প্রশ্ন:ধুমপান ও জর্দা খাওয়ার বিধান কি একই?

উত্তর:

১.ধুমপান করা নাজায়েয তথা মাকরূহে তাহরীমী। এতে আর্থিক অপচয়ের পাশাপাশি নিশ্চিত স্বাস্থ্যগত ক্ষতিও রয়েছে। জেনে শুনে নিজের জান-মালের ক্ষতি করা গুনাহ। অধিকন্তু ধুমপায়ীর মুখের দুর্গন্ধে অন্যের কষ্ট হয়, যা পৃথক একটি গুনাহ। তাই ধুমপান থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

আর দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় নামাযে দাঁড়ানো মাকরূহে তাহরীমী। বরং এ অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করাও মাকরূহ। হাদীস শরীফে ধুমপানের চেয়ে অনেক কম দুর্গন্ধ বস্তু কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেও নিষেধ করা হয়েছে।

অতএব বিড়ি-সিগারেটের তীব্র দুর্গন্ধের সাথে মসজিদে প্রবেশ করা যে নিষিদ্ধ হবে তা তো সহজেই অনুমেয়। অবশ্য এ কারণে নামায ত্যাগ করা যাবে না এবং মসজিদে গমনাগমনও বন্ধ করা যাবে না। বরং অতি দ্রুত এ বদ অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর নামায আদায়ের পূর্বে এবং মসজিদে প্রবেশের আগে ভালো করে মেসওয়াক বা ব্রাশ করে দুর্গন্ধ দূর করে নিতে হবে।

আরো প্রকাশ থাকে যে, ধুমপানের দুর্গন্ধ নিয়েও যদি কেউ নামায পড়ে নেয় তাহলে তার নামায আদায় হয়ে যাবে।

২.আর পানের সাথে স্বল্প পরিমাণে জর্দা খাওয়া জায়েজ।কারণ,বিশেষ পরিশোধনের কারণে এতে নেশা থাকে না।তবে ডাক্তারি মতে,এটি দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ক্ষতির কারণ। তাই যথাসম্ভব এ থেকেও বিরত থাকা উচিত। আর কারো ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে ক্ষতিকর প্রমাণিত হলে তার জন্য তা খাওয়া নাজায়েয হবে।তবে ঢালাওভাবে জর্দা খাওয়াকে নাজায়েজ কিংবা হারাম বলার অবকাশ নেই।

উল্লেখ্য যে, যারা পান-জর্দা খায় তাদের জন্যও নামায আদায়ের পূর্বে ভালোভাবে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া কর্তব্য। যেন পানের কণাগুলো বের হয়ে যায় এবং গন্ধও না থাকে।

আরো উল্লেখ থাকে যে, মিসওয়াক ইসলামের দায়েমী একটি সুন্নত। এ সুন্নতটির প্রতি যত্নবান হয়ে দাঁত এবং মুখ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা প্রতিটি মুমিনের কর্তব্য।

কিছু অসাড় যুক্তির জবাব:

জর্দা নিষিদ্ধ খমর তথা মদের সংজ্ঞায় পড়ে না। সেই সাথে মাদক হিসেবেও স্বীকৃত নয়।

যারা জর্দা খাওয়াকে হারাম বলতে চান, তারা সরাসরি কুরআন ও হাদীস থেকে সরাসরি কোন দলীল না দিতে পারলেও কতিপয় অসাড় যুক্তি পেশ করে থাকেন। আমরা সেসব যুক্তিগুলো খণ্ডনসহ একটু জেনে নিলে ফায়দা হবে ইনশাআল্লাহ।

যুক্তি নং-১

জর্দা খেলে মানুষ মাতাল হয়ে যায়, আর যা খেলে মাতাল হয়, তা হারাম।

উত্তর

জর্দা খেলে মানুষ মাতাল হবেই একথাটি সঠিক নয়। এতটুকু বলা যেতে পারে যে, অতিরিক্ত খেলে মাথা ঘুরাবে,বমি আসবে,মাতাল ভাবও আসতে পারে।

যদি বেশি খাওয়ায় মাথা ঘুড়ানো, বমি আসা বা মাতাল হওয়াকে নিষিদ্ধ ও হারাম হবার মানদণ্ড ধরা হয়, তাহলে বলতে হবে মধু খাওয়া হারাম। কারণ, খাটি মধু আপনি একসাথে এক দেড় কেজি খেয়ে দেখেন মাথা ঘুরবেই,বমি আসবেই,মাতাল হয়ে যাবেন।

এর মানে কি মধু খাওয়া হারাম?

আট দশ কেজি আঙ্গুর একসাথে পিষে রস বের করে একসাথে খেলে মাথা ঘুরায়, বমি আসে, মাতাল মাতাল লাগবে। এর মানে কি আঙ্গুর খাওয়া হারাম?

যে উদ্ভট যুক্তিতে জর্দাকে হারাম বলা হচ্ছে, সেই একই যুক্তিতে মধু ও আঙ্গুর খাওয়াও হারাম হয়ে যাবে।

তাহলে কি বুঝা গেল? এটি যুক্তি নয় বরং কুযুক্তি। কোন হালাল জিনিসকে হারাম করার অধিকার কারো নেই।

لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ ۖ [٦٦:١]

আল্লাহ আপনার জন্যে যা হালাল করছেন, আপনি তা নিজের জন্যে হারাম করেছেন কেন? [সূরা তাহরীম-১]

যুক্তি নং ২

জর্দা বানানো হয় তামাক পাতার মাধ্যমে। আর তামাক পাতা নেশাদ্রব্য।

তামাক পাতা নেশাদ্রব্য হবার কারণে এটির মাধ্যমে বানানো জর্দা খাওয়া হারাম। যেমন নেশা গ্রহণ করা হারাম।

উত্তর

এক নাম্বার কথাতো হল যে, তামাক পাতা তেমন কোন নেশাদ্রব্য নয় যে, যা মাদকের হুকুমে ফেলা যায়।

দ্বিতীয়ত তামাককে খানিক পরিশোধন করে জর্দা বানানো হয়ে থাকে। ফলে জর্দায় তেমন কোন নেশাই থাকে না।

শুধুমাত্র নেশার প্রাথমিক উপকরণ হওয়াই যদি কোন কিছু নিষিদ্ধ হবার মানদণ্ড হয়, তাহলে আমাদের প্রশ্ন হল, আরবে খমর বা মদ বলতে বুঝানো হতো, যা খেজুর, আঙ্গুর, কিশমিশ দিয়ে বানানো হতো।

এখন প্রশ্ন হল, যেহেতু খেজুর, আঙ্গুর ও কিশমিশ মদের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তাই কি এসব খাওয়া নাজায়েজ?

অবশ্যই নয়। কারণ, কোন কিছু মাদকের উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হলেই যতক্ষণ না তা মাদকে পরিণত হয়, ততক্ষণ সেটিকে হারাম বলার কোন সুযোগ নেই।

একইভাবে জর্দার মূল উপকরণ তামাক হলেও যতক্ষণ না তা মাদক হিসেবে সাব্যস্ত হয়, তথা এর মাধ্যমে মানুষ মাতাল হয়ে যাওয়া নিশ্চিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত সেটিকে মদের হুকুমে আরোপ করা অযৌক্তিক অসাড় মস্তিস্কের মন্তব্য ছাড়া কিছুই বলার সুযোগ নেই।

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাঃ ব্যাপকভাবে শির্কা এবং নাবীজ পান করতেন। যা বেশি পরিমাণ খেলে বা বেশিদিন ভিজিয়ে রাখলে তা মাদকে পরিণত হতো।

সুতরাং বুঝা গেল যে, যা মূলত মাদক হিসেবে স্বীকৃত নয়, তা নেশা পরিমাণ পান না করলে তা নিষিদ্ধ নয়।

