বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের ‘নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন’ বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওয়াশিংটন থেকে প্রকাশিত ‘দি নিউইয়র্ক টাইমস’ ‘ছাত্র বিক্ষোভ সরকারের জন্য বিব্রতকর’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এই পত্রিকার প্রতিবেদনে গতকাল বলা হয়, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে ছাত্রবিক্ষোভ সরকারের জন্য একটি বিব্রতকর অবস্থা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল ছাত্রদের এই বিক্ষোভের জন্য প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও এর প্রধান মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করছে। বলা হচ্ছে, এ দুটি দল তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করছে।
এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ঢাকায় হাজারো ছাত্রদের বিক্ষোভকে ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়েছে। তাদেরকে লাঠিপেটা করেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় মিডিয়ার রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভকারী ছাত্রদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায় পুলিশ।
এ সময় এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে অনেকে আহত হয়েছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, স্কুলের পোশাক পরে কিছু ‘ক্রিমিনাল’ সহিংসতায় যোগ দিয়েছে। তবে হামলার জন্য ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনকে দায়ী করেছে বেশির ভাগ বিক্ষোভকারী। এসব সংঘর্ষের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করেছে টেলিভিশন স্টেশনগুলো। তাতে দেখা যায়, বিক্ষোভকারী ছাত্ররা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছুঁড়ছে।
দেশের অন্য এলাকা থেকে বাস কোম্পানিগুলো ঢাকায় প্রবেশ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। এতে রাজধানী ঢাকা ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের অন্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে বাস হলো মূল চলাচলের মাধ্যম। এখানে রেলে প্রচন্ড ভিড় হয়। আর বেশির ভাগ মানুষের প্রাইভেট কার কেনার সামর্থ নেই। বাস কোম্পানিগুলোর মালিক ও শ্রমিকরা বলেছেন, কয়েক ডজন বাস ভাঙচুর করা হয়েছে ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে। আগুন দেয়া হয়েছে। তাই তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাস চালাবেন না।
গত শনিবারের সংঘর্ষকালে ঘটনাস্থলে ছিলেন এপি’র এক সাংবাদিক। তিনি বলেছেন, কিছু সাংবাদিকসহ অনেক মানুষ ওই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন। দ্য ডেইলি স্টার খবর প্রকাশ করেছে যে, এতে আহত হয়েছে ২৫ জন। তবে অন্য সংবাদ মাধ্যম এ সংখ্যা আরো বেশি বলে উল্লেখ করেছে।
দুটি বাসের বেপরোয়া গতির কারণে কলেজ পড়ুয়া দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। এরপরই গত সপ্তাহের রোববার থেকে বিক্ষোভ প্রতিবাদে উন্মাতাল হয়ে ওঠে ঢাকা। তারা প্রায় এক কোটি মানুষের শহর ঢাকাকে অচল করে দেয়। যে দুটি বাস যাত্রী ধরার জন্য ওই সময় পাল্লা দিচ্ছিল, তাতেই ওই দুই শিক্ষার্থী মারা যান। এমন প্রতিযোগিতা ও মৃত্যুর ঘটনা ঢাকা শহরে নিয়মিতই ঘটে থাকে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রদের এই বিক্ষোভে সমর্থন দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের দাবি যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে এবং তা দফায় দফায় পূরণ করা হবে।
বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাংলাদেশে নিরাপদ সড়ক দাবি করছে। এ খাতটি দুর্নীতিতে সয়লাব। এ খাতে রয়েছে লাইসেন্সবিহীন চালক ও রেজিস্ট্রিবিহীন যানবাহন। এ চিত্র ঢাকার একটি সাধারণ ঘটনা। প্রতি বছর দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ১২০০০ মানুষ মারা যান। এর জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ও ট্রাফিক আইন প্রয়োগে শিথিলতা।
রোববার আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, দূর্বৃত্তরা অনেক সাংবাদিককে পিটিয়েছে এবং তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। চলমান আন্দোলন নিয়ে এদিন প্রথমবারের মতো সরাসরি কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি সকল অভিভাবক ও বাবা-মাকে অনুরোধ করব, তারা যাতে তাদের সন্তানদের ঘরে ফিরিয়ে নেয়। তারা যা করেছে, সেটি যথেষ্ট। আমাদের পুলিশ রাস্তায় শৃঙ্খলা আনতে সপ্তাহব্যাপী পদক্ষেপ শুরু করেছে।’
প্রতিবেদনে দেশজুড়ে দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার প্রসঙ্গটি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কর্তৃপক্ষ মোবাইল অপােরেটরগুলোকে ২৪ ঘণ্টার জন্য থ্রিজি ও ফোরজি মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের দিকে রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়েছে।
মোহাম্মদ আতিকুর রহমান নামের এক আন্দোলনকারী ডিপিএ নিউজ অ্যাজেন্সিকে বলেন, শিক্ষার্থীরা রোববার শান্তিপূর্ণ মিছিল করছিল। কিন্তু পুলিশ হঠাৎ করে তাদের দিকে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, দূর্বৃত্তরা অনেক সাংবাদিককে পিটিয়েছে এবং তাদের ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। ৪ জুলাই, শনিবার ঢাকার জিগাতলায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সংবাদও গুরুত্ব পায় বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতে।
এবিসি নিউজের খবরে ৪ জুলাইয়ের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে, ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় পুলিশ ও সরকার সমর্থক কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিচার্জ করেছে এবং কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করেছে। এতে অনেক শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। বার্তা সংস্থা এপির একজন সাংবাদিকের বরাত দিয়ে বলা হয়, এ সংঘর্ষে কয়েকজন সাংবাদিকও আহত হয়েছেন।
প্রায় একই তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে এপি।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের খবরে বলা হয়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সহিংতায় রূপ পেয়েছে। জিগাতলা এলাকায় পুলিশ ও সরকার সমর্থক কর্মীদের হামলায় বেশ কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়েছে এবং তাদের অনেকে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। শনিবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার তথ্য জানাচ্ছে টেলিগ্রাফ। সংবাদমাধ্যমটির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পরিবহন খাত ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, ভয়াবহ এবং অনিয়ন্ত্রিত বলে মনে করা হয়। জিগাতলায় সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের দিকে রাবার বুলেট ছুঁড়েছে বলে টেলিগ্রাফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে পুলিশের মুখপাত্র মাসুদুর রহমান এ দাবি অস্বীকার করেছেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
শনিবারের জিগাতলার ঘটনায় কতজন আহত হয়েছেন, তার একটি চিত্র তুলে ধরেছে টেলিগ্রাফ। হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ওয়াডের্র একজন ডাক্তার আব্দুস সাব্বির বলেন, ‘আমরা বিকেল থেকে ১১৫ জনকে চিকিৎসা দিয়েছি। আহতরা অনেকেই রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়েছেন। কয়েকজনের অবস্থা ছিল গুরুতর।’
বিবিসি ও সিএনএন শনিবারের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনাকে গুরুত্ব দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্থান টাইমসের খবরেও শনিবারের সংঘর্ষে ১১৫ জনের আহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটের গাড়িবহরে হামলার খবর প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এএনআই।
Leave Your Comments