ইসলামে কি আদৌ ধর্ষণের শাস্তি বলে কিছু আছে?

ইসলামে কি আদৌ ধর্ষণের শাস্তি বলে কিছু আছে?
====================================
.
#নাস্তিক_প্রশ্নঃ মানুষের জীবন বিধান কুরআনে ব্যাভিচারের সাজা থাকলেও ‘ধর্ষণ’-এর জন্য কোন ধরণের সাজার নির্দেশ নেই (বরং আরো উৎসাহিত করে), কেন?
.
#উত্তরঃ অভিযোগকারী নাস্তিক-মুক্তমনারা বোধ হয় ভুলে গেছে যে ইসলামী শরিয়তের উৎস শুধু কুরআন না। কুরআনের পাশাপাশি সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াসও শরিয়তের উৎস।এসব ব্যাপারে সুস্পষ্ট দলিল রয়েছে। সুন্নাহ দ্বারা সুস্পষ্টভাবে ধর্ষণের শাস্তি সাব্যস্ত হয়েছে।
.
“ওয়াইল ইবনে হুজর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ)এর যুগে এক মহিলাকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হলে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাকে কোনরূপ শাস্তি দেননি, তবে ধর্ষণকারীকে হদ্দের শাস্তি দেন।” [১]
অনুরূপ মাতান(মূল অর্থ) এর বেশ কয়েকটি হাদিস সিহাহ সিত্তাহ গ্রন্থগুলোতে দেখা যায়।
.
লায়স (র) নাফি‘(র)-এর সূত্রে বর্ণনা করেন যে, সফিয়্যাহ বিনত আবু ‘উবায়দ তাকে সংবাদ দিয়েছেন যে, সরকারী মালিকানাধীন এক গোলাম গনিমতের পঞ্চমাংশে পাওয়া এক দাসীর সঙ্গে জবরদস্তি করে ব্যভিচার(ধর্ষণ) করে। তাতে তার কুমারীত্ব মুছে যায়।
‘উমার (রা) উক্ত গোলামকে কশাঘাত করলেন ও নির্বাসন দিলেন। কিন্তু দাসীটিকে সে বাধ্য করেছিল বলে তাকে কশাঘাত করলেন না। [২]
.
জোরপূর্বক ব্যভিচারকে ধর্ষণ বলা হয়। ধর্ষণও এক প্রকারের ব্যভিচার। ইসলামী ফিকহ শাস্ত্রে ধর্ষণকারীর শাস্তি ব্যভিচারকারীর শাস্তির অনুরূপ। আর তা হচ্ছে—অবিবাহিত ধর্ষকের জন্য কশাঘাত(বেত্রাঘাত) এবং বিবাহিত ধর্ষকের জন্য ‘রজম’(পাথর ছুড়ে মৃত্যুদণ্ড)। [৩]
.
এখানে অনেকেই একটি প্রশ্ন করে যে– অববাহিত ধর্ষকের শাস্তি কি লঘু হয়ে গেল? আসলে পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম দেশেই ইসলামী দণ্ডবিধি কার্যকর নেই, ইসলামী শাস্তির প্রয়োগ দেখে মানুষ অভ্যস্ত নয়, এ কারণেই এই প্রশ্ন। অবিবাহিত ধর্ষককে ১০০টি বেত্রাঘাত এর শাস্তি পেতে হয়। এই শাস্তি হয় প্রকাশ্যে। বেত্রাঘাত মোটেও সহজ কোন জিনিস না। এতগুলো চাবুকের আঘাত টানা হজম করা ভয়াবহ কঠিন ও কষ্টের ব্যাপার। যে এই শাস্তির শিকার হয় কেবল সে-ই এটি উপলব্ধি করতে পারে। তা ছাড়া এই শাস্তি হয় প্রকাশ্যে। হাজার হাজার লোকের সামনে এর শিকার হওয়া মানসিকভাবেও অপমানজনক। এই শাস্তি যাকে দেয়া হয় সে শারিরীক ও মানসিক উভয়ভাবেই শাস্তি লাভ করে। কাজেই এটি মোটেও সহজ বা লঘু কোন শাস্তি নয়। [৪]
.
যেহেতু এই শাস্তিগুলো প্রকাশ্যে দেয়া হয় (রজম ও বেত্রাঘাত) সমাজে এর একটা দীর্ঘস্থায়ী প্রতিক্রিয়া হয়। মানুষ প্রকাশ্যে এই শাস্তি প্রত্যক্ষ করে একটা বার্তা পায় যেঃ এই অপরাধ করলে এভাবেই প্রকাশ্যে ভয়াবহ শাস্তি পেতে হবে। শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি তো সাজা পাচ্ছেই, তার নাম-পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে ফলে এটি তার পরিবারের জন্যও অপমানজনক একটি ব্যাপার। ইসলামী শরিয়তের এই হদ(শাস্তি) বাস্তবায়ন হলে সমাজ থেকে ধর্ষণ ও ব্যভিচারের মত অপরাধগুলো নির্মুল হয়ে যেতে বাধ্য।
.
ইসলামী ফিকহ শাত্র অনুযায়ী যে নারীকে ধর্ষণ করা হয় তিনি মোটেও দোষী হবেন না এবং তাকে কোন প্রকারের শাস্তি দেয়া হবে না। একজন নারীকে যদি কেউ ধর্ষণ করতে যায়, তাহলে তার পূর্ণ অধিকার আছে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করার। এই আত্মরক্ষা তার জন্য ফরয। এমনকি এ জন্য যদি কোন নারী ধর্ষণে উদ্যত ব্যক্তিকে হত্যাও করেন, তাহলেও এ জন্য তিনি দোষী গণ্য হবেন না। [৫]
.
নাস্তিক-মুক্তমনারা এরপরেও হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারে যে – ধর্ষণের শাস্তির বিধান তো সুন্নাহ বা হাদিসে আছে; কুরআনে তো নেই! জবাবে আমরা মুসলিমরা বলবঃ ইসলামের সকল বিধি-বিধান যে কুরআনে থাকতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। কুরআনের বহু আয়াতে নবী মুহাম্মদ(ﷺ) এর আদর্শ তথা সুন্নাহ অনুসরনের নির্দেশ রয়েছে।
.
” যে লোক রাসুলের হুকুম মান্য করবে সে আল্লাহরই হুকুম মান্য করল। আর যে লোক বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে [হে মুহাম্মদ(ﷺ)], তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।”
(কুরআন, নিসা ৪:৮০)
.
” যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসুলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে।”
(কুরআন, আহযাব ৩৩:২১)
.
“বলুন – যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমাকে[মুহাম্মদ(ﷺ)] অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদেরকে ভালবাসেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী, দয়ালু।”
(কুরআন, আলি ইমরান ৩:৩১)
.
“আর রাসুল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক এবং আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা।”
(কুরআন, হাশর ৫৯:৭)
.
কুরআনের একটি আদেশ হচ্ছে নবী মুহাম্মদ(ﷺ) এর আদর্শ তথা সুন্নাহ অনুসরণ করা।অর্থাৎ সুন্নাহ অনুসরণ করা কুরআন অনুসরণেরই একটি ধাপ বা পর্যায়। যেহেতু কুরআন নির্দেশ দিচ্ছে সুন্নাহ অনুসরণ করার, কাজেই সুন্নাহ অনুসরণ মানেই হচ্ছে কুরআন অনুসরণ। নবী মুহাম্মদ(ﷺ) এর সাহাবীগণও ব্যাপারটা এভাবেই দেখতেন।
.
“একবার সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা) বললেনঃ “আল্লাহর লা’নত সে সব নারীদের উপর যারা দেহাঙ্গে উল্কি উৎকীর্ণ করে এবং যারা করায়; যারা ভ্রু চেঁছে সরু(প্লাক) করে এবং যারা সৌন্দর্যের জন্য দাঁতের মাঝে ফাঁক সৃষ্টি করে; এরা আল্লাহর সৃষ্টি বিকৃতকারী।”
এ কথা বনু আসাদ বংশের জনৈক মহিলা শোনে যার নাম ছিল উম্মে ইয়া’কুব। সে ইবন মাসউদের(রা) নিকট এসে বলেঃ “আমি শুনেছি আপনি অমুককে অমুককে লা’নত করেছেন?”
তিনি বললেনঃ “আমি কেন তাকে লা’নত করব না যাকে আল্লাহর রাসুল(ﷺ) লা’নত করেছেন এবং যার কথা আল্লাহর কুরআনে রয়েছে!”
সে বললঃ “আমি পূর্ণ কুরআন পড়েছি।কিন্তু আপনি যা বললেন তা তো পাইনি!”
তিনি বললেনঃ “তুমি কুরআন পড়লে অবশ্যই পেতে; তুমি কি পড়োনি–”
“আর রাসুল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক…। (সুরা হাশর ৫৯:৭)
সে বললঃ “অবশ্যই।”
তিনি বললেনঃ “নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এসব কর্ম থেকে নিষেধ করেছেন।”
[৬]
.
এ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম যে রাসুল(ﷺ) এর সাহাবীগণ সুন্নাহতে কোন বিধান থাকলে সেটাকে কুরআনের বিধান বলেই গণ্য করতেন।
.
হাদিস তথা সুন্নাহর প্রামাণিকতা সম্পর্কে আরো বিস্তারিত দলিল-প্রমাণের জন্য ‘হাদিসের প্রামাণিকতা’ (সানাউল্লাহ নজির আহমদ) বইটি দেখা যেতে পারে। [ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://goo.gl/jFM1ZZ ]
.
সুন্নাতে সাহাবা বা সাহাবী(রা)গণের আদর্শ অনুসরণের ব্যাপারে রাসুল(ﷺ) বলেছেন—
‘’আমি আল্লাহকে ভয় করার জন্য তোমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছি। আর (জেনে রাখ) তোমাদের ওপর যদি কোনো হাবশী(আবিসিনিয় নিগ্রো) গোলামকেও শাসক নিযুক্ত করা হয়, তবু তার কথা শুনবে এবং তার আনুগত্য করে চলবে। আর তোমাদের কেউ জীবিত থাকলে সে বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নাত এবং সঠিক নির্দেশনাপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করাই হবে তোমাদের অবশ্য কর্তব্য। এ সুন্নাতকে খুব দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকবে এবং সমস্ত অবৈধ বিষয়কে এড়িয়ে চলবে। কেননা, প্রতিটি ‘বিদআত’ (দ্বীনী বিষয়ে নব উদ্ভাবন) হচ্ছে ভ্রষ্টতা।”
[৭]
.
শরিয়তের দলিল হিসাবে সুন্নাতে সাহাবা বা সাহাবী(রা)গণের আদর্শ অনুসরনের ব্যাপারে আরো বিস্তারিত প্রমাণের জন্য খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(র) এর ‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকিদা’ বইয়ের ৫৮-৬২ পৃষ্ঠা [বইটির ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://goo.gl/VNXVz2 ] এবং ‘এহইয়াউস সুনান’ বইয়ের ১০২-১০৭ পৃষ্ঠা [বইটির ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://goo.gl/qLxAvz ] দেখা যেতে পারে।
.
এ আলোচনা থেকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হল যে, ইসলাম ধর্ষণের ন্যায় জঘণ্য অপরাধটির ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট শাস্তির বিধান রেখেছে এমনকি এই অপরাধ নির্মূল করবার ব্যবস্থা করেছে। সুতরাং নাস্তিক-মুক্তমনাদের দাবির কোন ভিত্তি নেই।
.
=======
লেখকঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার [ফেসবুক id: Muhammad Mushfiqur Rahman Minar]
#সত্যকথন
.
তথ্যসূত্রঃ
[১] সুনান ইবন মাজাহ, পরিচ্ছদ ১৪/৩০ {বল প্রয়োগে যাকে কিছু করতে বাধ্য করা হয়} হাদিস নং ২৫৯৮
[২] সহীহ বুখারী, অধ্যায়ঃ ৮৯ {বল প্রয়োগের মাধ্যমে বাধ্য করা (كتاب الإكراه)} হাদিস নং ৬৯৪৯
[৩] Ruling on the crime of rape – islamqa(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/72338
[৪] “Description of flogging for an unmarriezd person who commits zina” – islamqa(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/13233
[৫] “ধর্ষকের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য লড়াই করা কি ওয়াজিব?” – islamqa(শাইখ মুহাম্মদ সালেহ আল-মুনাজ্জিদ)
https://islamqa.info/bn/4017
[৬] সহীহ বুখারী ৪৮৮৬
[৭] আবু দাউদ ও তিরমিযী; রিয়াদুস সলিহীন :: বই ১ :: হাদিস ১৫৭

Leave Your Comments

Your email address will not be published. Required fields are marked *