সত্যবাদী রাসূল ﷺ
.
মদিনা সেদিন ধূলিধূসর, মলিন। কিছুক্ষণ আগে ছোট্ট শিশু ইবরাহিম দুনিয়া ছেড়ে তার রব্বের কাছে চলে গেছে। এখনও পিতা স্বয়ং রাসূলুল্লাহর ﷺ কোলেই আছে সে। শুধু ছোট্ট উষ্ণ দেহটা শীতল হয়েছে, হৃৎস্পন্দন থেমে গেছে। তীব্র আবেগ কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ছে।
.
অশ্রুসিক্ত নয়নে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, কণ্ঠ জড়িয়ে যায়। এমতাবস্থায়ও পিতা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলে উঠলেন, “ওহে ইবরাহিম! আমরা তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারি না। তোমার পিতার তো কেবল চোখের অশ্রু ঝড়ে আর তাঁর হৃদয় তোমার মৃত্যুতে শোকার্ত হয়। তবুও আমি যে এমন কিছুই বলব না যা কিনা আল্লাহর রাগকে আমন্ত্রণ জানাবে। আমরাও যে পরবর্তীতে তোমার অনুসরণ করব (অর্থাৎ মৃত্যুবরণ করব) এবিষয় যদি আল্লাহর পক্ষ থেকে নিশ্চিত সত্য ও ওয়াদাস্বরূপ না হতো, তবে নিশ্চয়ই আমি তোমার এই বিদায়ের সময় আরও বেশি কাঁদতাম ও শোকার্ত হতাম।” [১]
.
মদিনার শিশুদের সবচেয়ে কাছের মানুষটি ছিলেন যিনি, যাকে শিশুরা দেখলে জড়িয়ে ধরতো পরম আনন্দে, শিশুমনের সবকথা একমাত্র যে মানুষটির কাছে ভরসা করে অনায়াসে বলা যেত – সেই মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ নিজ শিশুপুত্রের মৃত্যু হল। আদর করে মুসলিম জাহানের পিতা ও আল্লাহর বন্ধু ইবরাহিমের (আলাইহিস সালাম) নামানুসারে পুত্রের নাম রেখেছিলেন ইবরাহিম।
.
প্রিয়নেতার কষ্ট মদিনাবাসীর মধ্যেও প্রবল, স্পষ্ট। আম্বিয়াদের (আলাইহিস সালাম) তো আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন সবচেয়ে ভালবাসেন, তাই তাঁদের জন্যই কঠিনতম পরীক্ষাগুলো ছিল সবসময় – এই ঘটনা সেকথাই যেন আরেকবার মনে করিয়ে দিল। কিন্তু একি! আকাশটা তো সকাল থেকে ঠিকই ছিল। এখন বেলা না পড়তেই কেমন অন্ধকার হয়ে আসছে যে! দেখতে দেখতেই সূর্যটা ঢেকে যাচ্ছে, অন্ধকার নেমে আসছে জমিনে!
.
গ্রহণের শুরু থেকেই গুঞ্জন শুরু হয়েছিল… মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ ছেলের মৃত্যুতেই প্রকৃতি এমন শোক প্রকাশ করছে। তিনি তো আল্লাহর নবী! সুতরাং তাঁর ছেলের মৃত্যুতে প্রকৃতির শোক প্রকাশ তো অতিস্বাভাবিক। সে গুঞ্জন কান এড়ায় নি তাঁর ﷺ. কিন্তু সদ্যপুত্রহারা মুহ্যমান রাসূলুল্লাহ ﷺ কিছু বললেন না, সূর্যগ্রহণ শুরু হতেই মাসজিদে প্রবেশ করলেন। গ্রহণ শেষ হওয়া অবধি চার রুকু আর চার সিজদাহ সহ দু’ রাকাআত সলাত আদায় করালেন।
.
