আল্লাহ কি আসলেই দয়ালু এবং ক্ষমাশীল (

আল্লাহর ক্ষমাশীলতা ও ন্যায়বিচার
====================
.
#নাস্তিক_প্রশ্নঃ আল্লাহ কি আসলেই দয়ালু এবং ক্ষমাশীল (Quran 1:3) যিনি কিনা একটা উট হত্যার জন্যে পুরো গোষ্ঠীর লোকেদের মেরে ফেলতে পারেন(Quran 7:73-78, 54:26-31)
.
উত্তরঃ আল্লাহ অবশ্যই দয়ালু এবং ক্ষমাশীল, তার অন্যতম সিফাতী নাম আর রহমান ও আর-রহীম। তবে তিনি আল-আদিল(পরম ন্যায়বিচারক) এবং আল-কাহহার(প্রবল পরাক্রমশালী) ও বটে। যা আল্লাহ কুরআনের পরতে পরতে দৃশ্যমান।
.
আসুন তাদের অভিযোগকৃত সালিহ(আ) ও তার ছামূদ জাতির ঘটনা সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাকঃ
.
; ছামূদ জাতি আদ জাতির বংশধর। তাদের মধ্যে কালপরিক্রমায় মূর্তিপূজা শুরু হয়। এমতাবস্থায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সালিহকে(আ) নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়ে নবী হিসেবে প্রেরন করলেন। তিনি যৌবনকাল থেকে শুরু করে বার্ধক্য পর্যন্ত তার জাতিকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যান, তবে তেমন কেউ সাড়া দেয়নি। সালিহ(আ) যখন বার্ধক্যে উপনীত হন তখন তার জাতি সালিহের(আ) দাওয়াতে ত্যক্ত ও বিরক্ত হয়ে এবং সালিহের(আ) নবুওয়াতের সত্যতা পরীক্ষা করার বললো “তুমি যদি সত্যবাদী হয়ে থাক তবে আমাদেরকে পাহাড় থেকে একটি প্রাপ্তবয়স্ক ঊটনী বের করে দাও” তখন সালিহ(আ) এই বললেন যে “যদি আমি তোমাদের এই দাবি পূরন করি তাহলে কি তোমরা ঈমান আনবে?” তারা সবাই এই শর্তে অঙ্গীকারাবদ্ধ হলো। আল্লাহর কাছে সালিহ(আ) দুয়া করলে আল্লাহ তার দুয়া কবুল করে নিলেন, ফলে পাহাড়ের পাথর ফেটে একটি প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ উটনী বের হলো। এই আশ্চর্যজনক ঘটনা দেখে তখনই কেউ কেউ ঈমান আনলো আর কেউ কেউ ঈমান আনার ইচ্ছাপোষন করলে ঠাকুর-পুরোহিত গোছের কিছু লোক বাধা দিলো। সালিহ(আ) তার জাতির এহেন অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে দেখে ভয় পেলেন যে এই জাতির উপর না আযাব চলে আসে। তাই নবীসুলভ দয়ার্দ্রতায় তিনি বললেন, “তোমরা এই উটনীর দেখাশোনা করো, এর কোনো ক্ষতি করোনা, তাহলে তোমরা হয়তো এই আযাব থেকে বেচে যাবে”। জাতির অন্যান্য ঊটনী থেকে এই ঊটনী ভিন্ন ছিলো। এই ঊটনী এক কুপের পানি একাই পান করে ফেলত, তাই আল্লাহর নির্দেশে সালিহ(আ) সিদ্ধান্ত দিলেন যে, তোমাদের ঊটরা একদিন ও আর এই ঊটনী আরেকদিন পালাক্রমে পানি পান করবে। কিন্তু অবাধ্য জাতি আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে সর্বসম্মতিক্রমে উটনীটিকে হত্যা করে ফেললো। সালিহ(আ) বললেন তোমাদের আর মাত্র ৩দিন সময় বাকি আছে এর মধ্যেই আযাব চলে আসবে, সেই অবাধ্য জাতির লোকেরা তখনও নিজেদের দাম্ভিকতা ও একগুয়েমি প্রদর্শন করে চললো, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার বদলে তারা সালিহকে(আ) নিয়ে মজা করতে লাগলো এবং তাকে হত্যা করার চেষ্টা চালায়। তবে আল্লাহ তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করে দেন, তাদেরকে ভূমিকম্প ও বিকট এবং প্রবল আওয়াজ ঘিরে ফেলে, আল্লাহর আযাবে পুরো ছামূদ জাতি সমূলে ধবংস হয়ে যায়। আল্লাহ কুরআনে বিভিন্ন স্থানে তাদের বর্ণনা দিয়েছেন;
.
{(সূরা আরাফ ৭ঃ৭৩-৭৯), (সূরা হুদ ১১ঃ৬১-৬৮), (সূরা নামল ২৭ঃ৪৫-৫২), (সূরা ক্বমার ৫৪ঃ২৩-৩১)}
.
[বিস্তারিতঃ (কুরআনুল কারীম বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর, ২/৭৭৭-৭৮৩), (তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ১/৪৩৬), (তাফসীরে ইবন কাছীর, ৮ম;৯ম;১০ম/৩৩১-৩৩৯), (তাফসীরে জালালাইন, ২/৪১৩-৪২০)]
.
ছামূদ জাতির আপরাধগুলো দেখা যাকঃ
.
(ক) তারা আল্লাহর সাথে শিরকে জড়িয়ে পড়েছিলো, তবে আল্লাহ নবী না প্রেরন করার পূর্বে কোনো জাতিকে আযাব দেন না তাই আল্লাহ সালিহকে(আ) নবী হিসেবে তাদের মধ্যে প্রেরন করলেন, যাকে আল্লাহ ছামূদ জাতির ভাই বলে সম্বোধন করেছেন (সূরা আরাফ ৭ঃ৭৩);
.
(খ) তারা নবী সালিহের(আ) তাওহীদের দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে ঔদ্ধত্যপূর্ন আচরণ করতে লাগলো, সালিহ(আ) তার যৌবনের শুরু থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত তাদেরকে তাওহীদ ও ঈমানের দাওয়াত দিয়ে গেলেও ছামূদ জাতি দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে অস্বীকার করতে থাকে;
.
(গ) তারা নিজে থেকেই সালিহের(আ) কাছে মুযিজা দেখানোর জন্য বললো, সালিহ(আ) নবীসুলভ দয়ার্দ্রতার কারনে ভাবলেন যে হয়ত মুযিজা প্রকাশ ঘটলে তারা ঈমান আনতে পারে। তাই সালিহ(আ) মুযিজা প্রকাশের আগে তাদের নিকট থেকে ঈমান আনার অঙ্গীকার নিলেন, তারা সর্বসম্মতিক্রমে সেই শর্তে রাজী হয়েছিলো;
.
(ঘ) যখন সালিহের(আ) দুয়া করার পরে আল্লাহর ইচ্ছায় ও অনুমতিক্রমে পাহাড়ের বুক ফেটে প্রাপ্তবয়স্ক একটি উটনী বের হলো তা তাদের জন্য আশ্চর্যজনক ছিলো এবং তারা সালিহের(আ) নবী হওয়ার সত্যতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলো, এই ঘটনাই কি যথেষ্ট ছিলো না যে তাদের সকলের জন্য আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করার জন্য, যেই দাওয়াত তাদের জাতিরই একজন যাকে আল্লাহ তাদেরই ভাই বলে সম্বোধন করেছেন, যিনি জীবনের শুরু থেকে শেষ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ক্রমাগত এই ঈমানের দাওয়াত দিচ্ছিলো, আর তারা মুযিজা প্রকাশের পূর্বেই ঈমান আনয়নের শর্তে আবদ্ধ ছিলো, তবুও তারা তাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম, নিজেদের হটকারীতা ও দাম্ভিকতায় অটল থাকলো, এত বড় ঘটনা তাদেরকে সামান্য কিছুক্ষন বিস্ময়ে হতবাক করে দিলেও তারা ঈমান আনলো না;
.
