কিবলা নিয়ে যত বিভ্রান্তি
==================
.
নাস্তিকরা কিবলা নিয়ে প্রশ্ন করার সময় wikiislam থেকে ধার করা একটা ছবি ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা দাবি করে এর অর্থ কুরআনে নাকি পৃথিবীকে সমতল হিসেবে বিবেচনা করেছে। মুসলিমরা এই প্রশ্নের ফাঁদে পড়ে বিভ্রান্ত হয়। নেটেও এ প্রসঙ্গে তেমন কোন লেখা পাওয়া যায় না। আজকে তাদের এই ছবির কেসগুলো পয়েন্ট বাই পয়েন্ট আলোচনা করবো ইনশাল্লাহ্। তবে তার আগে কিবলা নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি মনে করছি।
.
◑ কেন কা’বা’র দিকে মুখ করে সালাত পড়তে হবে?
.
যদি মুসলিমদেরকে কোনো এক বিশেষ দিক ঠিক করে না দেওয়া হয়, তাহলে কোনদিকে মুখ করে জামাতে দাঁড়াবে, তা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাবে। কেউ বলবে স্মৃতি সৌধের দিকে, কেউ বলবে শহীদ মিনারের দিকে।
যেখানে জামাতে দাঁড়ানোর সময় লাইনের আগে না পরে পা দিয়ে দাঁড়াবো, এই নিয়েই অনেক সময় তর্ক শুরু হয়ে যায়, সেখানে যদি কিবলা ঠিক করে না দেওয়া হতো, তাহলে কোনদিকে মুখ করে মসজিদ বানানো হবে, তারপর সেই মসজিদে কোনদিকে মুখ করে জামাত হবে, সেটা নিয়ে দলাদলি, হাতাহাতি লেগে যেত।
অনেক বছর কষ্ট করে তৈরি করা ঐক্য ভেঙ্গে যেতে একদিনের ঝগড়াই যথেষ্ট। একারণেই মুসলিমদেরকে কিছু ব্যাপার, যা তাদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখার জন্য জরুরি, সেগুলো আল্লাহ নিজে নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যেন এগুলো নিয়ে তর্ক করার কোনো সুযোগই না থাকে। [১] আর এজন্যই আমাদের কা’বামুখী হয়ে সালাত আদায় করতে হয়। এটা শুধু আমাদের ইবাদাতের জন্য দিক নির্দেশক, আর কিছু নয়।
.
◑ মুসলিমরা কি কা’বার সামনে মাথা নত করে?
.
মুসলিমরা কা’বার সামনে নয়, বরং কা’বার দিকে মুখ করে সালাতের অংশ হিসেবে আল্লাহর প্রতি মাথা নত করে। কা’বার কাছাকাছি গেলে কা’বা সামনে চলে আসবেই। কা’বার কাছে গিয়ে মানুষ নিশ্চয়ই অন্য কিছুর দিকে মুখ করে সালাত পড়বে না? এখন প্রশ্ন আসে, তাহলে মুসলিমরা হাজ্জ করতে কা’বার কাছে যায় কেন? তাও আবার কা’বাকে ঘিরেই ঘুরপাক খায়। এটাকে কি হিন্দুদের মতো এক বিশেষ মূর্তিকে ঘিরে ঘুরপাক খাওয়ার মতো হলো না?
প্রায় প্রতিটি ধর্মেই বিশেষ একটি জায়গা আছে যেখানে সারা পৃথিবী থেকে ধর্মপ্রাণ অনুসারীরা এসে একসাথে হন। এটা তাদের একতার প্রকাশ। এরকম একটি বিশেষ জায়গায় একসাথে হওয়াটা এটাই দেখিয়ে দেয় যে, সেই ধর্মের অনুসারীরা কোনো দেশ, জাতীয়তাবাদ, গায়ের রঙ, সমাজে স্ট্যাটাস, সম্পত্তি কোনো কিছুর পরোয়া করেন না। তাদের ধর্ম এসবের ঊর্ধ্বে। তারা নিজেদের মধ্যে সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে, একই জায়গায় একসাথে হয়ে, একই কাপড়ে, একইভাবে প্রার্থনা করেন। হাজ্জ মুসলিম জাতির এই অসাধারণ ঐক্য এবং সমতার নিদর্শন।
.
কা’বার পাশে ঘুরপাক খাওয়ায়টা বৈজ্ঞানিকভাবেই একটি চমৎকার পদ্ধতি। হাজার হাজার মানুষ যদি সোজা কা’বার দিকে হেঁটে যেত এবং তারপর সোজা হেঁটে ফেরত আসতো, তাহলে বিরাট বিশৃঙ্খলা, ধাক্কাধাক্কি লেগে যেত। কারো আর পুরো কা’বা একবারও ঘুরে দেখা হতো না। এর থেকে ট্রাফিক পরিচালনা করার জন্য ভালো পদ্ধতি হচ্ছে কোনো কিছুকে ঘিরে ট্রাফিক ঘুরতে থাকা, বাইরের থেকে ঘুরতে ঘুরতে ঢোকা এবং ঘুরতে ঘুরতেই বেরিয়ে যাওয়া।
.
এই পদ্ধতিটি এতই কার্যকর যে, ইংল্যান্ডে রাস্তার মোড়গুলোতে যেন ট্রাফিক জ্যাম না হয়, সেজন্য রাউন্ডএবাউট (Roundabout) বলে একটা ব্যবস্থা আছে। [২] রাস্তার মোড়ে গোলাকার একটা স্থাপনা থাকে। চারপাশ থেকে গাড়ি এসে সেই গোলাকার স্থাপনার চারিদিকে ঘুরতে থাকে। তারা ঘুরতে ঘুরতেই ঢোকে, তারপর ঘুরতে ঘুরতেই বেরিয়ে যায়। এভাবে গাড়ি নিয়ে যে কোনো রাস্তা থেকে প্রবেশ করে, যেকোনো রাস্তা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া যায়। রাস্তার মোড়ে কোনো ট্রাফিক লাইট দরকার হয় না। গাড়িগুলোকে অযথা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। ট্রাফিক লাইট ব্যবহার না করে রাস্তার মোড়ে এই অভিনব পদ্ধতির কারণে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম দূর করা যায়, সংঘর্ষ এড়ানো যায়, রাস্তার মোড়ে এসে গাড়িগুলোকে অনেক কম সময় অপেক্ষা করতে হয়, যখন চালকরা রাস্তার নিয়ম মেনে ভদ্রলোকের মতো গাড়ি চালান। কা’বার চারপাশে ঘোরার অবিকল এই একই পদ্ধতি আজকে ইংল্যান্ডে হাজার হাজার রাস্তার মোড়ে ব্যবহার হচ্ছে।
হাজ্জের আরেকটি রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে ২০-৩০ লক্ষ হাজি হাজ্জ করতে যাচ্ছেন। এটা দেখিয়ে দেয় যে, মুসলিমরা কোনো ছোটখাটো, দুর্বল জাতি নয়। লক্ষ লক্ষ ধনী মুসলিম পৃথিবীতে আছে, যাদের হাজ্জ করার খরচ বহন করার সামর্থ্য আছে। ২০-৩০ লক্ষ মানুষ একসাথে হওয়া বিরাট ঐক্যের নিদর্শন। হাজ্জিরা যখন সারা পৃথিবী থেকে হাজ্জে যান, বিভিন্ন দেশের বিমান-বন্দর, নৌবন্দর, এয়ারলাইন, নিরাপত্তা কর্মীদের মধ্যে সরগরম পড়ে যায়। লক্ষ অমুসলিম মুসলিমদের এই বিরাট উৎসব সম্পর্কে সচেতন হয়ে যায়। এই বিরাট ঘটনাটা অমুসলিম রাজনীতিবিদরা খুব ভালো করে লক্ষ্য করে।
.
‘মুসলিমরা কা’বার পূজা করে’ —অমুসলিমদের কা’বা সম্পর্কে এই ভুল ধারণার একটি বড় কারণ কিছু মুসলিমের কা’বার কাছে গিয়ে করা কাজকর্ম। হাজ্জের সম্প্রচারে দেখা যায়, কিছু মুসলিম মরিয়া হয়ে কা’বা ধরছে, কা’বার সাথে ঘষাঘষি করছে, কা’বার পাথরে চুমু খাওয়ার জন্য হাতাহাতি করছে। এগুলো দেখে যে কারো মনে হতে পারে যে, কা’বা হচ্ছে এক মহান পূজার বস্তু এবং মুসলিমরা আসলে কা’বার পূজা করে।
.
মুসলিমরা কোনোভাবেই কা’বার পূজা করে না। রাসূল (সা) পাথরে চুমু খেয়েছিলেন বিধায় আমরা মুসলিমরা তাতে চুমু খাই। হজরত উমার (রা)-এর একটা কথা এই ক্ষেত্রে বলা যায়- “সন্দেহ নেই তুমি শুধুই একটা পাথর, তোমার কারো উপকার বা অপকার কোনটাই করার সামর্থ্য নেই। আমি যদি আল্লাহর নবীকে তোমাকে চুম্বন দিতে না দেখতাম তাহলে আমিও চুম্বন করতাম না।”(সহীহ বুখারী, বুক ২, ভলিউম ২৬:৬৬৭)। এ থেকেই বুঝা যায় আমরা কা’বা ঘর বা হাজরে আসওয়াদের (পাথর) পূজা করি না। তাছাড়া মক্কা বিজয়ের পর বিলাল (রা) কা’বার উপরে উঠে আযান দিয়েছিলেন। রাসূল (সা) কিন্তু তাকে এজন্য কোন তিরষ্কার করেননি। কা’বা মুসলিমদের উপাসনার বস্তু হয়ে থাকলে রাসূল (সা) কখনোই কাবার উপরে উঠে আযান দেয়ার অনুমতি দিতেন না। [৩] আর হাজ্জের সময় যে ভিড় থাকে তাতে এই কা’বার পাথরে চুমু খেতে যেয়ে কিছুটা হাতাহাতির মত পরিস্থিতি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এর মানে এই না যে মুসলিমরা কা’বার পূজা করছে।
.
◑ কুরআন কি পৃথিবীকে সমতল বলছে?
.
কুরআনের কোথাও পৃথিবীর আকারকে সমতল বলা হয়নি। কেউ অকাট্য যুক্তি-প্রমাণের সাহায্যে কুরআনের পৃথিবীকে সমতল বানাতে পারবেন না। কুরআনে পৃথিবীর আকারকে যে সমতল বলা হয় নি, বরং গোলাকারের (স্ফেরিক্যাল) দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে- সে ব্যাপারে সামান্য আলোচনা করছি।
.
※ ১ম প্রমাণ: সূরা ইন্শিক্বাক্বের ৩ নম্বর আয়াত দেখুন- “আর যখন পৃথিবীকে সমতল করা হবে।” (৮৪:৩)
‘যখন সমতল করা হবে…’ অর্থাৎ এখনই সমতল না। যদি আল্লাহ্ পৃথিবীকে সমতলই বলতেন, তাহলে আবার সমতল করার কথা বলবেন কেন? এই আয়াত থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়, কুরআনে পৃথিবীকে সমতল বলা হয় নি। যদি এখানে মসৃণ সমতলের কথা বলা হত তা হলে আল্লাহ্ পরের আয়াতে এটি উল্লেখ করতেন না- “আর তার ভেতরে যা-কিছু রয়েছে তা নিক্ষেপ করবে এবং শূন্যগর্ভ হবে।” (৮৪:৪) এখানে মসৃণ সমতল নয়- একেবারে অরিজিন সমতল। যদি মসৃণ সমতলের কথা বলতেন, তাহলে পৃথিবীর উপরিভাগের কথা বলতেন। কিন্তু পুরো সূরাতে আল্লাহ্ কোথাও উপরি-অংশ বা উপরিভাগের কথা উল্লেখ করেন নি।
.
※ ২য় প্রমাণ: “তিনি রাত্রি দ্বারা দিনকে আচ্ছাদিত করেন এবং রাত্রিকে আচ্ছাদিত করেন দিন দ্বারা।” (সূরা আয-যুমার ৩৯:৫)
উপরের আয়াতটিতে যে আরবি শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো “يُكَوِّرُ”। যার অর্থ কোন জিনিসকে প্যাঁচানো বা জড়ানো, যেমনটা মাথার পাগড়ির ক্ষেত্রে বুঝানো হয়। অবিরত প্যাঁচানোর পদ্ধতি- যাতে এক অংশ আরেক অংশের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে। আমরা ভালোভাবেই জানি, পাগড়ি কিভাবে গোলাকারভাবে প্যাঁচানো হয়। এই আয়াতে বলা হচ্ছে, রাত ধীরে ধীরে ক্রমশ দিনে রূপান্তরিত হয়, অনুরূপভাবে দিনও ধীরে ধীরে রাতে রূপান্তরিত হয়। এ ঘটনা কেবল পৃথিবী গোলাকার হলেই ঘটতে পারে। পৃথিবী যদি চ্যাপ্টা বা সমতলভূমি হত, তাহলে রাত্রি থেকে দিনে এবং দিন থেকে রাত্রিতে একটা আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে যেত।
.
এছাড়া দেখুন আরও দুইটা আয়াত-
“আল্লাহ দিন ও রাত্রির পরিবর্তন ঘটান। এতে ‘অর্ন্তদৃষ্টি-সম্পন্নগণের’ জন্যে চিন্তার উপকরণ রয়েছে।” (সূরা নূর ২৪:৪৪)
“নিশ্চয়ই মহাকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং ‘রাত ও দিনের আবর্তনে বিশেষ নিদর্শন রয়েছে’ জ্ঞানবান লোকদের জন্য।” (সূরা আলি ইমরান ৩:১৯০)
.
আল্লাহ্ কেন বললেন অন্তর্দৃষ্টির কথা? কেন বললেন না বাহ্যিক দৃষ্টির কথা? আমরা বাহ্যিকভাবে দেখি, সূর্য উদিত হয় বা অস্ত যায়। আসলেই কি তাই? ‘রাত ও দিনের আবর্তনে বিশেষ নিদর্শন রয়েছে’- কি এমন ‘বিশেষ’ জিনিস রয়েছে যাতে আমাদের অন্তর্দৃষ্টি দিতে হবে? অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখার আর পাগড়ির মত প্যাঁচানোর কথা বলে এখানে ইঙ্গিতে পৃথিবীর স্ফেরিক্যাল শেপ এবং ঘূর্ণায়মানতার কথা বলা হয়েছে।
.
※৩য় প্রমাণ: “তিনি দুই পূর্বের প্রভু, আর দুই পশ্চিমেরও প্রভু।” (সূরা রাহমান ৫৫:১৭)
কুরআনে যদি পৃথিবীকে সমতলই বলা হত- তাহলে দুইবার পূর্ব আর দুইবার পশ্চিমের কথা বলা হল কেন? পৃথিবী যদি সমতল হত তাহলে সমগ্র পৃথিবীতে সূর্যের উদয় ও অস্ত একবার করে হত। কিন্তু পৃথিবী গোলাকার হওয়ায় এমনটা হয় না। কারণ আপনি যখন দেখছেন সূর্য উঠছে, তখন আসলে অন্য জায়গায় সূর্য ডুবছে। আর যখন দেখছেন সূর্য ডুবছে, তখন আসলে অন্য অবস্থানে সূর্য উঠছে (প্রকৃতপক্ষে সূর্য অস্ত বা উদয় কোনোটাই হয় না। বুঝানোর সুবিধার্থে এভাবে বললাম)। মোট দুইটা পূর্ব, দুইটা পশ্চিম। বিষয়টা আসলে আরও অনেক গভীর এবং আলোচনার বিষয়। জায়গার অভাবে এই মুহূর্তে সেদিকে আর যাচ্ছি না।
.
※ ৪র্থ প্রমাণ: পৃথিবীর আকার যে গোলাকার- এ ব্যাপারে ইসলামিক স্কলারদের অসংখ্য ফতওয়া রয়েছে। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইয়িম্যার ফতওয়া রয়েছে। [৪] গত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার শাইখ আব্দুল আজিজ ইবন বাযেরও এই ব্যাপারে ফতওয়া রয়েছে [৫] এছাড়াও আপনি দেখতে পারেন IslamQA-র ফতওয়া। [৬] আরও দেখতে পারেন IslamWeb-এর ফতওয়া। [৭]
‘পৃথিবী সমতল’ – এই ভুল ধারণা কোনকালেই মুসলিমদের মধ্য ছিল না। তবে ইউরোপীয় খ্রিষ্টানদের মধ্যে ছিল (বাইবেলবিশ্বাসী মৌলবাদী খ্রিষ্টানদের মধ্যে আজও আছে)। সেই প্রাচীনকালে ইসলামের স্বর্ণযুগে ইউরোপে কেউ যদি বলত “পৃথিবী গোল”, তাকে বাইবেল অবিশ্বাসের দায়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হত। মুসলিমরাই সর্বপ্রথম spherical trigonometry-র বিকাশ সাধন করে। [৮] এগারো শতকে মুসলিম গণিতবিদ আল বিরুনী spherical trigonometry ব্যবহার করে যেকোনো জায়গা থেকে কা’বা ঘরের দিক নির্ণয়ের পদ্ধতি বের করেন। [৯] এছাড়াও ভূপৃষ্ঠের যে কোন পয়েন্ট থেকে কিবলার দিক নির্ণয়ের জন্য মুসা আল খোয়ারিজমী, আল বাত্তানী, ইবনে ইউনুস, ইবনে আল হাইসাম, নাসিরুদ্দিন আল তুসীসহ প্রমুখ মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান ছিল। [১০] এদের কেউই কিন্তু বর্তমান সময়ের না। এখনও কি আপনার মনে হয় মুসলিমরা পৃথিবীকে সমতল ভাবত?
.
◑ কিবলা নিয়ে যাবতীয় বিভ্রান্তির অবসান:
.
কিবলা আসলে কোন দিকে হবে- এটা বের করার বেশ কিছু পদ্ধতি আছে। আমি সেদিকে যাবো না। শুধু main concept-টা জেনে রাখুন- যে দিক দিয়ে কা’বা সবচেয়ে কাছে সেটাই আপনার কিবলা। পৃথিবী গোলাকার বিধায় (পুরোপুরি গোল না), কোন একটা নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে বিভিন্ন উপায়ে আপনি কা’বায় যেতে পারবেন। কিন্তু এদের মধ্যে সর্বনিম্ন দূরত্ব যে দিকে সেটাই হবে আপনার কাঙ্খিত কিবলা। কয়েকটা complicated উদাহরণ দেখা যাক।
☞ [১ম কমেন্টে দেখুন চিত্রঃ ১]
.
কাবাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর মানচিত্র এটি আর গোলাকার হবার কারণে উত্তর আমেরিকার অবস্থান কাবার সাপেক্ষে বাস্তবে কিভাবে সেটা দেখুন। এখন কিন্তু কিবলা আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নেই। কিবলা এখন উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিকে হয়ে গেছে। মনে হয় যে কিবলা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কিন্তু বাস্তবে সেটা উলটে যায়, হয়ে যায় উত্তর পূর্ব দিকে। ভৌগলিক দিকগুলো দেখিয়ে দেয়া হয়েছে এখানে তাই সমস্যা হবার কথা না। আলাস্কা থেকে কাবা বরাবর সরলরেখা টানুন সেটা আপনাকে ভৌগলিক উত্তর দেখাবে তার মানে আলাস্কার কিবলা উত্তর দিকে। আবার কানাডা আর আমেরিকার উত্তর দিকে উত্তর-পূর্ব বরাবর হয়। এই ম্যাপ দিয়েও আসলে ১০০% পরিস্কার ধারনা পাওয়া সম্ভব না কারন এটা তিন মাত্রার ব্যাপার আর ২ মাত্রায় তাকে দেখানো পুরোপুরি সম্ভব না।
.
তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়। পৃথিবী যদি গোলাকার হয় তাহলে তো পূর্ব দিক দিয়েও যেখানে যাওয়া যাবে, পশ্চিম দিক দিয়েও সেখানে যাওয়া যাবে। যেমন USA থেকে পশ্চিম দিকে এশিয়া হয়ে ইউরোপ যাওয়া যাবে আবার পূর্ব দিকে সরাসরি ইউরোপ হয়েও যাওয়া যাবে। অর্থাৎ এসব ক্ষেত্রে আমি পূর্ব বা পশ্চিম যেদিকেই মুখ ফিরাই না কেন কিবলার দিকেই থাকবে। কিন্তু মুখ ফেরানো থাকলেই হবে না। USA থেকে ইউরোপ যাত্রার ক্ষেত্রে পূর্ব দিকেই যাওয়া হয় কারন সেদিকে গেলে কম দূরত্ব যেতে হবে। কিবলার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। ঐ যে একটু আগে বললাম যেদিকে মুখ ফেরালে কা’বা ও আপনার বর্তমান দূরত্ব থাকে সবচেয়ে কম সেদিকেই মুখ ফেরাতে হবে।
.
যদি মেরুতে থাকি তাহলে কোন দিকে মুখ ফেরাতে হবে? উত্তর মেরুতে গেলে সব দিকেই দক্ষিণ আবার দক্ষিণ মেরুতে গেলে সবদিকেই উত্তর। এবার আরেকবার ম্যাপটি দেখুন। সেখান থেকে কি বোঝা যায় না কোন দিকে মুখ ফেরাতে হবে? উত্তর মেরুবিন্দুতে যখন থাকবেন তখন কোন দিকের খোঁজ করা বোকামি। আপনাকে দেখতে হবে কোন দিক থেকে কা’বা সবচেয়ে কাছে, সেটাই আপনার কিবলা। সব দিকে দিয়েই আপনি যেতে পারবেন কা’বায় কিন্তু দিকের সাথে সর্বনিম্ন দূরত্বের ব্যাপারটাও বলেছি। মেরুতে সাধারন কম্পাস কাজ করবে না। সেখানে আপনাকে ব্যবহার করতে হবে Gyro compass (চুম্বকবিহীন একধরনের কম্পাস) [১১] এবং তারার অবস্থান হিসাব করে কিবলা ঠিক করতে হবে। একই নিয়ম দক্ষিণ মেরুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
.
আরেকটা ব্যাপার। অনেকেই গাড়ি, বাস বা ট্রেনে নামাজ পড়েন। তারা কি করবেন? রাস্তা তো আঁকাবাঁকা। এ ক্ষেত্রে নামাজ শুরুর সময়কার কিবলা ঠিক রাখলেই হবে। নামাজরত অবস্থায় কিবলা পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে রাস্তার কারণে সেটা নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই। আর আজকাল অনেক অ্যাপ্লিকেশান/ সফটওয়্যার আছে যা দিয়ে সহজেই কিবলার দিক বের করা যায়। তবে যদি একেবারেই সম্ভব না হয়, তাহলে সুবিধামত যে কোন দিকে ফিরে পড়লেই সালাত আদায় হয়ে যাবে। [১৪]
এবার আসি wikiislam-এর বিখ্যাত সেই বিভ্রান্তিকর ছবি প্রসঙ্গে। নিচের ছবিটাই হল সেই বিভ্রান্তিকর ছবি-
☞ [২য় কমেন্টে দেখুন চিত্রঃ ২]
.
❏ কেস ১: তাদের দাবি- যেহেতু পৃথিবী গোলাকার তাই একেবারে কা’বার কাছাকাছি ছাড়া যে কোন পয়েন্ট থেকে কিবলার দিকে মুখ করার অর্থ আকাশের দিকে মুখ করা! নাস্তিক ভাইদের কাছে তাহলে একটা প্রশ্ন করি। আমাদের দেশ থেকে আমেরিকা আসলে কোন দিকে? আপনি যদি বলেন পশ্চিম দিকে, তাহলে কিন্তু ভুল বলছেন। কারণ আপনি সামনের দিকে আঙ্গুল তুললে সেটা তো হবে আকাশের দিকে, কারণ পৃথিবী তো গোলাকার!! আশা করি উত্তর পেয়ে গেছেন। আমরা যে কোন direction-ই চিন্তা করি পৃথিবীর surface বরাবর, আসমান বরাবর নয়।
.
❏ কেস ২: এখানে তারা দাবি করে কা’বার একদম opposite-এ কিবলা হবে মাটির ভেতর থেকে নিচে। তাদের এই দাবির সাথে আরেকটু যোগ করি। শুধু একদম বিপরীত পাশে না, আরও অনেক জায়গা থেকেই কিবলা মাটির দিক থেকে নিচে। ‘প্রকৃতপক্ষে’ কা’বামুখী হতে হলে বাংলাদেশের মানুষদের আকাশের দিকে পা তুলে মাটির দিকে মুখ করতে হবে। এটা একটা উদ্ভট ও অসম্ভব ব্যাপার। আল্লাহ্ কারও সাধ্যের অতিরিক্ত কিছু চাপান না এবং মানুষকে অদ্ভুতভাবে কষ্ট দেওয়াও আল্লাহর মর্জি না। বরং আল্লাহ্ মানুষের অন্তর দেখেন এবং তার সাধ্যের ভিতরে কাজ দেন। এ কারণে কা’বামুখী হবার জন্য নিকটতম রৈখিক দিকে (যেমন- বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমে) মুখ করতে হয়। বোধসম্পন্নরা এখানে আল্লাহর অনুগ্রহ খুঁজে পায় এবং বক্রহৃদয়ের লোকেরা এখান থেকে আল্লাহ্ কিংবা রাসূল (সা)-এর ভুল খুঁজে পায়।
.
❏ কেস ৩: এই ছবিতে তাদের দাবি যেহেতু পৃথিবী গোলাকার, সেহেতু কা’বার দিকে মুখ ফেরার অর্থ হল একদিক থেকে কা’বাকে পশ্চাৎদেশ দেখানো! একই কথা কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কেউ যদি আপনার পেছন দিকে থাকে, তার অর্থ সে ঘুরে এসে আসলে আপনাকে পশ্চাৎদেশ দেখাচ্ছে! কি অদ্ভুত যুক্তি! এবার তাদের যুক্তি খণ্ডন করি। কা’বা ঘরের সাথে যদি আপনার সামনাসামনি কোন যোগাযোগ না থাকে বা সামনে কোন পর্দা বা অন্তরায় থাকে তাহলে আপনি কা’বার দিকে ফিরে যে কোন কিছুই করতে পারবেন। দেখুন IslamQA-র ফতওয়া। [১২]
.
❏ কেস ৪: সর্বশেষ চিত্রটা হল কা’বার antipode নিয়ে (কোন কিছুর একদম opposite-কে antipode বলে)। এখানে নাকি সবদিক সমান, তাই কা’বামুখী হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন দিক নাই। এইখানে এসে আমরা যে ব্যাপারটা ভুলে যাই তা হল The antipode also has an antipode. কা’বা ঘরের ভেতর যে কোন দিকে মুখ করেই সালাত আদায় করা যায়। আর সেই কা’বার antipode-এ যে কোন দিকে মুখ করে নামায আদায় করতে দোষ কি? দাঁড়ান, এখনও কথা শেষ হয় নি। প্রকৃতপক্ষে কা’বার antipode-এ কোন land area নেই। নিচের চিত্রটা দেখুন-
☞ [৩য় কমেন্টে দেখুন চিত্রঃ ৩]
.
এটা অবস্থিত প্রশান্ত মহাসাগরে, পলিনেশিয়া এরিয়ার ভেতর। কেউ যদি প্লেনে বা জাহাজেও থাকে, তাহলে তো চোখের নিমেষেই পার হয়ে যাবে। আর এই পয়েন্ট ছেড়ে গেলেই তো আবার সর্বনিম্ন দূরত্বের সাধারণ নিয়ম প্রযোজ্য হবে। তারপরেও যদি কেউ কোনভাবে exact এখানে অবস্থান করতে পারে, তাহলেও তার জন্য অসংখ্য direction থাকে না, কারণ পৃথিবী পুরোপুরি গোলাকার না। আর এজন্য সর্বনিম্ন দূরত্ব হিসাব করলে তার কাছে দুইটা direction থাকে, উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্ব। আর এই antipode থেকে নিকটতম land area হল Tematagi. [১৩] আর এই নিকটতম স্থলভাগ যেহেতু উত্তর-পশ্চিম direction অনুসরণ করে, তাই সবথেকে ভাল হয় উত্তর-পশ্চিম দিকে ফিরে সালাত আদায় করা। আর যদি কোনভাবেই কিবলা চিহ্নিত করা না যায় (যে কোন ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য), তাহলেও কোন সমস্যা নাই। তখন যে কোন দিকে ফিরে নামায পড়লেই হবে। এই ব্যাপারে IslamQA-র ফতওয়া আছে। [১৪]
.
এবার সর্বশেষ যে প্রশ্নটি আপনারা করতে পারেন সেটার উত্তরও দিবো ইনশাল্লাহ্। ISS (International Space Station)-এ অবস্থানকারী কোন মহাকাশচারী যদি নামাজ পড়তে চান তাহলে তিনি কিভাবে পড়বেন- এটাই তো? এই ব্যাপারে সিদ্ধান্তের জন্য ২০০৬ সালে মালয়শিয়ান ন্যাশনাল স্পেস এজেন্সি একটি কনফারেন্সের আয়োজন করে বিজ্ঞানী ও ধর্মীয় স্কলারদের নিয়ে।[১৫] এই কনফেরেন্সে সিদ্ধান্ত হয় মহাকাশচারী তার ক্ষমতা অনুযায়ী কিবলা নির্ধারণ করবে। সেটা চারটা স্টেপে প্রাধান্য পাবে। ১. কাবার দিকে মুখ করে ২. কাবার প্রজেকশনের দিকে মুখ করে ৩. পৃথিবীর দিকে মুখ করে ৪. সুবিধামত যে কোন দিকে মুখ করে। কিন্তু তবুও একটা সমস্যা থেকে যায়, ধরা যাক পৃথিবীর দিকে মুখ করেই নামাজ শুরু করল। কিন্তু ঘূর্ণনের কারনে নামাজের মধ্যেই মুখ অন্য দিকে হয়ে যেতে পারে, তখন? গাড়ি বা ট্রেনে চলার সময়ের মত এখানেও শুরুতে কিবলা ঠিক করে নিলেই হবে, পরে পরিবর্তন হলেও কোন সমস্যা নেই।
.
আশা করি কিবলা নিয়ে আপনাদের বিভ্রান্তি দূর হয়েছে। আল্লাহ্ আমাদের সঠিক পথে থাকার এবং গভীরভাবে চিন্তা করার তাওফিক দান করুক।
.
======
লেখকঃ নাফিস শাহরিয়ার [ফেসবুক id: Nafis Shahriar]
#সত্যকথন
=====
.
তথ্যসূত্র:
[১] মা’রিফুল কু’রআন — মুফতি শাফি উসমানী।
[২] https://en.wikipedia.org/wiki/Roundabout
[৩] আর রাহীকুল মাখতূম
[৪] Majmû` al-Fatâwâ (5/150), Majmû` al-Fatâwâ (6/546-567)
[৫] http://www.binbaz.org.sa/noor/9167
[৬] https://islamqa.info/en/118698, https://islamqa.info/en/211655
[৭] http://www.islamweb.net/emainpage/index.php…
[৮] David A. King, Astronomy in the Service of Islam, (Aldershot (U.K.): Variorum), 1993.
[৯] The Determination of the Co-ordinates of Cities. See Lyons, 2009, p85
[১০] Moussa, Ali (2011). “Mathematical Methods in Abū al-Wafāʾ’s Almagest and the Qibla Determinations”. Arabic Sciences and Philosophy (Cambridge University Press)
[১১] https://en.wikipedia.org/wiki/Gyrocompass
[১২] https://islamqa.info/en/69808
[১৩] https://en.wikipedia.org/wiki/Tematagi#Antipode_of_Mecca
[১৪] https://islamqa.info/en/148900, https://islamqa.info/en/65853
[১৫] https://en.wikipedia.org/w…/National_Space_Agency_(Malaysia)
http://www.moonsighting.com/faq_qd.html
.
কৃতজ্ঞতা- মুসাভভির মাহমুদ সিজন, ওমর আল জাবির এবং মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার ভাই
Leave Your Comments