গ্রহণ শেষ হয়ে এলে সলাত আদায়ও শেষ হল। এরপর তিনি ﷺ লোকেদের উদ্দেশ্যে বললেন, “সূর্য এবং চন্দ্র হল আল্লাহর নিদর্শনগুলোর মধ্যে দু’টি নিদর্শন। এদের গ্রহণ কারও মৃত্যুর কারণে হয় না। তাই যখন কোনো গ্রহণের ঘটনা হয় তখন তোমরা সলাত আদায় করো এবং আল্লাহকে ডাকতে থাক, যতক্ষণ না গ্রহণ সমাপ্ত হয়ে যায়।” মদিনাবাসীর ভুল ধারণার অবসান হল। [২]
.
.
এই ছিল রাসূলুল্লাহর ﷺ জীবদ্দশায় নিজ পুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর দিনে সূর্যগ্রহণের ঘটনা। NASA এর হিসেব মতে, ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারিতে হওয়া একটি সূর্যগ্রহণ মদিনা থেকে প্রায় ৭৬% দৃশ্যমান হয়েছিল। আরবি হিসেবে দশম হিজরির শাওয়াল মাস। ধারণা করা হয়, এই সূর্যগ্রহণটিই সেই ঐতিহাসিক সূর্যগ্রহণ। কিন্তু সূর্যগ্রহণের সেই ঘটনায় এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি লুকিয়ে আছে… তাদের জন্য যারা সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করতে পারে।
.
যখন মদিনার মানুষেরা নিজেরাই ভাবতে শুরু করেছিল যে প্রকৃতি বোধ হয় শোকের মাতম লাগিয়েছে, তখন একজন মিথ্যাবাদী তো সহজেই মানুষের ভেবে নেওয়া সেই ভ্রান্তিকে কাজে লাগানোর কথা। মিথ্যাবাদীরা তো সুযোগসন্ধানী হয়। নিজেকে রাসূল দাবি করা মানুষটির ছেলের মৃত্যুদিনেই কাকতালীয়ভাবে সূর্যগ্রহণ – একজন মিথ্যাবাদীর জন্য এমন সুযোগ তো সহস্রকোটি বছরেও মেলে না। কিন্তু মিথার পথে হাঁটলেন না সত্য ও সরল পথের নবী।
.
৪০ বছর ধরে ভালবাসা আর সত্যবাদিতায় ‘আল-আমিন’ বা বিশ্বাসী মানুষটি যখন আসমান-জমিনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে শেষ নবুওয়্যাতের দাবি নিয়ে আসলেন, তখন তাকে চরম শত্রু বনে যাওয়া মানুষেরাও মিথ্যাবাদী দাবি করতে পারে নাই। তাঁর জীবদ্দশায় হওয়া সূর্যগ্রহণের ঘটনাটি এককভাবেও সেই সাক্ষীই দেয়… মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ কখনোই মিথ্যাবাদী ছিলেন না। সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম।
.
পরবর্তীতে পৃথিবীতে আসা সমস্ত গ্রহণের ঘটনাই যেন রাসূল মুহাম্মাদের ﷺ সত্যবাদিতার স্মরণিকা হয়ে রইল। এ যেন স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের পক্ষ থেকে রাসূলের সত্যবাদিতার সাক্ষ্য, বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন, সত্যবাদিতার নাসীহা।
.
২১ আগস্ট, ২০১৭ তে আবারও সূর্যগ্রহণ দেখবে পৃথিবীবাসী। এর পরেও হবে আরো অনেক গ্রহণের ঘটনা। তখন কি মনে পড়বে না মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর ﷺ সত্যবাদিতার কথা?
.
[১] সীরাতে হালাবি ৩য় খন্ড, ৩৪ পৃষ্ঠা
[২] সহীহ আল-বুখারি, খন্ড ১৬, হাদিস ২২, ২৩, ২৪
.
লেখক: Tanvir Ahmed
Leave Your Comments