عَنِ ابْنِ بُرَيْدَةَ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَزُورُوهَا، وَنَهَيْتُكُمْ عَنْ لُحُومِ الْأَضَاحِيِّ فَوْقَ ثَلَاثٍ، فَأَمْسِكُوا مَا بَدَا لَكُمْ، وَنَهَيْتُكُمْ عَنِ النَّبِيذِ إِلَّا فِي سِقَاءٍ، فَاشْرَبُوا فِي الْأَسْقِيَةِ كُلِّهَا، وَلَا تَشْرَبُوا مُسْكِرًا»

বুরায়দা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমি কবর যিয়ারত করা হতে তোমাদেরকে নিষেধ করতাম এখন তোমরা যিয়ারত কর। তিন দিনের অধিক কুরবানীর গোশত খেতে নিষেধ করতাম, এখন যত দিন সম্ভব সংরক্ষণ করে খেতে থাক এবং নাবীয (খেজুর ভিজানো পানি) পান করা হতে নিষেধ করতাম। (মশক ব্যতীত অন্যান্য পাত্রে) এখন সকল পাত্রে পান কর। কিন্তু নেশা হয় এমন অবস্থায় নয়। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-৯৭৭]

عَنْ بَكْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ الْمُزَنِيِّ، قَالَ: كُنْتُ جَالِسًا مَعَ ابْنِ عَبَّاسٍ عِنْدَ الْكَعْبَةِ، فَأَتَاهُ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ: مَا لِي أَرَى بَنِي عَمِّكُمْ يَسْقُونَ الْعَسَلَ وَاللَّبَنَ وَأَنْتُمْ تَسْقُونَ النَّبِيذَ؟ أَمِنْ حَاجَةٍ بِكُمْ أَمْ مِنْ بُخْلٍ؟ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: الْحَمْدُ لِلَّهِ، مَا بِنَا مِنْ حَاجَةٍ وَلَا بُخْلٍ، قَدِمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى رَاحِلَتِهِ وَخَلْفَهُ أُسَامَةُ، فَاسْتَسْقَى فَأَتَيْنَاهُ بِإِنَاءٍ مِنْ نَبِيذٍ فَشَرِبَ، وَسَقَى فَضْلَهُ أُسَامَةَ، وَقَالَ: «أَحْسَنْتُمْ وَأَجْمَلْتُمْ، كَذَا فَاصْنَعُوا» فَلَا نُرِيدُ تَغْيِيرَ مَا أَمَرَ بِهِ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ

বকর ইবনু আবদুল্লাহ মুযানী (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ) এর সাথে কাবার সন্নিকটে বসা ছিলাম। এ সময় এক বেদুঈন তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, কি ব্যাপার? আমি দেখছি আপনার চাচাতো ভাইয়েরা (আগন্তুকদের) মধু ও দুধ পান করায়। আর আপনারা নাবীয (খেজুরের তৈরি শরবত) পান করান? তা কি আপনাদের দরিদ্রতার কারণে, না কৃপণতার কারণে? ইবনু আব্বাস (রাঃ) আলহামদুলিল্লাহ উচ্চারণ করে বললেন, আমাদের না দারিদ্র আক্রান্ত করেছে, না কৃপণতা। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সওয়ারীতে চড়ে এখানে এলেন এবং তাঁকে এক পেয়ালা নাবীয দিলাম। তিনি তা পান করলেন এবং অবশিষ্টটুকু উসামাকে পান করালেন। এরপর বললেনঃ “তোমরা খুবই উত্তম কাজ করেছ এবং এরূপই করতে থাক।” অতএব রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের যা করার নির্দেশ দিয়েছেন- আমরা তার পরিবর্তন করতে চাই না। [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং-১৩১৬]

যুক্তি নং-৩

জর্দা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর মাধ্যমে ব্যক্তি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ক্যান্সারসহ নানাবিধ রোগ হবার সম্ভাবনার কথা ডাক্তাররা বলে থাকেন। আর যে জিনিস শরীরের জন্য ক্ষতিকর তা ভক্ষণ করে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হারাম। সেই হিসেবে জর্দা খাওয়া হারাম।

উত্তর

হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, বেশিদিন এবং বেশি পরিমাণ এ দ্রব্য গ্রহণে শরীর অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তবে এটি নিশ্চিত নয়। কারণ, এমন অনেক মানুষ আছেন, যারা পঞ্চাশ ষাট বছর ধরে জর্দা খাচ্ছেন, কিন্তু জর্দা খাওয়ার কারণে তাদের মাঝে শারীরিক কোন সমস্যা হয়নি।

