এক ছিলো না। শরীয়তে মুহাম্মাদীর কুরবানী মিল্লাতে ইবরাহীমীর সুন্নত। সেখান থেকেই এসেছে এই কুরবানী। এটি শা’আইরে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীকি বিধানাবলীর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং এর মাধ্যমে শা’আইরে ইসলামের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আল্লাহ তা’আলা ও তাঁর রাসূলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে কুরবানীতে।
কুরআন ও হাদীসে কুরবানীর বর্ণনা
আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন- فصل لربك وانحر-
অর্থঃ অতএব আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামায পড়–ন এবং কুরবানী আদায় করুন।
(সূরা কাউসারঃ আ-২)
قل إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين-
অর্থঃ (হে রাসূল!) আপনি বলুন- আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ (অর্থাৎ আমার সবকিছু) আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য উৎসর্গিত।
(সূরা-আনআমঃ আ-১৬২)
لن ينال الله لحومها ولا دمائها ولكن يناله التقوي منكم-
অর্থঃ (মনে রেখো, কুরবানীর পশুর) গোশত অথবা রক্ত আল্লাহর কাছে কখনোই পৌঁছে না; বরং তাঁর কাছে কেবলমাত্র তোমাদের পরহেযগারীই পৌঁছে। (সূরা-হজ্জঃ আ-৩৭)
হাদীসের বর্ণনায় কুরবানী
কুরবানীর গুরুত্ব
সাহাবী আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
من وجد سعة لأن يضحي فلم يضح- فلا يقربن مصلانا-
অর্থঃ যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কুরবানী করলো না, সে যেনো আমাদের ঈদগাহে না আসে।
(মুসনাদে আহমদঃ ২/৩২১; মুস্তাদরাকে হাকেমঃ হা-৭৬৩৯; আত্-তারগীব ওয়াত-তারহীবঃ ২/১৫৫)
সাহাবী ইবনে ওমর রাযি. বলেন-
أقام رسول الله صلي الله عليه وسلم بالمدينة عشر سنين يضحي-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদীনা মুনাওয়ারায় দশ বছরের জীবনে প্রতি বছর কুরবানী করেছেন। (সুনানে তিরমিযীঃ ১/১৮১)
কুরবানী করার সময়
সাহাবী বারা ইবনে আযিব রাযি. বলেন-
خطبنا رسول الله صلي الله عليه وسلم- فقال: إن أول ما نبدأ به في يومنا هذا أن نصلي ثم نرجع فننحر- فمن فعل ذلك فقد أصاب سنتنا- ومن ذبح قبل ذلك فإنما هو لحم قدمه لأهله- ليس من النسك في شيئ-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে খোতবা দিলেন। তিনি বললেন- আমাদের এই দিবসে প্রথম কাজ নামায আদায় করা, এরপর কুরবানী করা। সুতরাং যে এভাবে করবে- তার কাজ আমার তরিকা অনুযায়ী হবে। আর যে আগেই যবেহ করেছে (তার কাজ আমার তরিকা অনুযায়ী হয়নি) অতএব তা পরিবারের জন্য প্রস্তুতকৃত গোশত বলে সাব্যস্ত হবে, (আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত) কুরবানী নয়।
(সহীহ বুখারীঃ ২/৮৩২; সহীহ মুসলিমঃ ২/১৫৪; সহীহ ইবনে হিব্বানঃ হা-৫৯০৭)
এক হাদীসে আছে যে, কোনো কোনো সাহাবী ভুলক্রমে ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করেছিলেন। তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁদেরকে পুনরায় কুরবানী করার আদেশ করেন।
(সহীহ বুখারীঃ ২/৮২৭; সহীহ মুসলিমঃ ২/১৫৩; সহীহ ইবনে হিব্বানঃ হা-৫৯১২, ৫৯১৩; সুনানে ইবনে মাজাহঃ পৃ- ২২৭; সুনানে নাসায়ীঃ ২/১৭৯)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেভাবে কুরবানী করতেন
সাহাবী জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
ذبح النبي صلي الله عليه وسلم يوم الذبح كبشين أقرنين أملحين موجوئين- فلما وجههما قال: إني وجهت وجهه للذي فطر السماوات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين- إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين- لا شريك له وبذلك أمرت وأنا من المسلمين- اللهم منك ولك عن محمد وأمته- بسم الله والله أكبر-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর দিন দুটি সাদা-কালো ও বড় শিং বিশিষ্ট খাসি দুম্বা যবেহ করেছেন। তিনি খাসি দুটিকে শায়িত করার সময় বললেন-إني وجهت وجهه للذي فطر السماوات والأرض حنيفا وما أنا من المشركين- এরপর তিনি যবেহ করলেন।
(মুসনাদে আহমদঃ ৩/৩৭৫; সুনানে আবি দাউদঃ হা-৩৮৬; সুনানে ইবনে মাজাহঃ পৃ- ২২৫)
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. বলেন-
رسول الله صلي الله عليه وسلم يذبح وينحر بالمصلي- كان
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদগাহে যবেহ করতেন এবং নহর করতেন।
(সহীহ বুখারীঃ ২/৮৩৩)
নিয়ম হলো গরু, ছাগল, দুম্বা যবেহ করা হবে এবং উট নহর করা হবে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই করেছেন।
সাহাবী শাদ্দাদ ইবনে আওস রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
إن الله تبارك ونعالي كتب الإحسان علي كل شيئ- فإذا قتلتم فأحسنوا القتلة- وإذا ذبحتم فإحسنوا الذبح- وليحد أحدكم شفرته وليرح ذبيحته-
অর্থঃ আল্লাহ তা’আলা সকল কিছুর উপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব যখন তোমরা হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা করো। যখন যবেহ করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে যবেহ করো। প্রত্যেকে তার ছুরিতে ধার দিবে এবং পশুকে শান্তি দিবে।
(সহীহ মুসলিমঃ ২/১৫২; সুনানে আবি দাউদঃ ২/৩৮৯; সুনানে নাসায়ীঃ ২/১৮২; সুনানে তিরমিযীঃ ১/২৬০; সুনানে ইবনে মাজাহঃ ২/২২৯)
কুরবানীর পশু
সাহাবী আনাস ইবনে মালিক রাযি. বলেন-
ضحي رسول الله صلي الله عليه وسلم بكبشين أملحين- فرأيته واضعا قدمه علي صفاحهما- يسمي ويكبر- فذبحهما بيده-
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটি সাদা-কালো বর্ণের (বড় শিং বিশিষ্ট) নর দুম্বা কুরবানী করেছেন। আমি দেখেছি, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বললেন। অতঃপর নিজ হাতে যবেহ করলেন।
(সহীহ বুখারীঃ ২/৮৩৪; সহীহ মুসলিমঃ ২/১৫৫-১৫৬)
عن جابر رضي الله عنه في حديث طويل —— ثم انصرف النبي صلي الله عليه وسلم إلي المنحر- فنحر ثلاثا وستين بدنة بيده-
অর্থঃ সাহাবী জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসে আছে, অতঃপর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরবানীর স্থানে এলেন এবং নিজ হাতে তিষট্টিটি উট নহর করলেন।
(সহীহ মুসলিমঃ ১/৩৯৮; সুনানে আবি দাউদঃ ১/২৬২)
উম্মুল মু’মিনিন আয়শা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
ضحي رسول الله صلي الله عليه وسلم عن نسائه بالبقر-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ থেকে গরু দ্বারা কুরবানী করেছেন।
(সহীহ বুখারীঃ ১/২৩১; ২/৮৩৪)
গরু ও উটে সাতজন শরিক হতে পারে
সাহাবী জাবির রাযি. বলেন-
خرجنا مع رسول الله صلي الله عليه وسلم مهلين بالحج- فأمرنا رسول الله صلي الله عليه وسلم أن نشترك في الإبل والبقر- كل سبعة منا في بدنة-
অর্থঃ আমরা হজ্জের ইহরাম বেধে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে বের হলাম। তিনি আমাদেরকে প্রতিটি উটে সাতজন করে শরিক হয়ে কুরবানী করার নির্দেশ দিলেন।
(সহীহ মুসলিমঃ ১/৪২৪)
অন্য বর্ণনায় আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
البقر عن سبعة والجزور عن سبعة-
অর্থঃ একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে এবং একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করা যায়।
(সুনানে আবু দাউদঃ ২/৩৮৮)
কুরবানীর পশুর বয়স
সাহাবী জাবির রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন-
لا تذبحوا إلا مسنة إلا أن يعسر عليكم فتذبحوا جذعة من الضأن-
অর্থঃ তোমরা (কুরবানীতে) ‘মুছিন্না’ ছাড়া যবেহ করবে না। তবে সংকটের অবস্থায় ছয় মাস বয়সী ভেড়া-দুম্বা যবেহ করতে পারবে।
(সহীহ মুসলিমঃ ২/১৫৫)
কুরবানীর উট অন্তত পাঁচ বছর বয়সী হতে হবে। গরু মহিষ দুই বছর এবং ছাগল- ভেড়া ও দুম্বা এক বছর হতে হবে। ভেড়া ও দুম্বার ক্ষেত্রে উপরক্ত হাদীস থেকে জানা গেলো যে, সেগুলো ছয় মাসের হলেও চলবে।
যে ধরণের পশু দ্বারা কুরবানী হয় না
সাহাবী বারা ইবনে আযিব রাযি. কুরবানীর পশু সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
أشار رسول الله صلي الله عليه وسلم بيده- ويدي أقصر من يده- فقال: أربع لا يضحي بهن- العوراء البين عورها والمريضة البين مرضها- والعرجاء البين ظلعها- والعجفاء التي لا تنقي- فقالوا للبراء: فإنما نكره النقص في السن والأذن والذنب- قال: فاكرهوا ما شئتم ولا تحرموا علي الناس-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাত দিয়ে ইশারা করেছেন- আমার হাত তো তার হাত থেকে ছোট- এবং বলেছেন- চার ধরণের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না। যে পশুর এক চোখের দৃষ্টিহীনতা স্পষ্ট, যে পশু অতি রুগ্ন, যে পশু সম্পূর্ণ খোড়া এবং যে পশু এত শীর্ণ যে, তার হাড়ে মগজ নেই। লোকেরা বললো- আমরা তো দাঁত, কান ও লেজে ত্র“টিযুক্ত প্রাণী (দ্বারা কুরবানী করা) ও অপছন্দ করি? তিনি বললেন- যা ইচ্ছা অপছন্দ করতে পারো। তবে তা অন্যের জন্য হারাম করো না।
(সহীহ ইবনে হিব্বানঃ হা-৫৯১৯; সুনানে আবি দাউদঃ ২/৩৮৭; সুনানে নাসায়ীঃ ২/২০২; সুনানে তিরমিযীঃ ১/২৭৫)
সাহাবী আলী ইবনে আবি তালিব রা. বলেন,
أمرنا رسول الله صلي الله عليه وسلم أن نستشرف العين والأذن وأن لا نضحي بمقابلة ولا مدابرة ولا شرقاء ولا خرقاء-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের আদেশ করেছেন, আমরা যেন (কুরবানীর) পশুর চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ্য করি এবং ওই পশু দ্বারা কুরবানী না করি, যার কানের অগ্রভাগ বা পশ্চাত ভাগ কর্তিত। তদ্রুপ ওই পশু দ্বারা যেনো কুরবানী না করি, যে পশুর কান ফাড়া বা কানে গোলাকার ছিদ্রযুক্ত ।
(সুনানে আবি দাউদঃ ২/৩৮৮; সুনানে নাসায়ীঃ ২/১৮০; সুনানে ইবনে মাযাহঃ ২২৭)
সাহাবী আলী ইবনে আবি তালিব রাযি. বলেন-
رسول الله صلي الله عليه وسلم أن يضحي بأعضب القرن والأذن-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিং ভাঙা বা কান কাটা পশু দ্বারা কুরবানী করতে নিষেধ করেছন।
(সুনানে ইবনে মাযাহঃ ২২৭)
কুরবানীর পশুর গোশত সংরক্ষণ
সাহাবী জাবির রাযি.-এর সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন- নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
كنا لا نأكل من لحوم بدننا فوق ثلاث مني- فارخص لنا رسول الله صلي الله عليه وسلم- فقال: كلوا وتزودوا والدخروا-
অর্থঃ আমরা আগে কুরবানীর তিন দিনের পর গোশত খেতাম না। কিন্তু পরবর্তীতে নবীজি আমাদেরকে তিন দিনের পরও গোশত খাওয়ার অবকাশ দিয়ে বলেন- তোমরা গোশত খাও এবং তা সংরক্ষণ করো।
(সহীহ মুসলিম- কিতাবুল আযাহীঃ হা-৫০৬৭)
উম্মুল মু’মিনিন আয়েশা রাযি.-এর এক বর্ণনায় আছে-
فكلوا والدخروا وتصدقوا-
অর্থঃ তোমরা খাও, সংরক্ষণ করো এবং সদকা করো।
(সহীহ মুসলিমঃ ২/১৫৮)
কুরবানীর পশুর গোশত-চামড়া বিক্রি
সাহাবী আলী ইবনে আবি তালিব রাযি. বলেন-
أمرنا رسول الله صلي الله عليه وسلم أن أقوم علي بدنة- وأتصدق بلحمها وجلودها وأجلتها- ولا أعطي الجزار منها- وقال: نحن نعطيه من عندنا-
অর্থঃ নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে তার (কুরবানীর উটের) আনুসঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করতে বলেছিলেন। তিনি কুরবানীর পশুর গোশত, চামড়া ও আচ্ছাদনের কাপড় সদকা করতে আদেশ করেন এবং এর কোনো অংশ কসাইকে দিতে নিষেধ করেন। তিনি বলেছেন- আমরা তাকে (তার পারিশ্রমিক) নিজের পক্ষ থেকে দিবো। (সহীহ বুখারী ১/২৩২; সহীহ মুসলিম ১/৪২৩-৪২৪)
কুরবানীর হিকমত ও তাৎপর্য
কুরবানীর মধ্যে অনেক হিকমত বিদ্যমান রয়েছে। এখানে কিছু বর্ণনা করা হলো।
পশু যবেহ করে কুরবানী করার মধ্যে এই হিকমত ও সবকও আছে যে, আল্লাহ তা’আলার মুহাব্বতে নিজের সকল অবৈধ চাহিদা ও পশুত্বকে কুরবানী করা এবং ত্যাগ করা। সুতরাং কুরবানী থেকে কুপ্রবৃত্তির দমনের জয্বা গ্রহণ করা উচিত। তাই কুরবানীর মধ্যে ইবাদাতের মূল বিষয় তো আছেই, সেই সাথে তাকওয়ার অনুশীলনও রয়েছে।
কুরবানী শিরক থেকে মুক্ত থাকার একটি কার্যকরী মাধ্যম। কেননা, মুশরিকদের মধ্যে পশু পূজার রেওয়াজ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ইসলাম মুসলিমদের কুরবানীর বিধান দিয়ে তাওহীদ তথা একত্ববাদের বিশ্বাসকে উজ্জ্বল ও দৃঢ় করণের পাশাপাশি এই শিক্ষাও দেয় যে, এসব জীব-জন্তু পূজার জন্য সৃষ্টি করা হয়নি; বরং এসব প্রাণী সৃষ্টি করা হয়েছে কুরবানী করে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য। এর দ্বারা একদিকে যেমন তাওহীদের বিশ্বাস শাণিত হয়। অপর দিকে মুশরিকদের প্রতিও কার্যত এমন আহ্বান করা হয় যে, তোমরা তোমাদের এহেন কার্যকলাপ ছেড়ে ইসলামের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হও। উদ্বুদ্ধ হও সুস্থ-জীবন যাপনে। বেরিয়ে যাও সত্যের অনুসন্ধানে। জাগিয়ে তোলো নিজেদের বিবেক প্রহরীকে। ফিরে এসো অসাড়-অনুভূতিহীন দেব-দেবীর উপাসনা থেকে। ছেড়ে দাও জীব-জন্তুর আরাধনা। শাণিত করো নিজেদের চিন্তা-চেতনা। আশ্রিত হও ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে।
কুরবানী করার মাধ্যমে সবাই আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা ও আধিপত্য দৃঢ়চিত্তে মেনে নেওয়ার অনুপ্রেরণা পায়। এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলার তাওহীদের স্বীকৃতি ঘোষিত হয়। কাফির-মুশরিকরা আল্লাহ তা’আলা ব্যতীত গায়রুল্লাহ বা দেব-দেবীর নামে পশু উৎসর্গ করে। আর মুসলমানরা সমস্ত গায়রুল্লাহ ও দেব-দেবীকে উপেক্ষা করে একমাত্র মহান আল্লাহ তা’আলার নামেই কুরবানী করে তাওহীদের স্বীকৃতি দানের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।
এসব পশুর অধিকার যে একমাত্র আল্লাহ তা’আলারই- কুরবানীর মাধ্যমে কার্যত তার স্বীকৃতি দান করা হয়। অর্থাৎ মুসলিমগণ বিশ্বাস করে থাকেন- আল্লাহ তা’আলাই হলেন এ বিশ্বজাহানের ¯্রষ্টা ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং এসব পশু তাঁরই। এটা তাদের বিশ্বাসগত স্বীকৃতি। আর কুরবানী হলো এরই কার্যত স্বীকৃতি।
আল্লাহ তা’আলা যে এসকল পশুকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং এসবের দ্বারা আমাদের নানাভাবে উপকার লাভের সুযোগ দান করেছেন- তার শুকরিয়া আদায় করা হয় কুরবানীর মধ্যেমে।
কুরবানীর মাধ্যমে আশরাফুল আম্বিয়া সায়্যিদুনা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, মূসা আলাইহিস সালাম ও ঈসা আলাইহিস সালাম প্রমুখ নবীগণের পিতা ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর স্মৃতি রক্ষা করা হয়। তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে কুরবানী করার চেষ্টার মাধ্যমে এর প্রবর্তন করেন।
কুরবানী করা দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ এবং পার্থিব জীবনের ভালোবাসা ইত্যাদি হতে পরিশুদ্ধি অর্জন করা হয়। কুরবানীর পশু যবেহ করার দ্বারা বাহ্যত কুরবানীদাতার মালের ক্ষতি হয়। আর এই লোকসান বা ক্ষতি আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্যই হয়ে থাকে। তাই যাকাতের মতো এর দ্বারাও সম্পদের ভালোবাসার মধ্যে কিছুটা ঘাটতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। সাথে সাথে কুরবানীদাতার মনে এই অনুভূতি জাগ্রত হয় যে, একটি পশুর কুরবানী যখন আল্লাহ তা’আলার দরবারে তাঁর সন্তুষ্টি এবং নৈকট্য অর্জনের কারণ হয়- তাহলে স্বয়ং নিজের জান-মাল সবকিছু আল্লাহর রাহে কুরবানী করে দেওয়া আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি ও সান্নিধ্য লাভের কত বড়ো মাধ্যম হতে পারে। এই অনুভূতি তার নিজের প্রতি ভালোবাসা কমিয়ে দিয়ে নিজেকে আল্লাহ তা’আলার রাহে কুরবানী করার চেতনাকে উজ্জীবিত করে।
আল্লাহ তা’আলার দীনকে পৃথিবীতে বিজয়ী করতে অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ‘কিতাল’ বা সম্মুখ অস্ত্রযুদ্ধেও এগিয়ে যেতে হবে মুসলিমদের। দুশমনদের রক্তপ্রবাহের সময় আসবে অনেক। সেক্ষেত্রে মুসলিমদের রক্ত¯্রােত দেখে যাতে ভয়ে প্রকম্পিত বা বিচলিত হয়ে না যায়। কুরবানী এরও একটা প্রশিক্ষণ বলা যায় নিঃসন্দেহে।
এছাড়া কুরবানীর মাধ্যমে গরীব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়। কুরবানীর মাধ্যমে দরিদ্র, অসহায়, ইয়াতীম ও অসহায়দের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ হয়।
কুরবানীর শিক্ষা
পশু কুরবানীর সাথে পশুত্বের কুরবানী করতে হবে। কারণ আমরা মানুষ। আমাদের মধ্যে যেমন ফেরেশতার স্বভাব আছে তেমনি পশুর স্বভাবও আছে। মানুষের মধ্যে যতো ভালো গুণ রয়েছে, সেগুলো হলো- ফেরেশতার স্বভাব। আর হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, খারাপ ব্যবহার করা, অন্যায়ভাবে কারো উপর আক্রমণ করা, মানুষের ধন-সম্পদ অবৈধভাবে দখল করা, কারো অধিকার কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি হলো পশুর স্বভাব।
কুরবানীর ঈদে আমরা পশু কুরবানী করে থাকি। কুরবানীর মূল ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে এই উপলক্ষে অর্জিত তাকওয়া বা আল্লাহভীতি দ্বারা আমরা নিজের পশুর স্বভাবকে কুরবানী করি না। তাই আমাদের সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার দূর হয় না। যদি পশু কুরবানীর সাথে সাথে আমরা নিজেদের পশুর স্বভাবকেও কুরবানী করতে পারি- তবেই আমাদের সমাজ হবে সুখময়, শান্তিময় ও আনন্দময়।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের আমলে মানুষ যেরূপ শান্তি ও নিরাপত্তার সাথে জীবন-যাপন করেছে, অনুরূপ পবিত্র স্বভাবের অধিকারী হয়ে আজও সেরূপ শান্তি ও নিরাপত্তা আমরা লাভ করতে পারি। এজন্য আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরামের গুণাবলী অর্জন করতে হবে। তাদের মাঝে ছিলো সব উত্তম গুণাবলী। আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম-এর মহান ত্যাগের অপূর্ব স্মৃতি কুরবানী প্রতি বছর আমাদেরকে এই শিক্ষাই দিয়ে যায়।
কুরবানীর ফযীলত
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
ما عمل آدمي من عمل يوم النحر أحب إلي الله من إهراق الدم- إنه ليأتي يوم القيامة بقرونها وأشعارها وأظلافها- وإن الدم ليقع من الله بمكان قبل أن يقع من الأرض- فطيبوا بها نفسا-
কুরবানীর দিনের আমলসমূহের মধ্য থেকে পশু কুরবানী করার চেয়ে কোনো আমল আল্লাহ তা’আলার নিকট অধিক প্রিয় নয়। কিয়ামতের দিন এই কুরবানীকে তার শিং, পশম ও ক্ষুরসহ উপস্থিত করা হবে। আর কুরবানীর রক্ত যমীনে পড়ার আগেই আল্লাহ তা’আলার নিকট কবুল হয়ে যায়। সুতরাং তোমরা সন্তুষ্টচিত্তে কুরবানী করো।
(সুনানে তিরমিযীঃ হা-১৪৯৩)
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রাযি. বলেন-
قلت يا رسول الله! أستدين وأضحي؟ قال: نعم- فإنه دين مقضي-
আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম- আমি ঋণ করে কুরবানী করবো কি না? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন- হ্যাঁ, করো। আল্লাহ তা’আলা তোমার ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করে দিবেন।
(দারা কুতনীঃ হা-৪৭১০)
সাহাবী যায়েদ বিন আকরাম রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
قال أصحاب رسول الله صلي الله عليه وسلم: يا رسول الله ما هذه الأضاحي؟ قال سنة أبيكم- قالوا فما لنا فيها يا رسول الله قال: بكل شعرة حسنة- قالوا فالصوف يا رسول الله؟ قال: بكل شعرة من الصوف حسنة-
সাহবায়ে কেরাম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এই কুরবানী প্রথাটা কী? তিনি ইরশাদ করেন- এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সুন্নাত। সাহাবায়ে কেরাম পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এতে আমাদের লাভ কী?
তখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- কুরবানীর পশুর প্রত্যেকটা চুলের পরিবর্তে একটি করে নেকী পাওয়া যাবে। সাহাবায়ে কেরাম আবার জিজ্ঞাসা করলেন, যে সমস্ত পশুর মধ্যে পশম রয়েছে- ওগুলোর মধ্যে কি সাওয়াব হবে? তিনি বললেন- ওগুলোতেও প্রতিটি পশমের বদলে একটি করে নেকী পাওয়া যাবে।
(সুনানে ইবনে মাজাঃ ২/২২৬, তারগীবঃ ২৫৫, মিশকাতঃ ১/১২৯)
সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
قال رسول الله صلي الله عليه وسلم: يا فاطمة! قومي إلي أضحيتك فاشهديها- فإن لك بأول قطرة تقطر من دمها أن يغفر لك ما سلف من ذنوبك قالت: يا رسول الله! لنا خاصة أهل البيت أو لنا وللمسلمين؟ قال: بل لنا وللمسلمين-
একবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতেমা রাযি.-কে ডেকে ইরশাদ করেন- হে ফাতেমা! তুমি তোমার কুরবানীর পশুর নিকট যাও। কেননা, কুরবানীর পশু যবেহ করার পর রক্তের প্রথম ফোঁটা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তোমার যাবতীয় গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। ফাতেমা রাযি. জিজ্ঞেস করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এটা কি শুধু আমার জন্য? নবীজি বললেন- এটা আমাদের জন্যে এবং সকল মুসলিমের জন্যে।
(আত-তারগীবঃ ২৫৬)
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন-
عظموا ضحاياكم- فإنها علي الصراط مطاياكم-
তোমরা মোটাতাজা পশু কুরবানী করো। কারণ এটা পুলসিরাতে তোমাদের সাওয়ারী হবে।
(বাদায়েউস সানায়েঃ খন্ড-৫, পৃ-৮০)
অন্য স্থানে বর্ণিত হয়েছে-
قال الرجل: أرأيت إن لم أجد إلا منيحة أنثي أفأضحي بها؟ قال: لا ولكن تأخذ من شعرك وأظفارك وتقص شاربك وتحلق عانتك فتلك تمام أضحيتك عند الله-
এক সাহাবী নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ! এক ব্যক্তি দুধ খাওয়ার জন্যে আমাকে একটি উট দিয়েছে। আমি কি তা দ্বারা কুরবানী করবো? নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে নিষেধ করলেন এবং বললেন, তবে তুমি নখ, চুল ইত্যাদি কাটো। এটাও তোমার জন্য আল্লাহর দরবারে পূর্ণ কুরবানী। এ বলে নবীজি ওই গরীব সাহাবীকে সুসংবাদ দিলেন।
(সুনানে আবি দাউদঃ ২/৩৮৫; সুনানে নাসায়ীঃ ২/১৭৯; সুনানে দারা কুতনীঃ ৪/২০২)
হাদীসের গ্রন্থসমূহে কুরবানীর ফাযায়েল সম্পর্কিত অনেক হাদীস রয়েছে। সব এখানে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বলাবাহুল্য, ইবাদতের মূলকথা হলো আল্লাহ তা’আলার আনুগত্য এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যে কোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দুটি বিষয় জরুরি। ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পালন করা এবং শরীয়তের নির্দেশনা মোতাবেক তা সম্পাদন করা।
উপরোক্ত বর্ণিত এ সমস্ত ফযীলত ওই সময় অর্জিত হতে পারে- যখন কুরবানী শরীয়ত অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। অন্যথায় সওয়াবের আশা করা কল্পনাতীত। অতএব, এ অসংখ্য সওয়াব হাসিলের লক্ষ্যে কুরবানীর মাসায়েল ও আহ্কাম সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞান অর্জন করে সে অনুযায়ী কুরবানী করা প্রত্যেক মুমিনের জন্য কর্তব্য।
আব্দুল্লাহ আল মাসুম
Leave Your Comments