প্রতি বছর রমযান মাস আসলেই অনেকের মনে একটি প্রশ্ন জাগে যে, মুসলিমদের কেন আরবি হিজরী সাল অনুযায়ী রোযা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে? একইভাবে আরও একটি প্রশ্ন ওঠে যে, প্রতি বছরই রমজান মাসে কোনো কোনো জায়গার মানুষ মাত্র ১২-১৩ ঘণ্টা উপবাস, আবার কোনো কোনো জায়াগার মানুষকে ২০-২২ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হয়। মনে হতে পারে, এটা কি আল্লাহ তায়ালার তাঁর বান্দাদের উপর অবিচার নয়?
.
এখানে আমি আমার সীমিত জ্ঞানের সাহায্যে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি। আশা করি, জানাতে পারবো আল্লাহর অনুগ্রহ কতটা গভীর। যারা বুঝতে পারবেন, আমার মনে হয়, তারা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা হারিয়ে ফেলবেন। প্রকৃতপক্ষে এই বিষয়টি থেকেও আল্লাহর অস্তিত্ব অনুভব করা যায়। একজন আল্লাহ্ না থাকলে এটা কখনওই এত পরিকল্পিত হত না।
.
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় যে, যদি সৌরবছরের কোন নির্দিষ্ট মাসে রোযা রাখার নির্দেশ দেওয়া হত, তাহলে যে এলাকায় ওই সময় গ্রীষ্মকাল, সেখানকার লোকেদেরকে চিরকাল গ্রীষ্মকালেই রোযা রাখতে হত। আবার যে এলাকায় ওই মাসে শীতকাল, সেখানকার লোকেরা চিরকাল শীতকালেই রোযা রাখতেন।
হিজরি সাল অনুযায়ী রোযা পালন করার সুবিধা হল, এটি সৌরবছর থেকে ১১ দিন কম। যার ফলে রমযান মাস প্রতি বছর সৌরবছর (অর্থাৎ খ্রিস্টাব্দ) থেকে ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। ফলে একই এলাকায় বিভিন্ন ঋতুতে রমজান মাস হয় এবং একই এলাকার মানুষ বিভিন্ন ঋতুতে রোযা পালন করার সুযোগ পান।
এ বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে রমযান আরম্ভ হতে চলেছে। পরের বছর রমযান মাস ১১ দিন এগিয়ে আসবে। হিসেব করলে দেখা যাবে, ঠিক ৩৩ বছর পর আবার এই মে মাসের শেষ সপ্তাহেই রমজান শুরু হবে। অর্থাৎ, কোন ব্যক্তি যদি একনাগারে ৩৩ বছর রমজান মাসে রোযা রাখে, তাহলে সে সমস্ত ঋতুতে রোযা করার সুযোগ পাবে। আবার মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭৫ বছর। তাই ধরা যেতে পারে একজন মানুষ মোটামুটি ৬৫ বছর রোযা করে (জীবনের প্রথম ১০ বছর বাদ দেওয়া হল)। আবার যেহেতু ৩৩ বছর অন্তর একই ঋতুতে রমযান মাস আসে, তাই কোন ব্যক্তি (পরপর ৬৬ বছরে) ৬৬টি রমযানে রোযা করলে ওই ব্যক্তি সারাজীবনে (একই জায়গায় থাকলে) একই ঋতুতে ২ বার রোযা করার সুযোগ পাবেন। অর্থাৎ, গ্রীষ্মকালে ২ বার, শীতকালে ২ বার, বর্ষাকালে ২ বার রমযান পাবেন। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে, চান্দ্রবছর অনুযায়ী রোযা রাখার নির্দেশের ফলে মানুষের যে সুবিধা হয়েছে ও সারা বিশ্বের মানুষের উপর যে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে, সৌরবছর অনুযায়ী রোযা রাখার নির্দেশ দিলে তা কোনভাবেই সম্ভব হত না।
.
দ্বিতীয় আরেকটি যে প্রশ্ন ওঠে, তা হল, এবছর উত্তর ভারত, বাংলাদেশসহ কর্কটক্রান্তি রেখার কাছে অবস্থিত এলাকার লোকেরা মোটামুটি ১৫ ঘণ্টা উপবাস থাকেন। সেক্ষেত্রে, আইসল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ডেনমার্ক, নরওয়ের মত দেশের মানুষরা প্রায় ২০-২২ ঘণ্টা উপবাস থাকতে হয়! স্বাভাবিকভাবেই অনেকের মনে প্রশ্ন উঠছে যে, এটা কি আল্লাহতায়ালার তাঁর বান্দাদের উপর অবিচার নয়?
কিন্তু, হিসেব করলে দেখা যাবে, এটিও আল্লাহতায়ালার অবিচার নয়। বরং ন্যায় বিচারের আরেকটি দৃষ্টান্ত। নীচের আলোচনায় দেখা যাবে, প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর সবাই গড় হিসেবে একই পরিমাণ সময় উপবাস থাকে।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, পৃথিবী সাড়ে তেইশ ডিগ্রি (23½°) হেলে সূর্যকে প্রদক্ষিন করে। আবার পৃথিবীর কক্ষপথ সম্পূর্ণ গোলাকার নয়, অনেকটা ডিম্বাকৃতি। যার ফলে ঋতু পরিবর্তন হয়। আবার পৃথিবী গোলাকৃতি হওয়ায় ও 23½° হেলে থাকায় পৃথিবীর সব জায়গায় দিনরাত্রির পরিমাণ সমান নয়, বিভিন্ন অঞ্চলের উষ্ণতাও আলাদা, এমনকি ঋতু পরিবর্তনও একই সময়ে হয় না। উত্তর গোলার্ধে যখন শীতকাল, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল। আবার দক্ষিণ গোলার্ধে যখন শীতকাল, উত্তর গোলার্ধে তখন গ্রীষ্মকাল। ২১শে জুন উত্তর গোলার্ধের সর্বত্র দিন সবচেয়ে বড় হয়। অন্যদিকে ওই দিনে দক্ষিণ গোলার্ধে দিন সর্বত্র ছোট হয়। আবার ২২শে ডিসেম্বর দক্ষিণ গোলার্ধে দিন সবচেয়ে বড় হয়, কিন্তু উত্তর গোলার্ধে দিন সবচেয়ে ছোট হয়। কিন্তু হিসেব করলে দেখা যাবে, সারা বছরের গড় হিসেবে পৃথিবীর সর্বত্র দিনরাত্রির পরিমাণ প্রায় সমান।
নীচে কলকাতা, লন্ডন, আফ্রিকার কাম্পালা ও দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের দিনের সময়ের তথা উপবাস থাকা সময়ের হিসেব দেওয়া হল।
.
কলকাতাঃ কলকাতার অবস্থান ২২°৩৪´উত্তর, ৮৮°২২´পূর্ব। কলকাতায় ২১শে জুন সূর্যোদয় শুরু হয় ৩টা ২৫ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৬টা ২৭ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের সময় ১৫ ঘণ্টা ২ মিনিট। আবার ২২শে ডিসেম্বর সূর্যোদয় শুরু হয় ৪টা ৫২ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৫টা ১মিনিটে। অর্থাৎ, দিনের পরিমাণ ১২ ঘণ্টা ৯ মিনিট। সুতরাং সারাবছরের দিনের গড় সময় ১৩ ঘণ্টা ৩৫ মিনিট।
.
ঢাকাঃ ঢাকার অবস্থান ২৩°৪২´ উত্তর, ৯০°২২´পূর্ব। ঢাকায় ২১শে জুন সূর্যোদয় শুরু হয় ৩টা ৪৫ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৬টা ৪৮ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের সময় ১৫ ঘণ্টা ৩ মিনিট। আবার ২২শে ডিসেম্বর সূর্যোদয় শুরু হয় ৫টা ১৭ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৫টা ১৬ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের সময় প্রায় ১২ ঘণ্টা। অর্থাৎ, সারাবছরের দিনের গড় সময়ের পরিমাণ প্রায় ১৩ ঘণ্টা ৩১ মিনিট।
.
লন্ডনঃ লন্ডনের অবস্থান ৫১°৩০´উত্তর, ০°৭´৩৯ˮ পশ্চিম। লন্ডনে ২১শে জুন সূর্যোদয় শুরু হয় ২টা ৪৪ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৯টা ২৫ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের পরিমাণ ১৮ ঘণ্টা ৪১ মিনিট। আবার ২২শে ডিসেম্বর সূর্যোদয় শুরু হয় ৬টা ২৩ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৩টা ৫৭ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের পরিমাণ মাত্র ৯ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট। সারাবছরের দিনের গড় সময় ১৪ ঘণ্টা ৭ মিনিট।
.
কাম্পালাঃ আফ্রিকার উগান্ডার রাজধানী কাম্পালা। কাম্পালা নিরক্ষরেখার খুব কাছে অবস্থিত। এর অবস্থান ০°১৯´উত্তর, ৩৩°৩৫ পূর্ব। নিরক্ষরেখার কাছে অবস্থিত হওয়ায় কাম্পালায় সারা বছর প্রায় একই সময়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়। এখানে ২১শে জুন সূর্যোদয় শুরু হয় ৫টা ৩১ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৬টা ৫৯ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের´গড় সময় ১৩ ঘণ্টা ২৮ মিনিট। ২২শে ডিসেম্বর সূর্যোদয় শুরু হয় ৫টা ২৯ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৬টা ৫৪ মিনিটে। অর্থাৎ দিনের সময় ১৩ ঘণ্টা ২৫ মিনিট। সুতরাং সারাবছরের দিনের গড় সময়ের পরিমাণ ১৩ ঘণ্টা ২৬ মিনিট (প্রায়)।
.
কেপটাউনঃ কেপটাউন দক্ষিণ আফ্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর। এর অবস্থান ৩৩°৫৫´ দক্ষিণ, ১৮°২৫´পূর্ব। এখানে ২১শে জুন সূর্যোদয় শুরু হয় ৬টা ২১ মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৫টা ৪৮মিনিটে। অর্থাৎ দিনের গড় সময় ১১ ঘণ্টা ২৭ মিনিট। ২২শে ডিসেম্বর সূর্যোদয় শুরু হয় ৩টা ৪৫মিনিটে এবং সূর্যাস্ত হয় ৪টায়। অর্থাৎ দিনের সময়। অর্থাৎ সারা বছরের দিনের গড় সময় ১৩ ঘণ্টা ৫০ মিনিট।
.
উপরিউক্ত হিসেবগুলি থেকে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের প্রায় সব জায়গায় সারাবছরের দিনের গড় সময় প্রায় সমান। সব জায়গায় দিনের গড় পরিয়ামাণ সাড়ে তের ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘণ্টার মধ্যে। সবা জায়গায় উপবাস থাকার গড় সময় সাড়ে তের থেকে ১৪ ঘন্টা। অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোন জায়গার মানুষ যদি (প্রথম ১০ বছর বাদ দিয়েও) সারাজীবন রমজান মাসের ৩০ দিন রোযা রাখে, তাহলে সারাবিশ্বের সব মানুষই প্রায় সমান পরিমাণ সময় রোযা থাকে।
.
তাছাড়া, যেসব এলাকার মানুষরা (যেমন আইসল্যান্ড, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, উত্তর রাশিয়া) এবছর ২১ ঘণ্টা উপবাস থাকছেন, তাঁরা ৩৩ বছর পর মাত্র ৮ ঘণ্টা উপবাস থাকবেন। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, নিরক্ষীয় অঞ্চলে দিনের গড় সময় সাড়ে তের ঘণ্টা। কিন্তু ব্রিটেন, জাপান, কানাডার মত দেশগুলিতে এই গড় একটু বেশী। প্রায় ১৪ ঘণ্টা।
.
তৃতীয় আরেকটি প্রশ্ন অনেকেই করেন যে, আফ্রিকার (এবং ভারত-বাংলাদেশেরও) অনেকেই প্রচণ্ড গরমে অনেক কষ্ট করে রোযা রাখেন। এমন কি সাহারা মরুভূমির কোন দেশ থেকে এব্যাপারে আরবের শায়খদের কাছে মাসয়ালা জানতে চেয়ে প্রশ্ন এসেছে যে, এই অত্যধিক গরমেও তাদের উপর রোযা থাকা ফরয নাকি কোন ছাড় আছে!! শায়খরা এর জবাবে বলেছেন, রোযা প্রত্যেকের উপর ফরয। কোন ছাড় নেই। তবে মৃত্যুর আশংকা থাকলে প্রাণ বাঁচাতে যতটুকু দরকার, ততটুক জল পান করা যেতে পারে।
বাস্তবিক পক্ষেই নিরক্ষীয় অঞ্চলগুলিতে সারাবছর অত্যন্ত গরম থাকে। ০° থেকে ২৩.৫° উত্তর ও দক্ষিনে গড় তাপমাত্রা থাকে ২৭° সেলসিয়াসেরও বেশী, এমনকি আফ্রিকার কোন কোন এলাকায় ৫০° সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠে যায়।। ২৩.৫° উত্তর/দক্ষিন অক্ষাংশ থেকে ৬৬.৫° উত্তর/দক্ষিন অক্ষাংশে গড় তাপমাত্রা থাকে ০°-২৭° সেলসিয়াস। ৬৬.৫° উত্তর/দক্ষিন অক্ষাংশ থেকে ৯০° উত্তর/দক্ষিন অক্ষাংশে তাপমাত্রা ০° সেলসিয়াসেরও নীচে থাকে।
.
স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে যে, ৬৬.৫° উত্তর/দক্ষিন অক্ষাংশের কাছে অবস্থিত এলাকার মানুষেরা মনোরম আবহাওয়ায় রোযা রাখতে পারেন, যার ফলে তাদের কষ্ট অনেক কম হয়। কিন্তু বাস্তবেই কি তাই? গ্রীষ্মকালে এই এলাকার মানুষদের প্রায় ২০ ঘণ্টা রোযা থাকতে হয়, যা অত্যন্ত দীর্ঘ সময়। কিন্তু নিরক্ষরেখার নিকটবর্তী মানুষদের এতো দীর্ঘ সময় রোযা থাকতে হয় না।
অতএব, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহতায়ালা কারো উপরই কোনোরকম অবিচার করেন নি। নিরক্ষীয় এলাকার লোকেরা প্রতিবছর অত্যধিক গরমে উপবাস থাকেন, কিন্তু প্রতিবছর তাদের প্রায় একই পরিমাণ সময় উপবাস থাকতে হয়। অন্যদিকে সুমেরু কিংবা কুমেরু এলাকার লোকেরা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় রোযা থাকলেও কোন কোন বছর তাদের অনেক দীর্ঘ সময় (২০-২২ ঘণ্টা) উপবাস থাকতে হয়, যা অত্যন্ত কষ্টকর। প্রকৃতপক্ষে সময় ও তাপমাত্রার এই সুষম বণ্টনের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার তাঁর বান্দাদের উপর অনুগ্রহ ও ন্যায়বিচারই ফুটে ওঠে। কে জানে, হয়ত আল্লাহতায়ালা মানুষের রোযা রাখার সুবিধার্থেই পরিকল্পনা করেই পৃথিবীকে ২৩.৫° কোণে হেলে পরিচালিত করছেন! যেমন, আল্লাহ্ বলেন-
.
“আল্লাহ্ উত্তম পরিকল্পনাকারী।” (সূরা আনফালঃ৩০)
“আল্লাহ্ কি বিচারকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিচারক নন?” (সূরা ত্বীনঃ৪)
“অতএব তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” (সূরা আর-রহমান)
.
পৃথিবীর ২৩.৫° হেলে থাকার আর কোন উপকারিতা দেখতে পাওয়া যায় না। আর পৃথিবী যদি হেলে না থাকতো, তাহলে সময়ের এরকম সুষম বণ্টন সম্ভব হত না। এর ফলে চিরকাল রমযান মাসে মেরু অঞ্চলের বাসিন্দারা কম সময় উপবাস থাকতো, অন্যদিকে নিরক্ষীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের অত্যধিক গরমের মধ্যেও অনেক বেশী সময় উপবাস থাকতে হত। এজন্যই হয়ত আল্লাহতায়ালা জ্ঞানীদের উদ্দ্যেশ্যে বলেছেন,
“আল্লাহর সৃষ্টিজগতে জ্ঞানবানদের জন্য নিদর্শন আছে।” (সূরা আল-বাক্বারাঃ আয়াত-১৬৪)
“আমি রাতকে ও দিনকে দুটো নিদর্শন করেছি।” (সূরা বনী ইসরাইলঃ আয়াত-১২)
“নিশ্চয় নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে মুমিনদের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে। দিবারাত্রির পরিবর্তনে…বুদ্ধিমানদের জন্য নিদর্শনাবলী রয়েছে”। (সূরা আল-জাসিয়াঃ আয়াত ৩-৫)
সুতরাং, এ থেকে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করা উচিত। কিন্তু এরপরেও কিছু ব্যক্তি আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে। রোজাদারদের উপর আল্লাহর এই ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করবে। অনেকেই পৃথিবীর দিন-রাত্রি নিয়ে চিন্তা করবে এবং সত্যের কাছে পৌঁছাবে কিন্তু নিজেরদের গোঁড়ামির কারণে তা সত্ত্বেও আল্লাহ্কে স্বীকার করবে না, আল্লাহর নিদর্শনাবলীকে স্বীকার করবে না। আল্লাহ্ সবাইকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন।
.
এখানে আরেকটি প্রাসঙ্গিক ব্যাপারে সংক্ষেপে আলোচনা করা হচ্ছে্। তা হল, যেসব এলাকায় স্বাভাবিক নিয়মে সূর্য উদয় হয় না বা অস্ত যায় না, সেখানকার মানুষ কি করবে?
সুমেরু বৃত্তরেখার উত্তরে অবস্থিত নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, সুইডেনের মতো দেশগুলির দক্ষিণ অংশে স্বাভাবিক নিয়মে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত হলেও উত্তর অংশের এলাকাগুলিতে গ্রীষ্মকালে সূর্য অনেকদিন অস্ত যায় না, তখন ওইসব এলাকায় দীর্ঘদিন দিনের মতো আলো ঝলমল করে; আবার শীতকালে সূর্য অনেকদিন ওঠে না, তখন ওই এলাকায় দীর্ঘদিন অন্ধকার থাকে। এরকমই একটি এলাকা হল ফিনল্যান্ডের উতসিয়োকি, যেখানে গত ১৫ই মে ১টা ৩২ মিনিটে সূর্যোদয় হয় এবং সূর্যাস্ত হবে আগামি ২৯শে জুলাই,১২টা ৪২ মিনিটে। অর্থাৎ রমযান মাসে সূর্য আর অস্ত যাবে না! যার কারণে এইসব এলাকার মুসলিমরা সেহরি ও ইফতারের সময়ের বিভিন্ন নিয়ম মেনে চলেন। যেমন, কেউ কেউ মক্কার সময় অনুযায়ী রোযা রাখেন। এদের যুক্তি মক্কা হল মুসলিমদের প্রধান কেন্দ্র। আবার কেউ কেউ নিকটবর্তী যেসব এলাকায় স্বাভাবিক নিয়মে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হয়, সেখানকার সময় অনুযায়ী রোযা রাখেন। আবার কেউ কেউ রাজধানী শহরগুলির সময় মেনে চলেন। আবার ফিনল্যান্ডের উত্তরের কিছু সংখ্যক মানুষ তুরস্কের সময় অনুযায়ী রোযা রাখেন। এদের যুক্তি তুরস্ক হল এইসব এলাকার সবথেকে কাছের মুসলিম দেশ। প্রকৃতপক্ষে, প্রত্যেক গোষ্ঠীরই নিজেদের নিয়মের সপক্ষে উপযুক্ত যুক্তি আছে। তবে এব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, ইসলাম একটি সহজ-সরল জীবনব্যবস্থা। এতে মানুষের জন্য কঠিন কোন নিয়ম রাখা হয় নি। আর রোযার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র দীর্ঘ সময় কষ্ট করে উপবাস থাকা নয়। তাই সবার মতে, এইসব এলাকায় রোযা রাখার সময় ব্যক্তিবিশেষের উপর নির্ভর করে। উল্লেখ্য এইসব উপরিউক্ত দেশগুলির উত্তর অংশে কয়েক দশক আগে মুসলিম সংখ্যা না থাকলেও বর্তমানে অনেকেই এখানকার বিভিন্ন খনিতে কাজ করেন। এছাড়া ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশের অনেক শরণার্থী এই এলাকাগুলিতে আশ্রয় নিয়েছে।
.
এ তো গেল উত্তর মেরুর কথা। দক্ষিণ মেরুতে কি হবে? দক্ষিণ মেরুর অ্যান্টার্কটিকা হল এমন একটি মহাদেশ যার প্রায় পুরো এলাকাতেই ৬ মাস দিন ও ৬ মাস রাত। যার কারণে এখানেও স্বাভাবিক নিয়মে রোযা রাখা অসম্ভব। উল্লেখ্য, এখানে কোন স্থায়ী বাসিন্দা নেই। কিন্তু গবেষণার কারণে অনেকে অবস্থান করেন। অনেকের মতে এখানে যারা থাকেন তাদের নিকটবর্তী অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ডের সময় মেনে রোযা থাকা উচিত। তবে ১৯৮৯ সালে সৌদি আরবের গবেষক ডাঃ ইব্রাহিম এ আলম ও আরও কয়েকজন অ্যান্টার্কটিকায় গেলে তাঁরা মক্কার সময় অনুযায়ী নামায পড়েন। সম্ভবত অ্যান্টার্কটিকাতে তাঁরাই প্রথম নামায পড়েন। আমার মতে, এখানে মক্কার সময়ানুযায়ী নামায ও রোযা করাই সুবিধাজনক। কেননা নিউজিল্যান্ড কিংবা অস্ট্রেলিয়ায় শীত ও গ্রীষ্মের সময়ের পার্থক্য অনেক। নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে শীত ও গ্রীষ্মের সময়ের পার্থক্য প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা। যার ফলে কোন ব্যক্তি গ্রীষ্মকালে অ্যান্টার্কটিকায় গেলে তাঁকে অনেক দীর্ঘসময় উপবাস থাকতে হবে কিন্তু কোন ব্যক্তি শীতকালে এখানে গেলে তাঁকে অনেক কম সময় উপবাস থাকতে হবে। অন্যদিকে মক্কার সময় অনুযায়ী রোযা থাকলে প্রায় সারাবছরই একই পরিমাণ সময় উপবাস থাকতে হবে। কেননা মক্কায় গ্রীষ্মকালে (২১ শে জুন) দিন ১৪ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট ও শীতকালে (২২শে ডিসেম্বর) দিন ১২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট।
.
তবে, উত্তর মেরু হোক কিংবা দক্ষিণ মেরু হোক, এইসব এলাকার মানুষরা যদি সারা জীবন বিশ্বের “যে কোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা”র সময় অনুযায়ী রোযা রাখেন, অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়া হোক কিংবা মক্কা কিংবা তুরস্কের সময় অনুযায়ী রোযা রাখেন, তাহলে এখানেও দেখা যাবে তারা গড় সময় (সাড়ে তের ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘণ্টা) অনুযায়ীই রোযা রাখেন। এব্যাপারেও দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টির সেরা মানবাজাতীর উপর আল্লাহ্ কোনরকম অবিচার করেননি। তাই বিশ্বের প্রতিটি জায়গার সব মানুষ সারাজীবন রোযা রাখলে আসলে তাঁরা প্রত্যেকেই সমান পরিমাণ সময় (গড়ে সাড়ে তের ঘণ্টা থেকে ১৪ ঘণ্টা) রোযা বা উপবাস থাকেন। তাই গরম দেশের মানুষ যারা অত্যধিক গরমে রোযা রাখছেন তাদের ভাবা উচিত উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরুর কাছে অবস্থিত দেশগুলির মানুষের কথা, যারা দীর্ঘ ২০-২২ ঘণ্টা রোযা রাখেন। আবার যারা উত্তর কিংবা দক্ষিণ মেরুর কাছে বসবাস করছেন, তাদের ভাবা উচিত নিরক্ষীয় দেশগুলির মানুষদের কথা, যারা অত্যধিক গরমে রোযা রাখেন। পরিশেষে একথাই বলবো যে, এখানে সময় ও তাপমাত্রার যে সুষম বণ্টনের কথা আলোচনা হল, তার জন্য প্রত্যেক মুমিনেরই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
.
===
লেখকঃ আলী মোস্তাফা (ভারত) [ফেসবুক id: Ali Mostafa]
#সত্যকথন
.
তথ্যসূত্রঃ
সুর্যোদয়, সূর্যাস্তের সময়সূচী নেওয়া হয়েছে, www.sunrise-and-sunset.com, www.islamicacademy.org, www.islamicfinder.com থেকে। অন্যান্য তথ্য www.wikipedia.com ও অন্যান্য ওয়েবসাইট থেকে।
Leave Your Comments