কাদিয়ানী সম্প্রদায় স্ববিরোধী কথাবার্তায় বড্ড ওস্তাদ। ইতিপূর্বে প্রমাণ সহ আপনারা জেনেছেন।
তারা এক মুখে নবী মুহাম্মদ (সা)-কে “শেষনবী” মানার কথা বলে। আবার দেখা যায় মির্যার নবুওত আর রেসালত দাবির বৈধতা প্রমাণ করতে পাল্টাপাল্টি দলিল(?) পেশ করতেও দ্বিধা করেনা। তবে কি তারা মুসলমানদের ধোকা দেয়ার জন্যই এমন নিকৃষ্ট বক্রপথ বেছে নিল?
কয়েক দিন আগে জনৈক কাদিয়ানী মতাবলম্বীকে দেখা গেল সে মির্যাকে নবী সাব্যস্ত করতে লিখেছে –
যদি ভবিষ্যতে কেউ নবী হন তিনি আবু বকর (রা)-এর চেয়েও উচ্চমার্গের হবেন। (তার এ দাবির পক্ষে দলিল স্বরূপ নিচের বর্ণনাটি পেশ করল)। মহানবী (সঃ) বলেন ‘আবু বকর এ উম্মতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ – যদি ভবিষ্যতে কোনো নবী হন তিনি ব্যতীত’। (দেখুন সুনানে তাবারানী)।
______
# খণ্ডন :
প্রথমত, তাদের উল্লিখিত বর্ণনাটিকে ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী, ইমাম যাহাবী, ইমাম ইয়াহিয়া বিন মুঈন এবং ইমাম আবু হাতিম প্রমুখ সবাই অগ্রহণযোগ্য বলেছেন। আরেকটু পরে আসছে।
____
দ্বিতীয়ত, কাদিয়ানিরা বর্ণনাটিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করে অনুবাদ করে থাকে। তার বিশুদ্ধ অনুবাদ আমরা করে দেব ইনশাআল্লাহ।
_____
৩- মূলত বর্ণনাটি কোনো ভাবেই নতুন কোনো নবীর আগমনের প্রতি ইংগিত করেনা। বড়জোর হযরত আবু বকর (রা)-এর সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার প্রতি ইংগিত করেছে।
_____
৪- মির্যা কাদিয়ানির পরিষ্কার একটি বক্তব্য ছিল, রাসূল (সা)-এর পরিপূর্ণ অনুকরণ আর অনুসরণের মাধ্যমে এবং তাঁর ফয়েজ দ্বারা উম্মত নবুওতের মত নেয়ামত লাভ করে থাকেন। (নাউজুবিল্লাহ)। তর্কের খাতিরে তার এ বাগাড়ম্বরপূর্ণ বক্তব্য মেনে প্রশ্ন করতে পারি যে, হযরত আবু বকর (রা) উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ফজিলতের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি কি জন্য নবুওয়াত লাভ করেননি? তবে কি আল্লাহ তা’আলা মির্যা কাদিয়ানিকে আবু বকরের চেয়ে বেশি যোগ্য মনে করতেন? নতুবা মির্যা কাদিয়ানী রাসূলের ফয়েজ আর আনুগত্যের ধুঁয়া তুলে নবুওতের দাবি করার যথার্থতা কোথায়? সে কি আবু বকরের চেয়েও শ্রেষ্ঠ?
________
এবার আসুন, তাদের পেশকৃত বর্ণনাটির আরবি ভার্সন এবং অনুবাদ তুলে দিই।
وقال رسول الله، صلى الله عليه وسلم: أبو بكر أفضل هذه الأمة إلا أن يكون نبي. (18) رواه الطبراني.
অনুবাদ : “আবু বকর এ উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম তবে নবী হলে ভিন্নকথা।” (দেখুন – তাবারানী)।
____
শাব্দিক অনুবাদ : أبو بكر আবুবকর أفضل সর্বোত্তম هذه এই الأمة উম্মতের إلا তবে أن يكون হলে نبي নবী (ভিন্নকথা)।
____
# উপলব্ধি : উপরের বর্ণনাটি দ্বারা দুটো মর্মার্থের সম্ভাবনা রয়েছে।
১- আবুবকর (রা)-এর পরে নবীর আগমন ঘটার। কিন্তু এ মর্মার্থ উদ্দেশ্য নেয়া যেতে পারেনা। কেননা এ মর্মার্থ পবিত্র কুরানের সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের বিরুদ্ধে যায়। সহীহ বুখারী এবং মুসলিম সহ অসংখ্য সহীহ হাদিসের সুস্পষ্ট বর্ণনারও বিরুদ্ধে যায়। সুনানে তিরমিযির একটি হাদিসে তো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখই আছে যে, لو كان بعدى نبى لعمر بن الخطاب نبياً. অর্থাৎ রাসূল (সা) ইরশাদ করেছেন – আমার পরে নবী হলে সে উমরই হত। সহীহ বুখারীর ১ম খন্ডের ৫০১ নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার উল্লেখ আছে, انا خاتم النبیین ﻻ ﻧﺒﻲ بعدى অর্থাৎ আমি খাতামুন নাবিয়্যীন, আমার পরে কোনো নবী নেই।’ সুতরাং উপরিউক্ত সম্ভাবনা বাতিল।
_______
২- বর্ণনাটিতে يكون পদটি أن (মাসদার/ক্রিয়ামূলের অর্থ নির্দেশকারী বর্ণ)’র কারণে ক্রিয়াপদ থাকেনি। ক্রিয়ামূল হয়ে গেছে। ফলে বিশেষ্যপদের অর্থ প্রকাশ করবে। আবার বাক্যে نبى শব্দটি রফা/পেশের অবস্থায় হয়ে বুঝাল যে, নবী সম্বোধন আবুবকরের প্রতি নয়। বরং শেষ যুগে ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ) এর নাযিল হওয়ার প্রতি ইংগিত। যিনি ইতিপূর্বে বনী ইসরাইলের জন্য এসেছিলেন। তিনি আখেরি নবীর শরীয়তের প্রচারক এবং একজন মুজাদ্দিদ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে আকাশ থেকে নাযিল হবেন। তাঁর এবং প্রতীক্ষিত ইমাম মাহদী একই সমসাময়িক কালে হবেন। হাদিসে পরিষ্কার এসেছে, তিনি ইন্তিকালের পর মদিনায় রাসূলের রাওজার পাশেই সমাহিত হবেন। নিশ্চয় আবুবকর (রা) তিনি যদিও এ উম্মতের মধ্যে সর্বোত্তম কিন্তু তিনি নবুওত আর রেসালতের অধিকারী হযরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ)-এর সমতুল্য হবেন না। উল্লেখ্য, ঈসা (আ) পুনরায় নবুওতপ্রাপ্ত হবেন না। তিনি পুরাতন নবী। কাজেই তার নুযূলের কারণে নবী মুহাম্মদ (সা)-এর খাতিমিয়তের উপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বেনা। হ্যাঁ, নতুন কারো পক্ষে যদি নবুওতপ্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকত তখন নিশ্চয় খাতিমিয়তের উপর আপত্তি জাগত। উপরের বর্ণনাটি এ দিকেও ইংগিত করে থাকতে পারে। এমতাবস্থায় সেটি আপনা জায়গায় সঠিক। সুতরাং কাদিয়ানিদের উদ্দেশ্যমূলক ও স্ববিরোধী মর্মার্থ বাতিল।
_____
এবার আসুন উক্ত বর্ণনাটি সম্পর্কে মুহাদ্দিসে কেরামের মতামত জেনে নিই।
____
আমরা খুঁজাখুঁজি করে কয়েকটি মতামত সম্পর্কে অবিহিত হয়েছি। নিচে দেখুন-
وهذا الحديث ضعيف، لأن من رواته إسماعيل بن أبي زياد، وهو لا يحتج به، قال عنه ابن حجر: “متروك كذبوه”. وقال الذهبي: قال يحيى: كذاب. وقال أبو حاتم: مجهول.
অর্থাৎ হাদিসটিকে ইমাম তাবারাণী রহঃ “দুর্বল” আখ্যা দিয়েছেন। কেননা হাদিসের সনদের ভেতর ‘ইসমাইল ইবনে আবু যিয়াদ’ নামক বর্ণনাকারী রয়েছে। তার বর্ণনা দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
শারেহে বুখারি ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ তিনি উক্ত রাবীকে “মুনকার” (অগ্রহণযোগ্য) বলেছেন। (তিনি আরো বলেন) মুহাদ্দিসগণ তাকে মিথ্যুক বলেছেন।
ইমাম যাহাবী রহঃ বলেন, ইমাম ইয়াহিয়া ইবনে মুঈন রহঃ তাকে “কাজ্জাব” (হাদিসের বর্ণনার ক্ষেত্রে মিথ্যা রটনাকারী) বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ইমাম আবু হাতিম রহঃ উক্ত রাবীকে “মাজহূল” (অজ্ঞাত/অপরিচিত) বলে আখ্যা দিয়েছেন।
এতো সামান্য কয়েকটি মতামত। এছাড়া আরো অনেক মতামত প্রমাণিত। আপাতত এ পর্যন্ত।
____
একটি কথা বলে রাখা দরকার তা হল, মির্যা কাদিয়ানি ১৮৩৮ সালে ভারতে জন্মগ্রহন করেছিল। সে ১৮৮০ সালে নিজেকে মুজাদ্দিদ দাবি করে। ১৮৯১ সালে প্রথমে মাসীহ ঈসা অত:পর ইমাম মাহদী দাবি করে। ১৯০১ সালে নিজেকে নবী এবং রাসূল দাবি করে। অথচ তারই লেখিত “মাজমুয়ায়ে ইশতিহারাত” পুস্তকের ১ম খন্ডের ২৩০-৩১ নং পৃষ্ঠায় “মুহাম্মদ (সা)-এর পরে যে কোনো নবুওত এবং রেসালতের দাবিদারকে নিজেও মিথ্যুক এবং কাফির বলে ফতুয়া জারি করেছিল।” (স্কিনশট প্রথম কমেন্টে) যাইহোক উপরে যে সমস্ত মুহাদ্দিসের মতামত পেশ করলাম তাদের সবাই মির্যার জন্মের শত শত বছর আগের মহামনীষী। মির্যা কাদিয়ানির নিকট তাদের কেউ কেউ যুগের মুজাদ্দিদ হিসেবেও স্বীকৃত। (দেখুন, আছলে মুছাফফা ১/১৬২-৬৫)। সুতরাং কাদিয়ানিদের পক্ষে উনাদের মতামত প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ থাকেনি।
____
পরিশেষে বলতে পারি, রাসূল (সা) সর্বশেষ নবী এবং রাসূল। এটাই মুসলিম উম্মাহার ঈমান। এর বিপরীতে বিশ্বাস কুফুরি। সুতরাং কাদিয়ানিদের উক্ত দাবি বাতিল। তাদের পেশকৃত হাদিসটির প্রকৃত মর্মার্থ কোন দিকে ইংগিত করে থাকতে পারে সেটিও বুঝিয়ে দেয়া হয়। এতদ্ব্যতীত তাদের উক্ত রেওয়ায়েত দুর্বল। কারো কারো মতে অগ্রহণযোগ্য এবং বর্ণনাকারী ইসমাইল বিন আবু যিয়াদ মিথ্যাবাদী। কাজেই এরকম একটি অপরিপক্ব ও অস্পষ্ট রেওয়ায়েত কখনো কুরানের আয়াতকে বাতিল করতে পারেনা। অসংখ্য সহীহ হাদিসের মুকাবিলায় এটি পুরোই মূল্যহীন।
Leave Your Comments