(ঙ) এই ঘটনা দেখে কিছু সত্যানুসন্ধানী সাথে সাথে মানুষ ঈমান আনলো এবং আরো কিছু সংখ্যক ও ঈমান আনার ইচ্ছাপোষন করলো, সেখানে পুরোহিত গোছের কিছু লোক তাদেরকে বাধা প্রদান করলো, একে নিজেরা আল্লাহর সাথে শিরকে লিপ্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করলো, নিজেরা ও আল্লাহকে অস্বীকার করলো সাথে অন্যদেরকে ও বাধা দিলো ঈমান আনতে!!!;
.
(ঙ) সালিহ(আ) এতকিছুর পরেও আল্লাহর আযাব চলে না আসে এই ভয়ে তিনি নবীসুলভ দয়া দেখিয়ে বললো তার জাতিকে উটনীটিকে যথাযথ লালন-পালন করতে এবং ঊটনীটির কোনো প্রকার ক্ষতি করতে নিষেধ করলেন;
.
(চ) তারা তুচ্ছ পানির বন্টন নিয়ে ঊটনীটিকে হত্যা করে ফেললো আর আল্লাহর অবাধ্যতা করলো, যেখানে পানির সমবন্টন আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন!!! এখানে ব্যাপারটি শূধুমাত্র ঊট হত্যা করা নয় বরং এখানে আল্লাহর অবাধ্যতা করাই মূল বিষয়, যেখানে আল্লাহ তাদেরকে এতসুযোগ দেওয়ার পরেও তারা ক্রমাগত আল্লাহর অবাধ্যতা করেই যাচ্ছিলো;
.
(ছ) যদি এমন হত কিছু লোক ঊটনী হত্যার সাথে জড়িত ছিলো বাকিরা সবাই নির্দোষ তবুও বলা যেত, কিন্তু না তারা সবাই এই জঘন্য কাজের সাথে জড়িত ছিলো, কাতাদাহ(রাহ) বলেন, “ যে ব্যক্তি ওকে হত্যা করেছিলো তার কাছে সবাই গিয়েছিল এমনকি স্ত্রীলোকেরাও এবং বালকেরাও। তাদের সবারই উদ্দেশ্য ছিলো তার দ্বারা ওকে হত্যা করিয়ে নেওয়া” অর্থাৎ ঊটনীকে হত্যা করার জন্যে ছোট বড় সবাই হত্যাকারীকে সমর্থন দিয়েছিলো, তাদেরই পরামর্শে হত্যাকারী কিদার ইবন সালিফ প্রস্তুত হয়ে যায় ঊটনীকে হত্যা করার জন্য। জাতির লোকেরা বাধা প্রদানের বদলে হত্যাকারীকে পূর্ণ সমর্থন যোগাল!!!;
.
{তাফসীরে ইবনে কাছীর, (৮ম,৯ম,১০ম/৩৩৬-৩৭), (১৮/১৮১)}
.
তাদের এত এত অপরাধের পরেই আল্লাহ তাদের বিকট আওয়াজ ও ভূমিকম্পের শাস্তি দিয়ে ধবংস করে দেন। আল্লাহ কখনই কোনো জাতি বা মানুষের সাথে তিল পরিমান জুলুম ও করেন না (সূরা নিসা ৪ঃ৪০), তিনি আর-রহমান , আর-রহীম। তিনিই তো মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, যিনি তার বান্দাকে ভালোবাসেন নিজ মায়ের থেকেও অনেক বেশী। তাই তো তিনি সামান্য পাথরের মূর্তি, গাছ, চন্দ্র-সূর্যের সাথে তাকে শরীক করে ফেলার পরেও নবী প্রেরন করে তাদেরই হেদায়াতের নিমিত্তে, সেই নবীদের মাধ্যমেই মুযিজা প্রকাশ করান মানুষের সন্দেহ দূর করার জন্য ও সত্যতা প্রমানের জন্য, কিন্তু এতকিছুর পরেও অনেক হতভাগারাই ঈমান আনেনা শুধুমাত্র পূর্বপুরুষ, অহমিকা এই তুচ্ছ দুনিয়ার দোহাই দিয়ে। তাই দেখা যায় সালিহের(আ) জাতি ছামূদের সাথে, যারা ক্রমাগত শিরক, মূর্তিপুজা আর আল্লাহর অবাধ্যতায় মেতে ছিলো, সালিহের(আ) রাত-দিনের ক্রমাগত দাওয়াত তাদের অন্তর নাড়া দেয়নি, তারা সালিহের(আ) সত্যতা প্রমানের জন্য মুযিজা প্রকাশের জন্য বললো, সালিহ(আ) তাদের অঙ্গীকারে ভাবলেন যদি এবার আমার জাতির লোকেরা ঈমান আনয়ন করে চিরসৌভাগ্য লাভ করতে পারে, মুযিজা প্রকাশ পাওয়ার পরেও তারা তাদের অবস্থা থেকে চুল পরিমান ও নড়লো না, মুষ্টিমেয় কিছু লোক ঈমান আনলেও যারা ঈমান আনার ইচ্ছা পোষন করলো তাদেরকে কিছু তথাকথিত সম্মানিতজন বাধা প্রদান করলো, এত কিছুর পরেও আল্লাহ তাদেরকে আযাব দিয়ে ধবংস করেননি, তাদের প্রতি নির্দেশ ছিলো তার মুযিজার নিদর্শনস্বরুপ সেই ঊটনীটির কোনোরুপ ক্ষতিসাধন করবেনা, তারা তাতেও বাধ সাধলো না
আল্লাহর অবাধ্যতার চূড়ান্ত সীমায় যেয়ে সেই ঊটনীকে হত্যা করতে উদগত হলো, সাথে হত্যাকারীকে বিন্দুমাত্র ও বাধা না দিয়ে বরং পূর্ণ সমর্থন করলো এবং আল্লাহর অবাধ্যতার সব সীমা পার করে ফেললো। আর তাই সর্বশেষ আল্লাহ আহকামুল হাকিমীন এই জাতিকে সমূলে ধবংস করে দিলেন ভূমিকম্প ও বিকট আওয়াজের মাধ্যমে, যারা দুনিয়ায় তাদের নির্মিত বড় বড় ইমারত নিয়ে খুব গর্ব ও দম্ভ প্রকাশ করত, এক আওয়াজই তাদের বিনাশের জন্য যথেষ্ট হয়ে গেলো। যার প্রমান আজো আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পৃথিবীর বুকে রেখে দিয়েছেন নিদর্শনস্বরুপ।
.
আল্লাহ কখনোই তার বান্দাদের প্রতি জুলুম করেন না, তার প্রতিটি সিদ্ধান্তই পরিপূর্ণ প্রজ্ঞাময় ও ন্যায়সঙ্গত। তবে এই ঘটনার আবেদন বর্তমানেও হারিয়ে যায়নি, এমন লোক বর্তমানে ও পাওয়া যাবে যারা মহান রবের অবাধ্যতায় চুল থেকে নখ পর্যন্ত ডুবে রয়েছে, যাদের অন্তর প্রতিমূহুর্তে সাক্ষী দেয় আল্লাহ সত্য তার রাসুল(صلى الله عليه وسلم) সত্য আর সত্য তার দ্বীনে ইসলাম তবুও যারা নিজেদের দাম্ভিকতা, অহংকার, হটকারীতা ও জেদ ও এই তুচ্ছ দুনিয়ার সুখ-শান্তি-স্বাচ্ছন্দ্যের কারনে সত্যকে মুখে স্বীকার তো করেই না বরং সেই দ্বীনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রকাশ্য এবং স্পষ্ট অপ্রকাশ্য যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে যায়, তাদের এই ঘটনা থেকে অনেক কিছুই শিক্ষার রয়েছে, যে এই জীবন খুব বেশি দীর্ঘ নয় একদিন এই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে, তাদের এই ঘৃন্য কাজগুলো নিদর্শন রুপে দুনিয়ার বুকে থেকে গেলেও তাদের ঠাই হবেনা, যেমন ছামূদ জাতির হাজার বছর পূর্বে তৈরী করা ইমারতের অনেকগুলো আজও আকাশ ছুয়ে গেলেও যারা এই সামান্য ইমারতের বড়াই করত তাদের আজ চিহ্ন পর্যন্তও নেই…………………………………….
=====================
লেখকঃ হোসাইন শাকিল

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *