#নাস্তিকদের_অভিযোগ_খণ্ডন–৫ [আগের পর্বগুলোর জন্য দেখুন #সত্যকথন_৮৭, #সত্যকথন_৮৮ ও #সত্যকথন_৯১ ]
.
#প্রাক_ইসলামিক_যুগে_আরবের_নারীরা_কি_বেশি_স্বাধীন_ছিল? (শেষ পর্ব)
.
সব থেকে বিশুদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থ কোরআন কারীমেও প্রাক ইসলামিক যুগে নারীদের অবস্থা সম্পর্কে বর্ণনা প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ্ তৎকালীন নারীদের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
وَإِذَا بُشِّرَ أَحَدُهُم بِالْأُنثَىٰ ظَلَّ وَجْهُهُ مُسْوَدًّا وَهُوَ كَظِيمٌ [١٦:٥٨] يَتَوَارَىٰ مِنَ الْقَوْمِ مِن سُوءِ مَا بُشِّرَ بِهِ ۚ أَيُمْسِكُهُ عَلَىٰ هُونٍ أَمْ يَدُسُّهُ فِي التُّرَابِ ۗ أَلَا سَاءَ مَا يَحْكُمُونَ [١٦:٥٩]
অর্থঃ “আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ প্রদান করা হয়; তখন তার চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দুঃখ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেয়া হয়েছে, তার গ্লানি হেতু সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্নগোপন করে। সে চিন্তা করে হীনতা সত্ত্বেও সে তাকে (কন্যাকে) রেখে দেবে না মাটিতে পুঁতে ফেলবে! সাবধান! তারা যা সিদ্ধান্ত নেয় তা কত নিকৃষ্ট”। (সূরা আন-নাহলঃ ৫৮-৫৯)
.
এই আয়াত আমাদেরকে অত্যন্ত পরিষ্কার করে দেখিয়ে দিচ্ছে যে, ইসলাম পূর্ব আরবের নারীরা কতটা অপমানিত হত। যে সমস্ত পিতাদের কন্যাসন্তান জন্মলাভ করত তারা লজ্জায় সমাজে মুখ লুকিয়ে বেড়াত। তাদের মনের মধ্যে ক্রোধ সৃষ্টি হত, এতটাই অপমানবোধ করতো যে কন্যাসন্তান কে রেখে দেবে নাকি মাটিতে পুতে ফেলবে তা নিয়ে ইতঃস্ততবোধ করতে থাকত। কেউ কেউ তাদের কন্যাসন্তানকে জীবিত মাটিতে দাফন করে দিত। কেননা কন্যা সন্তানকে তারা অপয়া মনে করত, তাদেরকে তারা সমাজের বোঝা মনে করত। আপনি যদি ইতিহাস গ্রন্থের দিকে তাকান তাহলেও এই ধরণের অসংখ্য উদাহরণ পাবেন। আমরা তার একটি ছোট্ট নমুনা আপনাদের সামনে পেশ করছি। “ইসলামের ইতিহাস” গ্রন্থে গ্রন্থকার লিখেন,
.
“বনী তামীম এবং কোরায়শদের মধ্যে কন্যা হত্যার সমধিক প্রচলন ছিল। তারা এজন্যে রীতিমত গর্ববোধ করতো এবং তাদের জন্যে সম্মানের প্রতীক বলে বিশ্বাস করতো। কোন কোন পরিবারে এ পাষণ্ডতা এতদূর পর্যন্ত গড়িয়েছিল যে, মেয়েরা যখন বেশ বড় হয়ে যেতো এবং মিষ্টি কথা বলতে শুরু করতো, তখন পাঁচ ছ’ বছর বয়সে তাকে সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত করে পিতা তাকে লোকালয়ের বাইরে নিয়ে যেতো। পাষণ্ড পিতারা পূর্বেই সেখানে গিয়ে গর্ত খুড়ে আসত এবং পরে মেয়েকে সেখানে নিয়ে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলে দিত। অবোধ মেয়ে তখন অসহায় অবস্থায় চীৎকার করে করে বাপের কাছে সাহায্য চাইতো, কিন্তু পাষণ্ড পিতা তার দিকে বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে ঢিল ছুড়ে ছুড়ে তাকে হত্যা করতো বা জীবন্ত মাটি চাপা দিয়ে নিজ হাতে কবর সমান করে দিয়ে নির্বিকারে ঘরে ফিরে আসতো এবং আপন কলিজার টুকরা সন্তানকে জীবন্ত প্রেথিত করার জন্য সে রীতিমত গর্ববোধ করতো। বনী তামীমের জৈনেক কায়স ইবন আসিম এভাবে একে একে তার দশটি কন্যাসন্তানকে জীবন্ত প্রেথিত করে। কন্যা হত্যার এ অমানুষিক বর্বরতা থেকে আরবের কোন কবীলাই মুক্ত ছিলো না। তবে কোন কোন এলাকা্র কবীলায় এটি অনেক বেশী হত, আবার কোন কোন কবীলায় তা কম হত”।
.
{নজিবাদী, আকবর শাহ খান, ইসলামের ইতিহাস, ১/৬৮; (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আগারগাও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা, ২য় সংস্করণ, জুন, ২০০৮)}।
.
এই হলো জাহেলী যুগের কন্যাশিশুদের উপর আরব জাতির করা নির্মম অত্যাচারের কিছু খণ্ডচিত্র। এবার চলুন হাদিস থেকে দেখি যে তাদের সময়ে সাধারন নারীদের কি ধরণের অত্যাচার করা হত। তাদের যৌন চাহিদা মেটাতে গিয়ে তারা নারীকে কিভাবে তাদের ভোগ্য পণে পরিণত করেছিল।
.
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সহধর্মিণী আয়েশা (রা) বলেছেনঃ জাহিলী যুগে চার প্রকারের বিয়ে প্রচলিত ছিল।
.
এক প্রকার হচ্ছে, বর্তমান যে ব্যবস্থা চলছে অর্থাৎ কোন ব্যক্তি কোন মহিলার অভিভাবকের নিকট তার অধীনস্থ মহিলা অথবা তার কন্যার জন্য বিবাহের প্রস্তাব দিবে এবং তার মোহর নির্ধারণের পর বিবাহ করবে।
.
দ্বিতীয়ত হচ্ছে, কোন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে মাসিক ঝতু থেকে মুক্ত হওয়ায় পর এই কথা বলত যে, তুমি অমুক ব্যক্তির কাছে যাও এবং তার সাথে যৌনমিলন কর। এরপর স্বামী তার নিজ স্ত্রী থেকে পৃথক থাকত এবং কখনো এক বিছানায় ঘুমাত না, যতক্ষণ না সে অন্য ব্যক্তির দ্বারা গর্ভবতী হত, যার সাথে যৌনমিলন করত। এটা ছিল তার স্বামীর অভ্যাস। এতে উদ্দেশ্য ছিল যাতে করে সে একটু উন্নত জাতের সন্তান লাভ করতে পারে। এ ধরণের বিবাহকে ‘নিকাহুল ইসতিবদা’ বলা হত।
.
তৃতীয় প্রথা ছিল যে, দশ জনের কম কতিপয় ব্যক্তি একত্রিত হয়ে পালাক্রমে একই মহিলার সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হত। যদি মহিলা এর ফলে গর্ভবতী হত এবং কোন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ায় পর কিছুদিন অতিবাহিত হত, সেই মহিলা এই সকল ব্যক্তিকে ডেকে পাঠাত এবং কেউই আসতে অস্বীকৃতি জানাতে পারত না। যখন সকলেই সেই মহিলার সামনে একত্রিত হত, তখন সে তাদের বলত তোমরা সকলেই জান- তোমরা কি করেছ! এখন আমি সন্তান প্রসব করেছি, সুতরাং হে অমুক! এটা তোমারই সন্তান! ঐ মহিলা যাকে খুশী তার নাম ধরে ডাকত, তখন এ ব্যক্তি উক্ত শিশুটিকে গ্রহণ করতে বাধ্য থাকত এবং ঐ মহিলা তার স্ত্রীরূপে গণ্য হত।
.
চতুর্থ প্রকারের বিবাহ হচ্ছে, বহু পুরুষ একই মহিলার সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হত এবং ঐ মহিলা তার কাছে যত পুরুষ আসত কাউকে শয্যাশায়ী করতে অস্বীকার করত না। এরা ছিল পতিতা, যার চিহ্ন হিসেবে নিজ ঘরের সামনে পতাকা উড়িয়ে রাখত। যে কেউ ইচ্ছা করলে এদের সাথে যৌনমিলনে লিপ্ত হতে পারত। যদি এই সকল মহিলাদের মধ্য থেকে কেউ গর্ভবতী হত এবং কোন সন্তান প্রসব করত তাহলে যৌনমিলনে লিপ্ত হওয়া সকল কাফাহ পুরুষ এবং একজন কাফাহ ( এমন একজন বিশেষজ্ঞ, যারা সন্তানের মুখ অথবা শরীরের কোন অঙ্গ দেখে বলতে পারত- অমুকের ঐরসজাত সন্তান)- কে ডেকে আনা হত সে সন্তানটির যে লোকটির এ সদৃশ্য দেখতে পেত তাকে বলতঃ এটি তোমার সন্তান। তখন ঐ লোকটি ঐ সন্তানকে নিজের হিসাবে গ্রহণ করতে বাধ্য হত এবং লোকে ঐ সন্তানকে তার সন্তান হিসাবে আখ্যা দিত এবং সে এই সন্তানকে অস্বীকার করতে পারত না। যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে সত্য দ্বীনসহ পাঠানো হল তখন তিনি জাহেলী যুগের সমস্ত বিবাহ প্রথাকে বাতিল করে দিলেন এবং বর্তমানে প্রচলিত শাদী ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিলেন”।
.
{বুখারী, মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল, আস-সহিহ, অধ্যায়ঃ কিতাবুন নিকাহ, ৮/৪৭৫১ ; (ইসলামিক ফাউন্ডেশন, আগারগাও, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা,একাদশ সংস্করণ, জুন-২০১৩)}।
.
এই হল জাহেলী সমাজের কিছুটা বাস্তব চিত্র। তৎকালীন আরব অভিজাত বংশের নারীদেরকেই কেবল মাত্র সম্মান করা হত, তাদের কথা সমাজে গৃহীত হত, তাদেরকে রক্ষায় যুদ্ধ হত, এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু অপরদিকে সমাজের সাধারণ স্তরের নারীদের ছিলনা কোন মর্যাদা, ছিলো না সমাজ স্বীকৃত কোন অধিকার, তাদেরকে বিচ্ছিন্ন রাখা হত সামাজিক সকল ধরণের কর্মকাণ্ড হতে। তাদের সাথে যেনা ব্যাভিচার করা জাহেলী সমাজের সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছিল। নিম্ন বংশীয় নারীরা কেবল মাত্র পুরুষের মনোরঞ্জনের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হত, তাদের কে পতিতা বানানো হত। অপরদিকে নারী দাসীদের অবস্থা আরও শোচনীয় ছিল। তাদের ছিলনা কোন সমাজ স্বীকৃত অধিকার, তাদের ছিল না কোন মর্যাদা, তাদের ছিল না কোন ধরণের প্রতিবাদ করার অধিকার। তাদের সাথে তাদের মালিকরা অনায়েসেই অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হতে পারত। সমাজের কেউ কিছুই বলতো না।
.
ব্যাভিচার এতটাই বিস্তৃত ছিল যে, সমাজের কোন স্তরের লোকেরাই এ থেকে মুক্ত ছিল না। অবশ্য কিছু সংখ্যক নারী পুরুষ (যাদের সংখ্যা নগণ্য) তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অহমিকার কারণে ব্যাভিচার থেকে বিরত থাকতো। জাহেলী যুগে একাধিক স্ত্রী রাখা দোষের কিছু ছিল না। দুই সহোদর বোনকে তারা একই সাথে বিয়ে করত। পিতার তালাক প্রাপ্তা স্ত্রী অথবা পিতার মৃত্যুর পর সন্তান তার সৎ মায়ের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতো। তালাকের উপর ছিল শুধুমাত্র পুরুষের একছত্র অধিকার। তাদের স্ত্রী গ্রহণ করার যেমন কোন সীমা ছিল না ( কেউ কেউ দশের অধিক বিয়ে করত), ঠিক তেমনি তাদের তালাকেরও কোন নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। যখন খুশি যাকে বিয়ে করত, যখন খুশি যাকে তালাক দিত এতে কোন নারী কোন ধরণের আপত্তি তুলতে পারতো না। তারা কোন ধরণের বিচার চাইতে পারতো না তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে।
.
{মুবারকপুরী, শফিউর রহমান, আর রাহীকুল মাখতুম, পৃষ্ঠাঃ ৬০-৬৪; আল কোরআন একাডেমী, লন্ডন, ২১ তম প্রকাশ, নভেম্বর, ২০১৩)}।
.
আরবের তৎকালীন ইতিহাস পাঠ করলে আমাদের সামনে অত্যন্ত সুস্পষ্ট রূপেই প্রতিয়মান হয় যে, তৎকালীন উচ্চ বংশীয় নারীরা ছাড়া, সমাজের অন্যান্য স্তরের নারীদের অবস্থা একেবারেই শোচনীয় ছিল। তাদের ছিল না কোন সমাজ স্বীকৃত অধিকার। ছিল না কোন সামাজিক মর্যাদা। তারা পুরুষের যৌন সামগ্রী হিসেবেই সমাজে বিবেচিত হত। সর্বোপরি নারীরা সে সমাজে মানুষ নয় বরং পুরুষের অধিকৃত সম্পত্তি এবং গৃহপালিত ছাগল ভেড়ার ন্যায় বিবেচিত হত।
.
কিন্তু ইসলাম আগমনের পড়ে তাদের এই ধরণের সকল অজ্ঞতা ও কুসংস্কার কে বাতিল বলে ঘোষণা করে। নারীদেরকে মানুষ হিসেবে পুরুষের সমান ঘোষণা করে। নারীদের কে ফিরিয়ে দেয় তাদের প্রাপ্য সম্মান, কন্যা শিশু হত্যাকে পাপের কাজ বলে ঘোষণা করে। ৪টির বেশী স্ত্রী রাখাকে হারাম করে দেয়। সমাজের নারী দাসীদের সাথে অবৈধ যৌন সম্পর্ক স্থাপন কে হারাম করে দেয়। নারীদের কে সম্পত্তিতে তার প্রাপ্য অধিকার প্রদান করে। মোটকথা একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে, মা হিসেবে, বোন হিসেবে তার প্রাপ্য ন্যায্য অধিকারকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে। প্রত্যেক পুরুষকে তার অধীনস্ত নারীদের রক্ষনাবেক্ষন করা, তাদের মাল ইজ্জজের হিফাযত করা, তাদের সাথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণ করা ইত্যাদিকে বাধ্যতামূলক করে দেয় ইসলাম। (ইনশাআল্লাহ বিস্তারিত আলোচনা সামনে আসবে)।
.
এ দাবি কেবল আমাদের নয়। অমুসলিমদের তৈরি এনসাইক্লোপিডিয়া “উইকিপিডিয়াতে” বলা হয়েছে,
“In 586 CE women were acknowledged to be human”
“৫৮৬ খৃষ্টাব্দে নারীদেরকে মানুষ বলে বিবেচনা করা হয়”
.
https://en.wikipedia.org/wiki/Women_in_pre-Islamic_Arabia
.
তাই ড. আজাদসহ নাস্তিকদেরকে আমরা বলতে চাই, আপনাদের কাছে প্রাক ইসলামিক আরবের কোন ইতিহাস বই থাকলে তা অধ্যয়ন করুন তারপর বিচার বিশ্লেষণ করে দেখুন যে কোন সমাজ নারীদেরকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদান করেছে। আর যদি সব কিছু জেনে শুনেও প্রাক ইসলামিক আরবের পক্ষে কলম ধরেন তো আমাদের আর এ কথা বুঝতে বাকি থাকে না যে, আপনারা নারীদেরকে কতটা নীচে নামিয়ে দিতে চান। আপনাদের উদ্দেশ্য নারী স্বাধীনতা নয় বরং স্বাধীনতা নামক ফাকা বুলির আড়ালে নারীদেরকে যৌন দাসী বানিয়ে উপভোগ করা, যেমনি প্রাক ইসলামিক যুগের আরব পুরুষরা করত।
.
বস্তুত একমাত্র মহান আল্লাহই সর্বজ্ঞানী।
.
#হুমায়ুন_আজাদ – ২
==========================
লেখকঃ জাকারিয়া মাসুদ [ফেসবুক id: Jakaria Masud]
.
Leave Your Comments