শুরুতেই মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি। আরাকানী মুসলিম মুহাজির ভাইদের খেদমতে দেশের উলামা হযরাত যে খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন, তা এক কথায় নজিরবিহীন। জাতীয় সেবা কার্যক্রমের সাথে উলামাদের সম্পৃক্ততা দিন দিন বাড়ছে। জাতীয় যে কোন বিপর্যয়ে প্রথমেই এগিয়ে আসছে দেশের উলামায়ে কেরাম। রানাপ্লাজা ধ্বসের পর উলামাদের ত্রাণ তৎপরতা, জামালপুরে বন্যহাতির উৎসবের বছর উলামাদের ত্রাণ তৎপরতা, এ বছর উত্তরবঙ্গে ত্রাণ তৎপরতা এবং সর্বশেষ আরাকানী মুহাজির মুসলিম ভাইদের জন্য যে ত্রাণ তৎপরতা চলছে তাতে উলামায়ে কেরাম অনেক নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন।
এখন যে বিষয়টির প্রতি আমি উলামা হযরতের দৃষ্টি আকর্ষণ করবো, তা হলো- দেশে সেবা কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে চলমান রাখতে হলে রাষ্ট্রীয় কিছু আইন কানুনের বিষয় আছে। আজ আরাকানি মুহাজির মুসলিমদের বিষয় অতিমানবিক বিধায় এখনো সে প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে না। কিন্তু খুব শীঘ্রই সে প্রশ্ন উত্থাপিত হবে। প্রশ্ন হবে- এত সাহায্য কোথা থেকে আসলো, কারা সেটা দান করলো, কিভাবে বাস্তবায়ন হলো, যে সকল দান বিভিন্ন মসজিদ থেকে উঠেছে তার সঠিক হিসাব আছে কি না তা হয়তো অনেকেই জানতে চাইবে।
আমাদের মধ্যে একটি বিষয়ে উদাসীনতা আছে। সেটা হলো আমরা যথাযথ হিসাব রাখতে অভ্যস্থ নই। মনে করি, আল্লাহর রাস্তায় টাকা উঠেছে, সেটাতো আল্লাহর রাস্তায়ই খরচ করছি, এত হিসাবের কী প্রয়োজন? না বন্ধু, এটা ঠিক নয়।প্রতিটি সঞ্চয়ের হিসাব সংরক্ষণ বর্তমান যুগে একটি বড় পুণ্যের কাজ। আপনার সব আয়োজন নষ্ট হয়ে যেতে পারে একটু এদিক সেদিক হলে। আপনার প্রতি অসাধারণ আস্থায় চির ধরতে পারে মুহুর্তেই। হিসাবপত্রে আমরা খুব র্দু্বল। এ জায়গাটাতেই আঘাত হানবে ইসলামের শত্রুরা। ইসলাম বিদ্বেষী সেবাখাতের অন্যসব প্রভাবশালীরা আপনাকে মুহুর্তেেই ঘায়েল করে ফেলবে। তখন আপনি ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থায় পড়ে যাবেন। তাহলে করণীয় কী?
হ্যাঁ, সেটাই এখানে আলোচনা করবো। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বড় বড় কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল আরাকানি মুহাজির ভাইদের পাশে দাঁড়িয়েছেন খুব শক্তভাবে। আপনারা মসজিদ তৈরী করছেন, টিউবওয়েল বসাচ্ছেন, ব্রিজ বানাচ্ছেন, টয়লেট বানাচ্ছেন, থাকার ঘর বানাচ্ছেন, নগদ অর্থ দিচ্ছেন, খাবার দিচ্ছেন। এর প্রতিটি কাজই গুরুত্বপূর্ণ। তার সাথে সাথে আরো বেশি গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো এই কাজের প্রতিটি আয়-ব্যয় সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া। যদি তা না করেন আপনি শত খালেসভাবে কাজ করার পরও ফেঁসে যেতে পারেন।
তাই এইমুহুর্তে যা প্রয়োজন সেটা হলো- আমি অনুরোধ করবো সবগুলো রাজণৈতিক দল বিশেষকরে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, যুব মজলিস, ইসলামী ঐক্যজোট, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ইত্যাদি দল সমূহের প্রতিটির একটি করে রেজিষ্ট্রার্ড সেবাখাত থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে সেবাকর্ম পরিচালনার রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের জন্য কয়েকটি দফতর, অধিদপ্তর রয়েছে। তারমধ্যে সমাজকল্যাণ বিভাগ অন্যতম।এছাড়া রয়েছে যুব উন্নয়ন বিভাগ, রয়েছে নারী ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগ।
প্রতিটি রাজণৈতিক দলের একটি করে অনুমোদিত সেবা বিভাগ থাকলে যে কোন জাতীয় দুর্যোগে এসব বিভাগ থেকে কাজ আঞ্জাম দেওয়া সহজতর। এই বিভাগের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ, কাজ বাস্তবায়ন, হিসাব সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রসার করা সম্ভব। আজ আমরা একটি বিষয় নিয়ে আপত্তি করছি। সেটা হলো- আরাকানী মুসলিমদের পেছনে সেবা দিয়ে যাচ্ছে এদেশের উলামায়ে কেরাম। কিন্তু সেখানে ব্রাক উপস্থিত হয়েই তার সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দেওয়া শুরু করেছে।
আমরা যখন যে দিকে ছুটি তখন অন্য দিকে আর খেয়াল রাখি না। সব এক দিকে ছুটতে থাকি। সবাই একমুখি কাজ করতে থাকি। ঠেলাঠেলি করে কাজ করতে থাকি। শেষে কার কতটুকু কৃতিত্ব সেটা নিয়ে শুরু হয় অহেতুক বিতর্ক। কে আগে নামলো, কে পরে নামলো, কে কতটা কাজের স্থান দখল করতে পারলো, কে কতটা সম্মুখসারিতে থাকতে পারলো সেটা নিয়ে শুরু হয় গীবত, পরনিন্দা। কোন অবস্থাতেই পর্যালোচনা নয়। কিছুদিন পর সকলের কাজই মানুষ ভুলে যায়। আমরাও ভুলে যাই। কারন কাজ শেষে একজন আরেকজনের পিছনে এমনভাবে লাগি, পরবর্তীতে আর এই কাজে কারোই আগ্রহ থাকে না। ফলে বঞ্চিত হতে থাকে ভিকটিমরা।
আমরা যখন যে দেশে বাস করি, তখন অবশ্যই আমদেরকে সে দেশের আইন মেনে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় নিয়ম-কানুন, ভাষা-পরিভাষা না জানলে কী বিপদ তা রোহিঙ্গা মুসলিমরা জ্বলন্ত উপমা। রোহিঙ্গা মুসলিমরা বার্মার জাতীয় ভাষা চর্চা থেকে দূরে ছিল। জাতীয় পর্যায়ে কাজ কর্ম করা থেকে দূরে ছিল। বলা হবে তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হযেছিল, কিন্তু এটাও সত্য, তারা পর্যায়ক্রমে একঘরে হয়ে পড়ছিল, এবং সেই সুযোগটাই বৌদ্ধমগরা কাজে লাগিয়েছে।
বাংলাদেশের আলেম সমাজকে রাষ্ট্রীয় যে কাঠামো আছে, তার ভেতর থেকে দ্বীনি নির্দেশকে কাজে লাগাতে হবে। প্রতিটি দলের একটি করে রেজিষ্ট্রার্ড সামাজিক সেবার খাত থাকলে তখন বহুমুখি কাজ করা সম্ভব, কাজের ধারাবাহিকতা রাখা সম্ভব। সময়ে সময়ে কাজের মান নিয়ে পর্যালোচনা সম্ভব। এর মাধ্যমে অসংখ্য লোকের কর্মসংস্থান হবে। দেশ ও রাষ্ট্রকে আরো বেশি অনুভব করা যাবে।
আমাদের একটি বড় দোষ হলো- যত আয় হয় তা সব বড় হুজুর জানে। এর হিসাব আর কেউ জানে না। ফলে নানা কথার ডালপালা ছড়ায়। রেজিস্ট্রার্ড সেবাখাত থাকলে, সমস্ত হিসাব ওদের কাছে থাকবে। আপনি বড় হুজুর, আপনি কর্তৃত্ব করবেন। আপনার নির্দেশে সবকিছুই হবে। কিন্তু সব কাজ আপনি একা করতে গেলে কিছু কথা উঠবেই। আপনিই অর্থ সংগ্রহ করবেন, আপনিই ব্যয় করবেন, আপনিই সেবাখাতের কাজ তদারকি করবেন, আপনিই হিসাব নিকাশ রাখবেন, আপনিই এর প্রচার ও প্রসার করবেন এটা হয়না। সম্ভব না। আপনিও একজন মানুষ। ফল যা হবার তাই হয়।
তাই দেশের সকল উলামা হযরাতের কাছে বিনীত নিবেদন আপনারা সেবা কার্যক্রমগুলো রাষ্ট্রীয় আইনের আওতার ভিতর কিভাবে পর্যায়ক্রমে নিয়ে আসা যায়, সেটা নিয়ে আপনার কাছের বন্ধুদের সাথে পরামর্শ করুন। আপনার পরিচিত সরকারী দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলুন। আপনি কাজ করছেন, আপনি দান করছেন, কিন্তু কাগজপত্রে আপনার এই কাজের কোন মুল্যায়ন হবে না।
যখন বাৎসরিক রিপোর্ট হবে, তখন দেখা যাবে ব্রাক রোহিঙ্গাদের মাঝে এত কোটি টাকা বিতরণ করেছেন, আশা এতটি বাথরুম করে দিয়েছে, গ্রামীন ব্যাংক এতটি ঘর করে দিয়েছে, কিন্তু আপনার হিসাব কই? হ্যা, আপনি হয়তো বলবেন- আমরা যা করি আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য করি, সেটা কি হিসাব রাখলে অসুবিধা? কিছু কাজ আছে যে গুলো প্রচারের দ্বারা মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়, সেটা প্রকাশ করতে কি অসুবিধা? বেশ কয়েকটি ইসলামী দল এবার বড় ধরণের সেবাকাজ আঞ্জাম দিয়েছে। কিন্তু এর রিপোর্ট কতটা সংরক্ষিত হয়েছে সেটা আমার জানা নেই। নিজেদের কাছেও সব রেকর্ড আছে কি না সন্দেহ।
হে বন্ধু! সময়টা যেহেতু আধুনিক, প্রযুক্তি যেহেতু এখন উন্নত, তখন আপনি কেন অবহেলা করবেন এগুলোকে? রাষ্ট্রকে অবজ্ঞা করার ফল খারাপই হয়। আমরা রাজনীতি করবো, সরকারের কঠিন সমালোচনাও করবো। কিন্তু কিছু কাজ আছে যেটা নিয়মতান্ত্রিকভাবে করার মধ্যে সুফল আছে।
27.09.2017
রুফাকা টাওয়ার
Leave Your Comments