শুধুমাত্র সম্ভাবনার কারণে, কোন হালাল জিনিস হারাম বলাটাও একটি অযৌক্তিক কথা।

বর্তমানের অনেক ডাক্তারগণ বলে থাকেন যে, ভাত, রুটি, মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য বেশি পরিমাণ খাওয়ার দ্বারা ডায়বেটিস, কিডনী সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে।

এখন কি বলা হবে যে, ভাত খাওয়া হারাম? মিষ্টি খাওয়া হারাম?

অবশ্যই নয়। বরং যার জন্য ক্ষতিকর হিসেবে নিশ্চিত হবে, কেবল তাকেই বলা হবে যে, তার জন্য তা গ্রহণ করা নিষেধ।

কিন্তু আমভাবে এ হুকুম আরোপ করে দেয়া অযৌক্তিক দাবী ছাড়া আর কী?

যুক্তি নং-৪

জর্দা একটি নেশা। কারণ, যারা পানের সাথে জর্দা খায়। তারা এটি না খেলে টিকতে পারে না। এর জন্য পাগল হয়ে যায়।

যেহেতু এটা নেশার মত হয়ে গেছে। তাই তা খাওয়া হারাম।

উত্তর

এটি একটি হাস্যকর যুক্তি। কোন হালাল জিনিস খেতে উদগ্রীব হওয়াকে নেশা বলাটা বোকামী ছাড়া আর কী? অনেকে আছেন চা না খেলে টিকতে পারে না। চা খাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যায়।

এজন্য কী বলা হবে যে, চা খাওয়া একটি নেশা। তাই তা হারাম?

অবশ্যই নয়। কারণ, কোন হালাল বস্তু খাওয়া কারো অভ্যাসে পরিণত হলে সেটি হারাম বলার কোন যৌক্তিকতা নেই।

যেমন কারো দুধ খাওয়া অভ্যাস, কারো আঙ্গুর খাওয়ার অভ্যাস, কারো রুটি খাবার অভ্যাস, কারো বা ভাত খাবার অভ্যাস। কোন হালাল বস্তুর অভ্যাস হয়ে যাওয়াকে নেশা বলা নেশার সাথে তামাশা বৈ আর কী?

فَكُلُوا مِمَّا غَنِمْتُمْ حَلَالًا طَيِّبًا ۚ وَاتَّقُوا اللَّهَ ۚ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ [٨:٦٩]

সুতরাং তোমরা খাও গনীমত হিসাবে তোমরা যে পরিচ্ছন্ন ও হালাল বস্তু অর্জন করেছ তা থেকে। আর আল্লাহকে ভয় করতে থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, মেহেরবান। [সূরা আনফাল-৬৯]

كُلُوا وَاشْرَبُوا مِن رِّزْقِ اللَّهِ وَلَا تَعْثَوْا فِي الْأَرْضِ مُفْسِدِينَ [٢:٦٠]

আল্লাহর দেয়া রিযিক খাও, পান কর আর দুনিয়ার বুকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে বেড়িও না। [সূরা বাকারা-৬০]

সুতরাং বুঝা গেল যে, জর্দা যেহেতু মদ নয়, সেই সাথে সমাজে মাদক হিসেবে স্বীকৃত নয়, এবং এটি খাওয়ার দ্বারা কোন প্রকার নেশাও হয় না।

তাই একটি হালাল জিনিসকে হারাম বলা আল্লাহর হালাল করা বস্তুকে হারাম করার নামান্তর। যা সুষ্পষ্টভাবে হারাম।

সুতরাং হালাল বিষয়কে হারাম বলার গোনাহ থেকে বাঁচতে হলে জর্দাকে হারাম বলার পাপ থেকে মুক্ত থাকা জরুরী।

[উত্তর প্রদানে-মুফতী হোসাইন আহমদ,নাযেমে তালীমাত-অত্র প্রতিষ্ঠান]

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *