ইসলামে ‘বাল্য-বিবাহ’ জায়েয, এটা বলতে আজ অনেক মুসলমানেরই লজ্জা বোধ হয়। কেন? কারন- বাঙলাদেশে আজ যে মানুষটির বয়স সার্টিফিকেট অনুযায়ী ১৮ বছরের এক সেকেন্ড কম, এদেশের আইন অনুযায়ী সে ‘শিশু’। পাশ্চাত্যে ১৩ বছরের ‘শিশু’ ছেলে-মেয়ে বিয়ে করলে তাদের হয়ত অনেক সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিন্তু ১৩ বছরের শিশু যৌনতা করলে তাতে তাদের কোনো সমস্যাই নেই। ‘বাল্য-বিবাহে’ ভয়টা কোথায়? ভয়টা হলো গর্ভধারনে। ছেলেদের জন্য কনডম রয়েছে। মেয়েদের জন্য পিল রয়েছে। তারপরও যদি কনডম ফেটে, পিলের অকার্যকারীতার ফলে মেয়ের গর্ভধারন ঘটেই যায়, তাহলে আধুনিক চিকিৎসার আশীর্বাদ(!) হিসেবে গর্ভপাতের সু-ব্যবস্থা(!) রয়েছে। এরপরও সমস্যা কোথায়?
একটি বিজ্ঞাপন দেখে মজাই লাগল। এইডসের সংক্রমন থেকে সাবধানতার বিজ্ঞাপন। লেখা রয়েছে -‘ঝুকিপূর্ণ শারীরিক সম্পর্কে কনডম ব্যবহার করুন’। অর্থাৎ ‘ঝুকিপূর্ণ শারীরিক সম্পর্কে’ নিরাপদ থাকুন। পরোক্ষ উৎসাহ প্রদান নয় কি?
সাম্প্রতি বাঙলাদেশে কনডম-পিলের দাম বেড়েছে। এতে কিছু সংখ্যক মানবতাবাদীর সংশয়ের শেষ নেই। কারন এতে দরিদ্রজনগোষ্ঠী এ থেকে পিছু হটবে। সঙ্গমের জন্য এতো ব্যয় করতে তারা চাইবে না। এর ফলে মেয়েরা প্রেগনেন্টে হয়ে যাবে। বাচ্চা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হবে। দরিদ্র দেশে জনসংখ্যা মানেই হলো অভিশাপ। মোদ্দা কথা, ‘পিল খাও, কনডম ব্যবহার কর, খাওয়ার লোক কমবে, দারিদ্রতা বন্ধ হবে, অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলবে’। সুজা কতা। আসলে কি তাই?
‘নানীর বয়স তেইশ’! এই শিরোনামে পত্রিকায় খবর পড়ে চোখ আটকে গেল। খবরটি পত্রিকায় দেখলাম ১৭ অক্টোবর ২০১২। পড়ে যে তথ্য পেলাম, তা হলো-দেশের নাম ‘রোমানিয়া’, শহরের নাম ‘ইনভেসতি’, এই শহরের বাসিন্দা ‘রিফকা স্ট্যানেস্কু’। তিনি নানী হয়েছেন। তার মেয়ে ‘মারিয়া’র বয়স এখন ১১। মারিয়া গত দু’বছর আগে, অর্থাৎ মারিয়ার বয়স যখন ৯ তখন তিনি ‘ইয়ন’ নামের এক পুত্রের জন্ম দেন। ‘রিফকা স্ট্যানেস্কু’র মা’র (ইয়নের বড়-মা) বয়স এখন ৪০। এখানেই শেষ নয়। দুই বছরের ইয়নের বাগদান সম্পন্ন হয়ে রয়েছে ৮বছরের কন্যার সাথে। ‘রিফকা’রও দুই বছর বয়সে বাগদান সম্পন্ন হয়েছিল। তারপর আবার ১১বছর বয়সে পালিয়ে মারিয়ার বাবাকে বিয়ে করেন। এটা ঐদেশের স্বাভাবিক ঘটনা। এটা আমাদের দেশের পত্রিকার একটি শিরোনাম হওয়ার কারণ কি? কারণ- এটা আমাদের দেশের পত্রিকার সাংবাদিকদের মনে নাড়া দিয়েছে। তারা এটাতে বিস্মিত, হতভম্ব! কারণ, তারা পাশ্চাত্যের কুত্তামার্কা সংস্কৃতির ধারক-বাহক যে! এরা কুত্তার মতো রাস্তায় রাস্তায় যৌনতার সয়লাব করতে রাজি, কিন্তু বিয়ে করতে রাজী নয়। কারণ- কুত্তাদের মধ্যে তো আর বিয়ে করার সংস্কৃতি নাই।
বাঙলাদেশের কোনো হুজুর যদি এই কাজ করত, তাহলে বোধয় ছিঃ ছিঃ রবে রাস্তায় থুতুময় হয়ে উঠত। ‘অন্ধকার যুগের মানুষ’ বলেও বহু কথা উঠত। এইসব ছ্যাচড়া টাইপের বুদ্ধিজীবীরা মনে করে, বেশী বয়সে বিয়ে করে আর অবৈধ সঙ্গমে উৎসাহিত করে তারা আধুনিক বনে গেছে।
মেয়ের বান্ধবীর সাথে সম্পর্ক করে পরিণয়ের একটি উদাহরণ হলো- প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। প্রথম প্রথম আমিও বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখিনি। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, মেয়ের বয়সী মেয়ের সাথে বিয়ে হয়েছে, তাই হয়ত এতো কথা, তার সাথে অবৈধ সম্পর্ক হলে এতো কথা হতো না। দু’একদিন কথা হলেও পরে ধামাচাপা পড়ে যেত। এ থেকে একটা শিক্ষা রয়েছে। কি শিক্ষা? শিক্ষাটা হলো- মেয়ের বান্ধবীর মাথায় হাত দিয়ে ‘মা’ বলা যাবে না। বান্ধবীর বাবা বলে ‘আঙ্কেল’ বলে পীড়িতের আলাপ জুড়ে দেয়া যাবে না। কার হাত কার মাথায় কি ভেবে যায়, তারাই ভালো বলতে পারবে। কার ডাকে কার বুকের ভেতর কী ধরনের আবেগের ঢেউ জাগে, বলা মুশকিল। শাওনের গানের সুরে মুগ্ধ হয়ে ধীরে ধীরে হুমায়ুন আহমেদ তার প্রেমে পড়েছিল। তাই ইসলামের শরীয়ত যে সকল কাজ নিষিদ্ধ করেছে, তা করলে এধরনের ঘটনা তো ঘটতেই পারে। অবাক হওয়ার কিচ্ছু নেই। কিন্তু মানুষের সমস্যা হলো, মা’র সাথে একসাথে বসে হিন্দি সিরিয়াল দেখতে পারলেও মেয়ে যদি কারো প্রেমে পড়ে, তাহলে মা হয়ে সেটা মেনে নিতে পারে না। মায়ের বোঝা উচিত, তিনি হিন্দি সিরিয়ালের দর্জ্জাল মায়ের ভূমিকাতে সে নিজেকে দেখলেও, তার মেয়ে হয়ত নিজেকে দেখেছে সেই নায়িকা রূপে, যে কিনা তার প্রেমিকের সাথে সবাইকে ছেড়ে যেতে প্রস্তুত। কে যে কোথা থেকে কী গ্রহণ করে, বলা মুশকিল। কথায় বলে না- ‘একই ফুল থেকে মৌমাছি নেয় মধু, ভ্রমর নেয় বিষ’।
নবীজি হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে যখন বিয়ে করেন, তখন তার বয়স ছিল- ছয় বছর, অপরদিকে নবীজির বয়স ছিল ৫২বছর। আয়েশা (রাঃ)-এর নয় বছর বয়সে নবীজি ঘরে তুলে আনেন। নবীজি যখন নবুওত প্রাপ্ত হন, তখন নবীজির বয়স ছিল- ৪০ বছর আর তখন উসমান (রাঃ) এর বয়স ছিল- ৩৪বছর। নবীজি (সাঃ) এর কন্যা হযরত রোকাইয়া (রাঃ) এর সাথে প্রথমে উসমান (রাঃ)-এর বিয়ে হয়। পরবর্তীতে রোকাইয়া (রাঃ) বদর যুদ্ধের সময় মদীনায় মৃত্যুবরণ করলে নবীজি (সাঃ) তার আরেক মেয়ে কুলসুম (রা)-এর সাথে তার বিবাহ দেন।
গুণিজনের বাল্যবিবাহঃ
বাঙলাদেশের বর্তমান সু-শীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাল্যবিবাহ হলো একটি মারাত্মক অপরাধ। কিন্তু আমাদের খুব পরিচিত কিছু গুণিজনের জীবনে এইরকম অপরাধ সংঘটিত হতে দেখি। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, মুসলিম ঘর থেকে উদ্ভুত, মুসলিম নামের ঐতিহ্যের বাহক, ইসলাম বিরোধী একটি শক্তি প্রায়সই মহানবী (সাঃ)-এর সাথে আয়েশা (রাঃ)-এর বাল্যবিবাহকে নিয়ে কটুক্তি করতে দেখা যায়। অথচ পৃথিবীতে এমন ঘটনা যে আরো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনেও রয়েছে, তা নিয়ে তাদের কোনো কটুক্তি তো দূরের কথা, কোনো তথ্য দিতেও কখনও দেখা যায় না। তেমন দুজন ব্যক্তির বাল্যবিবাহের কথা এখানে বলার প্রয়াস পাব। তবে মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ তাকেই বলা হয়, যার বয়স ১৭ বছর ৩৬৪দিনের মধ্যে। এদের ‘শিশু’ বলা হয়। যাদের বিয়ের সময় স্ত্রীর বয়স ১৭ বছরের মধ্যে ছিল, সেসকল বিয়েকে আমি বাল্যবিবাহ বলব।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জন্ম ৭ মে ১৮৬১ – মৃত্যু ১৯৪১। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী, জন্ম ১৮৭৩ – মৃত্যু ১৯০২। রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনী দেবীকে বিয়ে করেন ১৮৮৩ সালে। যখন রবী ঠাকুরের বয়স ছিল ২২ এবং মৃণালিনী দেবীর ১০।
মহাত্মা গান্ধী (মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী), জন্ম ২ অক্টোবর ১৮৬৯ – মৃত্যু ৩০ জানুয়ারী ১৯৪৮। মাহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা গান্ধী, জন্ম ১১ এপ্রিল ১৮৬৯ – মৃত্যু ২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪। তাদের বিয়ে হয় ১৮৮২ সালে, যখন তাদের উভয়ের বয়স ছিল ১৪। পারিবারিক মধ্যস্থতায় তাদের এই বিবাহ হয়েছিল। আমরা দেখতে পাচ্ছি, মহাত্মা গান্ধী তার স্ত্রীর থেকে প্রায় ৬মাসের ছোট ছিলেন!
১৯২৪ (২৫ এপ্রিল ১৯২৪/মতান্তরে ২৪ এপ্রিল ১৯২৪) সালে কাজী নজরল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বিবাহ করেন ‘প্রমীলা সেনগপ্ত’-কে। যমুনার পাশে ছোট্ট একটি গ্রাম ‘তেওতা’। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় থানার অর্ন্তগত এই ‘তেওতা’ গ্রামে ১৯০৮ সালের ২মে (১৩১৫ সালের ১৭ই বৈশাখ) জন্মগ্রহণ করেন প্রমীলা। প্রকৃত নাম আশালতা সেন। আর ডাক নাম ছিল দোলন দেবী দুলি। বিয়ের পর তিনি আশালতার নাম দেন প্রমীলা। বাবার নাম বসন্ত কুমার সেন, মায়ের নাম গিরিবালা দেবী। বিবাহের সময় কাজী নজরলে বয়স ছিল ২৩, আর প্রমীলা দেবীর ১৪। তিনি ১৯৬২ সালে মারা যান।
source:
(১) প্রথম আলো, ২৪.০৫.২০১৩
(২) তেওতার মেয়ে প্রমীলা. মিয়াজান কবীর.banglamail24.com
আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে একজন হলেন আমেরিকার কবি ‘এডগার অ্যালান পো’ (Edgar Allan Poe, January 19, 1809 – October 7, 1849) উনি তার কাজিন ভার্জিনিয়া এলাইজা ক্লেম পো (Virginia Eliza Clemm Poe, August 15, 1822 – January 30, 1847) )-কে বিয়ে করেন ১৮৩৫ সালে। যখন ভার্জিনিয়ার বয়স ছিল ১৩ আর পো’র ২৭। ভার্জিনিয়া ২৪ বছর বয়সে মারা যান।
টিকাঃ
বাঙালি জাতির গর্ব, বিশ্বকবি, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ছোটগল্পে ‘হৈমন্তি’তে বলেছিলেন-“কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিত উপরে আছে, সেজন্যেই তাড়া।” যারা এই ছোট গল্পটি পড়বেন, তারা খুব সহজেই বুঝতে পারবেন এখানে তিনি নৈতিকভাবে ‘যৌতুক’ দান এবং বাল্যবিবহের প্রতি তার বিরূপ মনোভাবে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তিনি নিজে বাস্তবজীবনে বাল্যবিবাহ করেছেন এবং তার সকল কন্য সন্তানকেই বাল্যকালে বিবাহ (বাল্য-বিবাহ) দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, কন্যাসন্তানের বিয়েতে কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার মতো ‘যৌতুক’ দিয়েছেন।
আমার বেশ মজাই লাগে, যখন দেখি রবীন্দ্রভক্ত কোনো ব্যক্তি ইসলামের বাল্য-বিবাহ নিয়ে কটাক্ষ্য করে আর যৌতুক বিরোধী স্লোগান দেয়। প্রকাশ্যে কখনওই রবীন্দ্রনাথের এই অধ্যায়কে আনা হয় না। পাছে রবীন্দ্রনাথের মর্যাদার হানী হয়! কিন্তু নবীজি (সাঃ) এবং আয়েশার (রাঃ) বিষয়টা তারা চট-জলদি সামনে আনে। এতেই বোঝা যায়, নবীজির সম্মানহানীর চেষ্টাতে তাদের কিচ্ছুই যায় আসে না। বরং এতে তারা ব্যতিব্যস্ত থাকে। এই বিষয়টা আমাদের আঙুলচোষা মুসলমানদের মনে রাখা দরকার। বুদ্ধিজীবীদের চাপাবাজীর চিপায় পড়ে বাঙালি মুসলমানদের আজ ধরাশায়ী দশা। মুক্তি মিলবে কবে?
Leave Your Comments