আজ ২ রা জিলকদ ১৪৩৯ হিঃ মোতাবেক ১৬ জুলাই ২০১৮ খৃষ্টাব্দ রোজ সোমবার বাদে আসর থেকে এশা পর্যন্ত আল জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা তাবলীগী জোড় অনুষ্ঠিত হয়। জোড় সঞ্চালনায় ছিলেন জামিয়া পটিয়ার মুঈনে মুহতামিম মাওলানা আবু তাহের নদভী দা: বা:। উক্ত জোড়ে জামিয়ার সম্মানিত শিক্ষকমণ্ডলী ও দায়িত্বশীলগণ উপস্থিত ছিলেন। কাকরাইল মারকাজ থেকে আগত মেহমানদের একজন বাদে আসর এবং অপরজন বাদে মাগরিব আলোচনা করেন। উক্ত জোড়ে প্রধান মেহমান হিসাবে আলোচনা করেন জামিয়া আহলিয়া হাটহাজারীর সিনিয়র শিক্ষক মুফতি জাসিমুদ্দীনন হাফিযাহুল্লাহ। বিশেষ অতিথি হিসাবে দিকনির্দেশনা মূলক নসীহত পেশ করেন জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার প্রধান পরিচালক, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক আল্লামা মুফতি আব্দুল হালিম বোখারী হাফিযাহুল্লাহ।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানা আনোয়ারা, বাঁশখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, চন্দনাইশ, পটিয়া, বোয়ালখালী, কর্ণফুলীসহ কক্সবাজার জেলা থেকে অনেক আলেম-ওলামা এবং সাধারণ মুসল্লী এই জোড়ে অংশ গ্রহণ করেন। প্রাইভেট গাড়ী ছাড়াও অনেকেই বিভিন্ন বাস রির্জাভ করে এই জোড়ে অংশ গ্রহন করেন। অল্প সময়ে ঘোষিত হাজার হাজার আলেম-ওলামা ও সাধারণ মুসল্লীদের অংশগ্রহণ ছিল লক্ষ্যনীয়। জোড় শেষে ওলামায়ে কিরাম ও মুসল্লীদের জন্য বিশেষ আপ্যায়নেরও ব্যবস্থা ছিল ।
বিশেষ অতিথির আলোচনায় আল্লামা বোখারী বলেন, আমাদেরকে আল্লাহ তা’য়ালা দেওবন্দী মতাদর্শের বিশ্বাসী হওয়ার তাওফীক দান করেছেন। এই জন্য সকলের উচিত আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং দোয়া করা, আল্লাহ যেন এই দেওবন্দী মতাদর্শের উপর অটল থাকার তাওফীক দান করেন, আমীন।
‘দেওবন্দীয়্যাত’ একটি মতাদর্শের নাম। ‘দেওবন্দীয়্যত’এর কথা কুরআন-সুন্নায় রয়েছে। আকায়েদের কিতাবেও আছে। তবে ভিন্ন নামে আছে। যেমন, আমাদের সাতকানিয়ায় একটি এলাকা আছে চরম্বা। সেখানে মুরগীর ডিমকে বলে ‘বজা’ আর আমিরাবাদে বলা হয় ‘আন্ডা’ তবে যখন শহরে আসে তখন হয়ে যায় ডিম। তেমিন ‘দেওবন্দীয়্যাত’ এই মতবাদটি কুরআন সুন্নাহ থেকে নির্গত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘ইহদিনাস সিরাতাল মুস্তাকীম’ সরল পথ কামনা কর। সেই সরল পথের কথা রাসুল সাঃ কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী’। ফুকাহায়ে কিরাম তার ব্যাখ্যা করেছেন ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’। আর এই সরল পথ ভারত উপমহাদেশে ‘দেওবন্দীয়্যত’ এর নামেই পরিচিত।
তদানিন্তিন দারুল উলূম দেওবন্দের মুহতামিম হাকীমুল ইসলাম কারী তৈয়ব রহ. ‘দেওবন্দীয়্যত’ এর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন,
دینًامسلمان ہے،فرقتاً اہلِ سنت والجماعت ہے، مذھبًا حنفی ہے، مشربًاصوفی ہے، عقیدتاً ماتردی ہے، سلوکاً چستی ہے بلکہ جامع السلاسل ہیں، فکرًاولی اللہی ہے، اصولًاقاسمی ہے، فروعًاگنگوہی ہے۔
অর্থাৎ ‘দেওবন্দীয়্যত’ মতাদর্শের ধর্ম হলো ইসলাম। দল হলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত। মাযহাব হিসেবে হানাফ ও মতবাদ হিসেবে সূফী। ইমাম আবুল মানুসুর মাতুরদীর আকীদায় বিশ্বাসী। আধ্যাত্মিকতায় চিশতী, বরং কাদেরী, সাহরাওয়ারদী, নকশবন্দী ও চিশ্তিয়া চারো তরিকার সমন্বয়কারী। শাহ ওলি উল্লাহ মুহাদ্দেসে দেহলভী রহ. এর চেতনায় এবং কাসেম নানুতভী রহ. এর মৌলিক নীতিমালা ও শাখাগত দিকগুলোর ক্ষেত্রে মুফতী রশীদ আহমদ গাংগুহী রহ. এর অনুসারী।
তাহলে বুঝা যায়, কুরানে কারিমে যা ‘সিরাতে মুস্তাকীম’
সুন্নাতে রাসুলে যা ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী’
আকিদার কিতাবে যা ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত’
সেটিই হিন্দুস্তানে ‘‘দেওবন্দীয়্যত’
দেওবন্দে একটি প্রতিষ্ঠান আছে ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’। রাসুল সাঃ তার প্রতিষ্ঠাতা। এটি প্রতিষ্ঠা করার পূর্বে মুহতামিম সাহেব রহ. স্বপ্ন দেখেন রাসুল সাঃ মাদরাসার প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে মাদরাসার এরিয়া দেখে বলেন, এই জায়গাটি মাদরাসার জন্য ছোট হবে। তিনি নিজেই একটি এরিয়া এঁকে দেন। সকলে ঐ স্থানে লাঠির চিহ্ন দেখতে পান। পরে ঐ নকশার উপরই মাদরাসার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
এই প্রতিষ্ঠান সকল বাতিলের মোকাবিলা করেন। ইহুদীবাদের মোকাবিলা করেন। খৃষ্টবাদের মোকাবিলা করেন। আরিয়া সমাজ, কাদিয়ানী মতবাদ, সালাফী মতবাদ ও বেরলভী মতবাদসহ সকল বাতিলের প্রতিরোধে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন সেই তখন থেকেই। এই জন্যই বাতিলরা সার্বক্ষনিক প্রচেষ্টায় থাকে এই দ্বীনী প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে দিতে। অনেক চেষ্টা তারা চালিয়েছে এবং চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আল্লাহ তাদের সকল চক্রান্তকে ‘পা জা আলা হুম কা আসফিন মা’কুল’ করে দেন।
کہساریہاں دب جاتے ہیں، طوفان یہاں رک جاتے ہیں
اس کاخ فقیری کے آگے شاہوں کے محل جھک جاتے ہیں۔
পাহাড় এখানে ধসে যায়, ঘূর্ণীঝড় এখানে থেমে যায়,
এই গরিবখানার সামনে রাজপ্রসাদও ঝোঁকে যায়।
মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ. এর ঘরে একদিন ভারতের প্রধানমন্ত্রি জওয়াহের লাল নেহরু আসলেন। হুজুর স্বভাবিকভাবে বসলেন আর তিনি দুই জানু হয়ে বসলেন।
কাদিয়ানীর মুকাবিলা করার জন্য বের হয়েছেন দেওবন্দের সন্তানরা। আল্লামা আতাউল্লাহ শাহ বোখারী , আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ.। তাসাউফকে সংস্কার করেছেন দেওবন্দের আরেক সন্তান হযরত আশরাফ আলী থানভী রহ.। ইংরেজ বেনিয়াদের থেকে এদেশকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেছিলেন দেওবন্দের সন্তান শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রহ.। মূলতঃ এটি হলো হক্বের টাওয়ার। এই টাওয়ারের উপর যুগ যুগ ধরে হামলা হয়ে আসছে। তবে আল্লাহ এটির মূল রক্ষাকর্তা, তিনিই এটিকে রক্ষা করবেন কিয়ামত পর্যন্ত ইনশা আল্লাহ।
এই হক্বের টাওয়ারে আজকে একটি এটেম বোমা মারা হয়েছে। ভারত উপমাহাদেশ, আরব-আজম, আফ্রিকা-আমেরিকাসহ গোটা বিশ্বে তার প্রভাব পড়েছে। সেই এটেম বোমা হল, বেতন নিয়ে যারা মাদরাসায় পড়ান তাদের চেয়ে ব্যভিচারী মহিলা অনেক উত্তম।
প্রকৃত বাস্তবতা হলো, তখনকার যুগে মুসলিম বিশ্বে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত ছিল। বায়তুল-মাল বা সরকারী কোষাগার থেকে ইমাম, মুয়াজ্জিন ও মাদরাসার মুয়াল্লিমদের বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা হতো। সেই যুগে ওলামায়ে কিরাম বলেছেন, কুরআন পড়িয়ে হাদিস পড়িয়ে বেতন নেয়া জায়েজ হবে না। পরবর্তী সময়ে ইসলামী শাসন ব্যবস্থাও নেই বায়তুল মালও নেই । তখন সকল ওলামায়ে কিরাম ইজমা বা ঐক্যমত হয়ে ঘোষণা দেন যে, বেতন-ভাতা ছাড়া যেহেতু এই কাজগুলো চলতে পারে না, তাই, মাদরাসা-মকতব রক্ষার স্বার্থে শিক্ষকতা, ইমামতি করে বেতন গ্রহণ করা জায়েয আছে। ফতোয়ায়ে শামী, এমদাদুল ফতোয়া, ফতোয়ায়ে দারুল উলুমসহ সকল ফতোয়ার কিতাবাদীতে তা স্পষ্ট লিখা আছে।
মূলতঃ এই কথার মাধ্যমে সূক্ষ্মভাবে চেষ্টা চালানো হচ্ছে যেন মাদরাসা বন্ধ করা যায়। যেমনি কাফির-মুশরিক ও নাস্তিক-মুরতাদরা চাচ্ছে মাদরাসা বন্ধ হয়ে যাওয়াটা।
সঙ্কট নিরসনে আমাদের করণীয়:
এ পরিস্থিতিতে আমারা কী করব? আমরা কি লাঠি নিয়ে মারামারি করব? না, আমরা লাঠি নিয়ে মারামারি করবো না।এই সঙ্কট থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হলে আমাদেরকে কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
এক. আমাদেরকে বেশী বেশী করে দোয়া করতে হবে। যেমন আপনাদেরকে স্পেনের একটি কাহিনি শুনাচ্ছি।
স্পেনে একজন অনেক বড় আল্লাহওয়ালা বুর্যগ লোক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল আব্দুল্লাহ আন্দুলসী। হাজার হাজার মুরিদ ছিল তাঁর। একদা তিনি এক মূর্তিপূজককে দেখে অত্মহাংকারী হয়ে মনে মনে বলেন, আমি এই মূর্তিপূজারীর চেয়ে অনেক ভাল। আমি আল্লাহর একত্ত্ববাদে বিশ্বাসী। তাঁর এই অত্মগৌরবপূর্ণ কথা আল্লাহর পছন্দ হয়নি। তাই আল্লাহ তার ভাগ্য পরিবর্তন করে দেন। একদিন তিনি মুরিদগণকে নিয়ে সফর করেন। এমন সময় এক খৃষ্টান সুন্দরী মহিলা রাস্তার পার্শ্বে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পান। ঐ বুযুর্গের দৃষ্টি সুন্দরী মহিলার প্রতি পড়ার সাথে সাথেই তিনি মহিলার প্রেমে পাগল হয়ে গেলেন। মুরিদদেরকে বলেন, তোমরা চলে যাও। আর তিনি ঐ সুন্দরী মহিলার পিতার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেলেন। সুন্দরী মহিলার পিতা তাকে বলেন, দুই শর্তে আমার মেয়েকে তোমার নিকট বিয়ে দিতে পারি। এক, তোমাকে খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। দুই, আমার কিছু শুকর আছে তা চড়াতে হবে। তিনি উভয় শর্ত মেনে নিয়ে ঐ সুন্দরী মহিলাকে বিবাহ করলেন। মুরিদরা মুরশিদের জন্য কান্নাকাটি করতে লাগলেন। দীর্ঘদিন পর আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করলেন। ঐ পীর সাহেব হুঁশ ফিরে পেলেন। তিনি সবকিছু ছেড়ে পুনরায় নিজের খানকায় ফিরে আসলেন। এবং ঐ খৃষ্টান মহিলাও ইসলাম ধর্ম কবুল করে নিলেন।
তেমনি আমাদেরকেও আল্লাহর দরবারে সিজদাবনত হয়ে বেশী বেশী কান্নাকাটি করতে হবে। যিনি এই কথাগুলো বলেছেন এবং যারাই তার পক্ষাবলম্বন করেছেন তাঁদের হিদায়তের জন্য এবং আমাদের নিজেদের হিদায়তের জন্য বেশী বেশী দোয়ায় মশগুল থাকতে হবে। আমরা আল্লাহকে বলব, হে আল্লাহ যারা বুঝতেছে না, যারা দেওবন্দের এই টাওয়ারে হামলা করতে চায় তাদেরকে হিদায়ত দান করুন।
এভাবে যদি আমরা দোয়া করতে থাকি তাহলে অচিরেই যারা বুঝতেছে না তারাও ঐ মহিলার মত মুসলমান হয়ে ফিরে আসবে, ইনশা আল্লাহ।
লাঠি নিয়ে মারামারি করে এই সমস্যার সমাধান কখনো সম্ভব নয়। আমি সেদিন কক্সবাজারে গিয়ে শুনলাম সেখানে একজন এসে বয়ান করছেন, অন্য দলের লোকেরা তাকে বাহির করে দেয়। এবং মিম্বারটি বাহিরে নিয়ে বড় দা দিয়ে টুকরা টুকরা করে দেয়, আহ!।
তাবলীগী জামাত তো একটি আদর্শ জামাত ছিল। ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও ভালবাসার নজীরবিহীন একটি জামাত ছিল। সেই জামাতের আজ এই দুরাবস্থা! সত্যিই আমদেরকে এই পরিস্থিতি খুবই কষ্ট দেয়। আল্লাহ রক্ষা করুন।
আমাদের অনেক আকাবীরগণ বলেছেন ইমাম মাহদি আঃ এসে যে হক্ব দলের সাথে যোগদান করবেন তা হলো তাবলীগ জামাত। কিন্তু আফসোস, আজ সেই জামাতের এই করুন দশা! আল্লাহ হিফাজত করুন।
মূলতঃ আমাদের মনে রাখতে হবে এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি পরীক্ষা। হয়ত আল্লাহ আমাদেরকে পরীক্ষা করছেন যে, তোমরা কি ব্যক্তি বিশেষের কারণে তাবলীগ করছো? আমরা বলব, না আমরা কোন ব্যক্তি বিশেষের কারণে নয়, একমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্যই তাবলীগ করে থাকি।
আব্দুল্লাহ আন্দুলসী রহ. যখন খৃষ্টান হয়ে গেছেন তখন তাঁর মুরিদগণ কি খৃষ্টান হয়ে গেছেন? না, তাঁর মুরিদগণ খৃষ্টান হননি। রবং তাঁরা আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে দোয়ায় মশগুল ছিলেন। ফলে আল্লাহ তা’য়ালা আব্দুল্লাহ আন্দুলসীকেও হিদায়ত দান করেছেন এবং ঐ মহিলাকেও হিদায়ত দান করেছেন। তেমনি এখনও যদি আমরা সিজদাবনত হয়ে আল্লাহর দরবারে দোয়ায় মশগুল থাকি তাহলে ইনশা আল্লাহ তাঁদেরকে আল্লাহ আবারো আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিবেন।
দুই. এই দাওয়াতে তাবলীগের প্রতিষ্ঠাতা হলেন দেওবন্দের সন্তান হযরত মাওলানা ইলিয়াছ রহ.। তাঁর লিখিত নীতিমালা অনুস্মরণ করে আমরা তাবলীগি কাজ চালিয়ে যাব।
তিন. আমাদের মূল পরিচয় হল ‘দেওবন্দিয়্যত’ তাই, দেওবন্দের সিদ্ধান্ত মেনেই তাবলীগি কাজ অব্যহত রাখবো।
চার. ব্যক্তিগতভাবে সাথীদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করবো। মারামারি ও ঝগড়া-ঝাটি করে রাজনৈতিক পন্থা অবলম্বন করবো না।
আমাকে সেদিন কক্সবাজারের এক মুরব্বি বলেন, আমিও এই বিষয়টি পরিপূর্ণভাবে জানতাম না। যখন সব জেনেছি ফিরে এসেছি। ওলামায়ে কিরামের উপর এমন আক্রমণ! এটি কিভাবে সম্ভব? তখন আমি বললাম, শুধু ওলামাদের উপর আক্রমণ নয় বরং মুসা আঃ এর উপরও আক্রমণ হয়েছে। মুসা আঃ দাওয়াত বন্ধ করে তুর পাহাড়ে চলে গেলেন। যার কারণে দাওয়াত বন্ধ হয়ে গেছে। এটি মুসা আঃ ঠিক করেননি। না‘ঊযুবিল্লাহ।
আশ্চর্য! মুসা আঃ তো সেখানে দাওয়াত শিখার জন্য গিয়েছিলেন। নবীগণ ভুল করতে পারেন না। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতে আকিদা হলো নবীগণ নবুয়্যাতের পূর্বাপর কখন গুনাহ করেননি, তাঁরা সকলেই মা‘সূম।
আরো আশ্চর্য হলো তিনি আমাদের নবীর উপরও আক্রমণ করেছেন। আল্লাহ আমাদেরকে হিফাজত করুন। তিনি বলেন, রাসুল সাঃ সকল বিবিগনের ওলিমার ব্যবস্থা করেছেন খেজুর দিয়ে আর যায়নাবের ওলিমার ব্যবস্থা করেছেন গোস্ত দিয়ে। এটি ভুল করেছেন। না‘ঊযুবিল্লাহ। রাসুল সাঃ ইজতিহাদী ভুল করলেও সাথে সাথে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেছেন। যেমন ইনশা আল্লাহ না বলার কারণে সূরায়ে কাহাফে আয়াত নাযিল করেছেন।
বন্ধুগণ! ওলামায়ে কিরামের উপর আক্রমণ, নবীগণের উপর আক্রমণ, আমাদের রাসুলের উপর আক্রমণ। এই সব কি সহ্য করা যায়? না, যায় না। কিন্তু তার পরেও সহ্য করতে হবে। দোয়া করতে থাকেন। মনে রাখবেন, হযরত ওমরের হিদায়ত কিন্তু দোয়ার মাধ্যমেই হয়েছিল। আল্লাহ আমাদের সকলকে হিদায়ত দান করুন, যারা দাওয়াত ও তাবলীগের কাজের সাথে লেগে আছেন তাঁদের সকলকে হিদায়ত দান করুন, আমীন।
প্রধান মেহমান মুফতি জসিমুদ্দিন সাহেব হাফিযাহুল্লাহ বলেন, আমি তাবলীগের এই সঙ্কট র্দীঘ কয়েক বছর ধরে উপলব্দি করছি। দুই বছর পর্যন্ত সাথীদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি। অনেক সাথীর ঘরে গিয়েও বুঝানোর চেষ্টা করেছি। নিজামুদ্দিনে আটটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। আমি সেখানে বলেছিলাম। নেজামুদ্দিন যেন আলমী (বিশ্বব্যাপি) শুরা মেনে নেন। আকাবিরদের তরিকা অনুযায়ী নেজামুদ্দিন থেকে যেন কেবলমাত্র ফজায়েলের বয়ান হয়, মাসায়েল নয় ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয় র্দীঘ অপেক্ষার পর পরিস্থিতি নিয়তন্ত্রনের বাহিরে চলে যাচ্ছে। তাই, আমরা মূখ খুলতে বাধ্য হচ্ছি। কক্সবাজারে এক নওজোয়ান আমাদের সাথে তর্ক করার জন্য দাঁড়িয়ে গেল। এইগুলো তাবলীগের শিক্ষা নয়। ওলামায়ে কিরাম সবসময় তাবলীগের তত্ত্বাবধান করে আসছেন। পরমর্শ দিয়ে আসছেন। লেখা-লেখির মাধ্যমে তাবলীগের সহযোগিতা করে আসছেন। শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ. এক চিল্লাও লাগাননি। এমনকি তিনদিনও লাগাননি। তাবলীগে কি তাঁর কোন ভূমিকা নেই? ওলামায়ে কিরাম দীনের এক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ নিয়ে আছেন। যখন যাদের সুযোগ হয় তাঁরা বের হন। তাঁরা তো সাত-আট বছর বয়স থেকে নিয়ে দীনের জন্য গোটা জীবনকে উৎসর্গ করে আসছেন।
আমাদের কিছু কিছু ভাই বলছেন, ওলামায়ে কিরাম এই কাজকে দখল করতে চায়। আশ্চার্য! ওলামায়ে কিরামের বেশী বেশী অংশগ্রহণের জন্য আমরা কত চোখের পানি ফেলে থাকি। আজ সেই ওলামায়ে কিরাম যখন এই কাজের প্রতি ধাবিত হচ্ছেন তাতে আপনাদের অভিযোগ? তাহলে আপনারা নিজেদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব রক্ষা করার জন্যই তাবলীগ করে থাকেন? ওলামায়ে কিরাম এই কাজে এগিয়ে আসলে আপনাদের সেই কর্তৃত্ব চলে যাবে তাই তাদেরকে ভয় পান?
মনে রাখবেন, ওলামায়ে কিরাম এই ধরনের নের্তৃত্বের কখনো আশা করেন না। এ পর্যন্ত কোন আলেম কি বলেছেন যে, আমাকে ইজতিমায় বয়ান দিতে হবে? না, বলেন নি। বলবেনও না। তাহলে কেন ওলামায়ে কিরাম সম্পর্কে আপনাদের এই বিদ্বেষ? মনে হয় এর পিছনে রাশিয়ার চালিত সেই পুরানো ষড়যন্ত্র কাজ করছে। রাশিয়ায় আলেম সমাজ থেকে ওলামায়ে কিরামের সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমে ইসলামকে ধ্বংশ করা হয়েছিল। তাহলে আমরাও কি জেনে-না জেনে ইসলামকে ধ্বংশ করার কাজে নিমজ্জিত? এগুলো আমাদেরকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। অতি আবেগী না হয়ে বিবেককেও কিছুটা কাজে লাগাতে হবে।
কাকরাইল থেকে আগত মুরব্বি বলেন, এই মেহনত চালু হয় মাওলানা ইলিয়াছ রহ.-এর হাতে ১৯২৪ সনে। তখন থেকে নিয়ে ১৯৪৪ সন পর্যন্ত তিনিই এই মেহনতের যিম্মাদার ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় এবং তাঁর নির্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্য হতে হযরতজী মাওলানা ইউছুফ রহ.কে আমীর নিযুক্ত করা হয়। অতঃপর তিনি ১৯৬৫ সনে ইন্তিকাল করলে শায়খুল হাদিস মাওলানা যাকারিয়া রহ. হযরতজী মাওলানা ইনামুল হাসান রহ.কে আমীর নিযুক্ত করেন। ১৯৯৫ সনে তাঁর মৃত্যুর পর আলমী শুরার মাধ্যমে কাজ চলে। পরবর্তীতে ৪/৫ বছরের মধ্যে শুরার সদস্য ২জন ব্যতীত অন্যরা ইন্তিকাল করেন। পরে পাকিস্তানে হাজী আব্দুল ওয়াহ্হাব ও ইন্ডিয়ায় মাওলানা সাদ সাহেব অবশিষ্ট থাকেন। ইতিমধ্যে নেজামুদ্দিনের মুরব্বিদের পক্ষ থেকে মাওলানা সাদ সাহেবের ঐদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও সেচ্চাচারিতার অভিযোগ উঠে। তাই ২০১৫ সনে রাইবেন্ডের ইজতিমায় আলমী শুরার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা হয়। পরে আলমী শুরার সদস্যদের নাম নির্বাচন করা হয়। সেখানে পাকিস্তানের ৫জন, ইন্ডিয়ার ৫ জন ও বাংলাদেশের ৩ জন্ সর্বমোট ১৩ জন বিশিষ্ট শুরা গঠন করা হয়। তবে মাওলানা সাদ সাহেব ও বাংলাদেশের এক সদস্য ব্যতীত অন্য সকলেই তা মেনে নেন। এর পর থেকেই তাবলীগ জামাতে এই বিবেদ সৃষ্টি হয়।
ইতিমধ্যে দারুল উলুম দেওবন্দ মাওলানা সাদ সাহেবের অত্যুক্তি ও বাড়াবাড়ি এবং মনগড়া কথাবার্তা সম্পর্কে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করেন। অতঃপর মাওলানা সাদ সাহেব রুজু করে কয়েক দফা পত্র লিখেন। সেগুলো পাওয়ার পর দারুল উলুম দেওবন্দ সর্বশেষ নিজেদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। সেখানে বলা হয় মাওলানা সাদ সাহেব দারুল উলুমের নিকট আস্থাভাজন ব্যক্তি নন। এবং দারুল উলুম আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, মাওলানা সাদ সাহেবের এই ইজতিহাদী মনোভাব অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তাবলীগী জামাত একটি গুমরাহ ফিরকায় পরিণত হবে। তাই, আসুন আমরা কোন ব্যক্তির দাওয়াত না দিয়ে আল্লাহর দাওয়াত চালিয়ে যাই। আল্লাহ আমাদের সকলকে হিদায়তের পথে অবিচল রাখুন, আমীন।
পরিশেষে, দেশ ও উম্মার হিদায়ত কামনা করে জোড় সমাপ্ত করা হয়।
প্রকাশনায়- আন-নূর বিডি.কম
সংকলনে- মিযানুর রহমান জামীল
Leave Your Comments