বয়সে বড় মেয়েদের বিয়ে করা কি ইসলামে নিষিদ্ধ?

বিয়ের বয়স একটা বিরাট ঝামেলার বিষয়। ক্লাশ নাইন-টেইনের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে অনেকে বলে- “বাল্যবিবাহ করবি?!” আবার যদি ২০ বছরের মেয়ে বিয়ে করি, তাহলে অনেকে বলে “কুড়িতেই বুড়ি”। আর যদি নিজের থেকে বয়সে বড় মেয়ের সাথে চলি, তাহলেও বলে- “শেষ পর্যন্ত আর মেয়ে পাইলি না!” জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে যদি সৃষ্টিকর্তার হাতেই থেকে থাকে বলে মানুষ বিশ্বাস করে, তবে কেন তারা এই সব নিয়ে এতো ফস্টিনস্টি করে?

ইসলামে বিয়ের বয়স নিয়ে এমন কোনো বাধা-ধরা কোনো আদেশ-নির্দেশ দেয়া হয় নাই যে, অমুক বয়সে বিয়ে হতেই হবে, নয়ত বিয়ে করা যাবে না! বরং আমরা সমাজের পোতারা এসব বানিয়েছি। এখন এটাকে সামাজিকতা বানিয়ে নিয়েছি, দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছি, নিজেদের মতন। হিন্দুদের সংস্পর্শে এসে মুসলমানদের মধ্যে এমন কিছু কুসংস্কার প্রবেশ করেছে যে, ভাবতে বড় কষ্ট হয়। যেমন- মুসলমানদের বিয়েতে যৌতুক দেয়া ‘হারাম’ ছিল। কিন্তু হিন্দুদের দেক-দেখায় আজ মুসলমানরাও অভ্যস্ত হয়েছে। ধুমধাম করে মুসলমানদের বিয়ে করা ঠিক নয়, বরং বিয়ে অনেকটা গোপনে বা কমখরচে করার নিয়ম। কিন্তু বিয়ে করার সময় মানুষের কাছ থেকে ধার দেনা করেও সামর্থের বাহিরে এখন খরচ করে। মুসলমানদের মধ্যে পর-পুরুষের বা পর-নারীর হাতের স্পর্শে লাগানো ‘গায়ে হলুদ’ দেয়ার রীতিও ছিল না। এখন মুসলমানদের মধ্যেও তা প্রবেশ করেছে। এই রাত্রে অনেকে মদ্যও পান করে ফুর্তি করে। নারী-পুরুষের নাচ-গানও অবাধে চলে। এই রাত্রের জন্য কেউ তা নিষেধও করে না। হলুদ না দিলে নাকি অনেকের বিয়ে হয়েছে বলে মনেই হয় না! যেমন- ছোটবেলায় একবার কোনো এক মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম- “মেয়েদের পেটে বাচ্চা হয় কখন? আমার ফুফুর তো বাচ্চা হয় না (তার তখনও বিয়ে হয়নি)! কিন্তু তার থেকে বয়সে অনেক ছোট মেয়েদেরও তো দেখি বাচ্চা হয়েছে!” তখন সেই মহিলা আমাকে জবাব দিয়েছিল- “গায়ে হলুদ না পড়লে মেয়েদের পেটে বাচ্চা আসে না!” তখন দেখেছিলাম অনেক পিচ্চি পিচ্চি মেয়েরাও একে অপরকে হলুদ দিচ্ছে। সেই মহিলাকে ঐসব পিচ্চি মেয়েদের দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম- “ওদের কি খুব তারাতারিই বাচ্চা হবে?”

বয়সে বড় মেয়েদের বিয়ে করা কি ইসলামে নিষিদ্ধ? উত্তর হলো- “না”। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সা. যখন প্রথম বিবাহ করেন তখন তার বয়স ছিল ২৫। আর তার স্ত্রী বিবি খাদিজা রা. এর বয়স ছিল ৪০। অর্থাৎ স্বামীর থেকে স্ত্রী ১৫ বছরের বড়। শুধু তাই নয়। নবীজিকে বিয়ের পূর্বে বিবি খাদিজা (রা.)-এর দুইবার বিয়ে হয়েছিল এবং দুইবারই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, তার পূর্বেকার ঘরে দুইজন সন্তানও ছিল। আমাদের দেশে কোনো মেয়ে যদি দুইবার বিধবা হয়, তাইলে তো তার খবরই আছে। বিশেষ করে মহিলারাই বলে বেড়াবে- “মেয়েটা সুবিধার না, অপয়া। তার কোনো স্বামীই টিকে না।” নবীজিকে বিয়ে করার ইচ্ছে পোষণ করে যখন বিবি খাদিজা (রা.) প্রস্তাব পাঠালেন, তখন কিন্তু নবীজির পরিবার এই ধরনের কোনো খারাপ মন্তব্য করেন নাই। বিবি খাদিজা (রাঃ)-কে ‘অপয়া’ বলে তার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করেন নাই। বরং সেই সমাজে বিবি খাজিদা (রাঃ) সুনাম ছিল। তাকে ‘তাহিরা’ (পবিত্রা) বলা হতো।

এই উদাহরণ দিলে অনেকেই বলতে পারে- “আরে! নবীজি (সাঃ) এর ব্যপার। তিনি তো নবী। তার সাথে কি আমাদের সাধারণ মুসলমানের তুলনা হয়! এইসকল বিয়ে করার নিশ্চয়ই কোনো কারন ছিল। তিনি তো ১১-১২টা বিয়ে করেছেন, তাই বলে কি আমাদের জন্য এতোগুলো বিয়ে করা জায়েজ?” খুবই ভালো যুক্তি। মেনে নিলাম। কিন্তু যদি আমি সাহাবীদের থেকে একই উদাহরণ দেই, তাহলে?

হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর পিতা (আব্দুলাহ্) যখন নবীজির মাতা (আমিনা)-কে বিয়ে করেন তখন পিতা আব্দুল্লাহ্ মাতা আমিনা-কে তার খেদমতের জন্য মক্কার বাজার থেকে একজন হাবশী ক্রীতদাসী কিনে গিফ্ট (হাদীয়া স্বরূপ প্রদান) করেছিলেন। তখনকার দিনে এমন প্রচলন ছিল। সেই দাসীর নাম ছিল- বারাকাহ্ বিনতে ছালাবা (রা)। তখন ‘বারাকাহ্’ ছিলেন কিশোরী বালিকা। নবীজি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন শিশু মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে সর্বপ্রথম এই ক্রীতদাসীই কোলে তুলে নিয়েছিলেন। নবীজির যখন বয়স ৬ বছর, তখন তার মাতা তার পিতার কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মদীনায় যাত্রা করেন। যাত্রাকালে তাদের সাথে এই ক্রীতদাসীও ছিলেন। ফেরার পথে আমিনা মারা যান। এই ক্রীতদাসীকেই আমিনা মৃত্যুকালে বলে গিয়েছিলেন- ‘এখন থেকে তুমি ওর মা।’ এই ক্রীতদাসীই ছিলেন নবীজির মাতাস্বরূপ। একবার মদীনায় একব্যক্তি তাচ্ছিল্যভরে এই ক্রীতদাসীর নাম উচ্চারণ করেছিল। ঘটনাটি ঘটেছিল মদীনার কাজী আবু বাকার ইবনে হাজমের সম্মুখে। ইবনে হাজম এই তাচ্ছিল্যের সাথে নাম নেয়ার অপরাধে সেই ব্যক্তিকে ৭০টি চাবুক মারার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ সামান্য ঘটনায় এমন শাস্তি কেন দেয়া হলো, এই মর্মে যখন কাজীকে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি জবাব দিলেন- ‘রাসূল (সাঃ) যাকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করেছেন, তাকে তুমি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে নাম ধরে ডেকেছ। তোমাকে ক্ষমা করলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন না’। এতে স্পষ্ট বোঝা যায়, তার কী সম্মান ছিল!

জীবনব্যাপী ধাত্রী হিসেবে নবীজির সেবা-যত্ন-পরিচর্যায় নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাই তিনি সুদীর্ঘকাল বিয়ে করতে পারেননি। নবীজির সাথে যখন খাদিজার বিয়ে হয়, তখনও খাদিজার বাড়িতে নবীজির সাথে এই ক্রীতদাসীও উঠে এসেছিলেন। তখন নবীজি তাকে বিয়ে করার কথা বলেন। তখন বারাকাহ্ বিনতে ছালাবা (রা)-এর বয়স ছিল ৫০ এর উর্ধ্বে। বিয়ে হয়- মদীনার অধিবাসী খাজরাজ গোত্রের বানু হারীছ শাখার উবাইদ ইবনে যায়দ’র সাথে। বিবাহের পূর্বে দাসত্ব থেকে নবীজি (সাঃ) তাকে মুক্ত করে দেন। বিয়ের পর বারাকাহ্ স্বামীর সাথে মদীনায় চলে যান। তারপর তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়। তার নাম রাখা হয়- আইমান। তাই বারাকাহ-কে ‘উম্মু আইমান’ (আইমানের মা) বলেও ডাকা হতো। তার এই স্বামী বেশীদিন বেঁচে ছিলেন না। স্বামীর ইন্তেকালের পর বারাকাহ্ পুনরায় নবীজি এবং খাদিজার গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। মদীনায় হিজরতের পূর্বে বারাকাহ্ (রাঃ) আবিসিনিয়ায় হিজরত করেছিলেন। মদীনায় হিজরতের সময় নবীজি (সাঃ) বারাকাহ্-কে তার ঘর সংসার দেখার দায়িত্বে রেখে যান। কিন্তু নবীজির সান্নিধ্য ব্যতীত তিনি থাকতে অনাগ্রহী ছিলেন। তাই সব রেখে একাকী কোনো বাহন ব্যতীত পদব্রজে মদীনায় গমন করেন।

বারাকাহ্ ছিলেন ক্ষীন-স্বাস্থ্যবর্তী, কৃষ্ণকায়। এবং মোটেও সুদর্শনা ছিলেন না। হিজরতের পর কোনো একদিন নবীজি (সাঃ) সাহাবীদেরকে বললেন, “যদি কেউ একজন জান্নাতী নারী বিয়ে করতে চায়, সে ‘উম্মে আইমান’-কে বিয়ে করতে পারে।” (এতে বোঝা যায়, জীবিত অবস্থাতেই বারাকাহ্ (রাঃ) জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছিলেন)। এই ঘোষনা দেবার পর যায়েদ ইবনে হারিছা (রাঃ) এগিয়ে এসে বললেন- “হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমি উম্মে আইমানকে বিয়ে করতে চাই। সে সৌন্দর্য ও সুষমা মন্ডিত নারী থেকে উত্তম।” রাসূলের তত্ত্বাবধানে তাদের বিয়ে হয়। বারাকাহ্ ছিলেন যায়েদ ইবনে হারেছা’র ৫ম স্ত্রী। তার প্রথম চারটি বিয়ের কোনোটিই বেশীকাল স্থায়ী হয়নি।

এতো লম্বা ইতিহাস বলার কারন হলো, এই বারাকাহ্ বিনতে ছালাবা (রাঃ) বা উম্মে আইমান (রাঃ) এর সাথে যায়েদ ইবনে হারীছা (রাঃ)-এর বয়সের পার্থক্য কতো ছিল? আসুন হিসেব করে দেখি।

ধরা যাক, নবীজি যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার মাতার দাসী এই বারাকাহ্ (রা) এর বয়স ছিল কমপক্ষে ১০। নবীজি (সাঃ) যখন হিজরত করেন, তখন নবীজির বয়স ছিল ৫২ কি ৫৩। সে হিসেবে মদীনায় হিজরতের সময় বারাকাহ্’র বয়স ছিল ৬২-৬৩বছর। অপরদিকে ৮ম হিজরীতে মুতার যুদ্ধে যায়েদ ৫৫বছর বয়সে বুকে তীরবিদ্ধ হয়ে শাহাদাত বরন করেন। তখন নবীজির বয়স ছিল- ৬১ বছর। এখান থেকে জানা যায় যে, নবীজি থেকে যায়েদ ৬ বছরের ছোট ছিলেন। আবার কারো মতে, যায়েদ নবীজির থেকে ২০বছরের ছোট ছিলেন (এ ধারনাটা আমার বিশ্বাস হয়না)। আমরা যদি প্রথম মতটিকেই সঠিক ধরে নেই, তাহলে দেখতে পাই- যায়েদ নবীজি থেকে ৬বছরের ছোট। আর অপরদিকে বারাকাহ্ নবীজি থেকে ১০বছরের বড়। অর্থাৎ বারাকাহ্ থেকে তার স্বামী যায়েদ ছিল (কমপক্ষে) ১৬বছরের ছোট। বিয়ের সময় বারাকাহ্’র বয়সও মোটামুটি হিসেব করলে বলা যায় যে, ৬০ এর বেশী ছিল। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ইসলামে বয়ষ্ক মেয়েদের বিয়েতে কোনো সমস্যা নাই। পুরুষের যে নেই, তা তো জানাই আছে। আমরা এই বুড়ো বয়সে বিয়ে করতে দেখলে তো কটাক্ষ করে বলি- ‘বুইড়া বয়সে ভীমরতি’। মনে রাখা দরকার যে, অনেকে বয়ষ্ক বয়সে স্ত্রী/স্বামী-সন্তান-আত্মীয়হীন হয়ে আজকাল ‘ওল্ডহোম’ গিয়ে থাকে। তখন তো ঠিকই মুখে ‘চুক চুক’ ধ্বনী তুলে আফসোস করি।

অতএব, নবীজির নিজের এবং তার খুব কাছের দুজন সাহাবীর আ’মাল থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে স্বামীর থেকে স্ত্রীর বয়সের বড় হওয়াটা কোনো সমস্যাই নয়। বিধবা বিবাহ, বাল্য বিবাহ, বয়ষ্ক বিবাহ কোনোটাতেই ইসলামের কোনো সমস্যা নাই। এরপরও যদি কোনো ব্যক্তি এ বিষয় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে, তাহলে বোঝা যাবে নবী এবং সাহাবীর কাজের উপর তাদের নিজেদের প্রবৃত্তিকে স্থান দিচ্ছে।।

টিকাঃ
আমাদের দেশের মানুষের ভেতরে একপ্রকার কুসংস্কার রয়ে গেছে যে, এমনিতেই কোনো কারন ছাড়া বয়সে বড় মেয়ের সাথে ছোট ছেলের মধ্যে বিয়ে দৃষ্টিকটু। তাছাড়া আমাদের দেশে দেখা যায়, বংশমর্যাদা রক্ষা করার জন্য কিংবা ছোট-ছোট সন্তানের মাতৃত্ব বা লালন-পালনের দিকে তাকিয়ে বড় ছেলে মারা গেলে ছোট ছেলেকে দিয়ে বড় ছেলের বৌকে বিয়ে করিয়ে রাখা হয়। এক্ষেত্রেও ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো সমস্যা নাই। নবীজি এবং সাহাবীগণ যা আ’মাল করে গেছেন এবং অন্যদের জন্য নিষিদ্ধ করেন নাই, অথচ সেই আমলে এই ঘটনার চল ছিল, তাহলে সেই ঘটনা ‘দৃষ্টিকটু’ (মাকরূহ্) অথবা ‘নিষিদ্ধ’ (হারাম) বলার অধিকার কার আছে?

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *