কুরআন কি আসলেই সকল অমুসলিম হত্যা করে ফেলতে বলে?

কুরআন কি আসলেই সকল অমুসলিম হত্যা করে ফেলতে বলে?
===================================
.
#নাস্তিক_প্রশ্ন ঃ ভবিষ্যতে যদি কখনো মুসলিমরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে আর কুরান (Quran 4:89) এর নির্দেশ অনুসারে সকল অমুসলিমদের হত্যা করে তবে সেটা কোনভাবেই অন্যায় বলে গণ্য হবে না (Quran 3:157, 3:169) ! আপনার কি এরপরেও মনে হয় ইসলাম কোন সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত ধর্ম হতে পারে?
.
উত্তরঃ পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছেঃ
.
“ তারা চায় যে, তারা যেমন অবিশ্বাসী, তোমরাও তেমনি অবিশ্বাসী হয়ে যাও, যাতে তোমরা এবং তারা সমান হয়ে যাও। অতএব, তাদের মধ্যে কাউকে আওলিয়া(পৃষ্ঠপোষক/অভিভাবক/বন্ধু)রূপে গ্রহণ করো না, যে পর্যন্ত না তারা আল্লাহর পথে হিজরত করে চলে আসে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে তাদেরকে পাকড়াও কর এবং যেখানে পাও সংহার কর। তাদের কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না এবং সাহায্যকারী বানিও না।
কিন্তু তাদেরকে নয়, যারা এমন সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয় যে তাদের সঙ্গে তোমরা চুক্তিবদ্ধ অথবা তোমাদের কাছে এভাবে আসে যে, তাদের অন্তর তোমাদের সাথে এবং তাদের কওমের সাথে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক।
…”
(কুরআন, নিসা ৪:৮৯-৯০)
.
“আর তোমরা যদি আল্লাহর পথে নিহত হও কিংবা মৃত্যুমুখে পতিত হও, তোমরা যা কিছু সংগ্রহ করে থাকো আল্লাহর ক্ষমা ও করুণা সে সবকিছুর চেয়ে উত্তম।” (কুরআন, আলি ইমরান ৩:১৫৭)
.
“ আর যারা আল্লাহর রাহে নিহত হয়, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না। বরং তারা নিজেদের প্রভুর নিকট জীবিত ও জীবিকাপ্রাপ্ত।”
(কুরআন,আলি ইমরান ৩:১৬৯)
.
প্রশ্নকর্তাগণ যে আয়াতের ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন, সেই আয়াত(নিসা ৪:৮৯) প্রসঙ্গে সাহাবী ইবন আব্বাস(রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, মক্কায় এমন কিছু লোক ছিল যারা ইসলামের কালিমা পাঠ করেছিল।কিন্তু এরা মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকদের সাহায্য করত। {অর্থাৎ এরা মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রে শত্রুর এজেন্ট হিসাবে কাজ করত} তাদের বিশ্বাস ছিল যে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সাহাবীগণ তাদেরকে কোন বাধা প্রদান করবেন না কেননা তারা প্রকাশ্যে ইসলামের কালিমা পাঠ করেছিল।
.
এদের ব্যাপারে কী করা হবে, তা নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে মতানৈক্য হয়েছিল।রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এ ব্যাপারে নিরব থাকলেন।অতঃপর আলোচ্য আয়াত(নিসা ৪:৮৯) নাজিল হল এবং ঐসব শত্রুর চরের ব্যাপারে আল্লাহর পক্ষ থেকে ফয়সালা এলো।
[তাবারী ৯/১০ এবং ইবন কাসির, নিসা ৪:৮৯ এর তাফসির দ্রষ্টব্য]
.
পরবর্তী আয়াতে(নিসা ৪:৯০) এটাও পরিষ্কার বুঝিয়ে দেয়া হল যেঃ এই ফয়সালা তাদের জন্য নয় যারা মুসলিমদের সাথে চুক্তিবদ্ধ কোন সম্প্রদায়ের নিকট যায় কিংবা যারা মুসলিমদের সাথে যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক নয়। ঐ আদেশ শুধু তাদের ব্যাপারে যারা মুসলিমদের মধ্যে শত্রুর চর হিসাবে কাজ করছিল।
.
কোথায় শত্রুর গুপ্তচরে প্রতি শাস্তির নির্দেশ আর কোথায় সকল অমুসলিমকে হত্যা করা!!!
বরাবরের মতই কুরআনের বিধানকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ও বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে আলোচ্য প্রশ্নটি উত্থাপন করা হয়েছে।আমরা জানি যে বর্তমানে পৃথিবীর সকল সেকুলার রাষ্ট্রেও শত্রুর গুপ্তচরের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হয়।নাস্তিক-মুক্তমনাদের কিন্তু কখনো এসবের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে দেখা যায় না।প্রকৃতপক্ষে, রাষ্ট্রের ক্ষতিসাধণকারী শত্রুর গুপ্তচরের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেওয়া দরকার, এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলবার কোন সুযোগই কারো নেই। আর একারণেই কুরআনের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলবার জন্য এর আয়াতকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করার প্রয়োজন হয়েছে নাস্তিকদের। পরকাল আর স্রষ্টার বিচারে যাদের বিশ্বাস নেই, তাদের কাছ থেকে আর কতটু্কু সত্যবাদিতাই বা আমরা আশা করতে পারি?
.
প্রশ্নকর্তাদের উল্লেখিত অপর আয়াতদ্বয় আলি ইমরান ৩:১৫৭ ও আলি ইমরান ৩:১৬৯ এ শহীদগণের মর্যাদা বর্ণণা করা হয়েছে। আল্লাহর পথে লড়াই করে মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিগণ শহীদ। আর আল্লাহর পথে যে লড়াই হয় তা সবসময়েই ন্যায়সঙ্গতভাবে হয়।একটি আয়াতেও “সকল অমুসলিমদের হত্যা করা”র নির্দেশ নেই। কুরআনে জিহাদের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য খুব পরিষ্কারভাবে বর্ণণা করা আছে। ফিতনা দূর করা ও আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা(সুরা আনফাল ৮:৩৯ দ্রষ্টব্য) ও মুসলিমদের জুলুম-নির্যাতন থেকে রক্ষা করা(নিসা ৪:৭৫ দ্রষ্টব্য)।কুরআন কস্মিণকালেও সকল অমুসলিমকে হত্যা করতে বলে না কিংবা কোন মানুষের উপর জুলুম করতে বলে না। বরং এর বিপরীত কথাই কুরআনে পাওয়া যায় [কয়েকটি নমুনার জন্য সুরা মুমতাহিনা ৬০:৮-৯, আনকাবুত ২৯:৪৬, মায়িদাহ ৫:৮-৯, আনআম ৬:১৫১-১৫২ দেখা যেতে পারে]।
.
হাদিসে বলা হয়েছে—
.
রাসূলূল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন কারণ ব্যতিত মু’আহিদ(ইসলামী রাষ্ট্রে চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম) কোন ব্যক্তিকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।
[সুনান আবু দাউদ; জিহাদ অধ্যায় ১৫, হাদিস ২৭৬০(সহীহ)]
.
মুতার যুদ্ধে রওনার সময় রাসূলুল্লাহ(ﷺ) তাঁর বাহিনীকে নির্দেশ দেন :
‘তোমরা কোনো নারীকে হত্যা করবে না, অসহায় কোনো শিশুকেও না; আর না অক্ষম বৃদ্ধকে। আর কোনো গাছ উপড়াবে না, কোনো খেজুর গাছ জ্বালিয়ে দেবে না। আর কোনো গৃহও ধ্বংস করবে না।’
[মুসলিম : ১৭৩১]
.
“… আমি তোমাদের কয়েকটি উপদেশ দিয়ে প্রেরণ করছি : (যুদ্ধক্ষেত্রে) তোমরা বাড়াবাড়ি করবে না, ভীরুতা দেখাবে না, (শত্রুপক্ষের) কারো চেহারা বিকৃতি ঘটাবে না, কোনো শিশুকে হত্যা করবে না, কোনো গির্জা জ্বালিয়ে দেবে না এবং কোনো বৃক্ষও উৎপাটন করবে না।’’
[মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক : ৯৪৩০]
.
যুদ্ধের ময়দানেও এভাবে ইসলাম ন্যায়-ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছে। মোটেও “সকল অমুসলিমদের হত্যা করা”র নির্দেশ দেয়নি।
.
যারা বলতে চায় ইসলাম “সকল অমুসলিমকে হত্যা করা”র নির্দেশ দেয়, তারা এক মারাত্মক নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দেয়। সকল অমুসলিমকে যদি হত্যাই করা হয়, ইসলামের দাওয়াত দেওয়া হবে কাকে বা ইসলামের বিস্তার হবে কিভাবে?
.
সব শেষে প্রশ্নকর্তা নাস্তিক-মুক্তমনাবৃন্দের উদ্যেশ্যে বলতে চাইঃ আপনারা এহেন রেফারেন্স উল্লেখ করে {সেই সাথে অপ্রাসঙ্গিক ও বিকৃত ব্যাখ্যা করে} প্রশ্ন তুলেছেন কী করে ইসলাম সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত ধর্ম হতে পারে। আমার প্রশ্নঃ আপনারা কি আদৌ কোন সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন? যে সৃষ্টিকর্তাকে আপনারা বিশ্বাসই করেন না, তখন কিভাবে আপনারা “সৃষ্টিকর্তার ধর্ম”র ব্যাপারে আস্তিকদের কাছে প্রশ্ন করেন? এটা কি কপটতা নয়? আর সৃষ্টিকর্তার নির্দেশিত ধর্ম কীরকম হওয়া উচিত বলে আপনারা মনে করেন? আপনাদের কি কোন প্রস্তাবনা আছে? আপনারা কি আসলেই স্রষ্টায় অবিশ্বাস করেন, নাকি নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ(বা উপাসনা) করে নিজেদের মনমত স্রষ্টার কল্পনা করেন?
.
“তুমি কি তাকে দেখো না, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার যিম্মাদার হবে?”
(কুরআন, ফুরকান ২৫:৪৩)
==============================
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রাহমান মিনার

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *